ভালোবাসায় ঘেরা

ভালোবাসায় ঘেরা

হঠাৎ মাথা ব্যথা অনুভব করছি। অফিস থেকে বসের কাছে ছুটি নিয়ে বাসায় আসলাম। মা রোদে পুরে রান্না করছে। পল্লবীকে (স্ত্রী) কোথাও দেখছি না। মা’কে জিজ্ঞাসা করলাম..

— পল্লবী থাকতে তুমি রান্না করো কেনো? মা চেঁচিয়ে বললো..

– তোদের দুই জনকে নিয়ে আমার হয়ছে যত জ্বালা। তুই থাকিস সারাদিন অফিসে আর তোর বউ সারাদিন ঘরের ভিতরে শুয়ে থাকে। মা কথা গুলো মজা করে বলছে এটা আগেই জানি। তবুও একটু আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম..

— মানে! পল্লবী সারাদিন কাজ না করে শুয়ে থাকে। আর সেটা তুমি সহ্য করে নাও। এখন বলো ও কই গেছে?
– কই আর যাবে! তোর পাশের বাড়ির শেফালী ভাবির কাছে গেছে।
— তুমি যেতে দিলে কেনো কাজ বাদে?
– মেয়েটার মনও ভালো নেই তাই মানা করিনি।

আমি রুমে এলাম। অফিসের ফাইলটা টেবিলের উপর রাখলাম। প্যান্ট খুলে লুঙ্গি পড়ছি। এমন সময় পল্লবী হাজির। কিছু বলিনি। আনমনা মুখের দিকে তাকাতেই নতুন করে প্রেমে পরে গেলাম। ফ্যাঁকাসে মুখ ওর। দেখতে একদম নিষ্পাপ শিশুদের মত লাগছে। ও বললো..

— আজ এতো সকালে এলে যে? আমায় দেখতে ইচ্ছে করছে বুঝি! ও কথাটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে বোঝতে পারলাম। ওর অনুপস্থিত নিয়ে কিছু বলিনি।
– হ্যাঁ গো হ্যাঁ। ঘরে এতো সুন্দর বউ রেখে অফিসে মন দিতে পারিনি। তাই চলে এলাম।

আমি লুঙ্গি পড়ে খাঁটের উপর ভর করে পা ঝুলিয়ে বসলাম। পল্লবী আমার পাশে বসলো। বোঝতে পারলাম আমার হাতের উপর হাত রাখার চেষ্টা করছে। সাহস পাচ্ছে না। মনে মনে হাসছি। আমার সাথে অনেক কথা বলছে। কিন্তু হাত রাখার কথা বলতে পারছে না। বললাম..

— কিছু বলতে চাচ্ছো! বলো জলদি। ধৈর্য্য আর হচ্ছে না। এক চিলতে হাসি দিয়ে বললো..
– কিছু বলতে চাচ্ছি তুমি বোঝলে কিভাবে? এই! তোমার মনে কি চলছে হু? আমার কাজ আছে।

পল্লবী উঠে চলে যাবে। পিছন থেকে হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিলাম। ভাবিও নাই ও খাঁটের সাথে ব্যথা পাবে। হ্যাঁচকা টান দেয়াতে খাঁটের উপর পরে থুতনিতে একটু কেঁটে গেল। ভয় পেয়ে ঘাবড়ে গেলাম। কি করবো বোঝতে পারিনি। ওরে রেখে মায়ের কাছে গেলাম দৌঁড়ে। পল্লবী পিছন থেকে ডাকছে। মা বললো..

— কিরে, ঘর থেকে দৌঁড়ে এলি কেনো? আজও নিশ্চয় পল্লবীকে কিছু করেছিস তাইনা! মেয়েটার সাথে এরকম দুষ্টুমি না করলে হয়না তোর? আমি ভয়ে সত্যিটা বলতে পারিনি। বললে মা বকা শুরু করবে।

– না মা। কেমন করে যেন ওর থুতনি কেঁটে গেছে। তুমি ওর কাছে গিয়ে দেখো যাও। মা হেসে হেসে বললো..

— তোদের দুজনকে নিয়ে আর পারা গেল না।

মা পল্লবীর কাছে গেল। এদিকে চুলোর আগুন নিভো নিভো করছে। প্রায় মিনিট পাঁচেক পর মা এলো। হাসি মাখা মুখ করে বললো..

— এই হারাম জাদা! তুই এখানে দাঁড়িয়ে থেকেও চুলার আগুন নিভলো কিভাবে? শিক্ষিত হয়ে অকর্মার ঢেকি হচ্ছিস! ঘরে যা। পল্লবী ঢাকছে। আজ তোর খবর আছে। খবর আছে শোনে ভয়টা যেন আরো বেড়ে গেল। যেতে চাচ্ছি না। মা জোর করে পাঠালো। ভয় নিয়ে রুমে ঢুকলাম। দেখি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সাজছে। খুব অবাক হলাম। কিছুক্ষণ আগে যে মেয়ে ব্যথায় কাতড়ালো সে এখন আবার সাজছে! আমি খাঁটের উপর আগের অবস্থায় বসে আছি। আমার উপস্থিতি পেয়ে ঠোঁট বাকা করে হাসি দিয়ে বললো..

— এই যে মিষ্টার, আমাকে ব্যথা দিয়ে কই গেছিলেন শোনি?

আমি কিছু বলতে পারছি না। মনে মনে ভাবছি, যে মেয়েটাকে ব্যথা দিলাম সেই এখন উদাসিনী হচ্ছে আমায় কাছে না পেয়ে। খুব অবাক হলাম। পাশে এসে বসলো পা ঝুলিয়ে। বরাবরের মতই হাতের উপর হাত রাখার চেষ্টা করছে। আমি দিতে দিচ্ছি না। যতবার হাত স্পর্শ করার চেষ্টা করছে, ঠিক তখন-ই আমি হাত সড়িয়ে নিচ্ছি। বোঝতে পারলাম খুব রাগ হয়েছে ওর। কিছু জিজ্ঞাসা করলেও উত্তর দিচ্ছে না। পাশ থেকে একটু দূরে গিয়ে বসলো। রাগ ভাঙানোর জন্য একটু একটু করে ওর কাছে গিয়ে বসতে চেষ্টা করছি। রাগ নিয়ে বললো..

— খবরদার, একদম কাছে আসার চেষ্টা করবে না। বারি দিয়ে মাথা ফাঁটিয়ে ফেলবো বলে দিলাম।
মাথা ফাঁটানোর কথা শোনে খিল খিল করে হেসে দিলাম। আমি হাসছি আর পল্লবী সাপের মত করছে। বললাম..

– আমি তোমার স্বামী না! স্বামীর সাথে কেউ এরকম করে কথা বলে?
রাগি মুখটা যেন নিমিশেই খুশিতে ভরে গেল। ও বললো..

— স্বামী তো কি হয়েছে? স্বামী হলে নিজের স্ত্রীকে এভাবে ব্যথা দিয়ে চলে যেতে না! যাও, তোমার সাথে কথা নেই। ভাগো।
– স্বামী-ই তো স্ত্রীর সাথে এরকম দুষ্টুমি করবে তাইনা! আমি করবো না তো কে করবে শোনি?
— হয়ছে, তবুও আমি কথা বলবো না।

রাগ নয়, বরং কিছু অভিমান নিয়ে চুপ হয়ে আছি। মনে মনে ভাবছি, ও আমাকে জোর করে কথা বলাক। হাতের উপর হাত রাখুক। কিছু সময় এভাবে বসে থেকেও কাজ হচ্ছে না। পাশ কাঁটিয়ে শুয়ে পরলাম। পল্লবী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো শুয়া দেখে।

— শুইলে কেনো? শরীর খারাপ লাগছে? আমি কিছু বলছি না। চুপচাপ শুয়ে আছি। আমি চাই ও আমাকে টেনে তুলুক। ভাবতে ভাবতেই ও আমার মাথায় হাত দিল। আমি চোখ বন্ধ করলাম। খুব লজ্জা লাগলো। চোখ খুললাম। পল্লবী বললো..

— একটু কিছু হলেই রাগ করতে হয়! পাগল একটা।
– হ, পাগল আমি। পাগলের সাথে কথা বইলো না।

ও আমার হাত ধরলো। তখন মনে হচ্ছিল মুহূর্তের মধ্যেই পুরো শরীরটা একদম বরফ হয়ে আসছে। কিছু বলতে পারছি না। বলার চেষ্টা করলেও পারছি না। এক হাত দিয়ে মাথা আরেক হাত দিয়ে আমার হাতটা ধরে আছে। খুব শক্ত করে ধরে আছে। হঠাৎ এমন সময় মায়ের আগমন। মনে হচ্ছিল পুরো ভালো লাগাটা ভেস্তে গেল। মা রুমে ঢুকেই বেরিয়ে গেল। হয়তো লজ্জা পেয়ে। যাক, বোঝতে পারলাম রান্না শেষ।

মা রান্নাঘর থেকে পল্লবীকে ডাকছে। ও মায়ের কাছে যেতে চাচ্ছে। আমি যেতে দিচ্ছি না। এর আগেও কয়েকবার যেতে চাইছিল কিন্তু আমি দেইনি যেতে। সাধারণত আমরা রাত দশটার আগেই খাওয়া শেষ করি। আজও তাই করলাম। শেষ করে রুমে এলাম। বসে বসে টিভি দেখছি। পল্লবী আসলো। মুখটা গুমরা গুমরা ভাব। হঠাৎ এমন কেনো ভেবে পাচ্ছি না। মুখে হাসি না থাকলে ওরে একটুও ভালো দেখায় না। জিজ্ঞাসা করলাম..

— হঠাৎ হাসিটা কই গেল?

কিছু বললো না। দেখে মনে হয় কতদিন ধরে চিন্তিত আছে। কিছু হলে তো আমাকে বলে ও। নয়তো মায়ের কাছে সব শেয়ার করে। আজ সকালেও মা বললো ওর মন খারাপ। কিছু বোঝতে পারছি না। আবার বললাম..

— এই পল্লবী, কথা বলছো না কেনো? কিছু হয়েছে তোমার! অসুস্থ? কাঁপা কাঁপা স্বরে উত্তর দিলো..
– না, এমনিতেই। শুয়ে পরো। ভালো লাগছে না। আর কিছু হলে তো আমি তোমার কাছে সব বলি তাইনা। কিছু হয়নি আমার।
— হঠাৎ মুখে হাসি নেই। তাই বললাম।

দু’জনেই শুয়ে পরলাম। কপালে হাত রেখে অনুভব করলাম শরীরে জ্বর নেই। জ্বর হলে মানুষের মনটা একটু খারাপ থাকে। তো ওর মন কেনো খারাপ? বললাম, এই পল্লবী ঘুম আসছো? খারাপ লাগলে চলো মাথায় পানি দেই। কিছু বলছে না।

প্রায় দুই ঘন্টা পর বিছানা ছেড়ে উঠলো। হয়তো পল্লবীর ধারনা আমি ঘুমিয়েছি। কিন্তু ওর চিন্তিত দেখে ঘুম আসছে না। উঠে দরজা খুললো। মনে হয় বাথরুমে যাবে। প্রায় আধ ঘন্টা পার হচ্ছে, আসার নাম নেই। এখন নিজেই চিন্তিত হলাম। কই গেলো ও এতো রাত্রে? ওর জন্য শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা করছি। অপেক্ষা করতে করতে প্রায় এক ঘন্টা পর রুমে আসলো। আমিও সেই আগের মত করে শুয়ে আছি। জিজ্ঞাসা করিনি এক ঘন্টা কোথায় ছিলে? পল্লবীর সাথে সংসার জীবন দুই বছর। কোনোদিন সন্দেহ জনক কিছু করেনি। আজ খুব জানতে ইচ্ছে করছে। তবুও কোথায় যেনো ওর প্রতি একটা দুর্বলতা লেগেই থাকতো। যা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। পল্লবী এসে শুয়ে পরলো। সকাল। যেখানে ঘুম ভাঙে পল্লবীর ডাকে আজ শেফালী ভাবির ডাকে ভাঙলো। আশ্চর্য ভাবে তাকিয়ে আছি ভাবির দিকে। আমি কিছু বলার আগেই ভাবি বললো..

— আবির, নাক ফুলটা রাখো। ভাবির কথা শোনে মাথায় ঘোরপ্যাঁচ খাচ্ছে। কিছুই বোঝলাম না।
– ভাবি আমি এই নাক ফুল দিয়ে কি করবো! আর এটা কার? ভাবি মাথা নিচু করে বললো..
— ভাই, এটা পল্লবীর। রাতে গিয়ে আমার কাছে রেখে আসছিল। কিন্তু দরকার পরেনি তাই ফেরত দিয়ে গেলাম।
– দরকার পরেনি মানে?
— তোমার কাছে টাকা চাইবে সাহস পাইনি।

তাই ওর মায়ের নাক ফুলটা আমার কাছে দিয়ে আসছিল। ছেলের সামনে “জে এস সি” পরীক্ষা। কিন্তু ফর্মফিলাপের টাকাটা ব্যবস্থা করতে পারিনি। তাই ও নাক ফুলটা বিক্রি করতে বলছিল। কিন্তু এটা নেয়াতে আমিও সারারাত ঘুম আসিনি। তাই ভাবলাম ফেরত দিয়ে আসি। রাত জুড়ে পলবীর উপর অহেতুক ভাবে সন্দেহ করে ঘুম পারিনি। না জানি ও এতো রাইতে কোথায় গেছিল!

– ভাবি, থাক। এটা আপনার কাছেই রাখেন। এটা বিক্রি করতে হবে না। ভাবি নিতে চাচ্ছিল না। হঠাৎ পল্লবী আসলো। ভাবিকে দেখেই ও চমকে উঠলো। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবির সামনে পল্লবীকে বললাম..

— তুমি তোমার মায়ের নাক ফুল দিয়ে অন্যকে সাহায্য করতে চাইছিলে তাইনা? ওর মুখটা যেন বন্ধ। মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। আমি উঠে বসলাম। ওরে আমার পাশে বসতে বললাম। ও বসলো। হাতের উপর হাত রেখে বললাম..

— যাও, ভাবিকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে দাও। পল্লবী টাকা দিতে সাহস পাচ্ছে না। ওর ভাবনা আমি রাগ করে বলতেছি। আবার বললাম..
— যাও, তুমি ভাবছো আমি রাগ করে বলছি! মোটেও না। যাও ভাবিকে টাকাটা দাও। উনার খুব প্রয়োজন। পল্লবী ভাবিকে টাকাটা দিল। আর উনি চলে গেল। ও রান্না করতে যাবে। পেছন থেকে ডাক দিয়ে আবার আমার পাশে বসতে বললাম। ওর মুখটা শুকিয়ে গেছে। বসতে চাচ্ছে না। আমি হাত টান দিয়ে বসালাম। ও বসলো।

— শুনো! টাকাটা তোমার হাত দিয়ে দেয়ালাম কেনো জানো? কারণ, আমার মা’ও ঠিক এরকমটাই করতো বাবাকে না জানিয়ে। অন্যের বিপদে পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতো মা। আর সব চেয়ে বড় ব্যাপার কোনটা জানো! মেয়ে মানুষ যত বিপদেই পড়ুক না কেনো, কখনো তারা ছেলেদের কাছে সাহায্য চাইবে না। চাইলে মেয়েদের কাছেই চাবে। একজন মেয়ের কষ্টটা শুধু একজন মেয়েই বোঝতে পারে। আমরা পুরুষ, কখনো এটা বোঝার চেষ্টাও করি না।
পল্লবী কিছু বলছে না। মাথা নিচু করে উড়না দিয়ে মুখ ঢেকে রাখছে। হয়তো লজ্জায়। তাই হাতটা মুখের উপর থেকে সরালাম। দেখি চোখে পানি জমে আছে। এই বোঝি চোখের পানি পরবে পরবে ভাব। বললাম, যাও মায়ের সাথে একটু রান্না করো। এটা নিয়ে কখনো আর ভাববে না। পল্লবী মা’কে সাহায্য করতে গেল।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত