পবিএ ভালোবাসা

পবিএ ভালোবাসা

‘ স্যার সত্যিই আপনি একটা বেহায়া!’ এত করে বলার পরও আপনি প্রতিদিন আমাকে পড়াতে আসেন। আচ্ছা স্যার আপনার লজ্জা করে না? নাকি আমাদের বাড়ির চা-নাস্তা খুব ট্যাশ?ওহ্হো আপনাকে তো খুব কমই চা নাস্তা দেওয়া হয়। বেশিরভাগ রাতে ডিনার করে যান! আর প্রতিদিন এক শার্ট না পরে আসলে হয় না? আপনার আত্মসম্মানবোধ না থাকতে পারে আমার আছে। আমার বান্ধবীরা, প্রতিদিন আপনার জন্য মজা করে আমার সাথে! এসব আমার আর ভালো লাগে না।

– ছাত্রীর কথা শুনে মুঁচকি হেসে বললাম’ বই বের করো সামনে পরীক্ষা, রেজাল্ট ভালো করতে হবে।’
– কথা আমার দিকে কিছুক্ষণ অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘আমি যে এতক্ষণ কার সাথে বকবক করলাম? আল্লাহ্ মালুম! ‘ তারপর বই বের করে পড়তে লাগল।

– আমি কথার(ছাত্রীর)দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবছি ‘সত্যিই আমি বেহায়া।’ আমার জন্ম যে মধ্যবিত্ত পরিবারে। তাই হয়তো বেহায়া। কথাকে পড়িয়ে রাতে পকেট হাতিয়ে দেখি পকেটে আশি টাকা! তাই ছোট্ট মহারাণীর জন্য একটা আইসক্রিম কিনে নিলাম।

– রাত বারোটা ছুঁই ছুঁই! চাঁদের আলো জানালার কাঁচ ভেদ করে মুখে এসে পড়ছে। ঘুম আসছে না কথার। কলেজে গেলেই বান্ধবীরা স্যারকে নিয়ে এটা -ওটা প্রশ্ন করে। তাই আজ স্যারকে অনেকগুলো কথা বলেছে। যদিও খারাপ লেগেছে তথাপি আমার জায়গা থেকে আমি ঠিকই বলেছি! হঠাৎ জেসির ফোন! এতরাতে। কিছু না ভেবে ফোনটা রিসিভ করতেই জেসি বলল ‘কেমন আছিস দোস্ত?’

– বেশি ভালো না। আর তুই এতোরাতে কেন ফোন দিলি?
-জারিফ এর সাথে ব্রেকাপ হয়েছে। থাক এসব কথা তুই কেন ভালো না?
– জানিস দোস্ত, আমার বেহায়া স্যারটাকে আজ অনেকগুলে কথা বলেছি। তবুও টিউশনি ছাড়তে রাজি না। এতো ছ্যাঁচড়া!
– সত্যিই তোর টিচারকে আমি মনে হয় জীবনে নীল শার্টটা ছাড়া অন্য কোন ড্রেসে দেখেছি বলে মনে হয় না।
– বাবার ভয়ে কিছু বলতেও পারি না। জানি না বাবার মন কিভাবে জয় করে নিয়েছে।

– দোস্ত গুড আইডিয়া তোর বাবার সামনে তাকে খারাপভাবে উপস্থাপন কর।
– কীভাবে? ‘তাহলে শোন’ এই বলে কথাকে জেসি সব প্ল্যানের কথা বললো।

– এদিকে ফজরের নামাযটা পড়ে, একটা টিউশন শেষ করে বাসায় এসে এসানমেন্টগুলো নিয়ে ভার্সিটিতে চলে গেলাম। এসাইনমেন্ট জমা দিয়ে, আরো দুইটা টিউশনি শেষ করে। সন্ধ্যা সাতটায় কথাদের বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলাম। রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। আর, মনে মনে ভাবছি এই সময়টাতে ভালো বেতনের একটা টিউশনি পেলে এই টিইশনিটা ছেড়ে দিব।

-জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই কথার বাসা। আমি বাসায় গিয়ে নর্ক করতেই কথা এসে দরজা খুলে দিল! অনেকটা আশ্চর্য হলাম কথার দরজা খুলাতে। রুমে এসে বসলাম। এসির মাঝে ঘামযুক্ত শরীরটা মনে হচ্ছে এলিয়ে দেয়।

এমন সময় কথা বলল’স্যার শাড়ির কুঁচিটা একটু ঠিক করে দিবেন? আমি পারছি না। ‘মাথার আঁচল দিতে গেলে নাভি বের হয়ে যায়! আর নাভি ঢাকতে গেলে মাথা থেকে কাপড় সরে যায়। দেন না স্যার কুঁচি টিক করে।

– ছাত্রীর কথায় বইয়ের ভেতর থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। কথার দিকে তাকিয়ে দেখি, অনেকটা বাচ্চা মেয়েদের মতো শাড়ি পরেছে। বাচ্চা মেয়েরা, যেমন গায়ে শাড়ি প্যাঁচিয়ে ছোট্টবেলা খেলা করে তেমনি! হাসি আকটে রাখতে পাচ্ছি না। আপনারা হয়ত তাই ভাবছেন? কিন্তু না মেয়েটা আমাকে অপমান করার জন্যই এসব নাটক করে প্রতিদিন। হয়তো আজ নতুন কোন প্ল্যান করেছে। মনে মনে স্থির করে নিলাম টিউসনিটা ছেড়েই দিতে হবে। আল্লাহ তায়ালা ভাগ্যে যা রেখেছে তাই হবে।

-কি হলো স্যার, আপনি না শিক্ষক। আপনার তো শাড়ি পড়ানোও শিখানো উচিত আমাকে। তাই না? ‘বলেই মুখ ধরে হেসে দিল কথা!

– চুপ করো আর পড়ো তো। সামনে ইয়ারচেঞ্জ পরীক্ষা। বইয়ে চোখ দাও কাজে লাগবে। রেজাল্ট খারাপ করলে আঙ্কেল কষ্ট পাবে।

– স্যার এই নেন নাস্তা!
– কয়েকটা টোস বিস্কুট সাথে, এক কাপ চা! কথাকে অঙ্ক করতে দিয়ে চায়ের কাপে টোস্ট ভিজিয়ে খাচ্ছি! টোস্ট খাওয়ার একটা কড়মড় শব্দ হচ্ছে। শব্দটা বড্ড আপন মনে হচ্ছে!

-স্যার জীবনে বিস্কুট খাননি? মনে হচ্ছে কোনদিন খাননি। জানেন যতটা না আপনাকে অসহ্য লাগে তার চেয়ে বেশি আপনার এই টোস্ট খাওয়ার শব্দটা অসহ্য লাগে!

– তাই বুঝি! এরপর খাবো যখন তখন শব্দ কম হবে যাও। আচ্ছা অঙ্কগুলো করেছ?
– এই নেন।
– আমি অঙ্ক দেখছি। অঙ্ক দেখা শেষ হলে বললাম’ তোমার এ অধ্যায়ে কোন সমস্যা আছে? ‘
– না স্যার। আচ্ছা স্যার গন্ডার দেখেছেন?
– না তয় টিভিতে দেখেছি!
– স্যার গন্ডারের চামড়া নাকি খুব শক্ত হয়?
– হুমম শক্তই তো বটে।
– না স্যার মনে হয় গন্ডারের চামড়ার চেয়েও শক্ত চামড়া আছে ।
– আচ্ছা কথা আজ আমি ওঠি।
– সে কি স্যার ডিনার করে যাবেন না?
-ধন্যবাদ।
-আমি কথাদের বাসা থেকে বের হতেই দেখে আকাশ ঘনকালো অন্ধকারে ছেয়ে গেছে!

বাসায় পৌঁছানোর আগেই বৃষ্টিতে শুরু হল। বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে বাসায় ফিরলাম। ঘুমাতে ঘুমাতে রাত দু’টা বেজে গেল। এদিকে ফজরের আযান শুনে ঘুম থেকে ওঠে নামায পড়ে আল্লাহর কাছে দু’খানা হাত তুলে অনেক কাঁদলাম। কারণ আমি যে আর পারছি না জীবন যুদ্ধে। আল্লাহ যেন আমাকে ধৈর্য্য ধরার শক্তি দেয়! পরের দিন জ্বর নিয়েই টিউশনিতে গেলাম। টিউশনিতে আজ বিস্কুট দিলেও খেলাম না। জ্বরে মুখ তিতো হয়ে আছে!

– জানেন স্যার আপনাকে দেখলেই কেন যেন আমার রাগ হয়। প্লিজ আপনি আর আমাকে পড়াতে আসবেন না। কাল থেকে আপনার মুখটা দেখতে চাই না! আপনার জন্য কলেজের সবাই আমাকে নিয়ে মজা করে। আমি পারছিনা।

– ওহ্, আচ্ছা! আমি চেষ্টা করব।

– টিউশনি শেষ করে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আঙ্কেল এমাসের পাঁচহাজার টাকা হাতে ধরিয়ে দিল।
-আঙ্কেল আজ তো মাসের ২৫ তারিখ! মাস শেষ হতে আরো পাঁচদিন বাকি।
– রাখো তো বাবা। পাঁচদিন আগে কি বেতন দেওয়া যায় না?
– আমি কিছু না বলে বাসা থেকে বেরিয়ে পরলাম। কথার শত কথা শুনেও এই টাকার জন্যই মূলত টিউশনিটা করায়। কারণ অন্য স্টুডেন্টরা যেখানে দু’হাজার টাকা দেয়। সেখানে পাঁচহাজার টাকা ঢের বেশি।

– এদিকে সামনে ইদ এসে গেছে।
– রাত নয়টায় দিকে গ্যারেজ থেকে রিক্সা নিয়ে বের হয়েছি!ইদে মহারাণীর জন্য কিছু তো কিনে দিতে হবে। তাই জ্বর নিয়েও সারা গায়ে চাদর প্যাঁচিয়ে রিক্সা নিয়ে বের হলাম । তবুও শীত করছে। এমন সময় কে যেন পিছন থেকে এসে বলল ‘ এই রিক্সা যাবেন? ‘

– আমি ইশারা দিয়ে উঠতে বললাম!
– রিক্সায় দু’টো মেয়ে উঠে। একটা মেয়ে বললো ‘ জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে নামিয়ে দিবেন!
– মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিলাম। শরীরে প্রচন্ড জ্বর ঠিকমতো রিকশা চালাতে পারছি না।

– এই রিক্সা জোরে চালান!

– কথাটা শুনে চমকে গেলাম! কথা! আমার রিক্সাতে! এদিকে জোরেও রিক্সা চালাতে পারছি না। মাঝরাস্তায় এসে থেমে গেলাম! পা চলছে না।
– চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ রিক্সা এক চাক্কা না দেখে ড্রেনে নামিয়ে দেয়! রিক্সায় থেক্কানে কথার বান্ধবী রিক্সা থেকে পড়ে যায়।

-কথা ঠাস! করে আমার গালে চড় বসিয়ে দিয়ে বলতে লাগে ‘ এই ছোটলোকের বাচ্চা রিক্সা দেখে চালাতে পারিস না?’ মদ খেয়ে রিক্সা চালাস নাকি?

– এই কথা চুপ কর ( জেসি)।
– চর খেয়ে, গায়ের চাঁদরটা মাটিতে পড়ে যায়। আমি আমতা আমতা করে বলি ‘ ম্যাডাম দেখতে পারিনি। ‘
– এদিকে চাদর পড়ে যাওয়ার সাথে সাথেই কথা আমার মুখ দেখে চিনে ফেলে!
– স্যার আপনি! আপনি রিক্সা কেন চালাচ্ছেন?
– কথার বান্ধবী অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে!
– ম্যাডাম রিক্সায় উঠেন। যাবেন না?
– কথা কিছু না বলে জেসিকে নিয়ে হেটেই রওয়ানা দিল।
– আমি রিক্সা নিয়ে গ্যারেজে জমা দিয়ে গেলাম। আজ শরীরটা ভালো না। বাসায় না এসে হাসপাতালে চলে গেলাম। মহারাণীর মুখ দেখলে সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে। হসপিটালে যাওয়ার পথে ভাবছি এই টিউশনিটা আর হয়ত থাকল না।

– দোস্ত, আজ বাসায় পরে যাবো। (কথা) কেন রে আঙ্কেল বকবে না?
– বকলে বকবে। তবে স্যার কেনো রিক্সা চালায় জানতে হবে। যে ভাবা সেই কাজ। দু’জন মিলে ফলো করে করে গ্যারেজ এসে পৌঁছায়। তারপর গ্যারেজ ওয়ালাকে জিজ্ঞেস করে ‘ আঙ্কেল একটু আগে যে ছেলেটা রিক্সা জমা দিয়ে গেল তাকে চিনেন?’

– রাজের কথা বলছো মা!
– হ্যাঁ!
– ছেলেটা বহুত বালা । ভার্সিটিতে পড়ে। সারাদিন টিউশনি করানোর পরেও রাত নয়টা থেকে দু’টা-তিনটা পর্যন্ত রিক্সা চালায় গায়ে চাদর জড়িয়ে।
– আচ্ছা চাচা কেন চালায় বলতে পারেন?
– আর বলো না মা-বাবা হারা ছেলে একমাএ ছোট বোনটার একটা কিডনি ড্যামেজ হয়ে গেছে। আরেকটা প্রায় সেরকমের দিকেই যাচ্ছে । চিকিৎসা করতে অনেক টাকা দরকার হয় প্রতিমাসে। বোনকে বাঁচাতে সারাদিন টিউশনি করানোর পরও রাতে না ঘুমিয়ে রিক্সা চালায় ছেলেটা ! খুব কষ্ট হয় ছেলেটাকে দেখে।

– কথার চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়তে লাগল! চোখের সামনে স্যারকে অপমান করার দৃশ্যগুলো বুকে কাঁটা হয়ে বিঁধছে । কথা বাসায় এসে আর ঘুমাতে পারলো না ”

– আজকে স্যারের জন্য অপেক্ষা করছে কথা। কালো পাড়ের নীল তাঁতের শাড়ি পড়েছে। চোখে ঘন করে কাজল দিয়েছে । এদিকে সাতটা বেজে যাচ্ছে এখনো স্যারের কোন খবর নেই। যে দু’চোখ সবসময় একটা মানুষকে দেখতে পারত না। আজ সে চোখ জুড়ায় পাগলের মতো সে মানুষটাকে খুঁজছে। সমানে ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে কথা। হঠাৎ তার মা এসে বলল’ কথা তোর টির্চার আর ”'”

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত