গোলাপ কুঁড়ির রূপকথা দিন

গোলাপ কুঁড়ির রূপকথা দিন

গোলাপকুঁড়ির মন আজ ভীষণ খারাপ । সবুজ রঙ্গা সেই ছোট্ট দুষ্টু প্রজাপতিটা আজও আসেনি তার কাছে । গোলাপকুঁড়ি তার হালকা সবুজ ফ্রকের মাঝে লাল টুকটুকে মুখখানি বের করে কেবলই এদিকওদিক তাকাচ্ছে । ঐ তো রঙ্গিন প্রজাপতিরা উড়ে উড়ে আসছে , ঐ তো বাদামিরঙ্গা মস্ত প্রজাপতিরাজ হেলেদুলে আসছেন , কিন্তু ঐ দুষ্টু টা আসছেনা কেন ? নাহয় ভুল করে একটু বকেই দিয়েছিল তাকে গোলাপকুঁড়ি , তাই বলে বুঝি ভুলে যেতে হয় এমন করে ? নাহ প্রজাপতিটাকে সে যতটা না দুষ্টু ভেবেছিল , ও দেখছি তার চাইতেও বেশি দুষ্টু !

গোলাপকুঁড়ির বাবা , গোলাপরাজ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন , ” কি হয়েছে গো , আমার মিষ্টি কুঁড়িটার অমন রাঙ্গা মুখখানি আজ এত মলিন কেন ? ” গোলাপকুঁড়ি ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে শুরু করে । ভোরের শিশির তার কান্না হয়ে ঝরে পড়ে সবুজ দূর্বাঘাসে । দূর্বারাজ হাহাকার করে উঠলেন , ” কি হয়েছে গোলাপরাজ , আমাদের রাজকন্যার চোখে জল ? ” কিন্তু কারো কোন কথারই জবাব দিল না গোলাপকুঁড়ি । সবাই কে হতাশ করে মুখ ফেরাল অন্য দিকে ।

গোলাপরানী কিন্তু গোলাপরাজের মত প্রশ্রয় দিলেন না মোটেও , বরং রেগে গেলেন ভীষণ । চোখ গরম করে তাকালেন মেয়ের দিকে , ” অতটুকুনি মেয়ের রাগ দেখ ! তুমি ভীষণ দুষ্টু হয়েছ । কি হয়েছেটা কি ? ঠিকমত খাচ্ছনা , ঘুমাচ্ছ না , হাসছনা , খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু ……” গোলাপরাজ থামালেন রানীকে , বললেন , ” আহা রানী , বকছ কেন আমার রাজকন্যা কে ? দেখছই তো মেয়েটার আমার কি মন খারাপটাই না হয়েছে …” গোলাপরানী মুখ বাকিয়ে বললেন , ” ঠিক আছে , আমি আর কিচ্ছু বলবনা , তুমি তোমার মেয়েকে মাথায় তুলে নাচো ”

গোলাপরাজ হাসলেন । তিনি ভীষণ ভালবাসেন তার গোলাপকুঁড়িকে । চুপিচুপি তিনি ডাকলেন দখিন হাওয়া কে । বললেন , ” দখিন হাওয়া দখিন হাওয়া তোমার কাছে ছোট্ট চাওয়া দেখনাকো মেয়েটি আমার মুখটি কেন করেছে ভার ”

দখিন হাওয়া ছুটে গেল গোলাপকুঁড়ির কাছে । গোলাপকুঁড়ির সাথে তার ভীষণ বন্ধুতা । সে তার মুখটি তুলে তাকিয়ে দেখল , রাঙ্গা মুখখানি শুকিয়ে এতটুক । ” সে কি গোলাপকুঁড়ি , তোমার মন খারাপ ?” ” হ্যা গো দখিন হাওয়া ।” ” কেন ? আমায় বলবে ? যদি পারি তোমার মন ভাল করতে ? ” ” পারবেনা , কেউ কিচ্ছুটি করতে পারবেনা , আমি বেশ জানি ” দখিন হাওয়া গোলাপকুঁড়ির চারদিকে একপাক ঘুরে বলল , ” তাই ? কি সেই কাজ যা দখিন হাওয়া তার সখির জন্যে করতে পারবেনা ?” গোলাপকুঁড়ি ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলল , ” ছাই পারবে । ” ” তুমি বলেই দেখ না ! ” ”তুমি পারবেনা , তুমি পারবে সেই দুষ্টুটার কান ধরে টেনে আনতে ? ” এটুক বলেই গোলাপকুঁড়ি জিভ কাটল । সর্বনাশ ! দখিন হাওয়া যদি টের পেয়ে যায় ? বাবাকে বলে দেয় সবকিছু ? দখিন হাওয়া ও চালাক ভীষণ । সে আগে থেকেই কিছুটা আন্দাজ করেছিল , সে নিচু স্বরে বলল , ” তুমি কার কথা বলছ গোলাপকুঁড়ি ? সেই দুষ্টু ঝগড়াটে সবুজ রঙ্গা প্রজাপতিটা বুঝি ? ” গোলাপকুঁড়ি লাজে রাঙ্গা হয়ে গেল । দখিন হাওয়ার কোন কথারই আর জবাব দিলনা সে । কিন্তু দখিন হাওয়া যা বুঝার তা সহজেই বুঝে নিল ।

সেদিন ও এমন ঝলমলে রোদ উঠেছিল আকাশে । পাখিদের মাঝে যেন শুরু হয়ে গিয়েছিল উৎসব । গোলাপকুঁড়ির মন সেদিন অনেক ভাল ছিল । দখিন হাওয়ার সাথে ঢেউ ঢেউ খেলছিল সে । বরাবরের মতই দুষ্টু প্রজাপতিটা দূর থেকে তাকে ভেংচি কাটছিল । গোলাপকুঁড়ি বোঝেনা , এই দুষ্টু ছেলেটা তার সাথে দুষ্টুমি করে কি এত মজা পায় , সে তো দুষ্টু প্রজাপতিটাকে পাত্তাই দেয়না ।দুষ্টু প্রজাপতিটা প্রজাপতিরাজের ছোট পুত্র , প্রজাপতিরানীর আহলাদ পেয়ে পেয়ে সে মাত্রাতিরিক্ত দুষ্টু হয়ে গেছে । তবে সবাই বলে কিনা , প্রজাপতিরাজপুত্র দুষ্টু হলেও ভীষণ দয়াময় । গোলাপকুঁড়ির যদিও সেটা মনে হয়না , তার কাছে মনে হয় , দুষ্টু প্রজাপতিটার মাথা ভরা কেবল দুষ্টু বুদ্ধি । হঠাত গোলাপকুঁড়ি লক্ষ করল প্রজাপতি তার দিকে এগিয়ে আসছে , সে এগিয়ে এসে বলল , ” গোলাপকুঁড়ি গোলাপকুঁড়ি আমায় খেলতে নেবে ? ” ” কেন তোমার বন্ধুদের সাথে খেল ” ” আজ যে আমার তোমার সাথে খেলতে ইচ্ছে হচ্ছে ” গোলাপকুঁড়ি মুখ বাকিয়ে বলল , ” তুমি আমায় ভেংচি কাটো কেন ? তোমায় খেলতে নেবনা ” প্রজাপতিরাজপুত্রের মুখে মেঘ ঘনিয়ে আসতে দেখে দখিন হাওয়া বলল , ” আহা সখি তুমি প্রজাপতিরাজপুত্রের সাথেই খেল , আমার যে একটু তাড়া আছে , দক্ষিনে যেতে হবে , মেঘরাজ বলে দিয়েছেন ” গোলাপকুঁড়ি রাজি হল । প্রজাপতির সাথে ” ছোয়াছুয়ি” খেলল বেশ মজা করে । তবে দুষ্টু প্রজাপতিটাই যে জিতে গেল খেলায় , গোলাপকুঁড়ি তো আর তার মত ছোটাছুটি করতে পারেনা । খেলা শেষে তাই গোলাপকুঁড়ির মুখ ভার । প্রজাপতি তাকে বলল , ” রাগলে তোমায় ভীষণ মিষ্টি লাগে , গোলাপকুঁড়ি ” ” আমি রাগতে চাইনি ,তুমি ভীষণ দুষ্টু , তাই রাগিয়েছ আমায় ” প্রজাপতি দুঃখ দুঃখ মুখ করে বলল , ” আমি তো তোমায় রাগাতে চাইনি ” ” তবে ? ” ” গোলাপ কুঁড়ি তোমায় ভালবাসতে দেবে আমায় ? তোমায় যত্ন করে সাজিয়ে রাখবো ” গোলাপ কুঁড়ি রাঙ্গা মুখে চেঁচিয়ে বলেছিল , ” দুষ্টু প্রজাপতি তুমি এক্ষুনি চলে যাও , এক্ষুনি ” ” আমায় ফিরিয়ে দিলে ?” ” হ্যা দিলাম ”

দুষ্টু প্রজাপতি ব্যথিত মন নিয়ে উড়ে গিয়েছিল । তারপর থেকে আর আসেনি বাগানে খেলতে । এভাবে কেটে যায় বেশ কিছু দিন । গোলাপ কুঁড়ি বোঝেনি সেই দুষ্টু প্রজাপতির মিষ্টি কথাগুলি তাকে এভাবে বদলে দেবে । সে অপেক্ষায় থাকে । কিন্তু দুষ্টু প্রজাপতি আর আসেনা ।

” দখিন হাওয়া সে কি আর ফিরবেনা ? ” ” জানিনা রাজকন্যা , তার যে কোন খোজ ই নেই , হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে যেন ” ” সব আমার দোষ , আমি তাকে দূর করে দিয়েছিলাম , আর আজ এত খুজেও তার দেখা পাচ্ছিনা ।” দখিন হাওয়া মৃদু হেসে বলল , ” সে ঠিক ফিরবে দেখে নিও ” ” কিন্তু …… কাল সকালেই যে আমি প্রস্ফুটিত হব , সে যদি ফিরে আসে , আমায় তো চিনতে পারবেনা, দখিন হাওয়া ” ” সে তোমায় ঠিক চিনে নেবে ” দখিনা হাওয়া বইতে লাগল । গোলাপ কন্যার মন খারাপ ।

পরদিন ভোরে গোলাপ কুঁড়ি অসাধারণ সুন্দর এক গোলাপে পরিনত হল । এমন সুন্দর গোলাপ কেউ আগে কক্ষনো দেখেনি । যেমন তার রঙ তেমনি সুবাস । সকলে তাকে অভিবাদন জানিয়ে গেল । গোলাপ দখিন হাওয়াকে ডেকে বলল , ” আমার একটি কাজ করে দেবে ? ” ” কি কাজ বল ?” ” আমি সুবাস দিয়ে প্রজাপতিকে ডাকব , তুমি সেই সুবাস ছড়িয়ে দাও , আমার বিশ্বাস সে ফিরে আসবে ” দখিন হাওয়া বইতে লাগল । সাথে চলতে লাগল গোলপের প্রতীক্ষা ।

বিকেল যখন পড়ে এল তখন দখিন হাওয়া ক্লান্ত হয়ে গেল । শিশির ভেজা মন নিয়ে গোলাপ তখন ও প্রতীক্ষায় । কিন্তু যার জন্যে এত অপেক্ষা , সে কোথায় ? গোলাপ কেবল ভাবে আর ভাবে , এত যাকে ডাকছে , সে কি একবার ও শুনছে না সেই ডাক ? প্রজাপতির উপর ভীষণ অভিমানে কাঁদতে লাগল গোলাপ । যে কিনা এক আকাশ আবেগ নিয়ে তাকে ভালবাসতে চেয়েছিল , কয়দিনের ব্যবধানে সেই আবেগ বুঝি এইভাবে হারিয়ে যায় ? গোলাপ নিজেকে বুঝ দেয় , প্রজাপতি তাকে ভালবাসেনি একদমই , সবই ছিল দুষ্টু প্রজাপতির দুষ্টুমি ।

দখিন হাওয়া বলে , ” গোলাপ আমি যে ভীষণ ক্লান্ত , প্রজাপতি আসছেনা কেন ?” গোলাপ ক্লান্ত গলায় বলে , ” সখি তুমি বাড়ি যাও । তার যদি আসবার হত তবে সে চলে আসত , সে আর আসবেনা । তুমি বাড়ি যাও ।” দখিন হাওয়া বাড়ি গেল ।

গোলাপ কাঁদছিল একা একা । হঠাত শুনল কে যেন ডাকছে তাকে , ” তুমি আর কেদনা গোলাপ , দেখ আমি ফিরে এসেছি ” গোলাপ ফিরে তাকিয়ে দেখল , সবুজ রঙ্গা ঝকঝকে চেহারার তরুন একটি প্রজাপতি , তার সেই দুষ্টু প্রজাপতি । গোলাপ কান্না কান্না গলায় বলল , ” হারিয়েছিলে কেন ?” ” আমি ভাবিনি তুমি আমায় চাইবে কখনো ” ” আমি অপেক্ষায় ছিলাম , তুমি বোঝনি ? আমি ভেবেছিলাম তুমি বুঝি আর আমায় চিনবেনা ”

প্রজাপতি গভীর মায়ায় গোলাপকে জড়িয়ে বলল , ” আমার গোলাপকুঁড়ির সুবাস আমি বুঝি ভুলে যেতে পারি ?”

জানালার পাশে দাঁড়িয়ে গোলাপ আর প্রজাপতিকে গভীরভাবে দেখছিল কোন এক মানুষ প্রজাপতির অপেক্ষায় থাকা ভেনাসের রাজকুমারী সিকিম । তার দুই চোখ জলে ভিজে উঠছে । সে জানেনা , এই অপরুপা গোলাপটির মত তার জীবনেও এমন কোন বিকেল আসবে কিনা । সে জানেনা, প্রজাপতির মতন রাজকুমার রিওন ও তার কাছে ফিরে আসবে কিনা ।

পরিশিষ্ট :

রুপকথার গোলাপেরা একদিনে ঝরে যায়না জেগে থাকে বহুদিন রুপকথার প্রজাপতিরা দূরে হারিয়ে যায়না ফিরে আসে একদিন তাই বাস্তবের দুর্ভাগা গোলাপদের জন্য অতিকল্পনাবিলাসী মনের এক অসম্ভব কল্পনা ” গোলাপ কুঁড়ির রূপকথা দিন ”

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত