পহেলা বৈশাখ

পহেলা বৈশাখ

চারিদিকে হালকা জোৎস্নার আলো। তেমন অন্ধকার হয়নি বটে। শান্ত, মনোরম এই পরিবেশ অরুর ভিসন প্রিয়। কিন্তু আজ পাখি দের নীরে ফিরতে তেমন দেখা গেল না। সোডিয়ামের এই আলোয় হয়ত কেউ আশে-পাশে নেই।
সব কিছুই যেন অরুর মতোই হচ্ছে। কিন্তু তার তৈরি করা এই সেগুনের বেঞ্চটায়, সেই নেই।
অনেক স্বপ্ন করে সে এই বেঞ্চটা বানিয়ে ছিল। প্রথম যখন সে এই বেঞ্চ বানিয়ে ছিল আমাকে নিয়ে তখন সে বলেছিল,

অরুঃ- আমার আর তোমার বিয়ে হলে প্রথম রাতে আমি এখানে এসে কাটাব।

আমিঃ- সবাই ত আমাদের চোর ভাববে!

অরু আমার কথাটাকে যেন স্বাভাবিক ভাবেই নিল। তার এমন করাটা আমার কাছে আশ্চর্যের। সাধারনত সে আমার সাথে সামান্য বিষয়েই ঝগরা করে। আমার তার ঝগরার বেশির ভাগই অসহ্য লাগে। কিন্তু ঝাগরায় তার কাজল কালো চোখে আমাকে ভ্রু কুচকে দেখা, আমি শুধু তাকিয়েই থাকি।

অরুঃ- আমাদের প্রথম বাবু হলে তখন সারাদিন এখানে ওকে নিয়ে বসে থাকব!

আমিঃ- তাহলে এখানে বাথরুম এর ব্যবস্থা করা দরকার। তাহলে প্রাকৃতিক ডাকে সারা দিবা কিভাবে?

দেখলাম অরু আমার প্রতি বিরক্ত। সে আর কিছু না বলেই উঠে গিয়েছিল। চারিদিকে হালকা এই আলো আমার যে আহামরি ভালো লাগে তা না। কিন্তু আজকের এই দিনে সারা রাত বসে থাকতে আমি অভ্যস্ত।

অরুর আসল নাম ছিল অরুনিমা আক্তার। আমিই তাকে এই নাম দিয়ে ছিলাম কেম্পাসের প্রথম দেখায়। কেম্পাসে প্রথম শুনতাম অপরূপ চেহারার অধিকারী এই মেয়েটি। কিন্তু আমি তার চেহারাতে তেমন কিছু বিশেষ দেখিনা। তার বিশেষত্ব তার অপরূপ মনে। আসলেই তার মন অপরূপ। কিন্তু জগতে কাউকে মনের প্রশংসা করতে দেখা যায় না।
কোনো এক পহেলা বৈশাখের উৎসবে বিবাহের প্রস্তাব দিয়ে ছিলাম। পরিবারের সম্মতিতে আমাদের নতুন জীবনের একটা ছোট কুড়ে ঘর বানাতে ব্যস্ত। প্রতি মুহূর্তে আমাদের নতুন কুড়ে ঘরের স্বপ্নে ভরা খড়কুটো গুলো বৃদ্ধি পেত।
এরকম ২ টি পহেলা বৈশাখ আমাদের স্বপ্ন দেখা চলতে থাকল। তার সব অদ্ভুত স্বপ্নে আমাকে বিশাল আসনে বসিয়ে রাখত। অরুর সবচেয়ে পছন্দের জায়গা ছিল এটি। যখন আমাদের অভিমান হত, তখন সে এখনে একা একা বসে পুকুরের স্বচ্ছ পানিতে তাকিয়ে থাকত। তার ইচ্ছা ছিল আমাদের বিবাহ হলে এখানে একটা সুন্দর ঘর বানাতে হবে। সে এখানে সব সময় থাকতে চায়। আমার মনে পড়ে কোনো এক পহেলা বৈশাখের ৩ দিন পূর্বে আমাকে বলে,

অরুঃ- আমাকে সেগুনের কাঠ এনে দিবা?

আমিঃ- কিছুটা স্তব্ধ হবে তাকে বললাম, প্রতিদিন না হয় ৫-১০ মিনিট দেরি করে আসি, তাই বলে আমাকে সেগুনের কাঠ দিয়ে মারবা! সে তখন কিছুটা রেগে গিয়ে বলেছিল,

অরুঃ- আমাকে কি তোমার জল্লাদ মনে হয়? জানো আমার না এখানে একটা বেঞ্চ বানাবর ইচ্ছা।

আমিঃ- তাহলে আমি একটা মিস্তিরি কে দিয়ে বানিয়ে আনি! তুমি কেন কষ্ট করবা?

অরুঃ- আমার মিস্তিরির লাগবে না। আমি নিজে হাতে বানাব, তুমি সাহায্য করবা!

আমিঃ- আচ্ছা ঠিক আছে।

সেদিন আর তেমন কথা হয়নি। হয়ত সেটাই ছিল আমাদের অনুভূতি বিনিময়ে অন্তিম সময়! আজ পহেলা বৈশাখ। সব প্রেমিক-প্রেমিকা একটা নিরিবিলি সময় কাটাচ্ছে। কেউ কেউ আমার নতুন ভাবে তাদের জীবন শুরু করছে। আমাদের ইচ্ছাটা ছিল আলাদা। আমাদের বিয়ের আর ৫দিন বাকি। আমি একটা ভ্যানে কিছু সেগুন কাঠ, করাত, পেরেক আরও যাবতিয় কিছু জিনিস নিয়ে সেই চির চেনা জায়গায় যাচ্ছি। অনেক খন যাবত দেখছি কিছু লোক আমাকে অনুসরণ করছে। তাদের কয়েকটা কে আমার চেনা মনে হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু আমি তেমন পাত্তা দিইনি।

আমি যখন সেই চির চেনা জায়গায় পৌছালাম, অরুকে দেখে প্রথম মনে হয়েছিল কেম্পাসে কিছু লোকের কথা মিথ্যে ছিলোনা। তাকে ওই দিন অনেক সুন্দর লাগছিল। তার পড়নে ছিল বৈশাখের সাজ, মূখে ছিল প্রশান্তির হাসি!
অরুর তার কাজে ব্যস্ত, সে Youtube দেখে তার কাংখিত বেঞ্চ বানাচ্ছে। আমি তার কাজে খুঁটিনাটি সাহায্য করছি। ভার্সিটি থাকতেও তেমন কোনো কাজের ছিলাম না। তাও অরু সব সময় আমাকে সকল অনুষ্টানে সাজানোর কাজে তার পাসে আমাকে রাখত। কোনো কাজ করতে পারতাম না। তার মুখের করা কথা গুলো ভালোই লাগত।।

সন্ধা থেকে রাত হতে চলল। আমাদের কাজ পায় শেষ। অল্প কিছু বাকি! হঠাৎ কেউ পেছন থেকে আমার মাথায় সজোরে আঘাত করল। কিছু বুঝে ওঠার আগে আমার পুর শরীর যেন অবস হয়ে আসল। আমি শুধু ভারি ভারি কন্ঠে শুনতে পাচ্ছিলাম, “মুইরে তুই জেলে পাঠাইস, ASP হইসস না! তোর সামনে তোর হবু বউরে ভোগ করুম! দেহি কি করস” আমার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, আমি আর তেমন কিছুই শুনতে পাচ্ছি না! আশেপাশে দেখলাম ৭-৮জন বেশির ভাগ কালো রুমালে মুখ ঢাকা। হয়ত অরু আর্তনাদ করে আমাকে জাগানোর চেষ্টা করছে, হয়ত বিফলে যেয়ে আশেপাশের লোক জনের কাছে সাহায্য চাচ্ছে।

কিন্তু জ্ঞান হারানোর শেষ মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল, “আমার অরু ত সবার চাইতে আলাদা, সে হয়ত বলেছিল, “তানভির তুমি ঠিক আছোতো?, তোমার বেথা লেগেছে?, কেউ আমার তানভির কে বাঁচাও!, তুমি শুনতে পাচ্ছো! আমাকে ক্ষমাকরে দিও, আমার দেওয়া কথা গুলো আমি রাখতে পারলাম না!” যখন আমার জ্ঞান ফিরেছিল আমার সামনে সেই অপরুপ মেয়েটির মূখ এসিড দারা ঝলসানো। তার শরীরে তেমন কোনো পোশাক নেই। ঝিম ঝিম করা মাথা নিয়ে তাকে কোলে তুলে নিয়েছিলাম। হয়ত তখন সে আকাশের তারা হয়ে আমার পাগলের মত দৌরানোর দৃশ্য দেখছে! হয়ত বা আমার ভালোবাসার পরিক্ষা নিচ্ছে।

আজ এই চেনা জায়গায় সব আছে। একটা সুন্দর বাড়ি, সেই আধ-তৈরি করা বেঞ্চ, নেই শুধু সে! না না সেও আছে, এইত তার কবর। এখান কার তারাদের মধ্যে সে হয়ত একজন! আমি অশ্রু ভেজা চোখে সেই তারাকে খুজি প্রতি পহেলা বৈশাখ। কারণ প্রতি পহেলা বৈশাখে এই আকাশে হাজাও তারার সমাবেশ! হয়ত এখানের কোন এক তারায় তার বাস! অথবা আমার অরু পছন্দ করে বলে প্রতি পহেলা বৈশাখ তার জন্ম দিনে তারা এসে অরুর কবরে শুভেচ্ছা যায়নায়! আমি শুভেচ্ছা জানাই গত ৪০ টা বছর।শারা রাত জেগে!

অবচেতন মনে বলে উঠলাম, “জানো অরু! ওই দিন তোমায় অনেক সুন্দর দেখিয়েছিল। শুধু আফসোস সেদিন আমার মুখ সেই প্রসংশা করতে পারেনি। গত ৪০ টা বছর সেই রূপের প্রসংশা করি, তুমি কি শুনছো!” আফসোস করি, “ ৪২টি বছর প্রতিনিয়ত তোমায় বলে গেলাম তোমায় ভালোবাসি, কিন্তু তোমার সেই অপরুপ কন্ঠে কখনো শুনলাম না ভালোবাসি!”

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত