ছেলেটা এই কথাটা বলতেই আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “কোথায় যাবি তুই? যেয়েই দেখ না!” ও
বলেছিলো, এমন করিস সবসময়, রাগ দেখাস, আমি চলে যাব, পরে খুঁজলেও পাবি না। তখন আমি শরীরের সব
শক্তি প্রয়োগ করে ধাক্কা দিয়েছিলাম ওকে। পরেই যাচ্ছিলো, তৎক্ষণাৎ হাত ধরে টেনে তুলেছিলাম। একটু
পর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেছিলাম, “এভাবেই ধরে ফেলবো!” অনেক সুন্দর করে হাসে ছেলেটা। মন জুড়ানো হাসি
একদম। সদ্য জন্মজাত শিশুর মায়াভরা হাসির মতন।
.
ছোটবেলা থেকে একসাথে কাগজের প্লেন উড়িয়েছি। রঙিন কৈশোরের দিনগুলোতে একসংগে দাবা খেলেছি।
জিততে চাইনি কখনো। ওর কাছে হেরেই থাকতে চেয়েছি। ক্লাস নাইনে প্রথম লাভ লেটার
পেয়েছিলাম। লেটার টা ওকেই পড়তে দিয়েছিলাম। ওর চোখটা ঝাপসা দেখতে পাচ্ছিলাম। ক্লান্ত চেহারায়
বলেছিলো- এক্সেপ্ট করে ফেলবি?
-তোর কি মনে হয়।
= ছেলেটা ভাল নারে!
– তুই কি করে জানলি?
= ভাল হলে লাভ লেটার দিত না।
– এটা মোটেও ভালো খারাপ বিচার করার ওয়ে না।
চট করেই বলে দিলো, I WON’T ABANDON YOU! NEVER EVER!!!
চোখ দুটো লাল, রাগে কাঁপছিলো। কথা টা বলেই চলে গেছিলো। এরপর আর কখনো ভালবাসি বলতে হয়নি। ওই
চোখ দুটোকে পড়লেই বুঝে যেতাম। অগাধ শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় ভরা দুটো চোখ। কলেজে আমার ডে শিফটে
ক্লাস হতো। দুইটা কোচিং করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যেতো। রোজ সন্ধ্যায় কাঁঠাল গাছের
আড়ালে একজন দাঁড়িয়ে থাকত! বাসা পর্যন্ত আমার পিছু নিতে থাকত। কিছুটা সাহসী ছিলাম বলে পাত্তা
দিতাম না। কিন্তু একদিন দুইদিন না। একটা মাস ধরে এরকম দেখছি। একদিন সাহস করেই নিলাম যে মুখোমুখি
হব। অন্ধকারে গাছের পিছন দিক থেকে এসে একটা টোকা দিলাম। ঘুরতেই দেখি ও।
– তুই এখানে প্রতিদিন কি করিস?
= এইতো, এমনি এদিক দিয়ে যাই আরকি!
– তোর এইদিকে কোন কাজ নেই। তুই সত্যি কর বল আমার পিছন পিছন কেন আসিস? আমাকে পরীক্ষা করতে? যে
কোন ছেলের সাথে আসছি কিনা?
= সত্যি বলছি অনেক সন্ধ্যা হয়ে যায়। তোকে সেইফলি বাসায় পৌছানোর জন্য পাহারা দিতে দিতে
যাই। আর কোন ইন্টেনশন নেই সত্যি। শুনছিলাম আর চোখ দিয়ে পানি পড়ছিলো। অন্ধকারে ও
কিছু দেখতে পায়নি। আমি বললাম,
– শোন, আর কখনো লুকিয়ে থাকবি না। পড়া শেষ হলে গেটের সামনে দাঁড়াবি। একসাথে চলে যাব। এখন চল।
.
ছেলেটা অনেক ব্রিলিয়ান্ট ছিলো Differentiation, integration, functions যেন আমার মাথার উপর নৃত্য করত।
Dyslexic রোগী মনে হত নিজেকে। অক্ষর গুলো মাথায় নাচতে থাকত। ছেলেটা আমাকে হাতে ধরে ধরে
একেক্টা ম্যাথ শিখাতো। ফাংশন গুলো আমাকে ট্রিক করে বুঝাতো। আমি তো মনে হয় ফেইলই করতাম ও না
থাকলে! টেস্টের পর কয়েক মাস একসাথে আমরা কোচিং করেছিলাম। বেশিরভাগ মেয়েই ওর উপর
ইম্প্রেসড ছিলো। একটা মেয়ে তো আমাকে বলেই ফেললো, “ওর ফোন নাম্বার টা দেয়া যাবে? তুই তো ওর বেস্ট ফ্রেন্ড!”
ওইদিন এত রাগ হয়েছিলো!! সেদিনই প্রথম আমি বলে ফেললাম, “ও আমার শুধু বেস্ট ফ্রেন্ডই না! ও আমার বয়ফ্রেন্ড ও ”
মেয়েটা পিট পিট করে কিছুক্ষন আমার দিয়ে তাকিয়ে
বললো-
“অও, he’s taken.”
আমার গা জ্বলে যাচ্ছিলো কথা শুনে!
ছেলেটা কে এই কথা বলতেই খুশিতে আত্মহারা একটা
ভাব এনে বললো,
= নাম্বার দিলে কি সমস্যা ছিল?
– তোর খুব শখ হয়েছে নাম্বার দেয়ার? তুই নিজে গিয়ে
দিয়ে আয়।
= আরে দিবি না ভাল কথা, রাগছিস কেন? আমি তো আর যাচ্ছি না।
আমার কি যেন হলো, ওর হাত দুটো ধরে ফেললাম, – যাস না কখনো আমাকে ছেড়ে।
মাদকতায় ভরা চোখ দিয়ে চেয়েছিলো।
অনেক খাটিয়েছিলাম ওকে একদিন। খাটাবই বা না কেন? এত সাহস কে দিয়েছিলো যে অন্য মেয়েকে হাতে
ধরে ধরে পড়া বুঝাচ্ছে!? ওদের মাঝখানে ভিলেনের মত
দাঁড়িয়ে বললাম,
– তোকে কি সবাই মাস শেষে স্যালারি দেয় এভাবে পড়ানোর পর। ও খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। এত জোরে কখনো এর আগে
কথা বলিনি। মেয়েটা চুপসে ছেলেটার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো, মাথায় মনে হয় রক্ত উঠে গেলো,
– এই মেয়ে, তোমার এত ছেলেদের পিছনে ঘুরার শখ হলে অন্য ছেলের পিছনে দাঁড়াও। ওর পিছন থেকে সরো।
মেয়েটা রাগে বিড়বিড় করে ছেলেটাকে বলল,
– Your gf is kinda rude, I’m greatly agitated by the violence. আমি রাগে চিৎকার করেই যাচ্ছিলাম।
.
আচ্ছা শোন, ভুল হয়েছে। যা বলবি তাই করব। আমি রেগে চলে যাচ্ছিলাম, তখন কানের ক্যছে ফিসফিস করে
বললো, “একদিন হারিয়ে যাব, সেদিন আর আমাকে পাবি না।”
.
ইন্টার এক্সাম শেষে সবাই ভার্সিটি কোচিং করে। ও করলো, SAT আর IELTS এর কোচিং। বাইরে পড়ার ইচ্ছা
চেপেছিল জনাবের। কত বলেছিলাম, দেশের বাইরে যেতে হবে না, এখানেই থাক। কিন্তু না, উনি যাবেনই।
এখানে পড়া আর ভাল লাগে না। আমি এখানেই প্রাইভেট ভার্সিটি তে ভর্তি হয়ে
গেলাম। ও SAT আর IELTS স্কোর দিয়ে স্কলারশিপ পেয়ে গেলো। ফোন করে একদিন কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, “শোন না!”
– বল না!
= জানিস? মেইল আসছে। (খুবই এক্সাইটেড)
– কিসের?
= হাওয়ার্ড এর। আমার স্কলারশিপ এক্সেপ্ট করেছে।
আমি মোটেও খুশি হতে পারিনি। কেমন যেন লাগলো! কথা বলতে পারছিলাম। কিছু একটা খালি খালি
লাগলো। ফোন কেটে দিয়েছিলাম। মোটেও খুশি হইনি। দেশে থাকলে নির্ঘাত বুয়েট নয়ত ঢাকা ইউনিভার্সিটি
তে চান্স হয়ে যেত। বাইরে যাওয়ার কি দরকার? শুধু শুধু কেন দূরে চলে যাবে? অনেক বলেছিলামও। ও আমাকে পাগলি বললো তার
উত্তরে।
– না গেলে হয় নারে?
= কি বলিস তুই? হাওয়ার্ড বুঝিস? হাওয়ার্ড! মানুষ
ওখানে পড়তে পারে না। আর আমি চান্স পেউএ গেছি। এই হাওয়ার্ড কোথায় জানিস? ওয়াশিংটন এ। আরেকটা
ওয়াশিংটন আছে। কিন্তু হাওয়ার্ড ওয়াশিংটনডিসি তে। এই ডি.সি মানে ডিস্ট্রিকট অফ কলাম্বিয়া। এটা
একদম ক্যাপিটালে…….
ও বলতে থাকে। আমি কিছু শুনি না। আমার কানে কথা গুলো ছন্দের মত বাজতে থাকে। আমি চিন্তা করি,
কয়েকদিন পর আমি শুন্য হয়ে যাব। ও চলে যাবে কয়েক বছরের জন্য। যার সাথে বারোটা বছর ছোট থেকে
একসাথে কাটিয়েছি, যে আমার জীবনের সবকিছু হয়ে গেছে সে চলে যাবে। ও শপিং করে, বুট কিনে, ব্লেজার
কিনে। আমি ওকে চেয়ে দেখি। ছেলেটা কত খুশি স্কলারশিপ পেয়ে! আমারো খুশি হওয়া উচিত। আমিও
খুশি হই, ওর সাথে কেনাকাটায় যোগ দেই। ও আমাকে নানান কথায় ভুলায়,
= এই তুই তো সারাদিন চকলেট খাস! ওখান থেকে তোর জন্য অনেক চকলেট আনব। আমি হাসি, ওর খুশি খুশি চেহারা দেখে হাসি।
– ওখানে সহজে জব পাবি? জব পাওয়া তো টাফ। ও বলত ম্যানেজ করে নিব।
.
এইত সেদিনই ও পৌছে স্কাইপে তে ভিডিও চ্যাট করলো। আমরা পুরো ফ্যামিলি ওর সাথে কথা বললাম। বললো,
ঠিক মত পৌছে গেছে। হোস্টেল খুব সুন্দর। আমি বলি, বিয়ে করে ফেল ওখানে ভাল কাউকে। ও বুঝতে পারে
আমি কষ্ট পাচ্ছি।
= বিয়ে করতে হলে তো প্রেম করতে হবে। মন টা তো ফেলে এসেছি রে! আমি আর কথা বাড়াই না। ওইটুকু ভাললাগা নিয়ে বসে
থাকি। ওই জিজ্ঞেস করে,
= মন খারাপ? আমি মাথা ঝাঁকাই।
= আমি চলে আসব তো। জানিস? এখানে তোর মত কেউ নেই। আমি ঝরঝর করে কেঁদে দেই। ল্যাপটপ বন্ধ করে দেই।
বারবার হারিয়ে যাওয়ার কথা বলে, আমি রাগ করতাম কথাটা শুনলেই। কে জানতো আসলেই য হারিয়ে যাবে।
.
একদিন ফোন করে আমার সেলফোনে।
= এই জানিস? একটা জব হয়েছে! আমি খুবই এক্সাইটেড হয়ে বলি,
– কোথায়? কি জব?
= ক্যাম্পাস জব। Rocket patrol and phonathon.
– ওই কি বললি? কিছুই বুঝলাম না। একটু পর আসলেই কি হল বুঝলাম না। খট করে একটা শব্দ
হলো। আর ফোনটা কেটে গেলো। অস্থির লাগতে থাকলো কেন যেন! রাত বারোটায় আন্টি ফোন করে বলে রোড ক্রস করতে
গিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। সেইন্ট এলিজাবেথস হসপিটালে আছে। নিমেষেই সব দোষ নিজেকেই দিতে ইচ্ছা হলো। আমি জানলে কখনই ওর সাথে তখন কথা
বলতাম না।
.
এরপর অনেক সময় কেটে গেছে। আমার থেমে যাওয়া পৃথিবী আবার ঘুরছে। পড়াশোনা করছি। ওর লাশ আমি
দেখিনি। দেখিনি মানে দেখতে দেয়া হয়নি। ঘরে বসে ছিলাম। বাইরে থেকে ওর মায়ের কান্নার আওয়াজ
শুনছিলাম। সত্যি বলতে, আমি একটুও কাঁদি নি। কান্না আসেই নি। আমার সাথে কথা বলতেই সব এলোমেলো হয়ে
গেলো। ছেলেটার অনেক বড় হওয়ার স্বপ্ন ছিলো। আমার সাথে কথা বলছিলো। সিগ্ন্যাল খেয়াল করে নি। সাই
করে গাড়িটা চাপা দিয়ে চলে গেলো। এখন নিজেকে অনেকটাই সামলে নিয়েছি। বারবার
পুরোনো দিনের কথাগুলো মনে পড়তো! এখন ব্যস্ত সময় পার করছি। যখন একা সময় পার করি, তখন ওর ছবির সাথে কিছুটা সময় পার করি
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা