বেশ কয়েকমাস আগে আমি যে হোটেলে কাজ করি, সেই হোটেলে এক জোড়া নবদম্পতি এসেছিলো। যদিও ঐ সময়টাতে অনেক নবদম্পতিই আসে কিন্তু ঐ দম্পতির মধ্যে এমন কিছু ছিলো, যার জন্য এই হোটেলের ঐ তলায় নিয়োজিত কর্মী ছাড়াও বাকিদের মুখে ওই দম্পতির প্রশংসা ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রত্যেকটা কর্মী,ব্যবস্থাপক, অভ্যর্থনা কর্মী সবার মধ্যেই একটা ভালো লাগা কাজ করতো ওদের জন্য। যেদিন যার দায়িত্ব থাকতো ঐ তলায় সবাই চেপে ধরতো তাকে সেই দম্পতির খবর পাওয়ার জন্য। সেই সৌভাগ্যবানদের মধ্যে আমিও একজন যার বেশিরভাগ দায়িত্বই পড়তো ঐ তলাতে।
গল্পটা তাহলে প্রথমদিন থেকেই শুরু করি। অন্যান্য সবসময়ের মতোই অনেক অতিথির মতোই হোটেলে আসে একজোড়া নবদম্পতি। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই দেখতে একদম পুতুল পুতুল। এতো অতিথির মধ্যেও ওদের দিকে আলাদাভাবে চোখ দেওয়ার কারণ ছিলো, হেঁটে আসার সময় মেয়েটার শাড়ির সামনের দিকটা একটু কুঁচকে যায়। নিজেই শাড়িটা ঠিক করার আগে ছেলেটাই বসে ঠিক করে দেয়। কতটা যত্নবান হলে এমন টা হয় ঠিক জানা নেই। তবে নবদম্পতিদের ক্ষেত্রে এটা স্বাভাবিক ঘটনা। রিসেপশনে রুম বুকিং হল ধ্রুব রায় আর মিষ্টি রায় নামে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে শাড়ি ঠিক করা থেকে নিচে রাখা ব্যাগ তোলা কোনোটাই স্ত্রী কে করতেই দিচ্ছে না ধ্রুব। এককথায়, কোনোভাবেই মেয়েটাকে নিচু হতে দিচ্ছে না এবং শেষদিন অবদি এটাই দেখেছি। মেয়েটা কিছুই বলতো না কেবল ছোট একটা হাসি দিতো।
পরদিন সকালে যখন জলখাবার নিয়ে রুমে যাই তখন সম্ভবত ভদ্রমহিলা তৈরি হচ্ছিলেন চিরুনি হাতে আয়নার সামনে বসে । চুলে চিরুনি টান লাগার সাথে সাথে অস্ফুট চিৎকার করে উঠল,হাত থেকে পড়ে গেল চিরুনি। ধ্রুব তখন সবে বিছানা থেকে নেমে আমার কাছ থেকে জলখাবারের ট্রে’টা নিয়েছে। স্ত্রীর চিৎকার শুনেই ট্রে ছেড়ে দিয়ে পড়িমড়ি করে ছুটে গেল। আমি শুধু অবাক হয়ে দেখছিলাম। দৌড়ে গিয়ে আগে এক ধমক লাগিয়ে দিলেন,
“কতবার বলেছি তোমায় যেটা পারবেনা সেটা করতে যাবে না। কেনো কথা শোনো না তুমি” অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে রইলেন বেচারী। গলাটা একদম নিচে নামিয়ে বললেন, “আমি ভেবেছিলাম আমিই পারবো। হঠাৎ চুলে টান লেগে যাবে বুঝতেই পারিনি” স্ত্রীর দিকে একবার তাকিয়ে নিচ থেকে চিরুনিটা তুলে নিলেন। হঠাৎ মনে পড়লো বোধহয় যে, আমি দাঁড়িয়ে। প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিলেন ভদ্রলোক। হাত থেকে ট্রে’টা নিয়ে আমাকে বিদায় দিলেন। স্বামী-স্ত্রীর সৌজন্যবোধই হয়তো সবার মধ্যে অন্যতম করে তুলেছিলো ওদের
খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো ভেতরে কি হয় দেখার। যদিও অভ্যাসটা খারাপ, তবুও সামলানো গেলো না নিজেকে। দরজার ফাঁকা দিয়ে চোখ রেখে দেখলাম, ট্রে রেখে স্ত্রীর দিকে এগিয়ে গেলেন। খুব যত্নে চুলে আঙ্গুল দিয়ে জট ছাড়িয়ে আস্তে আস্তে চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে দিলেন। এতটা সযত্নে স্ত্রীর চুল আঁচড়ে দিতে এই প্রথমবার দেখলাম হয়তো। হঠাৎ পেছন থেকে আরেক জন সহকর্মী এসে পিঠে হাত রাখাতেই চমকে উঠেছিলাম। পরে ওকেও সব খুলে বলি। কান থেকে কান ছড়াতে ছড়াতে ব্যবস্থাপক পর্যন্ত পৌঁছে গেল কথাটা। সকলেরই মনে হচ্ছিলো, নতুন বিয়ে তাই ভালোবাসাও বেশি,পুরোনো হতে হতে ভালোবাসাও উড়ে যাবে। মন মানতো না তারপরও।
অন্যান্য আবাসিক হোটেল গুলোর তুলনায় আমাদের হোটেলটাতেই তুলনামূলক কম শব্দ হতো। আর যতবার রায় দম্পতির রুমে গিয়েছি বুঝতে পারলাম ভদ্রলোক বেশি শব্দ একদমই সহ্য করতে পারতেন না। রাতে “ক্যান্ডেল লাইট ডিনার” এর জন্য অন্যান্য দম্পতিদের সাথে রায় দম্পতিও নিচে আসে। খুব জোরে গান না বাজলেও শব্দটা যথেষ্ট কানে লাগছিলো। স্ত্রীকে দূরে দাঁড় করিয়ে নিজেই এসে অনুরোধ করে যদি শব্দটা কমানো যায়। এতে অন্যদের অসুবিধে হলে তারা নিজেদের রুমেই চলে যাবে। সেদিন বুঝলাম শব্দে সমস্যা হয়তো ওনার স্ত্রী’র হয়। শব্দ কমানোর পরই ভদ্রলোক স্ত্রীকে নিয়ে আসেন। স্ত্রীকে নিজের হাতেই খাইয়ে দিয়েছিলেন আর মেয়েটা কেমন যেন শূন্য দৃষ্টি নিয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়েই ছিলো।
এভাবেই তিন-চার দিন পার হয়ে গেল। এর মধ্যেই দু-জনের ব্যবহারে হোটেল কর্মী থেকে শুরু করে অতিথি পর্যন্ত সকলে এতটাই সন্তুষ্ট ছিলো যে সকলের মুখে মুখে ঐ দুজনেরই প্রশংসা। সেদিন সকালে জলখাবার দিতে গিয়ে যেই দরজায় ঠুকেছি,প্রথম বারেই ভদ্রলোক দৌড়ে এলেন। ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন শব্দ না করার জন্য। ওনার স্ত্রী ঘুমোচ্ছিলেন। খুব কৌতুহল ছিলো আমাদের সকলেরই। সেদিন সাহস করে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম।
-“বলছি স্যার, একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? আসলে প্রশ্নটা এখানকার সকলেরই যারা আপনাদের দেখেছে।” ধ্রুব রায় আস্তে করে দরজা টা বন্ধ করে বেরিয়ে এলেন। কথার শব্দে যদি স্ত্রীর ঘুম ভেঙ্গে যায়। তারপর বলতে থাকে,
-“আমি বুঝতে পেরেছি আপনাদের প্রশ্ন। আসলে মাথা নোয়ালে বা চুলে টান পড়লে অথবা অতিরিক্ত শব্দে ওর মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা হয়। আর সেটাও খুব গুরুতর পর্যায়ে। তাই এসব ক্ষেত্রে একটু বেশিই নজর দিতে হয়। মেয়েটাতো নিজের যত্ন নিতে পারে না”।
সেদিন ওনার চোখে স্ত্রীর প্রতি কর্তব্যের সাথে ভালোবাসাটাও স্পষ্ট দেখেছিলাম। দুজন যখনই বের হতো কখনোই একজন আরেকজনের পাশ ছেড়ে যেতো না,অনেকে ভাবতো হয়তো নতুন বিয়ে তাই। কিন্তু ওনার চোখে স্ত্রীর প্রতি যে ভালবাসাটা দেখেছিলাম সেটা একদম গভীর হতে সৃষ্ট অনুভূতি না হলে হয়তো হয় না। সেই দিনের পর সকাল ১০/১১টা নাগাত হঠাৎই ধ্রুব রায় রিসেপশনে ফোন করেন। উদ্ভ্রান্তের মতো করছিলেন। যত দ্রুত সম্ভব যেন এ্যাম্বুলেন্স খবর দেওয়া হয়। ওনার স্ত্রী প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।নাক দিয়ে অনরবত রক্ত ঝরছিলো। এ্যাম্বুলেন্স আসার পর ওনার স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতাল চলে যান।
ওনারা আর ফিরে আসেন নি। পরদিন শুধু ওনাদের এক আত্মীয় এসে জিনিসপত্র গুলো নিয়ে যায়। ওনার থেকেই জানতে পারি প্রচন্ড মাথা ব্যথার কারণে হাসপাতালে ভর্তি আছেন মিষ্টি। ওনার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হঠাৎ এতো বেড়ে গেছে যে হয়তো ও জীবনের একদম শেষ পর্যায়ে। এরপর কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। প্রায় দু-বছর পর সেদিন ধ্রুব রায় কে রাস্তায় দেখতে পাই। রায় দম্পতি আমাদের সকলের মধ্যে এমনভাবে জায়গা করে নিয়েছিলেন যে হাজার ভীড়ে ওনাদের চিনে নিতে একটুও অসুবিধা হবে না। এতদিন পর ভদ্রলোককে দেখে ওনার স্ত্রীর কথা খুব জানতে ইচ্ছে হলো।
কৌতুহলবশত দাঁড়িয়ে পড়লাম একদম ওনার সামনে। আমি ভেবেছিলাম ভদ্রলোক আমাকে চিনবেনই না হয়তো। সামান্য একটা হোটেলের কর্মীকে ক’জনেই বা মনে রাখে! কিন্তু আমার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে ভদ্রলোক নিজ থেকেই ডাক দিলেন আমাকে। সৌজন্য সাক্ষাতের পর হুট করেই জানতে চাইলাম ওনার স্ত্রীর কথা। নিমিষেই যেন মুখে আলো জ্বলে উঠলো। কিন্তু গলার স্বরে বুঝলাম ভদ্রলোকের গলা ধরে আসছে। তবুও কোনোমতে ঢোক গিলে বলতে শুরু করলেন,
-“সেদিন হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার পর মিষ্টির অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকে। যেহেতু আমিও নিজেও ডাক্তার নিজের সমস্ত বিদ্যে প্রয়োগ করতে লাগলাম যদি কোনো নিরাময় বের করতে পারি। পরিচিত যত বড় বড় ডাক্তার ছিলো সবাই বসে মিটিং করলাম। দিনরাত এক করে অনেকটা সুস্থ করে আনলাম ওকে। কয়েকদিনেই মেয়েটা একদম ভেঙ্গে পড়েছিলো। তবে ওর মানসিকতা যে বেশ শক্ত সেদিনই বুঝেছিলাম। ওকে দেখতে আমার এক বন্ধু এসেছিলো তাঁর স্ত্রী আর নবজাতককে নিয়ে পরদিন যখন ওকে ঘরে নিয়ে আসি, হাত দুটো ধরে চোখে একরাশ আকুতি নিয়ে বলেছিলো,
-“আচ্ছা ধ্রুব এতদিন তো দেখলে। বলছি আমার হাতে কী আর দশটা মাস সময় হবে”!
কথাটা শুনে বুকের ভেতরটা কেমন জানি করে উঠলো। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে জানতে চাইলাম এ কথার কারণ কী! ও একটা কথাও বলেনি। কেবল টেবিলের ওপর থাকা ছোট পুতুলটার দিকে ইশারা করলো। আসলে আমি নিজেও জানতাম না ওর হাতে ঠিক কতটুকু সময় ছিলো। ওকে দেখে অবাক হতাম যে, একটা এইটুকু মেয়ে যে জানেই ওর হাতে খুব বেশি সময় নেই কী করে মানসিকভাবে এতটা শক্ত হতে পারে।
ও সবসময় আমাকেই সান্ত্বনা দিতো। বিয়ের আগে থেকেই জানতাম ও বাচ্চা খুব ভালবাসতো। মা হতে চেয়েছিলো। এর কিছুদিন পরই সুখবর টা পাই। হঠাৎই কল আসে ওর। মনে হচ্ছে, যেন কাঁদছে মানে হাসছে তাঁর মধ্যেই কাঁদছিলো। শুধু বলেছিলো, “ জানো তুমি, আমি মানে আমরা তিনজন হতে যাচ্ছি”। এরপরই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। হয়তো কান্নাটা আনন্দের ছিলো। নিজের থেকে অনাগত সন্তানের যত্ন বেশি নিতো তার সাথে আমারও। দেখতে দেখতে চলে এলো সেইদিন। যদিও সেটা আমাদের জন্য সবথেকে আনন্দের দিন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমি বলবো সেটাই আমার জীবনের সবচেয়ে অভিশপ্ত দিন।
যেদিন ওর ডেলিভারি হয় প্রসব ব্যথা এতটাই তীব্র ছিলো যে ব্যথাটা ওর মাথা পর্যন্ত উঠে যায়। অপারেশন থিয়েটারের বাইরে বসে শুধু ওর চিৎকারটাই শুনছিলাম। প্রত্যেকটা শব্দ বুকে এসে বিঁধছিলো। আমার কল্পনারও বাইরে, ঐ সময়টাতে ঠিক কতটা যন্ত্রনা ও সহ্য করেছিলো। বাচ্চাটার কান্না পর্যন্ত আমার কানে আসে নি। ডাক্তার যখন ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিলো গিয়ে দেখলাম বাচ্চাটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে ও।
ফুটফুটে মেয়েটা ওর মতই হয়েছে। হাত ধরে যখন কথাগুলো বলছিলো তখনও মেয়েটা কাঁদছিলো। একটু আগেই যে সন্তানের জন্ম দিয়েছে,বুকের দুধ পান করিয়েছে,বুকে জড়িয়ে ধরেইছিলো, আর হয়তো কিছুক্ষণ পরই সব স্মৃতি হয়ে থেকে যাবে। আর কখনো সদ্যজাত কন্যাকে দেখতেই পাবে না। ঠেলে কান্না আসছিলো কিন্তু ওর সামনে কাঁদতে পারলাম না। আমায় ছুঁয়ে বলেছিলো, “যেভাবে এতদিন আমার যত্ন নিয়েছো, ওকেও দেখে রেখো। তোমার এত যত্ন,এতো ভালোবাসার ঋণ হয়তো শোধ করতে পারলাম না। তবে কথা দিচ্ছি যতদিন আমাকে মনে রাখবে সবসময় তোমাদের পাশেই থাকবো।”
কথাগুলো বলতে বলতেই ওর নাক দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে ক্রমাগত,অথচ দেখা ছাড়া উপায় নেই তখন আর। ভদ্রলোক হঠাৎই থেমে গেলো। বাকিটা বুঝে নিতে খুব একটা কষ্ট হয়নি। পৃথিবীতে সত্যি ভালবাসা বেঁচে আছে সেটার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেলাম। সহানুভূতি না বরং কতটা ভালবাসা থাকলে একটা মানুষ এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করে যার জীবনের আয়ু হাতে গোনা কয়েকদিন। কতটা ভালোবাসলে দিনের পর দিন এতটা খেয়াল রাখে।।