– তোর সাথে কতদিন পরে দেখা! তাই না?
– হুম! শেষবার দেখা হয়েছিলো নাইনটি ফোরে মনেহয়।
– উঁহু নাইনটি ফাইভে। তুই সারাজীবন গাধাই থেকে গেলি। তোর মনে নেই নাইনটি ফাইভে আমার মা মারা গিয়েছিলো। তারপরেই তো…
– ছাড় এসব কথা। কেমন আছিস তাই বল?
– এই বয়সটাই এমন যে, এখানে ভাল খারাপের কোন বালাই নাই। সহজ কথায় চলে যাচ্ছে। কেন যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে কিচ্ছুটি জানি না। শুধু জানি যাচ্ছে।
– এখনো বদলে যাসনি দেখছি। আগের মতোই কথায় কথায় হেয়ালি।
– নারে অনেক বদলে গেছি। আগের সেই বন্যা নেই আমি। তোদের সবাইকে দেখে এতো ভাল লাগছে। নিজেকে যেন আগের মতো ফিরে ফেলাম। সবকিছু ঠিক যেন আগের মতো। সেই ভার্সিটির দিন। চায়ের কাপ। হুটহাট তোদের কেবলা গুলো জুনিয়র মেয়ে গুলোর প্রেমে পরে ব্যাকা হয়ে যাওয়া সব মনে পড়ছে সব।
– আমাদের প্রেমে পরাই কেবল মনে আছে তোর। আর তুই যে মাজেদ স্যারের সাথে…
– দেখ চড় খাবি গান্ডু। ওসব তোদের ভুল ধারণা। ছাড় তো। ভাল লাগে না এই ব্যাপারটা।
– তোর হ্যাসবেন্ড আসেনি?
– না। একাই এসেছি। তোর সাথে কে এলো?
– একাই এসেছি।
– তোর স্ত্রী। ছেলে মেয়ে। কিছুই তো জানি না। কত দিন পরে আজ দেখা!
– বিয়ে করিনি। একাই আছি। বেশ কেটে যাচ্ছে দিন।
– কেন রে! বিয়ে করলি না কেন। ঐ মেয়েটার কি যেন নাম ছিল। ইকোনমিকসে পড়তো।
– শায়লা।
– হ্যাঁ হ্যাঁ শায়লা। চমৎকার মেয়ে ছিল। ওর সাথে না তোর…
– শায়লা চমৎকার মেয়ে বলেই আমার সাথে কিছু হয়নি শেষ পর্যন্ত।
– আমি স্যরি রিদোয়ান। শায়লার কথা তোলাটা ঠিক হয়নি।
– না না এ আর এমনকি। এসব নিয়ে কি আর কেউ ভাবে। ছাড় এসব। তোর কথা বল। বেশ বুড়িয়ে গেছিস।
– তোর বাসায় কি আয়না নেই নাকি। নিজের দিকে তাকাস না। এতো বড় গামলার মতো টাক নিয়ে এসেছিস। আর আমাকে বলছিস বুড়িয়ে গেছি।
– আমি কি ভেবেছিলাম জানিস। তুই ঠিক সেই আগের মতোই আছিস। সেই ছটফটে ফর্সা মেয়েটা। ভারি একটা ব্যাগ নিয়ে এসে ধপাস করে বসে পরে বলবি- এই একটু বাতাস কর তো। অসহ্য গরম।
– তোর দেখি সব মনে আছে। এতদিন পরেও ভুলিসনি কিছুই।
– আমি তোদের তুলনায় ঝাড়াহাতপা। সংসার থাকলে তোদের স্মৃতিতে বাজারের ফর্দ ঢুকে অনেক কিছুই ভুলিয়ে দিতো হয়তো। আমার তো আসলে সেই দিন গুলো ভাবা ছাড়া আর কোন স্মৃতি নেই।
– অনেক কিছুই জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে তোকে। কিন্তু কিছুই জানতে চাইবো না। জানিস আমি এখানে শুধু একটা মানুষের জন্যই ছুটে এসেছি। শুধু তোর জন্য রিদোয়ান।
– কি বলিস? আমার জন্য?
– হ্যাঁ! তোর জন্যই। নয়তো সবাইকে এক সাথে পাওয়ার পরেও তোকে নিয়ে এখানে সবার আড়ালে এসে বসলাম কেন?
– তুই কি এখনো ঘটনাটা ভুলতে পারিস নাই?
– আমি কখনোই ভুলবো না। আমাকে এখনো বিদ্ধ করে…
– প্লিজ বাদ দে বন্যা। আমি ওসব মাথায় রাখিনি। তুই আমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু ছিলি। আছিস, থাকবিও। হয়তো আমাদের যোগাযোগ নেই। কিন্তু তুই আমার বন্ধু হয়েই আছিস।
– আমায় যে খুব পোড়ায় সেই ঘটনাটা। কি অন্যায়টাই না করেছি তোর উপরে। আমি আসলে তখন…
– বন্যা একটা জিনিস দেখবি?
– কি?
– নে দেখ। মানিব্যাগটা খোল।
– রিদোয়ান। এটা… এটা কি সেই টিপ। যেটা তুই আমার সাথে প্রথম দিন পরিচয়ের সময়ে নিয়েছিলি?
– হ্যাঁ! আমাদের বন্ধুত্বের একটা নক্ষত্র এটা।
– তুই এখনো আগলে আছিস রি-দো-য়া-ন?
– এছাড়া আর কি নিয়ে বাঁচি বল।
– আর আমি কিনা তোকে!
– প্লিজ বন্যা। ওসব ভুলে যা। একটা কথা কি জানিস?
– কি?
– জীবনের স্টেশন প্ল্যাটফর্ম থেকে সবাই সব গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না। তোরা তোদের মতো করে একটা গন্তব্যে পৌঁছে গেছিস। আমি কেবল একবার এই স্টেশন থেকে আরেকবার ঐ স্টেশনে ছুটে যাচ্ছি। আমাকে কোন গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারছে না কোন স্টেশন। আমি খুব করে একটা ঠিকানা চাই বন্যা। যেই ঠিকানায় আমি মারা যাওয়ার পরেও কেউ এসে খুঁজে যেন জানতে পারে; এটাই আমার ঠিকানা ছিলো।
– আমায় কি একটা বার সুযোগ দিবি?
– কি যে পাগলের মতো কথা বলিস না তুই? তোর কোন দায় নেই। আমি সবাইকে মুক্তি দিয়ে দিয়েছি।
– একবার আমার ভুল শুধরাইবার সুযোগ দে।
– সেটা আরেকটা ভুল হবে এতো বছর পরে এসে। যোগাযোগহীন এতোটা সময় আমরা পার করেছি। আরো ক’টা দিন ঠিক পার করে দিতে পারবো আমরা। মানুষ আর বাঁচেই বা ক’দিন বল!
– রিদোয়ান…
– প্লিজ বন্যা। আমি চাইনি কখনো তোর মুখটা গোমড়া থাকুক। তোর চোখে জল গড়িয়ে পড়ুক। প্লিজ মুছে ফেল চোখের জল।
– তুই তোর শার্টের আস্তিন দিয়ে মুছে দে।
– কেউ দেখলে কি ভাববে? মধ্যবয়সের দুই বুড়ো বুড়ি ছেলেমানুষি করছে।
– তাতে আমার কিছু যায় আসে না। দিবি?
– দিচ্ছি।
– চোখের কাজল লেপ্টে দিস না যেন।
– একবারই তো কেবল লেপ্টে দিয়েছিলাম। সেটাই প্রথম… সেটাই শেষ সর্বনাশ।
– রি-দো-য়া-ন…
– চল উঠি। আবার যদি কখনো দেখা হয়, তোর জন্য রূপার এক জোড়া নূপুর নিয়ে আসবো। কথা দিয়েছিলাম দিবো। ভুলে গিয়েছিলাম। আজ আবার মনে পরলো।
– তোর ফোন নাম্বার দে। আমি রোজ কল দিবো তোকে।
– আমাদের গন্তব্য অনেক আগে আলাদা হয়ে গেছে বন্যা। আমাদের মাঝে এখন এক সমুদ্র দূরত্ব। না থাকলো আর যোগাযোগ। হুট করে যদি কখনো দেখা হয় তো…
– তো…
– মানিব্যাগে রাখা টিপটা পরিয়ে দিবো তোকে। আঠা কমে গেছে। তাতে কি। ঠিক ঠিক তোর ভ্রুর মাঝখানে ভার্সিটির প্রথম দিনের মতোই জ্বলবে।