আট বছর পর নিজের বন্ধ থাকা পুরনো নাম্বারটা সচল করলো শাকিল। নির্দিষ্ট কোম্পানির কাস্টমার কেয়ারের জব করা এক বন্ধুর আন্তরিক সহযোগিতায়, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে নাম্বারটা সচল করতে পেরেছে সে। বাল্য বন্ধু হিসেবে ওর ব্যক্তিগত সব বিষয়ই আমার জানা আছে। মানুষের অবচেতন মনে, ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন চিন্তার প্রভাব পড়ে। তাই, এতদিন পর- ‘কি মনে করে সিমটা সচল করেছে’ সে প্রশ্ন আমি আর তাকে করিনি। বরং আট বছর আগে, কি কারণে সিমটা বন্ধ করেছিল -সেটা বলা যাক।
মিথিলা নামের এক মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল শাকিলের। পরিচয়টা হয়েছিল রং নাম্বারে। দু’জনের বোঝাপড়া ছিল খুবই চমৎকার। দীর্ঘদিন কথা বলতে বলতে তারা খুবই ঘনিষ্ট হয়ে গিয়েছিল। একজনের আরেকজনের প্রতি তাদের সেই ভালোবাসা কতটা গভীর ছিল, সেটা লিখে প্রকাশ করা রীতিমতো অসম্ভব। দু’জনের দুটো নরমাল ফোন ছিল। ফলে কেউ কারো ছবি দেখেনি। ভিন্ন উপায়ে দেখার সুযোগ থাকলেও মূলত তারা সে সুযোগটাও নেয়নি। একজন আরেকজনের প্রতি খুবই বিশ্বস্ত ছিল। কথা ছিল- কেউ কাউকে কোন ছবি পাঠাবে না, দু’জন সরাসরিই দেখা করবে। আরেকটা বিষয় তারা একমত ছিল, যে দেখতে যেমনই হোক- দেখা হওয়ার পর তারা কেউই কাউকে ছেড়ে যাবে না। একদম ‘অন্ধ ভালোবাসা’ যাকে বলে। সদ্য ‘মাধ্যমিক পাশ করা’ মেয়েটা তখন মফস্বলের একটা কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্রী। আমি আর শাকিল মাত্র বিবিএ শেষ করেছি। দুইজন দুই জেলার বাসিন্দা হলেও মেয়েটার বাড়ি আমাদের পাশের বিভাগেই।
অবশেষে একদিন এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। তাদের প্রথম দেখা। মেয়েটার দেওয়া ঠিকানা মোতাবেক আমি আর শাকিল যথা সময়ে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলাম। তবে যেখানে আমাদেরকে দাঁড়াতে বলা হয়েছে সেখানে নয়, বরং তার থেকে কিছুটা অদূরে অবস্থান নিলাম আমরা দু’জন। আমি আসতে চাইছিলাম না, কিন্তু শাকিলই আমাকে জোর করে নিয়ে এসেছিল। কারণ ওর মাথায় ভিন্ন পরিকল্পনা ছিলো।
আমরা দু’জন রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছি। শাকিলের মনে কি চলছে সেটা আমি জানিনা, কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা। শাকিলের গায়ের রং ফর্সা, দেখতেও যথেষ্ট সুদর্শন, যে কোন মেয়েই ওর দিকে দ্বিতীয়বার তাকাতে বাধ্য। অপরদিকে শাকিলের সাথে আমার তুলনা সম্পূর্ণ বিপরীত। একটা সুদর্শন ময়ূরের পাশে একটা কাক কে যেমন দেখায়, শাকিলের পাশে আমি ঠিক তেমনটাই। এখন, ‘মেয়েটা দেখতে কেমন হয়’ -আমি ভাবছি সেটাই। যদিও শাকিল আমাকে বলেছে, ‘মেয়েটা দেখতে যেমনই হোক’ -সে তাকে খুব খুশি মনেই গ্রহণ করে নেবে। এবং এটা যে শাকিলের মনের কথা -সেটা ও আমি জানি। হঠাৎ শাকিলের ফোনটা বেজে উঠলো।
–হ্যালো, তুমি কোথায়?
–আমিতো ওই রেস্টুরেন্টের সামনেই আছি, তুমি কোথায়?
–আচ্ছা, জাস্ট একটা মিনিট দাড়াও, আমি আসছি।
পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক, শাকিল আমাকে চোখের ইশারা করতেই আমি দ্রুত রেস্টুরেন্টের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দূর থেকে শাকিল আমাকে লক্ষ্য করছে। একটু পর খেয়াল করলাম, একজন তন্বী তরুণী আস্তে আস্তে ডান দিক থেকে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। তার সাথে আমার চোখাচোখি হতেই আমি চমকে উঠলাম। সাক্ষাৎ ডানাকাটা পরী! বুঝতে পারলাম, এটাই মিথিলা, আর আমার চাহনিতে তাকে বুঝিয়ে দিলাম যে- আমিই শাকিল। এই ফাঁকে আমি আড়চোখে একবার শাকিলের দিকে তাকালাম। ও দূর থেকে আমাদের দেখে মিটিমিটি হাসছে।
এতোটুক পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল, কিন্তু বিপত্তি বাঁধল এরপর। আচমকা আমি মেয়েটার অবয়বে পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। ধীরে ধীরে সেখানে ফুটে উঠতে শুরু করল এক ধরনের ভয় আর উৎকণ্ঠার চাপ। তারপর আমাদের অবাক করে দিয়ে, মেয়েটা ধীরে ধীরে পিছনের দিকে সরে যেতে শুরু করলো। আমি আর শাকিল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি সেদিকে। একসময় মেয়েটা আমাদের দৃষ্টির অগোচরে চলে গেল। ঠিক এই মূহুর্তে আমার মনে যে ভাবনাটা কাজ করছিল নিশ্চয়ই সেই একই ভাবনা কাজ করছে শাকিলের মনেও। “আমাকে (শাকিলকে) দেখে মেয়েটার পছন্দ হয়নি, তাই সে পিছু হটেছে। নিজের প্রেমিক দেখতে এতটা কুৎসিত হবে, এমনটা মনে হয় সে আশা করেনি।”
আমি দ্রুত শাকিলের দিকে ছুটে গেলাম। শাকিল থরথর করে কাঁপছে। রাগে, ক্ষোভে, লজ্জায় হঠাৎ শাকিল তার হাতের মোবাইলটা সজোরে ছুঁড়ে মারলো পিচঢালা রাস্তার উপর। মুহূর্তেই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল মোবাইলটা। সেই যে সিমটা বন্ধ হলো, গত আট বছর যাবত ওটা ওভাবেই ছিলো। সেদিনের পর থেকে গত আট বছর যাবত সে আর মিথিলার সাথে যোগাযোগ করেনি। মিথিলারও ওই নাম্বারটা ছাড়া শাকিলের সাথে যোগাযোগ করার জন্য আর অন্য কোনো উপায়ও ছিলনা।
তারপর পেরিয়ে গেছে অনেকটা সময়। শাকিলের জীবনে আর কোন প্রেম আসেনি। মেয়েটার প্রসঙ্গ আসলেই শাকিলকে দেখতাম তার চৌদ্দগুষ্টি ধরে ধুয়ে দিতো। সত্যি বলতে, ওই ঘটনার পর সমস্ত নারী জাতির প্রতিই তাঁর এক ধরণের বিতৃষ্ণা এসে গিয়েছিল। ইদানিং ওকে পরিবার থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। আমি কোন মেয়ের প্রসঙ্গ তুললেই ওর ওই এক কথা, “সব শালী একই রকম, সবাই খালি চেহারা আর টাকা পয়সা দেখে, ভালোবাসার কোনো দাম নাই।”
তবে মুখে যাই বলুক, বাস্তবতা যে সম্পূর্ণ বিপরীত সেটার প্রমাণ আমি বহুবারই পেয়েছি। ‘শাকিল যে ওই মেয়েকে জীবনেও ভুলতে পারবেনা’ -বুঝতে পেরেছি সেটাও। অনেকবারই মেয়েটার কথা ভেবে একা একা শাকিলকে চোখ ভিজাতে দেখেছি। এমনকি বেশ কয়েকবার আমাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চা ছেলের মত হাউ মাউ করে কাঁদতেও দেখেছি। আজ এতো বছর পর শাকিল সেই বন্ধ নাম্বারটা আবার এক্টিভ করেছে। তবে আমাকে অবাক করে দিয়ে শাকিল সিমটা নিজের কাছে না রেখে আমার দিকে এগিয়ে দিলো।
–নে এটা ধর।
–কি করবো এটা দিয়ে?
–কি করবি জানিনা, আমি এটা আর আমার সাথে বয়ে বেড়াতে চাইনা।
–ফোনে লাগাবো?
–না লাগালে এক্টিভ করে দিলাম কেন?
–যদি কোন কল আসে, কি বলবো? হঠাৎ শাকিল উত্তেজিত হয়ে উঠলো,
–এত প্রশ্ন করিস কেন? এত বছর পর আর কে কল করবে এখানে?
আমি আর কথা বাড়ালাম না। শাকিল হনহন করে হেঁটে চলে গেল। পেছন থেকে কয়েকবার ডাকলাম, ফিরেও তাকাল না। পরদিন বিকেলের দিকে বাজারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। বাইকটা বের করে ধুলাবালি পরিষ্কার করছি, এমন সময় আমার ফোনটা বেজে উঠলো। ডুয়েল সিম এর ফোন হওয়ায় ফোনটা হাতে নিয়ে কিছুটা চমকে উঠলাম। কল আমার নাম্বারে নয়, এসেছে শাকিলের এতদিনের অব্যবহৃত নাম্বারটাতে। এতদিন পর কে ফোন করবে! হয়তো রং নাম্বার হবে, এমনটা ভেবেই ফোনটা রিসিভ করলাম।
–হ্যালো, কে বলছেন? ওপাশ থেকে কোনও আওয়াজ আসছে না, তবে এটা বুঝতে পারছি, একটা কন্ঠ কাঁপছে, নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু কোন কথা বলছে না। একটু পর ওপাশ থেকে ফোনটা কেটে দিলো। মিনিট দুয়েক পর আবারও একই নাম্বার থেকে ফোন আসলো।
–হ্যালো, কে বলছেন প্লিজ? ওপাশ থেকে এক নারী কন্ঠের প্রতিউত্তর ভেসে এলো,
–আপনি কি শাকিল সাহেব বলছেন?
–না, আমি ওর বন্ধু জাহিদ বলছি। কে বলছেন প্লিজ? ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ নীরবতা, তারপর আবার কথা বলে উঠলো ওপাশের কণ্ঠস্বর।
–আমাকে আপনি চিনবেন না, আপনার সাথে আমার খুব জরুরি কিছু কথা আছে। ফোনে এত কথা বলা যাবেনা, আমি আপনার সাথে একটু দেখা করতে চাচ্ছি।
–ঠিক আছে, কিন্তু আপনি কে, আপনার সাথে আমার কি দরকার? -সেটা না বললে আমি আপনার সাথে কেন দেখা করবো?
–আমি মিথিলার বান্ধবী রুমা।
–মিথিলার বান্ধবী! কি বলছেন এসব?
–হ্যাঁ, এর বেশি কিছু আমি আপনাকে বলতে চাচ্ছি না। তবে আমাকে আর একটা বিষয় বলুন, শাকিল সাহেবের নাম্বারটা আপনার কাছে কেন? আর এই নাম্বার এতদিন বন্ধ ছিল কেন? উনি এখন কোথায় আছেন? কেমন আছেন?
আমার মাথা রীতিমতো বন বন করে ঘুরছে। সাতপাঁচ না ভেবে আমি বললাম,
–দেখুন, ওর জীবনে মিথিলা অতীত। ওনার ব্যাপারে শাকিলের আর কোনো আগ্রহই নেই। তাই আমি আপনার সাথে দেখা করতে পারছিনা বলে দুঃখিত। এবং এই প্রসঙ্গে আমি আপনার সাথে আর কোন কথাও বলতে চাচ্ছি না।
–দেখুন বিগত আট বছর ধরে আপনার বন্ধু একটা ভুলের মধ্যে আছে। শুধু এতোটুকুই আপনাকে বললাম, বাকিটা আপনার ইচ্ছা। ফোনটা কেটে দিলাম। মাথার ডান পাশটা চিনচিন করে ব্যথা করছে। কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিনা। শাকিলকে ফোন করবো?
তিনদিন পর মিথিলার বান্ধবী রুমার সাথে দেখা করে ফিরে এলাম। mআজ শাকিলকে সাথে নিয়ে আমার আবার ওখানে যাওয়ার কথা। মিথিলার বান্ধবীর বাসায়। সেখানে রুমা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আর শাকিলের জন্য অপেক্ষা করছে অনেক কিছু। মিথিলার বান্ধবীর কথা শুনলে শাকিল হয়তো রাজি হবে না, তাই অনেক কায়দা করে ওকে আমার সাথে নিলাম। বললাম, অনেক দূরে এক জরুরী দরকারে আমার এক আত্মীয়ের বাসায় যাবো। তোকেও আমার সাথে যেতে হবে। বিকেল নাগাদ আমরা ওখানে পৌঁছে গেলাম। রুমা দরজা খুলে আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন। দু’জন সোফায় বসে পড়লাম, বিপরীত দিকের আরেকটা সোফায় বসলেন রুমা। কোনরকম ভুমিকা না করেই শাকিলের দিকে তাকিয়ে রুমা বললেন,
–তো আপনিই মিস্টার শাকিল? শাকিল থতমত খেয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। আমি চোখের ইশারায় স্বাভাবিক আচরণ করতে বললাম।
–জি, আমি শাকিল।
–আচ্ছা, আমি মিথিলার বান্ধবী রুমা। শাকিল আর একবার তাকালো আমার দিকে। ওর চোখ দিয়ে রীতিমত আগুন বেরোচ্ছে। রুমা সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে আবার বলতে শুরু করলেন,
–শাকিল সাহেব, আপনি বিগত আট বছর যাবত একটা ভুলের মধ্যে আছেন। একটা জীবনকে আপনি মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন। রুমার কথা শেষ হতেই শাকিল যেন কিছুটা কেঁপে উঠলো। এবার দ্বিগুণ আগ্রহ আর উৎকণ্ঠা নিয়ে নিয়ে রুমার দিকে তাকালো শাকিল। রুমা আবার বলতে শুরু করলেন,
–সবচেয়ে বড় ভুলটা করেছেন আপনি নিজেই। যাকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন তার প্রতি আপনার বিশ্বাস এতটা ঠুনকো হলো কিভাবে? তবে কি আমি ধরে নেবো যে, আপনার ভালোবাসাটা মিথ্যে ছিল? এবার বেশ উত্তেজিত হয়ে কথা বলতে শুরু করল শাকিল,
–আমার বিশ্বাস ঠুনকো? আমার ভালোবাসা মিথ্যা? আমার? আপনি আমার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করুন, তাকে প্রথম দেখার পাঁচ মিনিট আগেও আমি আমার বন্ধুকে বলেছি, “সে দেখতে যেমনই হোক, আমি তাকে আপন করে নিব। তাকে নিয়েই আমি ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু দুষ্টামি করে তাকে কিছুটা পরীক্ষা করার জন্য আমি ওখানে আমার জায়গায় আমার বন্ধুকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলাম, আর তাতেই আপনার বান্ধবীর প্রকৃত রূপটা বেরিয়ে এসেছে।”
–ভুল শাকিল ভাই, খুব বড় একটা ভুলের মধ্য দিয়ে একটা সম্পর্ক আর একটা নিরীহ জীবনকে আপনি শেষ করে দিয়েছেন।
–ভুল! কিসের ভুল? আমার চোখ যা দেখেছে সেটাকে আপনি ভুল বলছেন?
–হ্যাঁ বলছি, কারণ আপনার চোখ যেটা দেখেছে আপনি সেটাই বিশ্বাস করেছেন। কিন্তু আপনার চোখ যেটা দেখেনি, সেটা আপনাকে বলার জন্য অপরপক্ষকে আপনি পর্যাপ্ত সময় এবং সুযোগটুকুও দেননি।
–কি বলছেন আপনি এসব?
–জি শাকিল ভাই, আপনি দেখেছেন-
“আপনার বন্ধুকে আপনি ভেবে, ওর পছন্দ না হওয়াতে ও পিছনের দিকে সরে গেছে।” আর আপনিও সাথে সাথে রাগ করে আপনার ফোনটা ভেঙে ফেলেছেন। আপনার কি একবারও মনে হয়নি, ওর এমনটা করার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে সেটা জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল? ওই মুহূর্তে আপনি যেটা দেখেছেন ওটা ছিল মিথ্যা, যে সত্যটা আপনি দেখেননি সেটা হচ্ছে, ওই মুহূর্তে যেখানে আপনার বন্ধু দাঁড়িয়েছিল ঠিক তার বিপরীত দিক থেকে একই সময়ে মিথিলার বাবাও হেঁটে আসছিলেন। সেই ভয়ে মিথিলা কিছুটা পেছনে সরে গিয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীতে ও সেখানে ফিরে এসে আর আপনাদেরকে পায়নি। আপনার নাম্বারটাও আর খোলা পায়নি।
রুমার কথা শেষ হতেই বাচ্চা ছেলের মত হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো শাকিল, ও মাই গড! এটা আমি কি করলাম!
হঠাৎ শাকিল নিজের মাথাটা দেয়ালের সাথে ঠুকতে আরম্ভ করলো। আমি আর রুমা দ্রুত উঠে গিয়ে ওকে ধরে আবার সোফায় বসালাম। ঠিক একই সময়ে আমাদের পিছনের দিকে ঘরের ভেতরের জানালাটা কিছুটা কেঁপে উঠলো। কিন্তু শাকিলের কান্না কিছুতেই থামছেনা। শাকিল কাঁদো কাঁদো গলায় রুমার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো,
–মিথিলা এখন কোথায় আছে? কেমন আছে? প্লিজ আমাকে ওর কাছে নিয়ে চলুন। রুমা আবার বলতে শুরু করলেন,
–ও প্রায়ই আপনার নাম্বারটাতে ট্রাই করতো, মাঝে মাঝে আমার কাছে এসে কান্নাকাটি করতো। আমাকে বলত, শাকিল আমাকে ভুল বুঝেছে, যে করেই হোক ওর ভুলটা আমাকে ভাঙাতেই হবে। তারপর দিন যায়, মাস যায় বছর যায়, কিছুতেই আর আপনার নাম্বারটা ওপেন হয় না। গত আট বছর যাবত ও প্রতিদিন অন্তত একবার হলেও আপনার নাম্বারটাতে ট্রাই করতো। এতোটুকু বলে, একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন রুমা। শাকিল প্রবল আগ্রহ নিয়ে রুমার দিকে তাকিয়ে আছে। রুমা আবার বলতে শুরু করলেন,
–গত চারদিন আগে ও সর্বশেষ আমার এখানে এসেছিল। তারপর আমাকে ওর লেখা একটা পুরোনো ডায়েরি দিয়েছে। ডাইরিটা অবশ্য আমি পড়ে দেখেছি। আর সেটা পড়ে আমি বুঝেছি, ও কি প্রবল ভাবেই না আপনাকে মিস করতো। আর ওর সিম কার্ডটাও দিয়েছে। বলেছে, এটা যেন কখনো বন্ধ না করি, দৈনিক অন্তত একবার হলেও যেন আপনার নাম্বারটাতে কল দিয়ে দেখি। এবং কখনো আপনার সাথে যোগাযোগ হলে যেন আপনাকে ওইদিনের সত্যিটা খুলে বলি।
–তারপর?
–পরিবারকে অনেক ভাবে ইগনোর করতে চেষ্টা করেছে। ওর বিশ্বাস ছিলো, আপনি একদিন না একদিন ফিরবেন। কিন্তু পারেনি, পরিবার থেকে একরকম জোর করেই ওর বিয়ে ঠিক করে ফেলা হয়েছিল। পরদিনই ওর বিয়ে ছিল। আপনি অনেক দেরী করে ফেলেছেন শাকিল ভাই। শাকিল যেন পাথরের মত জমে গেছে, আমরা সবাই চুপ, অনেকক্ষণ কারো মুখে কোন কথা নেই। তারপর শাকিলই নীরবতা ভেঙ্গে কথা বলে উঠলো।
–সব অপরাধ আমার, সব দোষ আমার। যা হওয়ার হয়ে গেছে, দয়া করে ওর সাথে আমার যোগাযোগ করার একটা ব্যবস্থা করে দিন। অন্যের ঘরনী হয়েছে তাতে আমার দুঃখ নেই, কিন্তু অন্তত ওর কাছে একবার ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটা আমাকে করে দিন।
–আবারো ভুল করলেন, শাকিল ভাই। আসলে আপনি ওকে বুঝতেই ভুল করেছেন সারা জীবন। আপনি কিভাবে ভাবলেন ও আপনাকে ছাড়া অন্য কাউকে মেনে নিবে? ও বিয়েটা করেনি, বিয়ের আগের রাতেই ও আত্মহত্যা করেছিল। শাকিলকে সামলাতে অনেক বেগ পেতে হল। আমি রুমার থেকে বিদায় নিয়ে, শাকিলকে বললাম, চল এবার ফেরা যাক। শাকিল তখনও অনবরত কেঁদেই যাচ্ছে। আমি আর শাকিল ফেরার জন্য মাত্র সামনের দিকে দু’কদম বাড়িয়েছি, এমন সময় পেছন থেকে রুমা আবার ডেকে বললেন,
–কোথায় যাচ্ছেন শাকিল ভাই? আপনি সারাজীবন শুধু ওকে ভুলই বুঝে গেলেন। বিগত আট বছর ধরে ওকে জ্বালিয়েছেন, আপনি কিভাবে ভাবলেন যে কোন প্রতিশোধ না নিয়েই মিথিলা আপনাকে এভাবে এমনি এমনি ছেড়ে দিবে? তারপর ভেতরের ঘরের দিকে উদ্দেশ্য করে রুমা বলে উঠলেন, কইরে, আর লুকিয়ে থাকার দরকার নেই। তোর কথা মতো বেচারাকে অনেক শাস্তি দিয়েছি, এবার বেরিয়ে আয়।
রুমার কথা শেষ হতেই শাকিল থতমত খেয়ে পিছনের দিকে ফিরে তাকালো এবং একইসাথে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। রুমার পাশে দাঁড়িয়ে অঝোর ধারায় কাঁদছে মিথিলা। আমাদের সম্পর্কগুলোতে মাঝে মাঝে কিছু দূরত্ব সৃষ্টি হয় সম্ভবত- আরো প্রবলভাবে ফিরে আসার জন্য। আরো নিবিড়ভাবে, আরো আপন করে প্রিয় মানুষটাকে কাছে পাওয়ার জন্য। শাকিল আর মিথিলাকে দেখে আমার অন্তত এমনটাই মনে হচ্ছে।