তুমি একদম শুকিয়ে গেছ! চেহারার একি অবস্থা করেছো?
– শুধু চেহারাটা-ই দেখলে? মনের ভেতর টা দেখলেনা? জানো মনটা ভেঙে গেছে আমার।
– নিজেকে কষ্ট কেন দিচ্ছ এভাবে? কষ্ট তো পাওয়ার কথা আমার। তুমি কেন পাচ্ছ বলতো?
– কেন তোমার কেন কষ্ট পাওয়ার কথা?
– এই যে তোমাকে কষ্ট দিয়েছি তাই।
– তাতে কি? আমি তো কখনো তোমার জীবনের বিশেষ কেউ ছিলামনা।
– তুমি আমার জীবনে বিশেষ একজন-ই ছিলে। আমি বুঝতে পারিনি সময় থাকতে। যদি সময় থাকতে একটু যত্ন নিতাম!
– আমি তোমাকে তো খুব প্যারা দিতাম। তুমি তো কখনো আমাকে নিয়ে হ্যাপি ছিলেনা।
– আশ্চর্যের বিষয় কি জানো? ঐ প্যার গুলোই এখন মিস করি। আর প্যারা দেওয়ার মতো কেউ নেই। একি হাসছো কেন?হাসার মতো কিছু বললাম কি?
– জানিনা। শুভ্র, তোমার সময় শেষ। আমার আর কথা বলতে ভালো লাগছেনা। তুমি চলে যাও। আর কখনোই আসবেনা।
– চলে যাওয়ার জন্য আসিনি লাবণ্য।
– লাবণ্য চোখ বন্ধ করে চিৎকার করতে লাগলো। প্লিজ তুমি চলে যাও। প্লিজ শুভ্র। চলে যাও তুমি।
– লাবন্যর মা তাড়াতাড়ি এসে লাবণ্য কে ধরে বলল, কি হয়েছে লাবু? চিৎকার কেন করছিস? স্বপ্ন দেখেছিস?
– মা শুভ্রকে চলে যেতে বল। ও কেন এসেছে?
– লাবু এখানে কেউ নেই। শুভ্র আসেনি। তুই স্বপ্ন দেখেছিস মা।
– আমি স্বপ্ন দেখিনি মা, সত্যিই শুভ্র এসেছে।
– লাবু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা কর মা, তুই অসুস্থ।
– চোখ খুলে লাবণ্য দেখলো, সত্যিই শুভ্র নেই। হ্যাঁ তাই তো। শুভ্র কিভাবে আসবে? শুভ্রর আসা তো সম্ভব না। শুভ্র তো…..
– লাবণ্য বলল, মা আমার বমি পাচ্ছে। আমাকে ওয়াশরুমে নিয়ে চল। বিকেল পাঁচটায় হাসান সাহেব লাবণ্যর রুমে আসলেন। লাবণ্য তখন ঘুমিয়ে ছিল। হাসান সাহেব আলতো করে লাবণ্যর মাথায় হাত দিয়ে তাকে ডেকে বলল, মা ওঠে পড়। রেডি হতে হবে। তোমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবো।
— লাবণ্য ছোট একটা শিশুর মতো করে উঠে বসল। খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল, বাবা তুমি বাইরে যাও আমি রেডি হয়ে আসছি। লাবণ্য হঠাৎ দেখলো শুভ্র খাটের উপরে বসে ফোন টিপছে। লাবণ্য গিয়ে এক টান দিয়ে ফোন টা কেড়ে নিল। তারপর মেঝেতে ছুড়ে ফেলল।
– শুভ্র বলল, একি তুমি ফোনটা ফেলে দিলে?
– বেশ করেছি আমি। আবার দিব। তুমি কেন আমার দিকে তাকাচ্ছোনা? তুমি কেন ফোনের দিলে তাকিয়ে আছো? সব ভেঙে ফেলবো, সব শেষ করে ফেলবো। লাবণ্য হাঁপিয়ে গেল।
– শুভ্র লাবণ্যর হাত টা টেনে ধরে তাকে বুকের মধ্যে আলতো করে জড়িয়ে ধরল। বলল, ভেঙেছো, খুব ভালো করেছো। আর এরকম করবোনা। দেখি চোখের পানিটা মুছে ফেলো। তুমি কেন এরকম করছো লাবণ্য? তুমি কেন আমার কথাটা ভাবছোনা? তুমি পাগলামী করলে আমার কষ্ট হয়। তোমার মা- বাবা, ভাই সবাই কষ্ট পায়। তুমি কেন বোঝোনা?
– আমি আর পাগলামী করবোনা শুভ্র, তুমি আমাকে ছেড়ে যেওনা। প্লিজ। তুমি আমার সাথে থাকলে আমি সুস্থ হয়ে যাবো।
– লাবণ্য, তোমার মা বাবা অনেকক্ষণ দরজায় কড়া নাড়ছে, দরজাটা খোল। যাও।
– না, তাহলে তুমি আবার চলে যাবে।
– সকালে তো চলে যেতেই বলেছিলে।
– না না। তখন আমি মন থেকে বলিনি। রাগ করে বলেছি। শুভ্র তুমি যাবেনা। আমি তোমাকে যেতে দিবোনা। আমি তোমাকে এভাবেই ধরে থাকবো। না হলে তুমি আবার চলে যাবে।
– না পাগলী, আমি যাবোনা। যাও দরজা টা খোল।
– ঠিক আছে। কিন্তু কথা দিলে যে তুমি যাবেনা।
-হ্যাঁ কথা দিলাম। দরজা খোলার সাথে সাথেই লাবণ্যর মা বাবা তাড়াহুড়া করে রুমে ঢুকে বলল, তুই ঠিক আছিস তো মা? এতক্ষন থেকে দরজা কেন খুলছিলিনা? চিৎকার কেন করছিলি? কি হয়েছে মা?
– মা, বাবা আসলে শুভ্রর সাথে একটু ঝগড়া হয়েছিল। তোমরা টেনশান করোনা। আমরা নিজেরা সব ঠিক করে নিয়েছি।
– লাবণ্যর মা বাবা মুখ তাকাতাকি করলো। তারপর লাবণ্যর লাবণ্যকে কাছে টেনে নিয়ে বললো, মা রে শুভ্র আসেনি। তুই একটু অসুস্থ তো, তাই স্বপ্ন দেখেছিস।
– মা কি বলছ? ঐতো শুভ্র! পেছনে তাকিয়ে লাবণ্য দেখল রুম ফাঁকা। সত্যিই কেউ নেই। লাবণ্য প্রলাপ বকতে বকতে মেঝেতে পরে যেতে লাগলো। হাসান সাহেব ধরে ফেললেন তাকে। লাবণ্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।
লাবণ্যর মা কাঁদতে কাঁদতে হাসান সাহেবকে বললেন, আমি আর সহ্য করতে পারছিনা গো। আমার মেয়েটার কি হয়ে গেল। আমার মেয়েটা এইটুকু বয়সে কত কিছু সহ্য করছে। আমার মেয়েকে সুস্থ করে দাও। আমি জানিনা তুমি কি করবে!
– হাসান সাহেব বললেন, আর দেরী করলে চলবেনা। অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে হবে। ওকে হস্পিটালে ভর্তি করতে হবে। আমি দেখছি কি করলে ভালো হয়।
প্রায় দেড় মাস ধরে লাবণ্যর ট্রীটমেন্ট চলছে। হঠাৎ একদিন নিলয় আসলো তাদের বাড়িতে। নিলয় এতদিন আমেরিকাতে ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যায় থেকে সাইকোলজিতে অনার্স মাস্টার্স করার পরই সে পিএইচডি করতে আমেরিকায় যায়। পিএইচডি শেষ করে দেশে ফিরেছে। নিলয়, হাসান সাহেবের সব চেয়ে কাছের বন্ধুর ছেলে। নিলয় লাবণ্যর চেয়ে সাড়ে ৪ বছরের বড়। ছোট বেলায় লাবণ্যর মা সব সময় নিলয়কে বলতো, আমার মেয়েকে বিয়ে করবি? নিলয় চুপ চাপ হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়াতো। একটা সময়, টিনএইজে নিলয় লাবণ্যকে ভীষণ ভালবেসে ফেলে। একবার সে লাবণ্যকে ভালবাসার কথা বলেই ফেলে৷ কিন্তু লাবণ্য ঠাট্টা ভেবেই উড়িয়ে দেয়। নিলয়কে পাত্তাই দেয়না। কোন এক অজানা কারণে নিলয়ের মাথায় জেদ চেপে যায় ও সাইকোলজি নিয়ে পড়াশোনা করবে। তাহলে ও মানুষের মন বুঝতে পারবে। এমনকি অন্য মানুষকে ও সেই সূত্র শিখিয়ে দিতে পারবে। ছোট বয়সের ভাবনা পরবর্তীতে এতটা কাজে দিবে এটা কে জানতো!
নিলয় লাবন্যর মায়ের কাছ থেকে সব ঘটনা শুনে নেয়। নিলয় শুভ্রকে চিনতো। আমেরিকায় যাওয়ার আগেই লাবণ্যর সাথে শুভ্রর সম্পর্ক তৈরী হয়। ২ মাস আগে শুভ্র অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। তাও আবার লাবণ্যর চোখের সামনে। তারপর থেকেই লাবণ্য অসুস্থ। লাবন্যর মাঝে মাঝেই হেলুসিনেশান হয়। না মাঝে মাঝে বললে ভূল হবে। প্রায়ই হতো। ও আরো অসুস্থ হয়ে যায়। এখনো লাবণ্যর ট্রীটমেন্ট চলছে। কখনো মনে হয় কিছুটা ইম্প্রুভ হয়েছে আবার কিছু সময় মনে হয় কোনই ইম্প্রুভ হয়নি।
– আন্টি, আর কোন টেনশান করবেননা। পড়াশোনা তো কম করলামনা! এখন লাবণ্যর ট্রীটমেন্ট টা আমার উপর ছেড়ে দিন। তবে তার আগে আমার বুঝতে হবে অর কন্ডিশানটা এখন কেমন। নিলয়ের কাছে ট্রীটমেন্ট চলছে প্রায় দেড় মাস থেকে। লাবণ্য আগের চেয়ে কিছুটা শান্ত হয়ে গেছে। তবে শুভ্রর সাথে সে অবচেতন মনে এখনো কথা বলে তবে আগের মতো সবসময় শুভ্রকে দেখতে পায়না৷ অর্থাৎ হেলুসিনেশান টা এখনো ঠিক হয়ে না গেলেও কমে গেছে কিছুটা।শুভ্রর সাথে কি কথা হয় সব কিছুই লাবণ্য নিলয়ের সাথে শেয়ার করে। এমন ভাবে করে যেন সব টা সত্যি। কখনো ঝগড়া করার কথা, কখনো অভিমান, কখনো রোমান্টিক সময় কাটানোর কথা এসব নিলয়ের সাথে শেয়ার করে। নিলয় লাবণ্যকে প্রায়ই বাইরে নিয়ে যায় ঘুরতে। তবে সব কিছুই লাবণ্যকে সুস্থ করে তোলার জন্য এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটে যায়।
নিলয় লাবণ্যকে নিয়ে বাইরে গিয়েছে, সেদিন রাস্তায় একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যায়। লাবণ্য আগের চেয়েও বেশী অসুস্থ হয়ে যায়। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে একদিন নিলয় হঠাৎই সে বাসায় জানায় সে লাবণ্যকে বিয়ে করতে চায়। সে লাবণ্যকে সুস্থ করার দায়িত্ব নিয়েছে। সে লাবণ্যকে নিজের করে পেতে চায়। নিলয়ের বাবা- মা প্রথমে রাজি ছিলনা। কিন্তু পরবর্তীতে নিলয়ের আত্মবিশ্বাসের কাছে হেরে যায়। তারা রাজি হয় শেষে। লাবণ্যর বাবা – মা তাঁদের নিজেদের অসুস্থ মেয়েকে নিলয়ের কাছে চেপে দিতে চায়নি। কিন্তু নিলয় তাদেরকে অনেক বুঝিয়েছে। তারপর তারা রাজি হয়েছে। রাজি না হয়েই বা কি করবে। নিলয়কে পছন্দ না করার মতো কোন কারণ নেই। তার উপর লাবণ্যর যা অবস্থা।
– লাবণ্য সব জিনিসপত্র ভাঙচুর করতে থাকে বিয়ের কথাটা শুনেই। কিন্তু নিলয় তাকে বলে বিয়ের পর সে শুভ্রকে একেবারে এনে দিবে। লাবণ্য তখন রাজি হয়ে যায়। লাবণ্য তো এখন শিশু৷ ওকে যে যা বোঝানে ও তাই বুঝবে। ধীরে ধীরে বিয়ের দিন ঘনিয়ে এল।
– বাসর ঘরে লাবণ্য নিলয়কে বলল, এখনি শুভ্রর কাছে নিয়ে চল।এখনি যাবো। ও খুব অশান্ত হয়ে উঠল।
-নিলয় গাড়ি বের করে লাবণ্য কে নিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা গাড়ি চালালো। শুভ্রকে খোঁজার নাটক করল। তারপর লাবণ্য গাড়ি থামাতে বলল।
নিলয় গাড়ি থামাতেই লাবণ্য গাড়ি থেকে বের হয়ে শুভ্র শুভ্র বলতে বলতে দৌড় দিল। নিলয় ও পেছন পেছন দৌড়। কিছুক্ষণ পর নিলয় লাবণ্যকে ধরে ফেলে। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে বলে তুমি শুভ্রকে চাওতো?? শুভ্রকে পেলেই তো হল তাইনা?
– হুম, আমি শুভ্রকে পেলে আর এরকম করবোনা। শুভ্রকে এনে দাও।
– নিলয় বলে লাবণ্য চোখ টা বন্ধ করে ফেল।
– হুম।
– আমি যতক্ষণ না বলবো, চোখ খুলবেনা।
-ঠিক আছে।
– শুভ্রকে মনে মনে ডাকো। মনে করো শুভ্র তোমাকে জড়িয়ে ধরে আছে। ফিল করো শুভ্রকে।বলেই সে লাবণ্যকে জড়িয়ে ধরলো।
– শুভ্র, তুমি আগে আসোনি কেন? আর যাবেনা তো?
– নিলয় বলল, আমি আর যাবোনা লাবণ্য। আর যাবোনা৷ আমার চোখের দিকে তাকাও।
– লাবণ্য নিলয়ের চোখের দিকে তাকালো। এক চিলতে হাসি ফুটল তার ঠোঁটে। শুভ্র বলেই নিলয়কে আবার জড়িয়ে ধরল।
প্রায় ৪ বছর কেটে গিয়েছে। এখন নিলয়কে আর শুভ্র হতে হয়না। লাবণ্য নিলয়ের সাথেই সংসার করছে। বেশ সুখেই আছে সে। এখন লাবণ্য পুরোপুরি সুস্থ। সাত মাসের প্রেগনেন্ট সে। সব ঠিকঠাক। শুধু কোন কোন দিন, মাঝরাতে শুভ্রর কথা মনে করে চোখের পানি ঝড়ায়। নিলয় হয়তো ঘুমিয়ে থাকে তখন। কিন্তু লাবণ্য যদি নিলয়ের গায়ে টাচ করে, সে ঘুমের মধ্যেই লাবণ্যকে বুকের মাঝে নিয়ে নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে লাবণ্য শুভ্রর কথা ভূলে যায়। নিলয়ের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু হৃদয়ের গভীরের কোথাও না কোথাও শুভ্র থেকেই যায় কিছুটা।