ভালোবাসা

ভালোবাসা

কাজী সাহেব যখন জিজ্ঞেস করলেন, “বিয়ের উকিল হিসেবে কার নাম হবে?’, তখন উপস্থিত সকলে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। একটুক্ষণ আগে বরের বেশে থাকা খালিদ সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলল, “কাজী চাচা, আমার নাম উল্লেখ করেন।” এরপর অন্যান্য বিষয় সাব্যস্ত করে পাঁচ লক্ষ এক টাকা দেন-মোহরে একেবারে অনাড়ম্বরভাবে শ্রাবনীর সাথে আমার বিয়েটা হয়ে গেল। আমাদের সাথে বুয়েটে পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের প্রায় সবারই স্ট্যাটাস উল্লেখ ছিল, ‘ইন এ রিলেশনশিপ’। পাশ করে বের হওয়া পর্যন্ত যে কয়েকজনের স্ট্যাটাস ‘সিঙ্গেল’ ছিল, আমি আর আমার বন্ধু খালিদ ছিলাম সেই সংখালঘু দলেরই একজন। এজন্য বন্ধুবান্ধবদের কম উপহাস সহ্য করতে হয়নি !

গত রোজার ঈদে বাড়ি গিয়ে খালিদ ফোন করে জানাল যে, ঈদের পর ০৭ই জুন, ২০১৯, শুক্রবার তার বিয়ে। আমাকে তো যেতেই হবে, অন্যান্য বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের নেয়ার দায়িত্বও আমার উপর বর্তালো। যাহোক, শেষ পর্যন্ত আমি আর খালিদের দুই রুমমেট জাহিদ ও নয়ন ময়মনসিংহের গৌরীপুরে তার বিয়ের অনুষ্ঠানে সশরীরে উপস্থিত হতে পেরেছিলাম। অবশ্য বন্ধুদের কম উপস্থিতির জন্য দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কৃতিত্বও কম নয়। খালিদের বিয়ে ঠিক হয়েছিল স্থানীয় কলেজের বাংলার অধ্যাপক তার শিক্ষক শওকত স্যারের মেয়ে শ্রাবণীর সাথে। এক্ষেত্রে তার বাবা খায়ের তালুকদারের চেয়ে খালিদের মায়ের ইচ্ছেটাই ছিল প্রবল, কারণ খালিদ আর শ্রাবণীর মা ছিলেন খুবই ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। আগে থেকেই চেনা থাকায় এবং কারও সাথে ‘এংগেজড’ না থাকায় খালিদও এ বিয়েতে কোন আপত্তি করেনি; কারণ শ্রাবণী শুধু ভাল পরিবারের শিক্ষিত মেয়েই ছিল না, নজর করা সুন্দরীও ছিল। ।

বিয়ের আগের দিন রাতেই আমরা বন্ধুরা গৌরীপুরে পৌঁছে যাই। রাত করে পৌঁছালেও এলাকায় সুপরিচিত এবং বিয়ের আমেজে জমজমাট খালিদদের বাড়ি খুঁজে পেতে আমাদের কোন সমস্যাই হয়নি। সবাই মিলে বিয়ের দিনের প্রোগ্রাম ঠিক করে খালিদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা তাদের বিশাল বৈঠকখানায় ঘুমাতে চলে যাই। পরের দিন জুম্মার নামাজ পড়েই সবাই রওনা হই কনের বাড়ির উদ্দেশ্যে। শ্রাবণীদের বাড়ির প্রবেশমুখে বিয়ের যে গেইটটি ছিল, তার ধরণ তালুকদার বাড়ির লোকজনকে খুব একটা সন্তুষ্ট করতে পারেনি। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা যখন বরের গেইট পার হওয়ার জন্য বিশ হাজার টাকা দাবি করল, তখন খালিদের বাবা তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন, “যে গেইট বেঁধেছ তোমরা, তার জন্য দুই হাজার টাকা দিলেই বেশি হয়।” উপস্থিত অনেকেই বিষয়টি লক্ষ্য করল।

“বিয়ের গেইটে বরপক্ষ টাকা দিয়ে গেইট পার হয় আপোষে, গেইটের চেহারা দেখে নয়”, হাসতে হাসতেই উত্তর দিলেন শ্রাবণীর ছোট চাচা শাখাওয়াত আলী খান। বিয়ের আভিজাত্য নিয়ে আরো কিছু কথাবার্তা হল, যদিও তা হাসি মুখেই, কিন্তু উভয়পক্ষের মধ্যে অসন্তোষের ছাপ সেখানে স্পষ্ট ছিল। বিয়ের গেইট ধরার বিষয়টি আগে থেকেই সাব্যস্ত করা না থাকায় আমরা একটু বিপাকেই পড়লাম। যাহোক, পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে গেইট পার হয়ে আমরা বরসহ চলে গেলাম বিয়ে পড়ানোর স্থানটিতে, যেখানে শ্রাবণীর বাবা শওকত স্যার তাঁদের পরিবারের অন্যান্য গণ্যমান্য লোকজন সহ অপেক্ষা করছিলেন।

শ্রাবণী বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে। তার বিয়ের ব্যবস্থাপনায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করার মত তার ছোট বা বড় ভাইবোন ছিল না। তার কাজিনরা অংশগ্রহণ করলেও তা ছিল অনেকটা দায়সারা গোছের। আর শ্রাবণীর বাবা হলেন সাহিত্যের লোক, একটু ভাবুক প্রকৃতির। বিয়ে অনুঠানের আড়ম্বর তাঁকে খুব একটা টানেনা। এজন্য শ্রাবণীর বিয়েতে উচ্ছাসের কমতি না থাকলেও আড়ম্বরের কিছুটা ঘাটতি ছিল, তবে কোনমতেই তা বিয়ের অনুষ্ঠানে গোলযোগ সৃষ্টির মত যথেষ্ট কোন কারণ নয়। বিয়ে পড়ানোর স্থানটিতে কেন স্টেজ করা হলো না, এর জন্যেও কনে পক্ষকে জবাবদিহি করতে হল। তবে একথা সে কথায় পরিস্থিতি একসময় উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পর্যায়ে চলে গেল। দেন মোহরের প্রসঙ্গ আসতেই খালিদের বাবা বললেন, “আমার ছেলের একেবারে নতুন চাকরি, দুই লক্ষ টাকার বেশি দেনমোহর দিতে পারবে না।” শুনে শ্রাবণীর সাখাওয়াত চাচা বললেন, ” আপনাদের মত আমাদের ফ্যামিলির তো একটা স্ট্যান্ডার্ড আছে, দুই লক্ষ টাকা দেনমোহরে আমরা মেয়ে বিয়ে দেই না।”

– ফ্যামিলির স্ট্যান্ডার্ড তো বিয়ের আয়োজনেই দেখতে পাচ্ছি, এই ফ্যামিলিতে ইঞ্জিনিয়ার ছেলেকে বিয়ে করাচ্ছি, এটিই অনেক বেশি।
– আমাদের মেয়ে কি গাঙের জলে ভেসে এসেছে? তাকে আবার ভাসিয়ে দিতে হবে?
– আমাদের তালুকদার পরিবারে মেয়ে বিয়ে দিলে যদি আপনাদের জলে ভাসিয়ে দেয়া মনে হয় , তাহলে আমাদের কাছে মেয়ে বিয়ে দিয়েন না।

এতক্ষন শ্রাবণীর ছোট চাচাই কথা বলছিলেন, এবার মুখ খুললেন শ্রাবণীর বাবা। খুব ধীর স্থির ভাবে তিনি বললেন, “এ বিয়েটা না হলেই মনে হয় তালুকদার পরিবারের সাথে খান পরিবারের সম্পর্কটা ভালো থাকবে। তবে আপনারা আজ আমাদের মেহমান, দুপুরবেলা অবশ্যই ডাল-ভাত খেয়ে যাবেন।” শুনে বর পক্ষের লোকজন সাথে সাথে উঠে পড়ল, আর ঘটনার আকস্মিকতায় আমরাও কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে পড়লাম। খালিদকে সবাই টেনে নিয়ে যেতে চাইল। সে বলল, “বন্ধুদের বিদায় দিয়ে আমি আসছি।” বরপক্ষের মুরুব্বিরা কাল বিলম্ব না করে বেরিয়ে গেল, আর আমরা কনের বাড়ির সামনে থাকা আম গাছের নিচের পুকুরঘাটে দাঁড়ালাম। বাড়ির ভিতর থেকে মহিলাদের কান্নার আওয়াজ কানে আসতে লাগল। মেয়েটার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরাও নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে থাকলাম।

খালিদের মুখের দিকে তাকানোই যাচ্ছিল না। আমরা তাকে বাবার অমতে বিয়ে করে ফেলার জন্য তাগাদা দিলাম। সে উত্তর দিলো, “আমার বাবা এমনই, বংশের বাজনাটা বড্ড বেশি বাজাতে পছন্দ করেন। আমি চাইলেও খানেরা আমার সাথে আর মেয়ে বিয়ে দিবে না।” শ্রাবণীদের সাথে ঘটে যাওয়া আজকের ঘটনার জন্য সে বেশ রাগান্বিত, সেই সাথে অনুতপ্তও হল। হঠাৎ সে জানতে চাইল, আমাদের মধ্যে কেউ শ্রাবণীকে বিয়ে করতে রাজী আছি কি-না। জাহিদ ও নয়ন দুজনেই ‘ইন এ রিলেশনশিপ’ স্ট্যাটাসের লোক। আমরাও জানি যে, চাকরীতে একটু সেট্ল হলেই তারা বিয়ের জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করবে। কাজেই বাকি থাকলাম আমি, যার স্ট্যাটাস আবার ‘সিঙ্গেল’ এবং চাকরির স্ট্যাটাসও অন্যদের চেয়ে ভাল।

কাজেই একসময় সবার উপদেশ আর অনুরোধের কেন্দ্রবিন্দুতে নিজেকে দেখতে পেলাম। এর মধ্যে আমন্ত্রিত লোকজনের অনেকেই আমাদের দিকে রাগান্বিতভাবে তাকাতে তাকাতে চলে যাচ্ছিল। শ্রাবণীর ভবিষ্যৎ নিয়ে শংকিত অনেকের কথাবার্তাই কানে আসল, কেউ কেউ বলেই ফেলল, “মেয়েটির কপাল আজকে পুড়লো, এর কেউ একে বিয়ে করবে না।” এভাবে মেয়েটির বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় আমিও বেশ মর্মাহত হলাম, তার ভবিষ্যৎ নিয়ে শংকা আমাকেও গভীরভাবে স্পর্শ করল। গতকাল খালিদের বিয়েতে আসার জন্য যখন বাবা-মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিলাম, তখন মা জিজ্ঞেস করছিলেন, “আমার ছেলের বিয়ে কবে হবে?”

– তোমরা যখন করাবে?
– তোর কোন পছন্দ থাকলে আমাকে বল, আমরা ব্যবস্থা করব। তোর পছন্দের উপর আমাদের আস্থা আছে।
– আমার কোন পছন্দ নেই মা।

” আমরা নিজেরা পছন্দ করে বিয়ে করে এখন পর্যন্ত সুখেই আছি। তোর পছন্দের কাউকে বিয়ে করে নিয়ে আসলেও আমরা মেনে নিব, এই গ্যারান্টি দিচ্ছি। আমার খুব দেখতে ইচ্ছা, আমাদের সৈকত কেমন মেয়েকে পছন্দ করে।” – পেপার হাতে ড্রয়িংরুমে ঢুকতে ঢুকতে বাবা বললেন। “তুই নিজে নিজে বিয়ে করলেও আমাকে কিন্তু জানাবি, ভাইয়া ! আমি গিয়ে ভাবীকে তুলে নিয়ে আসব।” – আমার ছোটবোন সোহানা হাসতে হাসতে বলল।

– “কিরে দোস্ত, হ্যাঁ বা না কিছু বল !” – খালিদের এ কথা শুনে আমার ভাবনার ঘোরটা কাটল।
– শ্রাবণী ও তার পরিবার থেকে থেকে আপত্তি না থাকলে আমারও আপত্তি নাই।
– “সবার মান-সম্মান বাঁচালি দোস্ত”- এই বলে খালিদ আমার সাথে কোলাকুলি করল।

খালিদ ও নয়ন বাড়ির ভিতরে গিয়ে যখন আমার সাথে শ্রাবণীর বিয়ের কথা বলল, তখন শ্রাবণীর ছোট চাচা তেড়ে আসলেন, বললেন, “বিয়ে ভেঙে এখন নাটক করতে এসেছো?”

– চাচা, আমার আব্বাকে তো আপনি জানেন ! আমার ইচ্ছা থাকলেও শুধু আব্বার কারণে আপনারা আমার সাথে শ্রাবণীর বিয়ে দিবেন না, সে আমি জানি। তবে এভাবে বিয়ে ভেঙে যাওয়াটা শ্রাবণীর ভবিষ্যতের জন্যও খুব ভাল হবে না। তাই আমি শ্রাবণীর বিয়েটা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সৈকতের সাথে দিতে চাই এবং তা আজই এই মুহূর্তে।।
কথার মাঝখানে শ্রাবণীর মা আসে রাগতস্মরে বললেন, “তোমরা বাপ-চাচাদের পারিবারিক অহংকারের কারণে আমার মেয়ের বিয়েটা আজ ভেঙে গিয়েছে। তাই মেয়ের বিয়ে নিয়ে তোমরা আর কোন কথা বলবে না।”
এরই মধ্যে খালিদ তড়িৎ গতিতে বাইরে এসে আমাকে হাতে ধরে শ্রাবণীদের বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলো। আমাকে দেখিয়ে বলল, “সৈকত আমার চেয়েও অনেক ভাল ছেলে। ইউনিভার্সিটি লাইফ পার করে আসলেও কোন মেয়ের সাথে তার কোন বিশেষ সম্পর্ক নেই। তার ব্যাপারে আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি।” তখন সবার দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দুতে থেকে জীবনে প্রথমবারের মতো আমি লজ্জাবোধ করলাম।

– “তোমার নাম কি বাবা?”- শ্রাবণীর মা জিজ্ঞেস করলেন।
– সৈকত আহমেদ।
– বাবা-মা কি করেন?
– বাবা ঢাকা সিটি কলেজের অধ্যাপক, মা বুটিকের ব্যবসার সাথে জড়িত।
– কয় ভাইবোন তোমরা?
– আমি আর আমার ছোট এক বোন আছে, অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে।
– এভাবে বিয়ে হলে তোমার পরিবার কি মেনে নিবে? আমাদের ব্যাপারেই কি ভাববে?
– আমার পরিবার মেনে নিবে বলেই আমি রাজি হয়েছি। আর আজ যা যা হয়েছে, আমি নিজে সব দেখেছি, আমি বুঝিয়ে বলব।
– তোমার জন্য দোয়া করি বাবা। আমি কথা বলে এসেছি, শ্রাবণীরও তোমার সাথে বিয়েতে কোন আপত্তি নেই।
– “তোমার না চাচী, ‘তোমাদের জন্য দোয়া করি’ হবে”- হাসতে হাসতে খালিদ বলল।

এরপর আবার সেই বিয়ে বাড়ি পড়ন্ত বিকেলে কিছুটা জেগে উঠল। কাজী সাহেবকে আবার ডেকে আনা হল, শ্রাবণীদের পরিবারের ঘনিষ্ঠজনরাও অনেকেই ফিরে আসলেন। বিয়ে পড়ানোর পর খাওয়া-দাওয়া শেষে প্রসঙ্গ আসল, কনে কি বাড়িতেই থাকবে, নাকি আজই বরের সাথে ঢাকায় চলে যাবে।

বিভিন্ন জনের ভিন্ন ভিন্ন মতামত থাকলেও খালিদ জোর দিয়ে বলল যে, কনে আজ বরের সাথে চলে যাওয়াটাই সবদিক থেকে সেইফ হবে। সন্ধ্যার পর শ্রাবণীর বাবা-মা কনেকে আমার হাতে তুলে দিলেন। আমি ও শ্রাবণী সালাম করে মুরুব্বিদের দোয়া নিলাম। খালিদকেও আমাদের সাথে আসার জন্যে অনেক পীড়াপীড়ি করলাম। কিন্তু ‘এদিকটাও আমাকেই ম্যানেজ করতে হবে’ বলে সে সেদিন গৌরীপুরেই থেকে গেল। অবশেষে খালিদের পরিচিত ড্রাইভারের গাড়িতে করে আমি, নয়ন ও জাহিদ শ্রাবণীকে নিয়ে রাত্র ৮:০০ টার দিকে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। সেই সাথে আমার নতুন জীবনের যাত্রাও শুরু হল।

সামান্য কিছুদূর এগোনোর পর ফোন পেয়ে আমরা বাজারের মত একটা জায়গায় থামলাম, শাখাওয়াত চাচাও এসে আমাদের সাথে যোগ দিলেন। সবাই নেমে চা খেয়ে আবার গাড়িতে চেপে বসলাম। এতক্ষন শ্রাবণী একটাও কথা বলেনি। শাখাওয়াত চাচা আসার পর তার মুখে প্রথম কথা শুনলাম। এটি লক্ষ্য করে বন্ধু নয়ন বলে উঠল, “জামাই সাথে থাকলেও ভাবি দেখি ভয় পায়, আর চাচায় আসলে সাহস পায়। তাহলে কি ভাবীর জামাই পছন্দ হয় নাই ?” একথা শুনে শ্রাবণীসহ সবাই হো হো করে হেসে উঠল। আমাদের অবিরাম আড্ডার মধ্যে খালিদ ফোন করে খোঁজ নিল, তখন আমরা ভালুকা পার হয়ে গিয়েছি। এরপর আবারো আড্ডায় ডুবে গেলাম। কখন যে এয়ারপোর্ট পার হয়েছি, টেরই পাইনি। খালিদ যখন আবার ফোন করল, তখন আমরা হোটেল রেডিসন পার হচ্ছি।

হঠাৎ মনে হল, ছোট বোনটাকে খবরটা আগেই জানানো উচিত ছিল। তাকে তখনি দিলাম ফোন, সে যে তখন চিৎকার করে সারা বাড়ি মাথায় তুলে ফেলেছিল, মোবাইলের এ প্রান্ত থেকে তা আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম।
এরপর যথারীতি শুরু হল আমার মায়ের বারবার ফোন করে খোঁজ নেয়া। রাত বারোটার দিকে আমরা আমাদের রায়ের বাজার বাসায় পৌঁছে গেলাম। দেখলাম, এই রাতেও ফুল নিয়ে আমার বোনটি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, বাবা-মা তার পিছনে দাঁড়িয়ে। আমরা সালাম করতেই বাবা-মা আমাদেরকে জড়িয়ে ধরলেন। এরপর বাবা সাখাওয়াত চাচার সাথে কোলাকুলি করলেন। শ্রাবণীকে বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কিসে পড় মা?”

– ইংরেজিতে অনার্স ফাইনাল দিয়েছি, আনন্দ মোহন কলেজ থেকে।
– তোমার বাবা কি করেন?
– ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর মহিলা কলেজের বাংলার অধ্যাপক।

“ভালই হল সৈকতের মা, আমরা দুই বেয়াই-ই শিক্ষকতায় আছি। আর শিক্ষকের ছেলেমেয়েরা বরাবরই ভালই হয়।”
এরপর খাওয়া-দাওয়া সেরে জাহিদ ও নয়ন একরুমে, আর শাখাওয়াত চাচা অন্য আরেক রুমে ঘুমাতে চলে গেল। আমার আরেকটু আড্ডা দেয়ার ইচ্ছে ছিল, আব্বার জন্যে পারা গেলো না। আমার রুমে গিয়ে তো আমি অবাক। আমার ছোট্ট বোনটি এত অল্প সময়েও আমার রুমটি বেশ সাজিয়েছে। আর খাটের উপর শ্রাবণী এখন আবার ঘোমটা টেনে বসা। নানা ধরণের মজার মজার কথা বলে সোহানা যখন বিদায় নিল, তখন শুনলাম শ্রাবণীর কণ্ঠ, “আমি আপনার জন্য বোঝা হয়ে আসিনি তো?”

– বোঝা না, হৃদয়ের ওঝা ! আর ‘আপনি’ না, এখন থেকে ‘তুমি’ হবে।

এভাবেই বিভিন্ন ঘটনা আর দুর্ঘটনার পথ পরিক্রমায় হঠাৎ করেই আমাদের বিয়েটা হয়ে যায়। বিয়েটা অনাড়ম্বরভাবে হলেও পরের শুক্রবারে ঢাকায় আমাদের যে বিবাহোত্তর সংবর্ধনা হয়েছিল, তাতে কিন্তু জাঁকজমকের ঘাটতি ছিল না।
সেই অনুষ্ঠানে খালিদের বাবা খায়ের তালুকদারকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, কিন্তু এবারেও শ্রাবণীকে তাঁর আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিতই থাকতে হয়েছে !

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত