অভিমান

অভিমান

-তোর দাদা জানতে চেয়েছে তুই বিয়ে করতে চাস কি না?
-বাবা! এসব কী বলছ? আমি একবারও তেমনটা বলেছি?
-তাহলে খালের পাড়ে একা একা উদাস হয়ে বসে থাকিস কেন?
-এমনি। আমার কারো সাথে মিশতে ইচ্ছে করে না। একা একা থাকতে আমার অনেক ভালো লাগে।
-একা একা থাকা ঠিক না। সবার সাথে মিশতে হয়, হাসি খুশি থাকতে হয়।

আমি আর কিছু না বলে মাথা নিচু করে খাওয়া শেষ করলাম। বাবা রুম থেকে বের হয়ে বাজারের দিকে গেল। এর মিনিট দশেক পর আমিও বেরিয়ে পড়লাম। সেই খালের পাড়, হেলে পড়া জাম গাছে বসে খালের স্রোতহীন পানির দিকে তাকিয়ে থাকতে আমার ভালো লাগে। দাদা কখন কীভাবে আমাকে এখানে কতবার দেখেছে আমি জানি না। তবে দাদা হুট করে বাবার কাছে বিয়ের কথা বলল কেন বুঝলাম না। আমি প্রেম করি ঠিক আছে, কিন্তু বিয়ে যে এখনই করতে হবে তেমন তো না। তার উপর রুমি অভিমান করে কয়েকদিন কথা বলে না। ফোন দিলেও রিসিভ করে না। তো উদাস হয়ে মন খারাপ করে বসে না থেকে নাচানাচি করব? গালে হাত দিয়ে বসে ছিলাম। এরই মধ্যে দাদা এসে হাজির। আমার পাশে জামগাছের নিচের দিকে বসলেন।

-বুঝলি নাতি? গালে হাত দিয়ে বসে থাকলে বৌয়ের অমঙ্গল হয়।
-দাদু, আমি তো বিয়েই করিনি।
-আজ হোক কাল হোক করবি তো। গালে হাত দিয়ে বসতে নেই। কী হয়েছে আমাকে বল। কোনো মেয়ে পছন্দ হয়েছে? আমাকে শুধু বল কোন গ্রামের কার মেয়ে। আমি নিজে তোর বিয়ের পয়গাম নিয়ে যাব।

-দাদা আমরা এখন বিয়ে করব না।
-ও আচ্ছা, তার মানে পছন্দের সাথে সাথে সম্পর্কও জোড়া লেগে আছে, তো এখানে প্রতিদিন উদাস হয়ে বসে থাকিস কেন?

-না মানে, আসলে হয়েছে কী..
– হইছে। কী হয়েছে দাদার কাছে বল।
-আসলে উত্তর পাড়ার খাদিজার কাছ থেকে নোট বই আনার সময় দাঁড়িয়ে একটু কথা বলছিলাম। আর এটা সে দেখে ফেলে। অন্যকিছু ভেবে অভিমান করে বসে আছে। কথা বলে না। যেহেতু ভুল বুঝে কথা বলে না। তাই আমিও কথা বলি না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে কষ্ট হচ্ছে দাদু।

-অভিমান। খুব খারাপ এই অভিমান। ভালোবাসার মানুষকে আলাদা করে দেয় এই অভিমান।
-কী বলছ দাদু? আর তোমার চোখে পানি কেন?
-দাদু চোখ মুছতে মুছতে বললেন, চোখে কী যেন পড়েছে। তোকে একটা গল্প বলি শোন। দাদা বলতে শুরু করলেন।

খালের ঐ পাড়ে একটা মসজিদ দেখছিস? মসজিদের মাইক ছিল না তখন। এর পাশেই একটা শিমুল গাছ ছিল। এখন আর সেখানে গাছটি নেই। সে শিমুল গাছের নিচে আমাদের মারবেল খেলা থেকে শুরু করে সব খেলার আসর জমত। দুই তিন এলাকার ছেলে মেয়েরা খেলতে যেত। আমি সেখানে খেলতে যেতাম। সেই শিমুল গাছের আশেপাশে শিমু নামের এক মেয়ে ছিল। আমার মনে হত শিমুল গাছের নামকরণ শিমু’র জন্যই হয়েছে। সে ছোট্টবেলা থেকে থ্রীপিছ পড়ত। গোলাপী ওড়না কাঁধ থেকে নিচ পর্যন্ত পড়ে থাকত। ফোকলা দাঁতের হাসি দেখলে আমারও হাসি আসত। হাতে চুড়ি আর পায়ে পায়েল। লম্বা ঐ ছোট মেয়েটি আমার দুই বছরের ছোট ছিল। সে ফোরে, আর আমি সিক্সে পড়তাম। মাঝে মধ্যে আমাদের এলাকার কেউ না গেলেও আমি একা একা যেতাম খালের ঐ পাড়ে। কেন জানিস? শিমুর ফোকলা দাঁতের হাসি দেখতে। তখন প্রেম ভালোবাসা কী জানতাম না। তবে কেন যেন তাকে দেখতে ভালো লাগত।

একবার খুব বৃষ্টির মধ্যে আমি চলে গিয়েছিলাম, শিমুল তলায় শিমুকে দেখতে। কিন্তু বৃষ্টির মধ্যে কেউ আসেনি। আমি ভিজে চুপসে যখন ফিরে আসছিলাম তখন পেছন থেকে সেই চিরচেনা ফোকলা দাঁতের হাসি আমার কানে আসল। পেছন ফিরে দেখি একটি ঘরের জানালা দিয়ে শিমু তাকিয়ে থেকে হাসছে। আমার তখন খুব আনন্দ হচ্ছিল।
আমি একরাশ তৃপ্তি নিয়ে বাড়ি ফিরে আসলাম।

আমি তখন ইন্টার পাশ করেছি। তখন আর আমার খেলার বয়স ছিল না। তবুও আমি শিমুল তলা গিয়ে শিমুর জন্য অপেক্ষা করতাম। তাদের বাড়ির পাশে শিমুল গাছ, তার আসতে সমস্যা হত না। তখন আমরা বাচ্চাদের খেলা দেখতাম আর একে অন্যের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। মনে হত অনন্তকাল এভাবে তাকিয়ে থাকতে পারব। হঠাৎ হঠাৎ শিমু হাসির ঝংকার তুলত। তখন শিমুর ফোকলা দাঁত ছিল না। লাউয়ের দানার মত দাঁত ছিল। আমি আর শিমু দু’জন জানতাম আমরা একে অন্যকে ভালোবাসি। কিন্তু বলার মত সাহস কারো ছিল না। আর বলার কী দরকার ছিল? আমাদের না বলা কথাগুলো আমরা চোখের ইশারায় বুঝে নিতাম। একদিন দেখি শিমুর চোখ ছলছল করছে। একটু পরপর ওড়না দিয়ে চোখ মুছে। আমি মনে মনে ভাবছি, শিমুর কি বিয়ে ঠিক হয়ে গেল?

বাচ্চারা যখন কমতে শুরু করল, শিমুলতলা প্রায় ফাঁকা। শিমু এগিয়ে এসে আস্তে করে বলছে, “আজ আমার প্রথম কথা বলা আপনার সাথে। সেই প্রথম কথাটা কতটা মধুর হত আমি সেটা নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম। আশায় থাকতাম একটি দিনের জন্য। কিন্তু আজ আমার সব স্বপ্ন ভেঙ্গে দিলেন। জেসমিন আমার কাছে বিচার দিছে, আমি এমনটা আশা করিনি আপনার কাছে।” কথাটুকু বলে শিমু ওড়নায় চোখ মুছতে মুছতে চলে গেল। সে রাতে আমার ঘুম আসেনি নাতি। পরদিন সকাল থেকে আমিও তোর মত এই খালের পাড়ে বসে ছিলাম গালে হাত দিয়ে। অপেক্ষায় ছিলাম, কখন বিকাল হবে আর কখন শিমুর অভিমান ভাঙ্গাব।

তোর মত এই বয়সে অনেকেই স্কুল ছুটি হলে মেয়েদের পিছু নেয়। একদিন বন্ধুরা ঘুরতে বের হয়েছি। স্কুল ছুটির পর সে বন্ধুরা মেয়েদের পিছু নিয়েছে। সেখানে আমিও ছিলাম। আর জেসমিন নামের শিমুর বান্ধবীও ছিল সে মেয়েদের ভীড়ে। সেই জেসমিন শিমুকে হয়তো কিছু বলেছে। আর সেটা শুনে শিমুর অভিমান হয়েছে। শিমুর অভিমান ভাঙ্গতে আমার চারদিন লেগেছিল। তবে সে অভিমানের কারণেই শিমুল তলায় শিমুর মুখে শুনেছিলাম সে আমাকে কতটা ভালোবাসে। বছর দেড়েক খুব ভালো চলছিল আমাদের সময়। দু’জনের চোখেই ভালোবাসার রং দিয়ে আঁকা অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু একদিন..

-কিন্তু একদিন কী দাদু? বলো না তাড়াতাড়ি।

– আমার বাবা অনেক রাগী ছিলেন। আমি খুব ভয় পেতাম। বড় ছেলে হিসেবে আমাকে বিয়ে করাবে বাবা। সেজন্য খালের ঐপাড়ে আমাকে নিয়ে মেয়ে দেখতে গেলেন। আমি বলেছিলাম বিয়ে করব না। বাবা বলেছেন, আগে দেখ। পছন্দ না হলে বিয়ে করিস না। আমিও মনে মনে ভেবে রেখেছি, মেয়ে যতই সুন্দরী হোক আমি বলব পছন্দ হয়নি। কারণ আমি শিমুকে ভালোবাসি। কিন্তু আমার ভাগ্য অনেক খারাপ ছিল। যে মেয়েকে দেখতে গিয়েছি সে মেয়েটি শিমুর চাচাত বোন। শিমু সেখানে ছিল। আমাকে দেখে শিমু উঠে চলে গেল। যাবার সময় আমি শিমুর চোখের করুণ চাহনী দেখেছি। আর সেই দেখাই আমার শেষ দেখা ছিল। আমি শিমুর চাচাত বোনকে পছন্দ হয়নি বলে দিয়েছি। কিন্তু শিমু ভেবে নিয়েছে, এখানে বিয়ে করলে শিমুর সাথে দেখা হবে তাই আমি মানা করেছি। আসলে শিমুকে রেখে আমি বিয়ে করতে চাই তাই পাত্রি দেখছি । এমনটাই ভেবে নিয়েছে শিমু।

আমি কত শতবার শিমুলতলা গিয়েছি আমি জানি না। শিমু আসেনি, একবারও আসেনি। অনেক মানুষ দিয়ে খবর পাঠিয়েছি, তবুও আসেনি। তাদের বাড়ি উঠার মত পরিস্থিতী ছিল না। পাশের বাড়িতে মেয়ে দেখতে গিয়ে পছন্দ হয়নি বলে ফিরে এসেছি। সে বাড়িতে শিমুর খোঁজে যাই কী করে? মান আর অভিমানে আমাদের গল্পটা সেখানেই শেষ ছিল। শিমুর বিয়ের আগের দিন আমি এই খালপাড়ে বসে ছিলাম। লাল নীল বাতি জ্বলছিল, আমি তাকিয়ে ছিলাম। আর ভিতরটা জ্বলছিল প্রেমের দহনে। শিমুর বিয়ের পর আমি তোর দাদীকে বিয়ে করি। তবুও আমার পছন্দে না, বাবার পছন্দে।

এই খালপাড়ে তুই সপ্তাহ খানেক ধরে আসিস। আসলে আমি এই খালপাড়ে কয়েক যুগ পাড় করে দিয়েছি। তোকে বসে থাকতে দেখে আমি আসতে পারি না। এই খালপাড়ে তোর বসে থাকতে হবে না। এখানে শুধু আমি বসব। তুই যারে নাতি। তার অভিমান ভাঙ্গা। অভিমান অনেক খারাপ। যা তাড়াতাড়ি। আমি উঠে এসেছি। আমার রুমির রাগ ভাঙ্গাতে হবে। দাদা তার শিমুর স্মৃতি নিয়ে খালপাড়ে বসে আছে। আমি আমার রুমির স্মৃতি নয়, রুমিকে নিয়েই সাজাতে চাই ভালোবাসার ঘর। আসার সময় পেছন ফিরে দেখি দাদা তার খদ্দরের চাদরে চোখের জল মুছে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত