-বাবা তুমি আজও ছেঁড়া পাঞ্জাবিটা পড়ে বাইরে গিয়েছিলে ? তুমি জানো না এটা পড়লে আসে পাশের সবাই হাসাহাসি করে ।
– ভুল হয়ে গেছে মা। আর পড়বো না।
– তোমাকে কতো করে বলেছি এই ভাঙা চশমা না পড়তে তবুও তুমি সেটাই পড়বে । আচ্ছা তুমি কি চাওনা আমি সমাজে ভাল ভাবে চলি।
– আমার পাগলি মেয়ে। ঠিক আছে বাবা আর পড়বো না। এখন বল দুপুরে কি রান্না করেছিস ভিষন খিদে পেয়েছে।
– আজ নেট থেকে একটা চাইনিজ খাবার শিখেছি ওটা রান্না করেছি। এখনই আনছি দাড়াও ।
এই বলেই খাবার টা বাবার সামনে দিলাম । বাবা কিছু সময় ভুরুকুঁচকে তাকিয়ে থেকে বললো ,
– মারে এটা কি রান্না করেছিস দেখতে মনে হচ্ছে খাবার টা সিদ্ধ হয়নি। কাঁচা খাবার খাওয়া যায় নাকি ।মাংস সাদা হয়ে আছে ।
– ওহ্ বাবা এটাই চাইনিজ খাবার ।
– ঠিক আছে তুই খা। আমাকে কয়টা ভাত দে। ভিষন খিদে লেগেছে ঔষধ খেতে হবে ।
– ভাত তো নেই বাবা ।এই গুলি খাওতো।
সেদিন বাবা একরকম বাধ্য হয়ে অল্প কিছু খাবার খেয়ে উঠে চলে গেল । আমি তো মহাখুশি আজ নিজের পছন্দ মতো খাবার খেয়েছি । পরদিন বাবা আমার জন্য সুন্দর একটা কাচ করা লাল টুকটুকে জামা এনে দিয়ে বললো,
– দ্যাখতো মা এটা কেমন হয়েছে । দোকানে অনেক দিন থেকে দেখে আসছি। কিন্তু হাতে টাকা ছিল না তাই কিনতে পারিনি। আজ বেতন পেয়ে এটা কিনলাম । আমি কিছু সময় জামাটা নেড়েচেড়ে বললাম,
– বাবা এই জামা আজকাল কেউ পরে না। আমার বন্ধুরা দেখলে হাসবে । আমি পারবো না পরতে ।শুধু শুধু কেন কিনতে গেলে । টাকা টা আমার হাতে দিতে নিজে পছন্দ করে কিনে আনতাম। সেদিন রাগে জামাটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেলাম । পরদিন বাবা আমার হাতে দুইহাজার টাকা দিয়ে বললো,
– এই নে মা তোর পছন্দ মতো জামা কিনে নিস।
আমি তো মহাখুশি । একবার ও ভাবলাম না টাকা গুলি কোথা থেকে এলো। যতোদিন দিন যেতে লাগলো বাবার থেকে আমার দুরত্ব বাড়তে লাগলো। সারা দিন ইন্টারনেট ফেসবুক বন্ধু বান্ধব এই গুলি বেশি ইমপরট্যান্ট মনে হতে লাগলো। বাবার কি লাগবে কি পছন্দ করে কোনও মূল্য আমার কাছে রইলো না। দুহাতে টাকা খরচ করতে লাগলাম । কখনও জিজ্ঞাসা করতাম না আচ্ছা বাবা তুমি কোথায় পাও টাকা । আমাকে চাওয়ার আগেই টাকা দিলে তুমি সারা মাস চলতে পারবে তো। ঔষধ খেতে পারবে ঠিক মতো। নাকি বুকের ব্যথার সেই পুরনো রোগটা তোমাকে চিনচিন করে কষ্ট দেবে সারাটা রাত। সকালে ভাল মানুষের মতো হেসে দিব্বি চলে যাবে অফিসে । নাহ আমি কখনও এটা জিজ্ঞাসা করতাম না। বরং বন্ধুদের কাছে বুক ফুলিয়ে বলতাম ,
– জানিস আমি যা চাই বাবা সব কিছু এনে দেয়। কখনও না করে না।
সেদিন রাতে আমি ফেসবুকে ব্যস্ত । বাবার গুনগুন করে কান্নার আওয়াজ আমার কানে এলো। অনেক টা বিরক্ত নিয়ে কাছে গিয়ে বললাম ,
– বাবা তুমি ঔষধ না খেয়ে আবার সেই আগের ব্যথায় ভুগছো। কতো করে বলেছি ঔষধ কাছে রাখবে সব সময় । এখন আমি কোথায় পাবো তোমার ঔষধ ।
– মা রে তুই একটু আমার কাছে বসে থাক ।আমার সব কষ্ট মুছে যাবে ।
– আহ বাবা সামনে আমার পরীক্ষা । কিছু লাগলে বলো। আমার পড়তে বসতে হবে ।
– ও তোর পরীক্ষা ঠিক আছে যা মা মন দিয়ে পড়। আমার চিন্তা করতে হবে না। আমার ব্যথা অনেক কমে গেছে তুই যা পড়।
বাবার কাছ থেকে এসে আবার ফেসবুক নিয়ে বসলাম । পরদিন পরীক্ষা কলেজে গিয়ে মনে পড়লো পরীক্ষার ফি বাসায় রেখে গেছি। তাড়াহুড়ো করে বাসায় আবার চলে এলাম। বাবার ঘরে পুরোনো সেই কাঠের আলমারি টা খুললাম। সামনেই টাকা ছিল । টাকা নিয়ে বের হবো ঠিক এমন সময় চোখ গেল বেশ পুরনো একটা ডায়েরিতে। ডায়েরিটা পুরনো হলেও বেশ যত্ন করে রাখা হয় দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কৌতুহল বেড়েই গেল কি লেখা এতে।
সামনের পৃষ্ঠা বের করতেই চোখে পড়লো গোটা গোটা করে লেখা আজ আমার রাজ্যে একটা ফুটফুটে রাজকন্যা এসেছে । আহ কি মিষ্টি একটা রাজকন্যা ।ওকে বুকের সাথে ধরতেই আমার বুকটা শীতল হয়ে গেল । বাবা হলে এতো সুখ আগে বুঝিনি। এই টুকু পড়তে হাসতে লাগলাম । বাবা আমার কথা লিখেছে । আমি পরের পৃষ্ঠা উল্টাতে শুরু করলাম আবার পড়তে লাগলাম আজ আমি সফল । আমার রাজকন্যা আলতো আলতো বুলিতে আমাকে বাবা ডেকেছে । ইচ্ছে করছিল পৃথিবীর সবাই কে চিৎকার করে বলি আমার মেয়ে আমাকে আজ বাবা বলে ডেকেছে । পৃথিবীর সব সুখ বাবা ডাকের কাছে মূল্যহীন ।
আমার লেখা গুলি পরে কেমন যেন হাত কাঁপতে লাগলো। বাবা আমাকে এতো ভালোবাসে কিন্তু আমি কি করেছি। কাঁপা কাঁপা হাতে একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগলাম, আমার পৃথিবী আমার মেয়ে । যাকে আমি নিজের থেকে ও বেশি ভালোবাসি। কিন্তু যতো বড়ো হতে লাগলো আমার পৃথিবী বদলে যেতে লাগলো। আমার থেকে দুরে সরে যেতে লাগলো। ওর মা ছয়বছর বয়স থাকতে আমাকে রেখে চলে গেল সব কিছু মিটিয়ে দিয়ে । আমাকে একাকিত্বর সঙ্গী করে । কিন্তু আমি কখনও একা নিজেকে মনে করিনি। আমার সাথে আমার পৃথিবী আছে আর কি লাগে ।
জানো সীমা ! তোমার মেয়ে এখন অনেক বড়ো হয়ে গেছে ।নিজের পছন্দ শিখে গেছে । মনে আছে তোমার, আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকীতে তুমি আমাকে একটা পাঞ্জাবি দিয়েছিলে ওটা এখনও আমি যত্ন করে রেখেদিয়েছি। ওটার সাথে মিশে আছে তোমার আমার হাজারো মুহূর্ত । তোমার দেওয়া সেই চশমা যেটা চোখে দিয়ে আমি বই পড়তাম তুমি মিষ্টি করে ধমক দিয়ে বলতে একদিন তোমার এই চশমা আমি ভেঙে ফেলবো তখন বুঝবে কেমন লাগে । আমি জানি তুমি মুখে বললেও রোজ ওটা যত্ন করে মুছে রাখতে আলতো হাতে । এখনও ওগুলো আমি মাঝে মাঝে পড়ি। কিন্তু আর হবে না হয়তো । অবনী বলেছে ওই গুলি পড়লে সবাই হাসাহাসি করে । তাই ঠিক করেছি আমার ঘরে দরজা বন্ধ করে ওটা পড়বো। তোমার কথা ভেবে দুফোটা চোখের জল ফেলবো।
বেশ কিছু দিন ধরে দোকানে লাল জামা টা দেখছিলাম । রোজ ভাবতাম আমার রাজকন্যা এটা পড়লে অনেক ভালো মানাবে । কিন্তু আমার কপাল খারাপ ওটা ওর পছন্দ হলো না। তুমি চিন্তা করোনা না সীমা আমার কাছে ঔষধ কেনার কিছু টাকা ছিল ওটা ওকে দিয়েছি নিজের পছন্দ মতো জামা কেনার জন্য । আচ্ছা তুমি বলো দুদিন ঔষধ না খেলে কি আমি মরে যাবো ? কিন্তু অবনী খুশি আমার এতেই সব কষ্ট মুছে যায় । কয়েক দিন ধরে একটা ভয় কাজ করছে মেয়েটা দেখতে দেখতে বড়ো হয়ে গেল । দুদিন পর পরের বাড়িতে চলে যাবে । তখন আমি ওকে ছাড়া কিভাবে থাকবো। কিভাবে আমার দিন কাটবে । এটা মনে করলেই বুকের যন্ত্রণাটা বহুগুণ বেড়ে যায় । পৃথিবীতে সব থেকে কষ্ট নিজের হাতে রাজকন্যা সাজিয়ে অন্যের ঘরে তুলে দেওয়া । সেই দিনটার অপেক্ষায় আছি। তারপর নিশ্চিত মনে তোমার কাছে চলে আসবো। তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করছো বহুবছর ধরে আমি বুঝতে পারি অনুভব করতে পারি।
লেখা গুলি শেষ করে আমি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম । বুক ফেটে যাচ্ছে কষ্টে। চিৎকার করে কাঁদছে ইচ্ছে করছে । কেমন পাষাণ সন্তান আমি ।আমার কোনও ক্ষমা হতে পারে না। বাবাকে আমি দিনের পর দিন কষ্ট দিয়েছি। একি করেছি আমার মরে যাওয়া উচিত । না না এভাবে আর না। পৃথিবীতে সব থেকে বেশি আমি বাবাকে ভালোবাসি । বাবা আমাকে মাফ করে দাও। কোনও দিন তোমার অবাধ্য হবো না।
আলমারিতে খুঁজে লাল জামাটা বের করে পড়লাম । চলে গেলাম বাবার অফিসে ।আমাকে এভাবে দেখে বাবা অবাক হয়ে গেল । বাবাকে সাথে নিয়ে অনেক ঘুরলাম । বাবা খুশিতে ছোট বাচ্চাদের মতো করছে । আমার হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে যেমন সন্তান মায়ের হাত ধরে রাখে। আমার জমানো টাকা দিয়ে বাবা কে একটা সুন্দর পাঞ্জাবি আর একটা নতুন চশমা কিনে দিলাম ।
বাবা জুতো জোড়া ছিড়ে গিয়েছিল বহুবার তবু ও ওটা পড়তো আর বলতো এই জুতো জোড়া আমার অনেক পছন্দ তাই ফেলি না। কথাটা মনে করতেই কেঁদে দিলাম । জোর করে দোকানে নিয়ে নতুন জুতো কিনে বাসায় চলে এলাম। রাতে শুয়ে শুয়ে অনেক কাদলাম। কয়েকবার বাবার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলাম আজ বাবার বুকে ব্যথা একটু ও নেই। খুব শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে । বার বার আমার চোখ আজ ভিজে যাচ্ছে তবে কষ্টে না আনন্দে। বাবাকে ভালোবাসি অনেক বেশি ভালো ।