নীল শাড়ি

নীল শাড়ি

দীপা গোসল করে মাত্র বের হয়েছে। বের হয়েই দেখে খাটের উপরে একটা র্যাপিং করা প্যাকেট। সে একটু বাইরে উঁকি দিল, কিন্তু রাশেদ কে দেখতে পেল না। দীপা খুব আগ্রহ নিয়ে প্যাকেট টা খুলে ফেলল। প্যাকেট খুলেই দেখে একটা নীল রংয়ের শাড়ি। তার এত বেশি আনন্দ হচ্ছিল যে চোখে পানি চলে আসল। সে মনে মনে ভাবছে রাশেদ তাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য শাড়িটা এনেছে।

আজ আবার তাদের দাওয়াতে যাওয়ার কথা আছে। রাশেদের বন্ধুর বিবাহ বার্ষিকীতে। তাই সে যতটা তাড়াতাড়ি পারলো শাড়িটা সাদা রংয়ের ব্লাউজের সাথে পরে নিল। তারপর তার চুল গুলো ভালো ভাবে আঁচড়ে নিল। চুল দিয়ে তখনো পানি পরছে টপটপ করে। মুখে সামান্য পাওডার লাগালো আর ঠোটে হালকা লিপস্টিক। কানে পড়লো বেশ ঝোলা দুল। কপালে একটা ছোট্ট কালো টিপ। কি সুন্দর লাগছে দীপাকে। আয়নায় সে নিজেকে দেখে নিজেই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিল। আর কত জল্পনা কল্পনা করছিল মনে মনে। একবার ভাবলো একটু ফুল হলে ভালো হতো। চুলে ফুল লাগাতে পারতো, আরও ভালো লাগতো তাকে। তারপর রাশেদ এসে দীপার চুল গুলো আলতো করে ছুয়ে তাকে মুগ্ধ হয়ে দেখতো।

রাশেদ আর দীপার বিয়ে হয়েছে দেড় মাস মাত্র। তাদের বিয়েটা পরিবার থেকেই হয়েছে।রাশেদ একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকুরী করে। বিয়ের কথা বার্তা চলার সময় দীপার ছবি দেখেই দীপাকে পছন্দ হয়েছিল রাশেদের। সে বিয়েতে হ্যাঁ বলে দিয়েছিল। তারপর পারিবারিক ভাবে খোঁজ খবর নেওয়ার পর রাশেদের বাবা মাও দীপাকে ছেলের বৌ করতে রাজি হয়ে যায়। দীপার বাড়ি থেকেও কোন সমস্যা ছিলনা। কিন্তু দীপা খুশি ছিলনা। দীপা অনার্স ৩য় বর্ষের ছাত্রী। দীপার একটা রিলেশনশীপ ছিল। কিন্তু দীপা ভীষণ চাপা স্বভাবের হওয়ার কারণে এই কথাটা বাড়ির কাউকে বলতে পারছিলনা। যখন দেখল যে ব্যাপার টা এগিয়েই যাচ্ছে তখন সে সাহস করে তার বাবা মাকে তার সম্পর্কের কথা জানিয়েছিল। কিন্তু তারা কোনভাবেই দীপার কথা মেনে নেয়নি। অনেক বুঝিয়ে ও যখন কাজ হয়নি তারা একরকম জোর করেই দীপাকে রাশেদের সাথে বিয়ে দেয়।

বাসর ঘরেই দীপা, রাশেদকে বলে দেয় যে তার একটা সম্পর্ক ছিল। সে ছেলেটিকে এখনও ভুলতে পারেনি।যেহেতু রাশেদের সাথে দীপার বিয়ে হয়ে গিয়েছে তাই সে সেই ছেলেটির সাথে আর যোগাযোগ করবেনা। কিন্তু মনের উপর তো আর কারো কন্ট্রোল থাকেনা, তাই যতদিন মন থেকে ঐ ছেলেকে মুছে ফেলতে পারছে ততদিন রাশেদকে ভালোবাসতে পারবেনা। রাশেদ যেন কোন ভাবেই তার উপর কোন অধিকার না খাঁটায়। তবে হ্যাঁ রাশেদ তার বন্ধু হয়ে থাকতে পারে। নিজের জীবনের এমন একটা বিশেষ দিনে রাশেদের জীবনে এরকম বাংলা সিনেমার শুটিং হয়ে যাবে সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। বিয়ের রাতে নিজের বউ এর মুখে এসব কথা কোন ছেলেরই সহ্য হওয়ার কথা না। রাশেদেরও হলনা সহ্য। সে সহ্য করতে না পেরে দীপাকে বলল, বুঝলাম আপনার সমস্ত কথা। বাকি কথা কাল শুনবো। আমার শরীর খুব খারাপ ঘুমাতে হবে। আপনি থাকেন আমি বাইরে যাচ্ছি।

– এই শুনুন, আপনি কি পাগল? এখন বাইরে গেলে সবাই কি ভাববে? বাড়ি ভর্তি মানুষ। আমাদের মধ্যেকার সব কথা কি সবাইকে জানাবেন নাকি?
– তো কি করবো বলুন?
– এক কাজ করুন আপনি খাঁটের ঐ পাশে শুয়ে পড়ুন। আমি আপনাকে ট্রাস্ট করি।

রাশেদ একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো, যেটার মানে দীপা বুঝলনা।রাশেদ শুয়ে পড়লো। তার শরীরে ক্লান্তি। কিন্তু চোখে ঘুম নেই। দীপার জন্য একটা আংটি কিনেছিল। ভেবেছিল দীপাকে কিছুক্ষণ পর দীপা তাকে বলল এই যে শুনুন, ঘুমিয়ে পড়েছেন? সাথে সাথে রাশেদ চোখ বুজে ফেলল। দীপা আরো দু- তিন বার ডাকলো। কিন্তু রাশেদ সাড়া দিলনা৷ ঘুমের ভান করে রইল। রাত বাড়তে থাকলো। দীপা একসময় জেগে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়লো। রাশেদ আদৌ ঘুমিয়েছিল কিনা তার জানা হলনা।

বিয়ের ১০-১৫ দিনের মাথায় রাশেদ আর দীপা ভাড়া বাসায় উঠলো। নতুন আলাদা সংসার, শুধুই তারা দুই জন। এই বাসায় এসে দীপা আর রাশেদের মধ্যেকার সম্পর্ক কিছুটা উন্নতি হল। ফ্রেন্ডশিপের মতো। দীপা ধীরে ধীরে রাশেদের উপর কিছুটা নির্ভর হতে শুরু করলো। রাশেদ ও দীপার প্রতি কিছুটা উইক হতে শুরু করলো নতুন করে। তাদের সম্পর্ক টা আপনি থেকে তুমি তে চলে এসেছে। কিছুটা দাবী আর কিছুটা অধিকারও জন্ম নিয়েছে একে অপরের প্রতি। কিন্তু ভালোবাসে কিনা এটা দীপা এখনও বুঝে উঠতে পারেনি। কিন্তু রাশেদ যখন অফিসে থাকে, দীপার একা একা কিছুই ভালো লাগেনা। রাশেদ আসার পর দীপার সময়টা অনেক ভালো কাঁটে৷ সারাদিনের জমানো কথা রাশেদকে দীপা বলতে থাকে। সময় চলতে থাকে। তারা ধীরে ধীরে আরও ফ্রী হতে থাকে। কিন্তু কেউ কাওকে বলতে পারেনা ভালোবাসি। এর মধ্যে একদিন রাতে হঠাৎ করেই দীপা ভীষণ কাতরাতে থাকে। রাশেদের ঘুম ভেঙে যায়৷ রাশেদ ফোনে সময় দেখল, রাত দেড়টা বাজে। রাশেদ তাড়াতাড়ি করে লাইট অন করে দীপাকে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে?

– পেটে ব্যথা, আমি সহ্য করতে পারছিনা।
– হঠাৎ পেটে ব্যথা কেন? দাঁড়াও অ্যাসিডিটির একটা ওষুধ দিচ্ছি, খেলে ঠিক হয়ে যাবে।বলে রাশেদ ওষুধ নেওয়ার জন্য যেতে লাগল আর দীপা রাশেদের হাত টেনে ধরলো।

– এটা অ্যাসিডিটির ব্যথা না।
– তাহলে কিসের ব্যথা? কি হয়েছে দীপা? বলো আমাকে?
– দীপা কাঁতরাতে কাঁতরাতে বললো, বলতে পারবোনা।
– আজব তোহ, বল। না বললে কি করে বুঝবো এত কষ্ট পাচ্ছ তুমি?

– এটা মেয়েলি সমস্যা। তোমাকে খুলে বলতে পারবোনা। এরকম ব্যথা আমার অনেক সহ্য করতে হয়।
– রাশেদ বলল, বুঝতে পেরেছি। কথাটা শুনেই দীপা এত কষ্টের পরেও লাল হয়ে গেল।
– ওষুধ নাওনা?
– নিই তোহ। কিন্তু ওষুধ নেই এখন বলেই দীপা আরো ছটফট করতে লাগলো।
– রাশেদ বললো আজব মেয়ে তুমি? ওষুধ রাখবেনা সবসময়? ওকে দাঁড়াও আমি আসছি।

কিছুক্ষণ পর রাশেদ হট ওয়াটার ব্যাগে করে গরম পানি নিয়ে এল। দীপার পেটে সেঁক দেওয়ার জন্য। এই ঘটনার পর দীপা প্রথম বুঝতে পারলো রাশেদকে সে ভালোবাসে। খুব ভালোবাসে। রাশেদের উপর আরো ডিপেন্ডেন্ট হয়ে গেল সে।এভাবেই তাদের মধ্যে ধীরে ধীরে প্রেম ছোওয়া দিতে থাকে। কিন্তু কেউ কাউকে বলতে পারেনা।

এর মধ্যে আরেকটা ঘটনা ঘটে যায়। দীপাকে তার প্রাক্তন বয় ফ্রেন্ড ফোন করে। দীপা যখন তার প্রাক্তন প্রেমিকের সাথে কথা বলছিল তখন রাশেদ দীপার আড়ালে থেকে সব কথা শুনে ফেলে। দীপা ফোনে বলছিল যেন আসিফ তাকে আর ফোন না করে৷ সে এখন অন্য কারো বৌ। তাছাড়া বাস্তবতা অনেক কঠিন। সে আসিফকে এটাও বলে যে সে তাকে পুরোপুরি মন থেকে মুছে ফেলেছে। সে রাশেদকে ভালবেসে ফেলেছে। এই ভালোবাসা বুঝানো সম্ভব না। স্বর্গীয় ভালোভাসা। আর সে এটাও জানালো আসিফকে, সে কয়েকদিন থেকেই রাশেদকে জানাতে চাচ্ছে তার ভালোবাসার কথা। পূর্ববর্তী ব্যবহারের জন্য মাফ ও চাইবে। কিন্ত সে বলে উঠতে পারছেনা। রাশেদের মনে এক অন্যরকম ভালোলাগা ঢেউ খেলে গেল। দীপা জানতেও পারেনি যে রাশেদ সবটা শুনে নিয়েছে। দীপা আয়নার সামনে বসেই কল্পনার রাজ্যে ডুকে ছিল। তার কেন জানিনা মনে হচ্ছিল সে কয়েকদিন থেকে যেই কথাটা বলবো বলবো করেও বলতে পারছিলনা, আজ রাশেদ নিজেই তাকে সেই কথা বলবে। হঠাৎ রাশেদের কথাতে তার ঘোর কাটে।

– একি দীপা, এই শাড়ি টা তুমি পড়েছো কেন? আমাকে তো জিজ্ঞেস করতে পারতে তাইনা? এটা কি করলে তুমি?
– দীপা আহত দৃষ্টিতে বলে, এটা আমার জন্য না?
– আরে তোমার জন্য কেন হবে? আজ বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছিনা? ভাবীর জন্য কিনেছি এটা, উপহার দিব বলে?
– অপমানে দীপার মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা করলো। চোখ ছলছল করছে। সে বলল, আমি এখনি চেঞ্জ করে আসছি।
– চেঞ্জ করে আর কি হবে? তুমি তো পড়েই নিয়েছো? এটা কিভাবে দিবো? কেমন একটা কাজ হলো? ওকে পড়েই যখন আছো, তখন এটা পড়েই চলো। অন্য কিছু কিনে নিবো যাওয়ার পথে।

– দীপা অন্য দিকে তাকিয়ে আহত স্বরে বললো, আমি এটা পড়ে যেতে পারবোনা রাশেদ, আমাকে ২০ মিনিট সময় দাও, আমি রেডি হয়ে আসছি। দীপা অন্য ঘরে যাবে ঠিক সে সময় রাশেদ দীপার হাতটা টেনে ধরলো। তারপর বললো, শাড়িটা খুলোনা কেমন? সুন্দর লাগছে খুব।

– রাশেদ প্লিজ, আমাকে যেতে দাও। আর অপমান করোনা প্লিজ। অন্যের জন্য আনা জিনিস আমি কেন পরে থাকবো?
– অপমান কখন করলাম?
– তুমি বুঝবেনা। দেড় মাস হয়েছে বিয়ে হয়েছে। এখনো নিজের বৌ এর জন্য শাড়ি আনোনি, অথচ বন্ধুর বৌ এর জন্য এনেছো, বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলল দীপা।
-আচ্ছা তোমার কি আমাকে পাগল মনে হয়? রাশেদের মুখে দুষ্টু হাসি।
– মানে কি? পাগল মনে করবো কেন?
– এই যে, নিজের বৌ ছেড়ে পরের বৌ এর জন্য শাড়ি কিনবো এটা ভাবলে কি করে?
– আমি কেন ভাববো? তুমিই তো বলেছো?
– আমি বললেই তুমি সেটা বিশ্বাস করে নিবে?
– মানে কি? এটা কার জন্য এনেছো?

– তোমার জন্য।
– মিথ্যা বলছো তুমি।
– মিথ্যা বলে আমার লাভ?
– জানিনা।
– কি জানো?
– কিছুই জানিনা?
– ভালোবাসো?
– নাহ।
– বাসোনা?
– বাসি। খুব ভালোবাসি। দীপা কেঁদে ফেললো।
– এই তুমি এত্ত ইমোশনাল কেন? শোন আমিও ভালোবাসি৷ খুব ভালোবাসি। কয়েকদিন থেকে তুমি যেমন বলবো বলবো ভাবছিলে আমি ও ভাবছিলাম। কিন্তু বলতে পারিনি।

– আমি যে বলতে চেয়েছি তুমি কি করে জানলে?
– তুমি ফোনে কথা বলার সময় আমি শুনেছি।
– ওহ! তাহলে তুমি আড়ি পেতে আমার কথা শুনে বেড়াও।
– শুনতেই পারি। বৌ তুমি আমার। আচ্ছা তোমার হাতটা ধরি?
– তুমি তো কতবার আমার হাত ধরেছো, তাহলে আজ পারমিশান নিচ্ছ কেন? একটু আগেই তো ধরলে।
– আগের হাত ধরা আর এখনকার মধ্যে তফাৎ আছে।
– আমি কে তোমার?
– কে আবার? বৌ!
– বৌ এর থেকে কেউ পারমিশান নেয় হাত ধরার জন্য?
– ওহ তাই তো! বলেই রাশেদ দীপার মাথা টা তার বুকের মধ্যে চেপে ধরলো। দীপা বলল- আচ্ছা রাশেদ আমাকে এত কষ্ট দিলে কেন?সোজাসুজি বললেই তো পারতে।

– তুমি আমাকে বাসর ঘরে অত কষ্ট কেন দিয়েছিলে? বরের সামনে অন্য ছেলের কথা বলেছো! তখন তো আমিও কষ্ট পেয়েছি।

– ওহ তার শোধ নিলে? বলেই দীপা রাশেদের বুকে কয়েকটা ঘুসি মারতে থাকলো। তারপর বললো, নাও এবার আমাকে মারো। রাশেদ দীপার হাতটা ধরে তার কপালে একটা চুমু একে দিল। তারপর বললো, দীপা তোমার জন্য একটা গিফট আছে। যেটা বাসর ঘরেই দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু দেওয়া হয়নি।

– কি গিফট?
– আঙটি।
– পড়িয়ে দাও।
– উহু। এখন না। চলো বন্ধুর বাড়ি দাওয়াতে যাই। ওখান থেকে ফিরি। তারপর রাতে তুমি লাল রঙের একটা শাড়ি পরে থাকবে। চুলে কিছু ফুল দিবে আর হালকা সাজবে। তখন তোমার হাতে পরিয়ে দিবো।
– ঠিক আছে চলো। দুজনে বেড়িয়ে গেল একসাথে। তাদেরকে দেখে এই মূহুর্তে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দম্পতির এক জোড়া।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত