একজোড়া স্যান্ডেল কিংবা একটি প্রেমের গল্প

একজোড়া স্যান্ডেল কিংবা একটি প্রেমের গল্প

পর্দার ওপাশে মা কান পেতে আছেন এটা বুঝতে পেরে ইচ্ছা করেই আমি গলা খাদে নামানোর ভান করে (আসলে গলা খাদে নামবে না, মা’র কান পর্যন্ত কথাগুলি পৌঁছাবে) শওকত ভাইকে বললাম, “আপনাকে কেউ কখনো প্রোপোজ করেছে?”

শওকত ভাই তখন আমাকে নেসলার সল্যুশনের রিএকশন বুঝানোর চেষ্টা করছেন। হঠাৎ এই প্রশ্নে তিনি ভয়ংকর রকমের চমকে গেলেন। শুধু চমকে গেলে ঠিক ছিল, লজ্জায় তার কান লাল হয়ে গেল। তিনি ঢোঁক গিলে বললেন, “কী বললে?” আমি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে মনে মনে বললাম, “কী বলেছি সেইটা শুনেই তো আপনার কান মুলার মতো লাল হয়ে গিয়েছে, আবার জিজ্ঞেস করেন কেন?” মুখে বললাম, “কিছু না, চলেন পড়ি।” শওকত ভাই আর স্বাভাবিক হতে পারলেন না, যতক্ষণ পড়ালেন মাথা নিচু করে পড়ালেন, এরপর মাথা নিচু করেই বের হয়ে গেলেন।

উনি চলে যাওয়ার পর আমি নখে নেইলপলিশ লাগাতে বসলাম। আমি জানি কৌতূহল আর রাগে মায়ের পেট ফেটে যাচ্ছে কিন্তু এখন ভুলেও তার আশেপাশে যাওয়া যাবে না। কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে মা আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করবেন কিন্তু সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করতে পারবেন না কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি ধরা পড়ে যাবেন যে তিনি লুকিয়ে কথা শুনছিলেন। মায়ের ধারণা আমি শওকত ভাইয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। তাই তিনি আমার ওপর গোয়েন্দাগিরি চালাচ্ছিলেন। আমি তাঁর সন্দেহের আগুনে খাঁটি গাওয়া ঘি ঢেলে দিয়েছি। মায়ের সন্দেহ অমূলক না। গত চার মাস ধরে শওকত ভাই আমাকে কেমিস্ট্রি পড়ান। গত চার মাস ধরে আমি উনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। শওকত ভাই ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়েন। এপ্লাইড কেমিস্ট্রি। গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জ। ফ্যামিলির অবস্থা সুবিধার না। নিজের পড়ার খরচ যোগাড় করেন টিউশনি করে। আমাকে তিনি সপ্তাহে তিনদিন পড়ান; রবি, মঙ্গল, বৃহস্পতি।

শওকত ভাই আমাদের বাসায় প্রথমদিন এসেও ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছিলেন। তাঁকে ড্রয়িংরুমে বসতে বলে বুয়া গেছে উপরে মা’কে খবর দিতে। আমি আর মা নিচে নেমে দেখি, শওকত ভাই স্যান্ডেল হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। বাসার বাইরে স্যান্ডেল রেখে আসার সিস্টেম নেই। ভেতরের কার্পেট দেখে যে কেউ বুঝবে, এই কার্পেট যথেষ্ট দামি। শওকত ভাই সেই কার্পেটে স্যান্ডেল পরে দাঁড়ানোর সাহস পাননি। তাই তিনি স্যান্ডেল হাতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মা উনাকে বললেন, “দাঁড়িয়ে আছো কেন বাবা? বসো! তোমাকে তুমি করেই বললাম, কিছু মনে করো না!” শওকত ভাই হড়বড় করে বললেন, “না খালাম্মা, কোনো সমস্যা নেই, ঠিক আছে।” স্যান্ডেল হাতে বসে তিনি সুবিধা করতে পারবেন না, এইজন্যই তিনি দাঁড়িয়ে আছেন, এটা চিন্তা করেই আমার পেট গুলিয়ে হাসি আসছে কিন্তু এখানে হেসে ফেলা ঠিক হবে না,পরে মা’র কাছে ঝাড়ি খেতে হবে। নতুন প্রাইভেট টিউটরের সামনে হিহি করে হেসে ফেলার কারণে মা’র কাছে ঝাড়ি খাওয়া কোনো কাজের কথা না।

কথাবার্তা সব বলাই ছিল, শওকত ভাই সেদিনই আমাকে পড়াবেন। স্যান্ডেল হাতে করে দোতলায় পড়ার রুমে যাওয়া যায় না। মা উঠে যাওয়ার পর আমি উনাকে বললাম, “আপনি আমার কাছে স্যান্ডেল দিন, আমি জায়গামতো রেখে দিচ্ছি।” উনি আমতা আমতা করে বললেন, “ইয়ে, আমাকে জায়গাটা দেখিয়ে দিলে হতো না, আমি নিজেই রেখে আসতাম!” আমি কঠিন গলায় বললাম, “আমি আপনার স্যান্ডেল নিয়ে ভাগবো না।” শওকত ভাই বিনা বাক্য ব্যয়ে আমার হাতে স্যান্ডেল দিলেন। স্যান্ডেল র্যাকে উঠিয়ে রাখতে গিয়ে আমি প্রথম বুঝতে পারলাম, কেন উনি আমার হাতে স্যান্ডেল দিতে চাননি। এতো জীর্ণদশার স্যান্ডেলও মানুষ পরে!

সেদিন পড়াতে পড়াতে রাত হয়ে গেল। প্রথমদিন একটা মানুষ আসছে, আমার মা তাকে খাওয়ার টেবিলে বসালেন। শওকত ভাই কিছুতেই খাবেন না, আমার মাও নাছোড়বান্দা। তিনি মানুষকে খাওয়াতে ভালবাসেন। শওকত ভাই হার মানলেন। বেসিনে হাত ধুতে গিয়ে তিনি কিছুক্ষণ চেষ্টা করলেন ট্যাপ ছাড়ার কিন্তু জুৎ করতে পারলেন না। গুঁতাগুঁতি করতে গিয়ে হঠাৎ ট্যাপ খুলে পানির ঝাপটা এসে উনাকে ভিজিয়ে দিল। মা যতোই বলেন, কিছু হয়নি, উনি ততোই লজ্জায় মাথা আরো নিচু করেন।

উনি যে একটা লজ্জাবতী লতা, সেইটা আমি বুঝতে পারলাম এক সপ্তাহ পড়ার পরই। পড়ানোর সময় উনি সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকান না। কলম এগিয়ে দেয়ার সময় ভুলেও যদি হাতে হাত লেগে যায়, উনি দুইশ বিশ ভোল্টের শক খাবার মতো ভাব করে হাত সরিয়ে নেন। উনি চান আমাকে ননস্টপ পড়াতে,আমি নানা প্রশ্ন করে উনাকে ত্যক্ত করি। উনি চান প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে পড়ার দিকে নিতে, আমার উনার সাথে গল্প করতে ভালো লাগে। উনি গল্প করতে পারেন না। দুই একটা কথা বলে শামুকের মতো নিজের খোলসের ভেতরে ঢুকে যান।

আমি এই শওকত ভাইয়ের প্রেমে পড়লাম। আমি ভেবেছি একদিন কৌশলে উনাকে বলবো কিন্তু আমার লজ্জা লাগে। আমি ঠিক করেছি কেমিস্ট্রি বইয়ের ভেতরে উনার নাম লিখে রাখবো, তার পাশে লাল কালি দিয়ে একটা হার্ট এঁকে দিবো। এইভাবে প্রেম নিবেদনের পদ্ধতি অত্যন্ত সস্তা কিন্তু শওকত ভাই একজন বুদ্ধিহীন মানুষ, অন্য কোনো উপায়ে উনাকে বললে উনি কিছুই না বুঝে হাঁ করে তাকিয়ে থাকবেন। একবার ভেবেছিলাম চিঠি লিখবো, কাগজ নিয়ে বসে থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দিয়েছি কিন্তু কিছুই লিখতে পারিনি। আমার এইচএসসি পরীক্ষা সামনের মাসে, সিলেবাস কমপ্লিট। এরমধ্যে মা আমাকে সন্দেহ করেছেন কিন্তু হাতে নাতে কোনো প্রমাণ পাননি বলে কিছু বলতে পারেননি। আমিও শওকত ভাইকে কিছু বলতে পারিনি কিন্তু আমি উনাকে আরো বেশি ভালোবেসে ফেলেছি। মাঝে মাঝে আমার ভয়ংকর কষ্ট হয়, তখন আমি বাথরুমের দরজা বন্ধ করে কাঁদি। কেন উনি এমন? কেন উনি কিচ্ছু বোঝেন না?

শওকত ভাই আমাকে আর পড়াবেন না। গ্র্যাজুয়েশন শেষে উনি মোটামুটি ভালো বেতনের চাকরি পেয়ে গেছেন, সেখানে আপাতত জয়েন করবেন। আজকে উনি বিদায় নেবেন। আমাকে একগাদা উপদেশ দিলেন, এই পড়বে, ওই পড়বে, পরীক্ষার সময় নার্ভাস হবে না, এইসব হাবিজাবি। উপদেশ বর্ষণ শেষে আমি প্রথমবারের মতো নিজে থেকে উনার হাত ধরলাম। উনি আবারো দুইশ বিশ ভোল্টের ইলেক্ট্রিক শক খেয়ে হাত সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলেন, আমি ছাড়লাম না; শক্ত করে ধরে থাকলাম।

উনার হাতে একটা খাম দিয়ে বললাম, “এখানে আমার জমানো কিছু টাকা আছে। আপনি এটা দিয়ে একজোড়া জুতা কিনবেন। নিজের স্যান্ডেলের ছিরি কী হয়েছে তাকিয়ে দেখেছেন কোনোদিন? অফিসে প্রথমদিন ওই স্যান্ডেল পরে গেলে দারোয়ান ঢুকতে দিবে না।” শওকত ভাই কিছু একটা বলতে গিয়ে আটকে গেলেন। চুপচাপ মাথা নিচু করে সম্মতি দিলেন। আমি উনাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। উনি চলে যাচ্ছেন, পেছন থেকে ডেকে বললাম, “শুনুন!” উনি ঘুরে তাকালেন। “আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করবো।” উনি কি একটু হেসে মাথা নাড়লেন? জানি না, ঝাপসা চোখে আমি দেখতে পাইনি।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত