মাহির আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টাই লাগাচ্ছে আর চেচিয়ে জান্নাতকে ডাকছে।জান্নাত রান্নাঘর থেকে ছুটে এলো।
-কি হয়েছে?
-আমার ঘড়ি কোথায়?
-মাহির তোমার দৃষ্টিশক্তি যথেষ্ট ভালো। তবুও তুমি প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো হাতের কাছে থাকলেও কেন পাওনা?
-আশ্চর্য,খুজে না পেলে কি করবো?
-ভালোভাবে দেখো টেবিলের উপরেই আছে।আমি প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তোমার জিনিসপত্র প্রথমেই হাতের কাছে ঘুছিয়ে রাখি তবুও তুমি প্রতিদিন এমন করো।
-সারাদিনে তো এটুকুই করো আমার জন্য।তাও এতো কষ্ট।কেমন বউ তুমি?
-কি বললে তুমি?আমি সারাদিনে তোমার জন্য কি করি এটুকুই দেখলে?আমি তোমার পরিবারের জন্য,তোমার বাবা,মা,ভাই,বোনের জন্য কি কি করি সেটা দেখলে না?
প্রতিদিন সকালে ৫.৩০ এ ঘুম থেকে উঠি।তোমার বাবা সকাল ৬টা এক কাপ কড়া রংচা খেয়ে হাটতে যায়,এটা তার অভ্যাস। তার এই অভ্যাসের জন্য নিজের অভ্যাস বদলে দিয়েছি।ঘুম থেকে উঠে তার জন্য চা বানাই,তারপর সবার জন্য দুধ চা,একেক জনের রুচিমাফিক একা হাতে নাস্তা বানাই।তুমি আর বাবা অফিসে যাও।৮টার মধ্যে তোমাদের নাস্তা রেডি চাই।আমি একা একা হিমসিম খেয়ে যাই আর তার মধ্যে প্রতিদিন তোমার এই ডাকাডাকি।
জান্নাত গভীরভাবে নিশ্বাস ছেড়ে আবার বলতে শুরু করলো,আমাদের ২বছরের রিলশনে তুমি আমার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছো।আমি বিয়ের আগে ভার্সিটি,কোচিং,এসাইনমেন্ট তৈরি, গ্রুপ স্টার্ডি নিয়ে এতোটাই বিজি ছিলাম যে ঘরের কাজ করার তেমন সুযোগ পাইনি।আর মাও আমায় করতে দেয়নি কিন্তু এখানে এসে আমাকে একা হাতে সব সামলাতে হচ্ছে।কিন্তু এই নিয়ে আমি তোমায় কখনো অভিযোগ করি নি।আমার ইচ্ছে ছিলো বিয়ের পর চাকরি করবো। কিন্তু তুমি একদিন আমার হাত ধরে বললে যে,জান্নাত আমার মা অসুস্থ। তুমি যদি চাকরি করো তাহলে এ সংসার ভেসে যাবে।আমার ভাইবোন আর মা বাবাকে কে দেখবে।তখন আমি বলেছিলাম, আমি আছি এই সংসারের জন্য।আমার উপর ভরসা রাখ।আমি থাকতে এই সংসার ভেসে যেতে পারেনা।তারপর এই আনারি হাতে সংসারের হাল ধরলাম।সকাল, দুপুর, রাত তিনবেলা রান্না করা,ধুয়ামোছা করা,তোমার মায়ের দেখাশুনা করা সব কিছুই আমি একা হাতে করছি।
সকালে তোমাকে আর বাবাকে নাস্তা দেওয়া,তারপর আম্মাকে নাস্তা দেওয়া,তোমার ২০বছর বয়সী বোনকে নিজ হাতে খাবার বেড়ে দিতে হয় তবেই সে খায়।আমার হাত ধরে করুন সুরে বলে ভাবি ঝুড়িতে ময়লা কিছু কাপড় আছে প্লিজ ধুয়ে দিও।তখন না বলতে পারি না,মাথা নেড়ে সম্মতি জানাই।তারপর সে কলেজে চলে যায়,নয়তো ফোন নিয়ে বসে পড়ে।তোমার ভাই ১০টায় ঘুম থেকে উঠে ভাবি নাস্তা দেও নাস্তা দেও বলে চিল্লানি শুরু করে যদিও সব কিছু টেবিলেই ঘুছানো থাকে।এত্ত এত্ত ময়লা কাপড় এনে বলে ধুয়ে রেখো।কোনদিন জিজ্ঞাসা করে না ভাবি তুমি ভালো আছো,ভাবি তুমি খেয়েছ,ভাবি তোমার মন খারাপ,তোমাকে কাজে সাহায্য করে করবো, কোনোদিন জিজ্ঞেস করে না।এটা করে দাও,ওটা করে দেও,আমি চাকরের মতো ওদের ফুট-ফরমায়েশ শুনি। কোনোদিন না বলেনি।নিরবে সব মেনে নিয়েছি।
তুমি আমাকে বিয়ের পরের দিনই এই সংসারের দায়িত্ব দিয়েছো।আর আমি একা হাতে সামলে গেছি।অনেক বাধা পেয়েছি কিন্তু হার মানি নি।প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সমস্যার সাথে লড়াই করেছি।তবে এই লড়াইয়ে আমি কাউকে পাশে পাই নি,,না তোমার ভাইবোন, না তোমার বাবা মা,না তোমাকে।সাহায্যের জন্য কাজের লোক রাখতে চাওয়ায় আম্মা সাফ মানা করে দিয়েছে।তার নাকি নিজের সংসারে বাইরের মানুষের কাজ পছন্দ না। আমি তোমাকে ভালোবেসে নিজের পরিবার ছেড়ে তোমার সাথে থাকতে এসেছি।তোমার কি উচিৎ ছিল না আমার পাশে থাকার।পাশে থেকে লড়াই না করতে পারতে অন্তত কাধে হাত রেখে বলতে তো পারতে”ভয় পেওনা,আমি আছি ।
কিন্তু তুমি এটুকুও করোনি। বিয়ের পরের দিন মেয়েরা নাইওর যায় কিংবা হানিমুনে যায় আর আমি,,,আমি নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর আগেই পুরো পরিবারের দায়িত্ব পেয়েছি।যাদের আমি চিনি না,জানি না তাদের।নতুন বাড়ি,নতুন পরিবেশ, নতুন লোকজন। সব কিছু বুঝতে, সব কিছুর সাথে মানিয়ে নিতেও কিছু সময়ের প্রয়োজন। কিন্তু আমাকে কোন সময় দেওয়া হয়নি।তুমি আমাকে ভালোবাসো বলে বিয়ে করোনি,তোমার পরিবারের হাল ধরতে কাউকে প্রয়োজন তাই আমাকে বিয়ে করেছো তাই না মাহির?
-তুমি ভুল ভাবছ,জান্নাত?আমি তোমাকে ভালোবাসি বলেই বিয়ে করেছি।যখন আমার বিয়ের কথা হচ্ছিলো তখনি আমি তোমার কথা বলেছি।
-আচ্ছা,,তুমি আমার খোঁজ রাখো? মাহির মাথা নিচু করে আছে।কিছু বলছেনা।
-অফিস,বাড়ি,ছুটির দিনে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাওয়া এই তোমার জীবন।বিয়ের পর কখনো আমাকে নিয়ে বাইরে গিয়েছ?বিয়ের আগে তো বেশ ঘুরতে যেতে। না এখন পুরনো হয়ে গেছি তাই আর ভালো লাগে না।বিয়ের আগে তো খুব ভালোবাসার কথা বলতে, আর এখন?
জান্নাত ছলছলে চোখে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো।ডয়িং রুম ওদের রুমের সাথে হওয়ায় জান্নাতের শ্বশুর ওদের সব কথা শুনেছে।আর তিনি কিছুটা অপরাধবোধে ভুগছে।যে মেয়েটা সংসারের জন্য এতো করছে তিনি তারই খোঁজ রাখেন নি।তার সুবিধা-অসুবিধার খেয়াল রাখেনি।জান্নাত শুধু তার ছেলের বউই নয় মিহির মতোই তার আরেক মেয়ে।তার ভালোমন্দগুলো তার দেখা উচিৎ ছিল।তিনি খুব দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অফিসে আজ মাহিরের কাজে মন বসছেনা।বার বার জান্নাতের বলা কথাগুলো মনে পরছে।আর অনুশোচনা অনুতাপে ভিতরটা পুরে শেষ হয়ে যাচ্ছে।কেননা জান্নাতের বলা প্রতিটা কথা সত্যি। মাহির একজন ভালো স্বামী হতে পারে নি।সে তার কোন দায়িত্ব পালন করে নি। মাহির এক গুচ্ছ গোলাপ হাতে বাড়ি ফিরেছে।জান্নাত জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।
-জান্নাত!! জান্নাত মাহিরের কন্ঠ শুনে ঘুরে দাড়ালো। মাহির জান্নাতকে কিছুক্ষণ দেখলো তার বলতে শুরু করলো,
-জান্নাত,আমি জানি আমি তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছি।আমি একজন আদর্শ প্রেমিক হতে পেরেছি কিনা জানিনা কিন্তু আদর্শ স্বামী হতে পারেনি।শুধুমাত্র নিজের দিকটাই দেখেছি তোমাকে কখনো বুঝার চেষ্টা করিনি।জানিনা তুমি আমায় ক্ষমা করতে পারবে কিনা কিন্তু আমি তোমায় কথা দিচ্ছি আমি আজ থেকে তোমার সাথে আছি।সকল পরিস্থিতিতে আমাকে তোমার পাশে পাবে। প্লিজ আমায় ক্ষমা করো।
-ঠিক আছে।
মাহির জান্নাতের দিকে এগিয়ে গিয়ে গোলাপের গুচ্ছ হাতে দিয়ে বললো তোমার জন্য এনেছি।এরি মধ্যে শ্বশুর মশাইয়ের ডাক। জ্বি আব্বা আসছি বলে জান্নাত গোলাপগুলো ফুলদানিতে রেখে শ্বশুরের কাছে গেলো।
-জ্বি আব্বা বলুন।
-তোমার জন্য তোমার পছন্দের আইসক্রিম এনেছি।এই নেও।
-এতোগুলা?
-যতটুকু খেতে পারো খাও।বাকিগুলো ফ্রিজে রেখে দেও যখন খেতে ইচ্ছে হবে বের করে খাবে।
-জ্বি আব্বা।
জান্নাত তো বেশ খুশী। আজকে পছন্দের ২টো জিনিস পেয়েছে।মনটা ফুরফুরে লাগছে। সকালে এলার্মের আওয়াজে ঘুম ভাংলো জান্নাতের।ফ্রেশ হয়ে মাহিরের জিনিসপত্র গুছিয়ে রান্না ঘরে গেলো জান্নাত।রান্নাঘরে গিয়ে জান্নাতের চোখ কপালে।জান্নাতের শ্বশুর চা বানাচ্ছে।জান্নাতকে দেখে মিষ্টি হেসে বললো,
-তারাতারি উঠে গেছি তাই ভাবলাম চা বানাই।
-তাই বলে রান্নাঘরে আসবেন?আপনি বসুন আমি চা বানিয়ে আনছি।
-আমার চা বানানো হয়ে গেছে।তুমি খাবে? আমি কিন্তু চা খারাপ বানাই না।
জান্নাত মিষ্টি হেসে বললো, জ্বি বাবা খাবো।আমি কাপ নিয়ে আসি।দুজনে মিলে গল্প করছে আর চা খাচ্ছে। জান্নাত পরটা ভাজছে আর ভাবছে আজ মাহির আমায় ডাকেনি,,তার মানে ও ওর কথা রেখেছে। মাহির আজ সব কিছু নিজে নিজেই করেছে।মুচকি মুচকি হাসছে।
-কি হলো ভাবি মুচকি মুচকি হাসছো কেন?ব্যাপারটা কি? জান্নাত ঘুরে দেখলো তার একমাত্র ননদ মিহি দাড়িয়ে আছে।মিহিকে কিচেনে দেখে কিছুটা অবাকও হলো।
-মিহি,তুমি কিচেনে,কিছু লাগবে?
-না কিছু লাগবেনা।সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেছে তাই ভাবলাম তোমাকে হেল্প করে দেই।বলো কি করতে হবে?
-না কিছু করতে হবেনা,বাবার আর মাহিরের নাস্তা বানানো শেষ।ওদের খাবার দিয়ে মায়ের নাস্তা বানাবো।তারপরে তোমাকেও নাস্তা দিয়ে দিবো।
-তাহলে আমি বাবা আর ভাইয়ার নাস্তা সার্ভ করে দেই।না করবে না।কারণ আমি শুনবো না।
সকাল থেকে জান্নাতের শুধু অবাক হওয়ার পালা।সব কিছু কেমন জানি স্বপ্ন লাগছে। মিহি নাস্তা,ভাইয়ার জন্য চা নিয়ে গেলো।তাদের সার্ভ করে দিয়ে চা গরম করে জান্নাত আর ও খেয়ে নিলো। জান্নাত ওর শাশুড়ীর জন্য নাস্তা নিয়ে গেলো।ওকে দেখেই ওর শাশুড়ী বসতে বললো।জান্নাত পাশে গিয়ে বসলো।ওর শাশুড়ী ওর হাত ধরে বললো, মা তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছে তাইনা।এতো গুলো মানুষের দায়িত্ব তোমার কাধে।আমিও দেখো কি অক্ষম একটা মানুষ।তোমাকে কোন কাজে সাহায্য করতে পারিনা।সারাদিন শুয়ে বসে থাকি।তোমার উপর অনেক প্রেশার পরছে।আমি আর তোমার শ্বশুর ঠিক করেছি তোমাকে সাহায্য করার জন্য একজন কাজের লোক রাখবো।
-কিন্তু আপনার তো,,
-কাজ তো কাজ ই তুমি একটু খেয়াল রাখবে তাহলেই হবে।
-জ্বি,আচ্ছা। জান্নাত ডাইনিং এ এসে দেখলো মিহি ওর নিজের আর জান্নাতের প্লেটে খাবার বাড়ছে।
-ভাবি দেখতো সব ঠিক আছে কিনা।
-সব ঠিক আছে।
-শিখে রাখছি কয়দিন বিয়ে করছি না।
-বাব্বা,,শ্বশুরবাড়ি গিয়ে বরকে কিভাবে বেড়ে খাওয়াবে তা শিখে নিচ্ছ বুঝি?
মিহি কিছুক্ষণ হেসে বললো, নয়তো স্বামিকে হাতে রাখতে পারবোনা। মিহি আর জান্নাত দুজনেই হাসছে। জান্নাত দুপুরের জন্য রান্না করছে।মিহান উঠলো কিনা দেখতে গিয়ে দেখে মিহান টেবিলে বসে নাস্তা করছে।জান্নাত দেখছে একদিনে পুরো পরিবার কিভাবে বদলে যেতে পারে।যে ছেলেটা প্রতিদিন নাস্তা দিয়ে যাও বলে চিতকার শুরু করে দিতো আজ সে নিজেই নাস্তা নিয়ে খাচ্ছে। বিকেলে মাহিরের ফোন এলো জান্নাত রিসিভ করতেই মাহির বললো, “জান্নাত রেডি হয়ে থেকো,সন্ধ্যায় বের হচ্ছি আর হ্যা ওই যে গোল্ডেন কালারের একটা শাড়ি আছে না তোমার ওইটা পরবে।” এটুকুই বলে ফোন রেখে দিলো। জান্নাত মাহিরের পছন্দমতো সেজেগুজে মাহিরের সাথে বড় একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছে।কিছুক্ষন পরে ওয়েটার কিছু মোমবাতিসহ একটা চকলেট কেক নিয়ে এলো।জান্নাত কেক দেখে অবাক হলো। কিন্তু আজ তো ওর জন্মদিন নয় তবে কেক কিসের।মাহিরকে জিজ্ঞেস করেই ফেললো,
-মাহির আজ তো আমার কিংবা তোমার জন্মদিন নয় তবে কেক কিসের?
মাহির মুচকি হেসে বলল,আজ আমাদের বিয়ের ২মাস পূর্ন হলো সেই উপলক্ষে এই আয়োজন। মাহির একটা প্যাকেট থেকে বেলি ফুলের মালা বের করে জান্নাতের খুপায় গুজে দিলো।তারপর একসাথে কেক কাটলো। ওরা ওখান থেকে বের হয়ে রিকশা করে কিছুক্ষণ ঘুরে ফুচকা, আইসক্রিম খেয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে রাতের জন্য খাবার কিনে বাড়ি ফিরলো। একসাথে সবাই ডিনার করে জান্নাত বারান্দায় মাহিরের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে। “মাহির জানো আজকের দিনটা আমার কাছে স্বপ্নের মতো কেটেছে।” মাহির জান্নাতের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “প্রতিটা দিন তোমার স্বপ্নের মতো কাটবে,প্রমিস”