বাসায় ঢুকতেই যখন মা আর অহনার অদ্ভুত কান্ড দেখলাম তখন আমার চোখ যেন কপালে। যে যুগে বউ আর শ্বাশুড়ির মাঝে সাপে-নেউলে সম্পর্ক তৈরি হয় সেখানে দেখছি আমার মা অহনার মাথায় তেল মেখে দিচ্ছেন আর অহনা হাতে বই নিয়ে পড়ছে।
অহনার সাথে আমার বিয়েটা খুব আকস্মিক ভাবে হয়। মাত্র ষোল বছরের মেয়েটাকে বিয়ে করার জন্য আমার মতো সাতাইশ বছরের ছেলেকে রাজি হতে হয় একমাত্র আমার মায়ের কারণে। অহনার মা বাবা আজ থেকে দুই মাস আগে একটা দুর্ঘটনায় মারা যান। মা বাবাকে হারিয়ে অহনা একদম অনাথ হয়ে যায়। মা বাবা হারানোর পর অহনা তার কাকার বাসায় থাকতে শুরু করে। কিন্তু তার কাকা-কাকী অহনার সাথে খুব খারাপ আচরণ করেন। হয়তো এতোটা তুচ্ছ আর খারাপ ব্যবহার কেউ ঘরের কাজের বুয়ার সাথেও করেনা। অহনার মা আর আমার মা ছোটকালের বান্ধবী ছিলেন। অহনার কষ্ট মায়ের সহ্যের বাইরে ছিল। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে অহনাকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসবেন। কিন্তু আমাদের পরিবারে মা আর আমি ই ছিলাম। তাই একজন মেয়ে আমাদের বাসায় এমনভাবে নিয়ে আসাটা আমাদের সমাজ ভালোভাবে দেখবে না।
আমার মা সিদ্ধান্ত নিলেন যে অহনাকে আমার সাথে বিয়ে করাবেন। আমি এটার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে ছিলাম কিন্তু মায়ের অনুরোধ আর অহনার কথা চিন্তা করে মায়ের হুকুমকে প্রত্যাখ্যান করতে পারি নি। কিন্তু মাকে আমি সরাসরি বলে দেই যে যখন পর্যন্ত অহনা পর্যাপ্ত বয়সে পা না রাখে ততক্ষণ ওর আর আমার মাঝে স্বামী স্ত্রীর কোনো সম্পর্ক তৈরি হবেনা। আমাকে দেখে অহনা বলে উঠে, “কি, হিংসে হয় নিজের মাকে আমার মাথায় তেল মেখে দিতে দেখে?” মা ফিক করে হেসে উঠেন। অহনাও হাসতে শুরু করে। আমি বলি, “হিংসে হবার কি আছে? তুমি বাচ্চা মানুষ তাই আমার মা তোমার মাথায় তেল মেখে দিবেন এইটা স্বাভাবিক!” অহনা রাগ করে বলল, “কি আমি বাচ্চা! মা দেখতাছেন কি বলছেন উনি! আমি কি বাচ্চা?”
মা কিচ্ছু না বলে হাসি থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছেন। আমি শয়তানি হাসি দিয়ে রুমে চলে যাই। একটু পরই অহনা আমার রুমে আসলো। “কি চাই?” অহনাকে দেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম। অহনা রাগে ফুসফুস করতে করতে বলল, “আমাকে বাচ্চা কেন বললেন?” আমি অন্য দিকে তাকিয়ে বললাম, “বাচ্চা কে বাচ্চা বলবনা তো কি বলব?” “দেখেন, আমি কিন্তু বাচ্চা না!” অহনার রাগ দেখে আমার হাসি বের হয়ে গেল। কিন্তু আমার হাসি অহনার রাগটা বাড়িয়ে তুললো। অহনা দাঁত কটমট করতে করতে বলল, “একটু পর বুঝবেন আমাকে বাচ্চা বলার মজা কি?”
আমি অহনার কথাকে স্বাভাবিক ভাবে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে দেখি অহনা রুম থেকে বেরিয়ে চলে গেছে। আমি প্রতিদিন এই সময়ে বেলকনিতে গিয়ে সিগারেট খাই। এইটা আমার একটা অভ্যাস। কিন্তু যখন সিগারেটের প্যাকেট টা বের করতে যাব তখন দেখি পকেট টা নেই। আমার বুঝতে বাকি রইলোনা যে এইটা অহনার করা কাজ। অহনার কথাকে স্বাভাবিক ভাবে নেয়াটা আমার বড় ভুল হয়েছে। আমি অহনার রুমে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম , “সিগারেটের প্যাকেট টা কোথায়?” অহনা বই পড়ছিল। বইয়ের পাতা থেকে নজর সরিয়ে বলল, “আমি কি জানি? আমি তো বাচ্চা মানুষ!” “আচ্ছা সরি আমার ভুল হয়েছে। তোমাকে আর কখনো বাচ্চা বলবনা!” “এখন আর এইসব বলে লাভ নেই। আমি তো বাচ্চা তাইনা!”
আমার রাগটা বেড়েই চলছিল। আমি হুমকি দিয়ে বললাম, “দেখ আমি কিন্তু মাকে বলে দেব!” অহনা মুচকি হেসে বলে, “যান গিয়ে বলুন!” মহাবিপদ। মা কে যদি বলি আমার সিগারেটের প্যাকেট অহনা লুকিয়েছে তাহলে মা উল্টো আমাকে বকা দিবেন কারণ আমি মায়ের থেকে লুকিয়ে সিগারেট খাই। ইসস কি যে মুসিবত! “প্লিজ অহনা ভুল হয়ে গেছে। আর কখনো বাচ্চা বলবনা তোমাকে। এবার তো দাও প্লিজ!” আমার অনুরোধে অহনা সিগারেটের প্যাকেট টা বের করে দিল। আমি বেলকনিতে গিয়ে সিগারেট জ্বালালাম। সিগারেটের ধোঁয়া আকাশের দিকে ছুড়ে দিচ্ছি আর চাঁদের পাশে থাকা তারাগুলো গুনছি তখনই অহনা পেছনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“সিগারেট টা কি ছাড়তে পারবেন না?” হটাৎ কথাটা শুনে পেছনে তাকিয়ে অহনাকে দেখে বললাম,
“কেন?”
“সিগারেট স্বাস্থ্যের জন্য ভালনা তা জানেনা না?”
“হুম”
“ছেড়ে দেননা তাহলে!”
“ইসস যাও তো! পারবনা।” আমি বিরক্ত হয়ে কথাটা বলতেই অহনা চলে যাচ্ছিল। আমি তাকে পেছন থেকে ডেকে বললাম, “মাকে বলনা যেন!” সে মাথা নেড়ে চলে গেল। আমি আবার ধোঁয়া ছুড়তে লাগলাম। আমি বিছানায় ঘুমোতে গেলাম তখনই অহনা পানির জগটা এনে আমার রুমে রাখতে রাখতে বলল, “আজ আপনার সাথে ঘুমাই?” আমি কথাটা শুনে হকচকিয়ে গেলাম। “ঐ, ফাইজলামি কর? যাও গিয়ে মায়ের সাথে ঘুমাও!” অহনা বলল, “আমি কিন্তু আপনার স্ত্রী!” “তো কি হয়েছে? স্ত্রী হয়েছ দেখে গাছের গোটা হয়ে গেলে নাকি, হ্যাঁ?”
অহনা রাগে চলে গেল। মাঝেমধ্যে অহনার বাচ্চার মতো আচরণ আমার ভালোই লাগে। কখনো কখনো অহনা আমাকে জড়িয়ে ধরে, কখনো আমার জন্য প্রিয় খাবার রান্না করে, বেলকনিতে বসে দীর্ঘক্ষণ গল্প করে, সিগারেট খেতে বারণ করে, আমার স্ত্রী হওয়ার অধিকার জমায়। সামনে যদিও অহনাকে এইসবের জন্য ধমক দিয়ে থাকি কিন্তু গোপনে সেই মুহূর্তগুলো মনে করি আর হাসি। প্রকাশ্যে ভাল না বাসলেও গোপনে বাসি। গোপনে ভালবাসার মজাটাই যে অন্যরকম!
এভাবেই দিন কাটতে লাগলো। আমি অনেক পরিবারে বউ আর শ্বাশুড়ির সম্পর্ক দেখেছি যেখানে শ্বাশুড়ি বউকে গালাগালি করে অথবা বউ শ্বাশুড়িকে দেখতে পারেনা। কিন্তু আমার ঘরের কাহিনীটা ভিন্ন। আমার মা অহনাকে বউ হিসেবে না, মেয়ে হিসেবে ভালোবাসেন। এইতো কয়েকদিন আগের কথা। এক আন্টি আমাদের বাসায় এসেছিলেন। অহনা চা বানিয়ে ঐ আন্টিকে দিয়েছিল। কিন্তু চা তে চিনি কমে যাওয়ায় আন্টি অহনাকে বলেন, “কি গো বউমা, চা ও বানাতে পারনা? চায়ে দেখি চিনি কম! মা কি কিছু শিখিয়ে দেননি? তোমার শ্বাশুড়ি তোমাকে পড়ালেখা করিয়ে বড় ভুল করছেন।” কথাটা শুনে মায়ের খুব রাগ হল।
উনি বললেন, “একদম বাজে কথা বলবেন না। আমি আমার মেয়েকে পড়ালেখা করিয়ে ভুল করছি না। ও আমার ছেলের স্ত্রী হতে পারে কিন্তু আমার জন্য মেয়ের সমান। আর আমি আমার মেয়েকে যতটুকু সম্ভব পড়ালেখা করাব। আপনারা তো ঘরের বউকে কাজের মেয়ে ভাবেন যে কিছু পারুক আর না পারুক রান্না টা যেন করতে পারে।” মা অহনাকে সত্যিই নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসেন। অহনার চুলে তেল মেখে দেন, অহনার যত্ন নেন। অহনাও মাকে যথেষ্ট সম্মান করে।
সামনে অহনার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। দিনরাত পরিশ্রম করে পড়াশোনা করছে অহনা৷ আগে যাও টুকটাক রান্নার কাজে অহনা মাকে সাহায্য করে দিত, কিন্তু মা এখন অহনাকে রান্নাঘরে ঢুকতে একদম বারণ করে দিয়েছেন। অহনা ই শুধু রাত জেগে পড়ে না, মা ও তার সাথে রাত জেগে তার জন্য চা-কফি বানিয়ে দেন। মা আর অহনার ভালবাসা দেখে আমি প্রায়শই অবাক হই। অহনার পরীক্ষা চলাকালীন মা অহনাকে নিয়ে পরীক্ষা হলে যেতেন। অহনা পরীক্ষা দিত আর মা বাহিরে বসে থাকতেন। অনেকেই আমার মাকে অহনার আপন মা মনে করতো কিন্তু তারা খুব অবাক হতো যখন জানতো যে উনি অহনার শ্বাশুড়ি।
পরীক্ষার রিজাল্ট বের হল। খুব ভালো রিজাল্ট অহনার। আমি খুশি, অহনা খুশি কিন্তু আমার মায়ের খুশি যেন তুঙ্গে। মা সারা মহল্লায় চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে জানান দিচ্ছেন “আমার মেয়ে পাশ করেছে।” মায়ের এমন খুশি আগে কখনো দেখিনি। আমি অহনার কাছে গিয়ে বললাম, “ধন্যবাদ অহনা, তোমার কারণে আজ আমার মা খুব খুশি।” অহনা আমার হাতটা আলতো করে ধরে বলল, “তাহলে আমাকে কিছু চাইলে দিবেন?” “কি চাই তোমার!” “আপনি প্লিজ সিগারেট খাওয়াটা ছেড়ে দিন!”