সেই মেয়েটি

সেই মেয়েটি

ওপাশ থেকে সামান্য ফুঁপানির আওয়াজ আসে।মেজাজ আমার আরো কয়েক ডিগ্রি খারাপ হয়।ঠাসিয়ে এক ধমক দিয়ে বলি,
– এই মেয়ে!সমস্যা কি তোমার। নিজের কান্না শুনানোর জন্য ফোন করেছো তুমি?
ঈশিতার কান্নার বেঁগ যেনো আরো কিছুটা এগিয়ে যায়।আমি চুপ করে থাকি!খানিকবাদে ঈশিতা নিজেই ভাঙ্গা গলায় বলে,
– আমি সত্যিই সরি!আমার জন্যই আজ আপনাকে এতগুলো কথা শুনতে হয়েছে!আমি সত্যিই বুঝতে পারি নি এমন কিছু ঘটে যাবে!আমাকে আপনি মাফ করে দিন।
এটুকু বলেই ঈশিতা আবার হুহু করে কেঁদে উঠে।
কথা খানিক না,পুরোপুরিই সত্য।আজ এই মেয়ের জন্যই আমায় নিজের ক্যারেক্টার নিয়ে কথা শুনতে হয়েছে!নিজের শিক্ষা,দীক্ষা নিয়ে কথা শুনতে হয়েছে!আরো কতো কথাই না শুনতে হয়েছে,যার

অনেকগুলো এখন মনেও করতে পারছি না।
আপনার উপর যদি কেউ সহায় না হয়, তবে ঢাকা শহরে একটা টিউশনি পাওয়া মানে খড়ের মধ্যে সুঁচ খুজে পাওয়ার সমান!যখন, গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করার পরও শত চেষ্টা করে নিজের মন মতো একটা জব পাচ্ছিলাম না,তখন আমার এক পাতানো ফ্রেন্ড আমার উপর সহায় হয়েছিলো।পাতানো ফ্রেন্ডের বিষয়টা অন্য আরেকদিন ক্লিয়ার করবো।আজ আসল গল্পটা বলা যাক।তো সেই পাতানো ফ্রেন্ডের কৃপাতেই ঈশিতাকে পড়ানোর দায়িত্বটা পেয়ে যাই আমি।

প্রথম যেদিন ঈশিতাকে পড়াতে যাই, সেদিন ঈশিতাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকবার কলিংবেল টিপতেই দরজা খুলে যায়।আমি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে।একে তো দুধে আলতা গায়ের রং তার উপর সাদা চুরিদার পড়ায় মেয়েটিকে কোনো এক অপ্সরা বলে মনে হয়েছিলো আমার।সেদিন আমিই প্রথমে নিরবতা ভেঙ্গে বলেছিলাম,
– আমার নাম রূপক আহমেদ, ঈশিতার নতুন টিচার।ঈশিতাকে ম্যাথ পড়ানোর জন্য আমাকেই ঠিক করা হয়েছে।
সামনে থাকা মেয়েটি তখন আমায় সালাম দিয়ে বলেছিলো,
– ভেতরে আসুন স্যার!আমিই ঈশিতা।
এমন কথায় আমি খানিকটা থমথম খেয়ে যাই।ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকি।একটু আগেই যার শারীরিক গঠন, মোহনীয় সুন্দর্য আমায় প্রায় গ্রাস করে নিয়েছিলো,সে মুহুর্তেই আমার চোখে পিচ্চি মেয়েতে পরিনত হয়।

ঈশিতা মেয়েটাকে প্রথম দিকে বেশ চুপচাপ স্বভাবেরই মনে হয়েছিলো।কিন্তুু যত দিন যেতে থাকলো মেয়েটার চঞলতা ততই বাড়তে থাকলো।মাঝেমাঝে মেয়েটা এমন বাচ্চা সুলভ আচরন করতো খুব কষ্টে নিজের হাসিকে চেপে রাখতে হতো।নিজের গাম্ভীর্য প্রকাশ করতে কন্ঠে খানিকটা গম্ভীরতা এনে বলতাম, “চুপকরে পড়ো মেয়ে।এতো কথা কিসের।”

এমন কথায় সে কিছুটা ভেঙচিয়ে উঠতো।আমি অনুমান করতাম,সে মনে মনে বলতো, “হুহ!আপনি একটা পঁচা লোক।আপনি সব সময় আমার সাথে এমন করে কথা বলেন”।

তার বাচ্চা সুলভ আচরন গুলো যে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ছিলো সেটা আমার কাছে পরিষ্কার হয় আরো কিছুদিন বাদে।সেদিন বাহিরে খুব করে বৃষ্টি হচ্ছিলো।কেমন এক অদ্ভুত শীতলতায় ছেঁয়ে গিয়েছিলো চারোদিক।হঠাৎ করেই আমার তৃষ্ণার্ত পুরুষালি চোখ জোড়া তার চোখে চোখ রাখে।আমি চমকে উঠি সেই চোখের দিকে তাকিয়ে।কি গভীর চাহনি!কি ভয়ঙ্কর ভালোবাসাই না ফুটে উঠেছিলো তার চোখে।আমি দ্রুত নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছিলাম সেদিন।আমি জানি এমনটা সম্ভব না।একে তো মেয়েটা কেবল ইন্টারমিডিয়েট পড়ছে!প্রাপ্ত বয়স্কের ছোঁয়া সে এখনো পেয়ে উঠে নি,তার উপর তার ফ্যামিলি স্ট্যাটাস!এ ব্যাপারে চিন্তা করাও আমার তখন অপরাধ!

ঈশিতার আচার-আচরন দিনকে দিন বিগড়ে যেতে থাকে।সে কিভাবে আমার বাড়ির ফোন নাম্বার জোগার করেছিলো আমি তা বলতে পারি না।তবে আমি তাকে পড়িয়ে আসার পরপরই সে ছোট করে মেসেজ করতো। বলতো,”আজকে যে শার্ট টা পড়েছিলেন এই শার্ট টা আর পড়বেন না।এই শার্টে আপনাকে একদম মানায় না।আর হ্যাঁ,আপনার রিসেন্ট পোষ্টে দেখলাম কয়েকটা পেত্নী লাভ রিয়েক্ট দিয়েছে।এদের আজই লিষ্ট থেকে বের করবেন!এমন ক্যারেক্টারহীন পেত্নীদের লিষ্টে রাখার কোনো দরকার নেই।

এইতো কিছুদিন আগে মেয়েটাকে বেশ কঠিন এক ম্যাথ বুঝাচ্ছিলাম।তখন সে আমার দিকে কিছুসময় এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আহ্লাদমাখা কন্ঠে বলেছিলো,”জানেন আপনার চুলগুলো না খুব সুন্দর।আমার না সব সময় ইচ্ছে করে আপনার চুলে একটু ছুঁয়ে দিতে।দিবেন একটু ছুঁয়ে দিতে?দেই না একটু ছুঁয়ে।প্লিজ?

সেদিন আমি সব রাগ একসাথে ঝেড়েছিলাম।পড়ানো ম্যাথই ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে করতে দিয়েছিলাম তাকে।
না পাড়ায় স্টীলের স্কেল দিয়ে সবটুকু শক্তি নিয়ে দুটো মেরেছিলাম তার বাম হাতের তালুতে। সাথে সাথেই তার মসৃণ সাদা ধবধবে হাতের তালুতে স্কেলের দাগ বসে গিয়েছিলো।মনে হচ্ছিলো,আর একটু জোড়ে মারলে বোধহয় হাতের তালুর চামড়া ভেদ করে রক্ত বেরিয়ে আসতো।হাতের তালুর মতো তার চোখও লাল হয়ে উঠেছিলো মুহুর্তেই।নিচের দিকে তাকিয়ে বেশ কিছুক্ষন নিশ্চুপ কান্না কেঁদেছিলো সে।তার চোখের জল টপ টপ করে পড়ছিলো!আমার মন খারাপ হয়ে যায়।অপরাধবোধ কাজ করে মনে।মেয়েটার নিশ্চুপ কান্না আমাকেও পীড়া দিতে থাকে।সেদিন পড়ানো শেষে বাসায় এসে আমি নিজেই তাকে ছোট করে মেসেজ করে বলেছিলাম,”সরি”!
আমার ম্যাসেজে সে সাথে সাথেই প্রত্তুত্যরে বলেছিলো, “আই লাভ ইউ”!

এমন প্রত্তুত্যরে আমি একটু ধাক্কার মতো খাই।এমন প্রত্তুত্যরের জন্য আমি একটুও প্রস্তুুত ছিলাম না!যদিও কোথাও না কোথাও ভালো লাগার শীতল হাওয়া আমায় গ্রাস করতে চেয়েছিলো।আমি প্রশ্রয় দেই নি।রেগে গিয়ে বলেছিলাম,
“বেয়াদপ মেয়ে!তোমাকে আরো কয়েক ঘাঁ বেশি দেওয়া উচিত ছিলো!”

এরপর থেকে মেয়েটা যেনো আরো বেশি সাহসী হয়ে উঠে।পড়াতে গেলেই নানা রকম বায়না ধরে আহ্লাদি হয়ে বলে,”আজ আর না পড়লাম প্লিজ।চলুন না,আজ একটু গল্প করি!

তার কথার প্রত্তুত্যরে আমি বলি,”তোমার বাবা-মা মাস গেলেই আমাকে টাকা দেয়।সেটা এমনি এমনি না।আর আমরা গরীব মানুষেরা টাকা হালাল করে খাই।হারাম টাকা আমাদের সয় না।

এমন কথায় মেয়েটা মুখ গোমরা করে বলে,”আপনি সব সময় এমন কঠিন করে কথা বলেন।মানুষের মন খারাপ করে দিতে আপনার দু-দন্দ সময়ও লাগে না।নিন পড়ান!যত ইচ্ছে পড়ান!

এসব পর্যন্তই ঠিকই ছিলো,তবে আজ মেয়েটা যে এমন কিছু করে বসবে আমি স্বপ্নেও তা ভাবতে পারি নি।

খাতায় ম্যাথ করে দিচ্ছি আর বুঝাচ্ছি,এমন সময় সে হঠাৎ সামান্য ঝুঁকে এসে টুক করে আমার গালে চুমু খেলো।আমি অবাক হওয়ারও সময় পেলাম না।তাকিয়ে দেখি দরজার সামনে ঈশিতার মা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছেন!
ঈশিতার কথায় আমার ভাবনার সুঁতো কাটা পড়ে।সে নাকের সর্দি টানতে টানতে বলে,
– কি হলো!কথা বলছেন না কেনো?আমি সত্যিই অনেক সরি।প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিন।
আমি শীতল কন্ঠে ছোট করে বলি,
– হুম।
সে নাকের সর্দি টেনে ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলে,
– আম্মু এমন করবে জানলে আমি কখনোই ওমন কিছু করতাম না বিশ্বাস করুন!আমি তো ভেবেছিলাম…….।
আমি অবাক হই।অবাক হয়ে বলি,
– যা বলবে পরিষ্কার করে বলো মেয়ে!
সে ভীত কন্ঠে বাচ্চা বাচ্চা ভঙ্গিতে বলে,
– দেখলেন তো!আপনি সব সময় আমায় ধমকিয়ে কথা বলেন।আমার কি দোষ! আমি তো ভেবেছিলাম আম্মু আমাদের ওভাবে দেখলে আব্বুকে বলে আপনার সাথে আমার সম্পর্ক পাকাপুক্ত করার ব্যাবস্থা করবেন।তাই দরজার সামনে আম্মুর উপস্থিতি টের পেয়েই আমি…..!
ঈশিতার এমন কথায় আমি হতভম্ব হয়ে রই কিছুক্ষন!হাসবো না কাঁদবো কিছুই বুঝে আসে না।একরাশ বিস্ময় নিয়ে বলি,
– তারমানে তুমি বুঝে শুনে ইচ্ছে করে এটা করেছো?
সে খানিকসময় চুপ করে থাকে।বলে,
– আমি সরি তো!
আমি ভেবে পাই এই মেয়েকে কি বলা উচিত।কিছুসময় চুপ থেকে থমথম গলায় বলি,
– আসলে কি জানো, সবকিছুই পূর্বনির্ধারিত ঠিক করা থাকে।যা আমরা চাইলেও আটকাতে পারি না, আবার না চাইলেও না!আমি জানি না সামনে কি হবে বা হতে চলেছে।শুধু জানি তুমি যেমনটা ভাবো এমনটা কখনো সম্ভব নয়।তোমার জীবন আর আমার জীবন চুম্বকের দুই প্রান্তের মতো।যা একে অপরকে আকর্ষণ নয় বিকর্ষণ করে।
ঈশিতা আবার ফুঁপিয়ে উঠে।কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে,
– যত যাই বলুন,আপনাকে আমি কখনোই ছাড়বো না!কোনো দিনও না।এক মুহুর্তের জন্যও না!আপনাকে নিয়ে আমি কাব্য রচনা করবো।আমার মনের সমস্ত অনুভূতিগুলোকে আপনার রঙে রাঙ্গাবো।আপনাকে নিয়ে মনে যত সুপ্ত ইচ্ছেগুলো সব একে একে পূরণ করবো।
এইটুকু বলে সে একটু চুপ করে।কিছুটা কতৃত্বের সুর তুলে বলে,
– আর হ্যাঁ,কাল আপনি হলুদ পান্জাবি পড়ে আমাদের বাসার সামনের যে মোড় টা আছে ওখানে বসে আমার জন্য অপেক্ষা করবেন।আমি কলেজে যাওয়ার নাম করে রিকশায় আপনার সাথে পুরো শহর ঘুরবো।নতুন এক গল্পের শুরু করবো।আপনি যদি না আসেন,আমি কিন্তুু সোজা আপনার বাসায় গিয়ে হাজির হবো হুহ!তখন আবার আপনি আমার দিকে চোখ রাঙ্গিয়ে তাকাতে পারবেন না!!

আমি চুপ করে থাকি।মেয়েটার এমন কতৃত্বের সুরের কথাবার্তা বড় ধরনের নাড়া দিয়ে যায় মনে!সব পুরুষেরাই চায় কেউ না কেউ এমন একজন থাকুক যে তাকে প্রধান্যের শেখড়ে বসিয়ে রাখবে।আচ্ছা আমার তো হলুদ পান্জাবি নেই।আমি যদি গাঢ় নীল রঙা পান্জাবি পড়ে অপেক্ষা করি তবে কি মেয়েটা রাগ করে গাল ফুলিয়ে থাকবে?পরক্ষনেই আমি অশ্চর্য হই নিজের চিন্তা-ভাবনা দেখে।তবে কি আমি সত্যিই বাচ্চা বাচ্চা স্বভাবের চমৎকার এই মেয়েটির প্রেমে পড়ে গেলাম!!

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত