পথের দেখা

পথের দেখা

ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের গাড়িতে মাঝপথে উঠেছিলাম আমি, ঠিক লোকাল বাসের মতো৷ বাসে একটি সিটই খালি তাও আবার একটা তরুণীর পাশে৷ কানে হেডফোন লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে খুব মনোযোগের সাথে তাল মিলাচ্ছিলো৷ হেডফোনের একটা মাথা তরুণীর কানে আর অন্য মাথা কাঁধ গড়িয়ে পরে আছে৷

আমি প্রথমে ওর দিকে অতটা খেয়াল করিনি৷ কখন যেন কাঁধে মৃদু স্পর্শের শিহরণে ওর সুন্দর মুখখানি আবিষ্কার করলাম৷ বাম গালে তিলটা জ্বল জ্বল করছিলো৷ তারপর নজরে আসলো প্লাকবিহীন ভ্রুযুগল, কাজলবিহীন চোখ, লিপস্টিকবিহীন ঠোঁট আর মেকআপবিহীন অমসৃন গাল, হালকা লোমে আবৃত মুখমন্ডল আর তিল৷ পরনে ছিলো সাদা ধবধবে থ্রীপিস৷ সব মিলিয়ে ওকে অপ্সরির মতো লাগছিলো৷ গাড়ি চলছে আপন পথে আর আমার চোখে রাজ্যের ঘোর৷ আমি মজেছি ঐ ক্ষুদ্র কালো তিল এ৷

হঠাৎ ব্রেকে ঘুম ভাঙলো অপ্সরির৷ চোখ মেলে নিজেকে কারো কাধে আবিষ্কার করলো ঠিকই কিন্তু তাতে তার মধ্যে কোন জড়তা নেই৷ আরো আকড়ে ধরলো আমায়৷ স্পর্শটা এত ভালো লাগছিলো যে সেটা হারানোর ভয়ে আর কিছু বললাম না৷ ‘আবির৷ সেই কখন বাসে উঠেছি তারপর থেকেই তুমি চুপচাপ৷ কি হয়েছে বলো তো? কিছু কি ভাবছো? কোথায় গিয়েছিলে?’ আমি ভাবছি “আবিরটা কে? তাছাড়া মেয়েটা তো আমায় দেখলো তাহলে আমি যে আবির না সেটা চিনলো না কেন?”
কিছু না বলে চুপ করে রইলাম৷

‘আমি বুঝেছি এভাবে চলে আসাতে তুমি রাগ করেছো? কি করব বলো বাবা আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিলো৷ আমি তোমাকে ছাড়া কিভাবে থাকতাম বলো৷ আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো কিন্তু ঐ ছেলেটা তো আমায় টাকার লোভে বিয়ে করতে এসেছে৷ আমাকে করুণা করতে এসেছে৷ নাহলে কোন অন্ধ মেয়েকে কেউ বিয়ে করতে আসে? জানি তোমার টাকার লোভ নেই তবুও আমি আমার গয়না নিয়ে এসেছি৷ কম করে হলেও ১৫-১৭ ভরি হবে৷ হাতের আন্দাজে বললাম আমি তো আর দেখতে পাই না৷ এগুলো বিক্রি করে তুমি একটা ব্যবসা করবে৷ আমাদের বেশি টাকা লাগবে না৷ আমি অল্পেই খুশি৷ শুধু এমন করেই ভালোবেসো সারাজীবন৷ কিছুদিন পেরিয়ে যাওয়ার পর বাবার থেকে ক্ষমা চেয়ে নেবো৷ কেমন?’ কথাগুলো শুনে কিছুটা হলেও কাহিনী বুঝলাম৷ আর এও বুঝলাম কেন মেয়েটা নিঃসংকোচে আমায় জড়িয়ে ধরে রেখেছে৷ ‘গয়না কেন এনেছো?’ ‘বা রে তুমি আমি খেতাম কী তবে? তাছাড়া তুমিই তো বলেছিলে গয়না আনতে৷ তুমি যদি ১০ হাজার টাকা বেতনেরও চাকরি করতে তাহলে গয়না আনতাম না৷’

ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম ‘আরে ওগুলো তো মজা করে বলতাম৷ আমি তো পুরুষ মানুষ৷ চারটে হাত পা আছে৷ প্রিয়তমাকে খাওয়ানোর মতো অর্থ উপার্জন ইনশাআল্লাহ্ করতে পারতাম৷ ওসব না আনলেও পারতে৷’ ‘আমার জিনিস আমি এনেছি এত কথা কেন বলছো? তুমি একটু ব্যাগটা খুলে চুপিচুপি দেখো না?’ ওর হাত থেকে ব্যাগটা নিলাম৷ খুলে কিছু গয়না দেখলাম তবে সেগুলোকে স্বর্ণ মনে হলো না৷ সাথে পেলাম এক টুকরো কাগজ৷ তাতে লেখা আছে তানিয়া,

জানি তুমি আমায় ভালোবাসো কিন্তু আমি তোমায় ভালোবাসি না৷ বড় লোকের অন্ধ মেয়ের সাথে প্রেম করা যায়, বিয়ে করা যায় না৷ তোমাকে বিয়ে করে সারাজীবন ভুগব নাকি আমি? মাঝে সাঝে টাকা পেতাম তাতেই আমি খুশি৷ কিন্তু ঝামেলা কাধে বয়ে ঘুরতে পারব না আমি তাই চলে গেলাম৷ তুমি গয়নাগুলো এনে ভালোই করেছো৷ ব্যাগ খালি থাকলে বুঝে ফেলবে তাই ফুটপাত থেকে কিছু গয়না কিনে ব্যাগে রাখলাম৷ গয়নাগুলোর প্রয়োজন ছিলো আমার, তোমাকে নয়৷ পারলে বাবার কাছে ফিরে যেও৷ আমাকে যদি ১০ কোটি টাকার অফার করতো তোমার বাবা তাহলে শুধু অন্ধ কেন, ল্যাংড়া, খোড়া, বিধবা যা হতো তাই বিয়ে করতাম৷ তোমাকে এটা বৃথাই লিখেছি৷ তুমি তো আর কোনদিন এটা পড়তে পারবে না৷ হা হা হা৷ টা টা৷ বাই বাই৷ আবির৷ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লাম৷ ‘কি হলো আবির? আমি কি ভুলভাল কিছু এনেছি? গয়নাগুলো ঠিক আছে তো? যতটুকু জানি আমার বিয়ের গয়না আমার আলমারিতেই রাখার কথা৷ তুমি যখন বাইরে গেলে তখন তো ব্যাগটা তোমার কাছেই ছিলো৷ পরে পাশের সিটে হাত দিতেই ব্যাগের অস্তিত্ব পাই৷ তুমি হয়তো নামার সময় সিটের উপর রেখে গিয়েছিলে৷ সেই ফাঁকে কিছু হয়নি তো?’

আমি তানিয়ার চোখের দিকে তাকালাম৷ ঐ চোখে কোন প্রতারণা, ছলনা নেই৷ এমন একটা মেয়েকে কেউ ঠকাতে পারে? এর থেকে দূরে থাকা সম্ভব? মুচকি হেসে বললাম ‘সব ঠিক আছে৷ আসলে এত স্বর্ণ কোনদিন দেখিনি তো তাই৷’ ‘বাঁচালে আমায়৷ তোমার কাছে এগুলো রেখে আমায় মুক্তি দাও৷ আর শোন আমার পায়ের কাছে ব্যাগের ভেতর একটা খামে টাকা আছে৷ তখন যে আমার হেডফোনটা বের করলে তখন খামটা পাওনি?’ ‘না৷’ ‘ব্যাগটা আমার হাতে দাও তো আমি বের করে দিচ্ছি৷’ ব্যাগটা ওর হাতে দিলাম৷ অনেকক্ষণ খোঁজার পরে কোন খাম পেলো৷ ‘এই দেখো এখানে এক লাখ টাকা আছে৷’ হাতে নিয়ে দেখলাম সত্যিই টাকা৷ একটু আইকিউ খাটিয়ে বললাম— ‘টাকার কথা তো আগে বলোনি৷’ ‘ইচ্ছে করেই বলিনি৷ সারপ্রাইজ দেবো বলে৷’ বুঝলাম টাকার কথা আবির জানতো না তাই নিতে পারেনি৷ আহারে বেচারা আবির৷

তানিয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে বললাম— ‘তুমিই তো আমার কাছে বড় সারপ্রাইজ৷’ ‘সত্যিই? I Love You Abeer. আমি অন্ধ তারপরও তুমি আমায় কতোটা ভালোবাসো৷ বিয়ে কবে করবে?’ ‘তুমি কবে করতে চাও?’ ‘আজই৷’ ‘ঠিক আছে বাস থেকে নেমেই কাজী অফিসে যাবো৷’ তারপর সারা রাস্তায় অনেক কথা হলো৷ বাস থেকে নামার আগে চিঠিটা ছিড়ে জানালা দিয়ে ফেলে দিলাম৷ এর আর প্রয়োজন নেই৷ এমন একটা রত্ন পেলে তাকে যত্ন করে রাখতে হয়৷ স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে নেমে আসা অপ্সরি তানিয়া৷ কাজী অফিসে গিয়ে আমরা বিয়ে করে নিলাম৷

এরপর পেরিয়ে গেলো ১৫ বছর৷ আমাদের দুই মেয়ে এক ছেলে৷ প্রথম প্রথম তানিয়ার দেখাশোনা কিছুটা আমি করতাম বাকিটা ও নিজেই করতে পারতো৷ এখন তো ছেলে মেয়েরা মাকে দেখাশোনা করে৷ অন্ধ স্ত্রীকে নিয়ে সংসার জীবনে আমার কোন সমস্যা হয়নি৷

একবছর পরই ওর বাবার কাছে গিয়ে আমরা ক্ষমা চেয়ে এসেছি৷ ওকে ১৫-১৭ ভরি সোনার গয়না বানিয়ে দিয়েছি৷ অবশ্য ওর টাকাটা আমি কাজে লাগিয়েছিলাম সেটা আবার ফেরতও দিয়েছি৷ তানিয়া এখনও জানে না আমি আবির নই আমি রাহাত মাহমুদ৷ কিছু সত্যি সামনে না এলে যদি জীবনটা স্বপ্নের মতো হয় তবে সে স্বপ্ন দেখাই উত্তম৷ থাকুক না কিছুটা আড়াল৷ যে আবডালে ভালোবাসা থাকে বন্দী, তাতেই না হয় করলাম সন্ধি৷

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত