রুমের দরজায় টোকা মেড়ে বলছে — মে আই কাম ইন স্যার।একটা মেয়েলি কন্ঠ,আমি বিছানা থেকে একটু উঠে বললাম, — শিওর, আসুন।
ভেতরে এক সুদর্শন রমনীর আগমন।আমি উঠে বসলাম।গায়ের টিশার্ট টা ঠিক করলাম।
— গুড মর্নিং মিঃ জামান
— গুড মর্নিং মিস…
— সোমা,
— জ্বী বলুন।
— জ্বী স্যার আমি হোটেলের ম্যানেজ মেন্টের দায়িত্বে আছি।আপনি আমাদের হোটেলে নতুন তাই খোজ নিতে এলাম।কোন সমস্যা আছে কি না।বলতে বলতে, স্যার বসতে পারি?
— হ্যা বসুন।
— তো স্যার অনেক বছর পরে দেশে এসেছেন? রুম বুকিং এর সময় আপনার বন্ধু বলেছিল।
— হ্যা তা প্রায় দশ বছর হবে।
আমি খেয়াল করলাম মেয়েটার শরীর থেকে চড়া পারফিউমের গন্ধ আসছে।এমন ভাবে আট- শাট পোশাক পড়ে আছে যে শরীরের প্রতি টা পয়েন্টের আবেদন ঝুকে আসছে।।কথার ফাকে একটু ইশারা করে বল্লো আমাদের হোটেলে সব ব্যাবস্থা আছে, কোন কিছুর দরকার হলে বলুন, আমরা এ্যরেঞ্জ করব।
ইংগিত পুর্ন কথায় আমার ভীষন হাসি পেলো।খুব গম্ভীর ভাবে মিসঃ সোমার দিকে তাকিয়ে আমি হাসি দিলাম।তারপর মৃদু হাসি দিয়ে বল্লাম — থ্যাংকু, দরকার হলে জানাবো।তারপর মিসঃসোমা চলে গেলেন।বাংলাদেশে আসার পরে আমার ভীষন ক্লান্ত লাগছে।আসলে দেশের একটা টান ই আলাদা থাকে।মনে হচ্ছে কত দিন পর আমি ঘুমাচ্ছি।নাহ এখন আর ঘুম আসছে না।জানালার পাশের পর্দাটা সরিয়ে একটু বাইরে দেখার চেস্টা করলাম।সেই পথ….. এই পথে কেটে গেছে আমার কত শত ঘন্টা,কত পথ ক্লান্ত হয়ে ঘুড়েছে। পকেটে পাচ টাকার নোট নিয়ে হেটে হেটে মার্কেটিং এর কাজ করেছি একটা ফুড এন্ড বেভারিজ কোম্পানির।নস্টালজিয়ায় মন ভরে যাচ্ছিল, এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো।
কলটা রিসিভ করতেই দেখি, বন্ধু সফিক
—- হ্যালো, কি করছিস?
— এই কি আর করা, রেস্ট করছি।
— আচ্ছা বিকেলে আমাদের একটা মিটিং রয়েছে নতুন যে গার্মেন্টস টা নিচ্ছিস ওটার, তোকে তো থাকতে ই হবে।
—- হা, থাকব আমি।এই সব কাজের জন্যই তো দেশে আসা।
—- হ্যা তোর সেক্রেটারি থাকছে হোটেলে,কিছু দরকার পড়লে ফোন দিস ওকে।আর কার,ড্রাইভার সবই আছে ওখানে।বের হবি কোথাও?
—- হা ওদের নাম্বার গুলো মনে হয় আমার ডায়রিতে নোট করে দিয়েছিলি।নাহ, আপাতত কোথাও বের হবো না।আচ্ছা নতুন গ্রুপ ওফ কোম্পানির কাগজ, পত্র গুলো নিয়ে তো বসতে হবে।
—- হা, আজ মিটিং টা শেষ হোক।রাতে সব তোর রুমে দিয়ে আসব,নিজে চেক করে নিস।পরে কাল ওই অফিসে বসা যাবে।
কথা শেষ করে শাওয়ার নেয়ার কথা মনে পড়ে গেলো।ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে আয়নার সামনে দাড়ালাম।হঠাত মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে।ছোট বেলায় মা বলতেন —- বাপ আমার লেখা পড়া শিখে ম্যাজিস্ট্রেট হবে।খেতে বসলে মা তাই আমাকে সব সময় বেশি বেশি খাওয়াতেন।খেতে না চাইলেও মা বলতো বেশি বেশি না খেলে তোর মাথার ব্রেন কমে যাবে।সেই সময় মা ক্লাশ ফাইভ পর্যন্ত পড়েছিলেন।কিন্তু লেখা পড়ার প্রতি প্রচুর আগ্রহ ছিল।চুলায় কোন কাগজ জ্বাল ধরানোর জন্য পেলে মা তা আগে পড়তেন।মা ছোট বেলায় আমাকে ফুল আকা শিখাতেন।দারুন দারুন সেলাই করতেন।পারলে আমার শার্টের পকেটে ও ফুল সেলাই করে দিতেন।বড্ড পাগলামী ছিল মায়ের আমাকে নিয়ে।বাবা একটা সরকারী অফিসে হেড ক্লার্ক ছিলেন।আমার আর কোন ভাই, বোন ছিল না।কেন ছিল না মাকে মাঝে মাঝে প্রশ্ন করতাম,কিন্তু মা তখন বলতো তুই আমার সাত রাজার ধন এক মানিক তাই অন্য ভাই বোন নেই।
বাবা মারা যায় তখন আমি কেবল কলেজে ভর্তি হয়েছি।কেমন জানি সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেলো।মা আর আগের মত হাসতেন না।গায়ে সাদা শাড়ী,মাঝে মাঝে মনে হত মাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কাদি।কিন্তু পারতাম না।এই ঢাকা শহরের এক ছোট্ট ঘরে থাকতাম আমি আর মা।হ্যা কি জানি নাম জায়গাটার ,,,,, জামতলা।জামতলার বাড়িতে দেয়াল এত ঝক ঝকে ছিল না।স্যাত স্যাতে ছিল।একটা টেবিল ফ্যান ছিল আমার রুমে।মায়ের রুমে ছিল একটা সিলিং ফ্যান।লোড সেডিং এর সময় মা তার হাত পাখা নিয়ে আমার কাছে আসত আর বসে বসে বাতাস করত।সময় কত দ্রুত চলে যায়।ও মাঝে মাঝে কিন্তু মায়ের মত আর একজন ও আমাকে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করত!! উম রিক্তা, হ্যা আমার ক্লাশ মেইট।
যাক এই এসি রুমে বসে ও আজ ও আমি মায়ের হাত পাখা কে বড্ড মিস করি।খুব যেতে ইচ্ছে করছে সেই জামতলার বাসায়।এলোমেলো সব কথা ভাবতে ভাবতে আমি মোটামুটি নিজের কাপড়, চোপড় পরে নিয়েছি।এমন সময় আবার রুমে টোকা, — yes coming
—- sir, room service.
— ok
—– sir, will u take your lunch in room or outside?
—- হা হা বাংলায় বলুন মিঃ। আমি বাংলা ভাল জানি।তবে স্টুডেন্ট ছিলাম ইংলিশ সাহিত্যের।
আমি আসিফ জামান, ইংলিশ সাহিত্যের ছাত্র হয়ে ও মার্কেটিং এর কাজ করেছি।প্রথম মাসের বেতনটা যখন মায়ের হাতে তুলে দিয়েছিলাম, মা বলেছিল, তুই না ম্যাজিস্ট্রেট হবি বলছিলাম,এখন কি হইলি।সে দিন আমি মায়ের চোখে পানি দেখেছিলাম,কিছুই বলিনি শুধু মায়ের গলাটা জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম, এত ভেবোনা মা — হবো একদিন।
—-আর কবে হবি!! সকাল বেলা কত্ত বড় একটা ভারী ব্যাগ নিয়ে বাইরে যাস।যখন ফিরিস মুখটা শুকিয়ে কাট হয়ে থাকে।
মায়ের আশা রাখতে পারিনি তবু হাল ছাড়িনি।মায়ের মত আর একজন আমাকে নিয়ে যথেস্ট স্বপ্ন দেখতো, রিক্তা,ক্লাশের সব থেকে আলাদা একটা মেয়ে।কলেজের সবাই মোটামুটি পছন্দ করে।ইয়ার ফাইনালে ঠিক আমার পেছনে ওর পরীক্ষার ছিট পড়েছিল।পেছন থেকে কলমের খোঁচা মেড়ে ফিস ফিস করে বলছে —- এই, এইইইইই
আমি একটু ঘাড় নেড়ে পেছনে তাকিয়ে, বললাম —কি?
—-চার নাম্বারের উত্তরটা পারছিনা।তোমার খাতাটা একটু ডান দিকে ঘুড়িয়ে লিখলেই দেখতে পাব।
মনে মনে ভাবলাম,কি সিরিয়াস মেয়েরে বাবা, আমি যে উত্তরটা লিখেছি পেছন দিক থেকেই খেয়াল করছে,শকুনের চোখ বাব্বা।এটা আমি বলেই ফেললাম।মেয়েটা কটমট করে তাকালো, তবু আমি খাতাটা এমন ভাবে ধরলাম যেন পেছন দিক থেকে দেখতে পায়।সব কিছুই ঠিক ছিল, প্রবলেম হলো যতীন স্যারের।স্যার বিষয়টা বুঝে ফেল্লেন।চশমার ফাক দিয়ে বড় দুটো চোখ বের করে তাকিয়ে আমার খাতাটা নিয়ে গেলেন।পরে রিক্তার খাতাও নিয়ে গেলেন ,তারপর আমাদের দুজন কে ক্লাশ রুম থেকে বের করে দিলেন।রুম থেকে বের হবার পর ইচ্ছা করছিল রিক্তা কে ঠাশ করে একটা থাপ্পড় দেই।কিন্তু মেয়ে মানুষ তাই কিছু বল্লামনা,যেই আমি ওর দিকে চোখ গুলো বড় করে তাকিয়েছি ওমনি, আমার দিকে তাকিয়ে ঝাড়ি মেরে বল্লো, একটু সাবধানে করতে পারলেন না!! এত হাদারাম কেন আপনি??
—- আরে আজব মেয়েতো তুমি? আমি তোমার জন্য নিজের অনিস্ট করলাম আর তুমি কোন কৃতজ্ঞতা বোধ নেই।
—- আমি কি বলেছিলাম, স্যারের সামনে খাতাটা মেলে ধরতে!!
সেই শুরু, তারপর একদিন ক্লাশে যতিন স্যার, আমাদের দু জন কে দাড় করালো, হাস্য কর একটা ব্যাপার ছিল সবার কাছে।বল্লো,সফিক, তুমি একটা মেয়ের কাছে ধরা খেয়ে গেলে।কিছু শিখো বুচ্ছো তোমার চেয়ে কিন্তু রিক্তা ভাল মার্কস পেয়েছে আর তুমি পাচ মার্কের জন্য ফেইল করেছো।সেই দিনটা, ছিল আমার জীবনের আলাদা দিন।কেমন করেই জানি রিক্তার সাথে আমার প্রেম বলো ভালবাসা বলো হয়ে গেলো।ফাইনালের পরে একটা চাকরী ভীষন দরকার ছিল।তাই উঠে পরে চাকরী খুচ্ছিলাম।ও দিকে রিক্তার বাসায় বিয়ের জন্য ঝামেলা করছে।কিন্তু আমি তো জাম তলার সফিক, বেকার সফিকুজ্জামান ওরফে জামান সাহেব,কোন বাবা, মা ই তার মেয়ে কে এমন ছেলের কাছে বিয়ে দিবে না।ন্যাচারাল,,,, তাই রিক্তাকে নিয়ে আমি কাজী অফিসে গিয়ে বিয়েটা সেরে নিলাম।তেমন কিছু দিতে পারিনি।বন্ধুরা বলেছিল বেলী ফুলের মালা নাকি মেয়েরা পছন্দ করে তাই রিক্তার জন্য কিছু বেলী ফুলের মালা কিনে নিয়েছিলাম।রিক্তা ফুল গুলো ওর চুলে পড়েছিল।একটা শাড়ি পরেছিল সুতির।আমার কাছে মনে হয়েছিল কোন প্রতিমা দাঁড়িয়ে আমার সামনে।জাম তলার বাসায় তখন আমরা দুই জন সদস্য,রিক্তা আর আমি।প্রেমিকা যখন নব বধুর রুপে নিজের ঘরে পাবেন তখন মনে হবে, রাজ্যের সুখী মানুষটা আপনি।রিক্তা কে যখন প্রথম জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছি,তখন মনে হয়েছে আমি ওর মাঝে বিলিন হয়ে গেছি।আর যাই হোক গরমে তো আর আমার মরতে হবে না।মায়ের সেই হাত পাখা দিয়ে বাতাস করার মত একজন পেলাম বাসায়।অনেক ভালবাসা আর মমতায় ঘিড়ে রাখবে আমায়।দিন গুলো কিন্তু আমাদের খারাপ কাটেনি জামতলার বাসায়।
রিক্তা কিন্তু ভীষন আদুরে ছিল।স্বভাবটা ও সবসময় মিস্টি মিস্টি ভাব নিয়ে চলতো।মাঝে মাখে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মন হত মেয়েটা কত আপন করে নিয়েছে আমাকে, ওর বাবা,মা স্ট্যাটাস সব ভুলে কেমন করে শুধু আমাকে নিয়ে দিন কাটিয়ে দিচ্ছে।প্রথম আমার মাসিক বেতন ছিল ১২ হাজার টাকা।মার্কেটিং এর কাজ করি বলে মাঝে মাঝে কিছু বাড়তি টাকা পাওয়া যেত।তা দিয়ে মাঝে মাঝে দু জন ছুটির দিনে বাইরে ঘুড়তে যেতাম।বন্ধুরা বলতো কিছু টাকা সঞ্চয় করিস।বিপদে কাজে লাগবে।অনেক ভেবে, অনেক কস্ট করে মাসিক পাঁচশত টাকা জমাতাম এ্যাকাউন্টে।
আবার সেই রুমের টোকা — ইয়েস কামিং।
—- স্যার, কোথাও কি বের হবেন এখন?
—- উম জানাব পরে।
আমার গম্ভীর ভাব দেখে ড্রাইভার আর কথা বাড়ালো না।চলে গেল…. রুমে পুরোটাই সিগারেটের গন্ধে গুমুট হয়ে আছে।একটু বিশুদ্ধ অক্সিজেনের খোজে বাইরে যাওয়া উচিত।ভাবছি লাঞ্চটা সেরে তারপর যাব।হোটেলের ওয়েটার রা যখন খাবার নিয়ে এল…. কিছু সময় আমি মাকে মিস করলাম।পরীক্ষার সময় মা আমার জন্য শিং মাছের ঝোল রান্না করত।আর পাতে তুলে দিয়ে বলত বেশি করে খা মাথা ঠান্ডা থাকবে পরীক্ষার হলে।কত রাত আমি গরমে অতিস্ট হয়ে মায়ের ঘরে গিয়ে মায়ের সাথে ঘুমিয়েছি।মা সারা রাত হাত পাখা দিয়ে আমায় বাতাস করত।নাহ মায়ের কথা মনে হতেই এখন আর কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না।এই দশ বছরে মাকে হাজার বার মনে পড়েছে কিন্তু এতটা খারাপ লাগে নি।মা যে দিন মারা যায় সে দিন আমি রিক্তার বুকে মুখ লুকিয়ে অনেক কেদেছিলাম।কিন্তু কি অবাক কান্ড, ওর বুকের গন্ধটা ও ঠিক মায়ের বুকের সেই মমতা মাখা গন্ধের মতই ছিল।
এলো মেলো চিন্তা করতে করতে আমি সামান্য একটু খেয়ে নিলাম।বিকেলে একটা কনফ্যারেন্সে এটেন্ড করতে হবে।তাই একটু রেস্ট নিয়ে তৈরি হয়ে নিলাম।আমি মিঃ সফিকুজ্জামান… এই শহরে জুতার তলা খয়ে যাওয়া অংশ তালি দিয়ে পথে পথে ঘুড়েছি।অফিস করার মত ভাল কাপড় ছিল না।সেই বার বিয়ের এক বছর পরে রিক্তার বাবা,মা আমাদের দেখতে এলেন।তখন আমার জন্য দুটো শার্ট পিচ আর দুটো প্যান্ট পিচ এনেছিলেন।কেন জানি ভীষন অভিমান কাজ করেছিল তাই সে গুলো আর রাখা হল না।জানেন তো গরীবের আর কিছু না থাকুক আত্মসন্মান বোধটা প্রবল থাকে।
আজ আমি দামী গাড়ীতে শহরের বড় কোন হোটেলে মিটিং এ জয়েন করতে যাচ্ছি।সময় কতটা বদলে যায়,সাথে মানুষ ও।আমাদের জামতলার বাসায় কোন কলিং বেল ছিল না।তাই কেউ আসলে সহজে বুঝতে পারত না রিক্তা।ছোট্ট একটা টিভি কেনার জন্য অনেক বার বলেছে।আমি বলতাম —এবারের সেলস কমিশনটা যদি ভাল আসে তবে কিনে দিব।হা দিয়েছিলাম তবে সাদা কালো টিভি।বড্ড বেমানান ছিল রিক্তার সাথে ওই টিভিটা কিন্তু ও কিছু বলতো না।ছুটির দিনে যখন ও গুটিশুটি মেরে আমার বুকের মধ্যে মুখটা লুকিয়ে ঘুমিয়ে থাকত তখন মনে হত কে বলেছে আমি বার হাজার টাকা বেতনের সেলস এক্সজিকিটিভ!! আমি হলাম প্রেম দেবতা।যখন ভাবতাম রিক্তাকে একটু কাছে টানব ঠিক তখন ই কাজের বুয়া এসে দরজায় ধুরুম ধারুম শব্দ করতে থাকত।রিক্তা তখন একটু মুচকি হেসে উঠে চলে যেত।রিক্তা পরে বুয়াকে বলে দিল, একটু বেলা করে কাজে আসতে।ছুটির দিন গুলো ছিল আমাদের একান্ত ভালবাসার দিন।হাজার স্বপ্ন হাজার কথা।ছুটির দিনে রিক্তা শাড়ী পরত।ও জানতো ওর শাড়ি পড়া আমার ভীষন ভাল লাগে।আর ঘুমের সময় ঠিক আমি ওর শাড়ির ফাকা দিয়ে হাতটা ওর পেটে রেখে ঘুমাতাম।
যাক প্রথম দিনে মিটিংটা সাক্সেস ছিল।
মিটিং শেষে বন্ধু বেশ জোড় করছে ওর বাসায় ডিনারে জয়েন করার জন্য।কিন্তু না করে দিলাম।বল্লাম—— আজ না অন্য কোন দিন।আবার ফিরে এলাম আমার রুমে।ফ্রেশ হয়ে পেপার,ম্যাগাজিনে চোখ বুলাচ্ছি।আবার দরজায় টোকা —- ইয়েস কামিং।
—-স্যার,আমার ডিউটি শেষ আপনি আমাদে সম্মানিত অথিতি।কোন দরকার পরলে রুমে তো বাটন তো রয়েছেই কাজে লাগাবেন।
— সমস্যা নেই,….
—- স্যার কোন সমস্যা নেই তো?
এবার আমি খুব রুড় ভাবে তাকালাম মিস ঃ সোমা, আমি জানি আমার কি দরকার আর কি দরকার নেই।প্রয়োজন পড়লে নিউজার্সি থেকে আমি মেয়ে মানুষ নিয়ে আসতে পারতাম।আপনি কি জানেন বিগত দশ বছরে আমি কোন মেয়ে মানুষের গায়ের গন্ধ অনুভব করিনি। আশা করি আপনি আমাকে এ ব্যাপারে আর বিরক্ত করবেন না।
— সরি স্যার
বলার পরে ও কি জানি বলতে চাচ্ছিল।আমি উঠে বললাম আমি কিছু ফাইল নিয়ে বসব।আপনি যেতে পারেন।
মেয়েটার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো।
কিন্তু আমি অবাক হয়ে গেলাম, একটা ব্যাপারে, দেশটা কত আধুনিক হয়ে গেছে অথবা এটাও বড় বড় ফাইভ স্টার হোটেলের কোন বিজনেস পলিসি।খানিকটা হাসিই পেলো কারন আমার ক্যারিয়ার শুরু কিন্তু মার্কেটিং দিয়ে ই।ক্লাইন্টদের ধরে রাখতে কত ই ফরমুলা এ্যাপ্লাই করছে।যাক কাল সকাল থেকেই আমাকে বেড়িয়ে পরতে হবে।বিদেশে থেকে দেশের ব্যাবসায় প্রতিষ্ঠা পেতে অনেক শ্রম আর মেধার দরকার।তাও যদি আমার বন্ধু না থাকত সাথে তবে আর হয়ত করা হত না।
কেন জানি মাঝ রাতে ঘুমটা ভেংগে গেলো।খুব ইচ্ছে করছে জামতলার বাসায় গিয়ে ঘুমাই।মায়ের মুখটা খুব টানছে।যদি ঘরের পুরনো বাক্স খুজে মায়ের একটা শাড়ী পেতাম!! বেশ ভাল হত।সারাদিন মায়ের গায়ের গন্ধ নিতাম।
ও রিক্তা!! কিছু কি আছে ওর এখনো জামতলার বাসায়! জানি না।আমাদের বিয়ের দুই বছরের মাথায় রিক্তা কনসিভ করলো।অফিস থেকে ফেরার পরে আমাকে পেছন দিক থেকে গলাটা জড়িয়ে ধরলো।আমি তো অবাক,ভাবলাম চাকরি পেয়েছে মনে হয়।কারন ও প্রায় ই পেপারের বিজ্ঞাপন দেখে দেখে এ্যাপ্লাই করত,ইন্টারভিউ ও দিয়েছে কয়েকটা।আমি ওর হাত ছাড়িয়ে বললাম,কি হয়েছে বলো?
ওর মুখটা কানের কাছে এনে বল্লো —- তুমি বাবা হবে।বলে আবার গলাটা জড়িয়ে ধরলো।
আমি একটু ম্লান হাসি হেসে বললাম ও আচ্ছা।কথাটায় ও ভীষন কস্ট পেয়েছিল।ওর আসা ছিল আমি ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করব।কিন্তু তা করিনি।এ বিষয়টা নিয়ে রিক্তার সাথে আমার বেশ তর্ক শুরু হয়ে গেলো।ওকে বার বার বোঝাতে চেয়েছি, যেখানে আমি তোমার ছোট ছোট শখ গুলোই পুরন করতে পারি না,সেখানে একটা বাচ্চা মেইন্টেইন কি করে করব? দুইটা বছর সময় দাও আমাকে প্লিজ।সে দিন রাগ করে কিছুই খেলো না,ঘুমিয়ে ছিল।
কয়েকদিন ধরেই ও আমার সাথে ঠিক মত কথা বলে না।অফিসে এক বন্ধুর কাছে জানতে পারলাম।এবশন করাতে হলে তাড়াতাড়ি ই করতে হয়।নইলে সমস্যা হবে।ওনার কাছ থেকে একটা হাসপাতালের ঠিকানা নিলাম।কোন এক শুক্রবারে রিক্তাকে বলতে গেলে জোড় করেই নিয়ে গেলাম।নার্স এসে বল্লো চার মাসের কাছাকাছি বাচ্চা,নস্ট যখন করবেন ই এত দেরী তে কেন আসলেন?
আমি মাথা নীচু করে বসে ছিলাম।হ্যা অপরাধ বোধ কাজ করছিল কিন্তু আমি নিরুপায়।বাসায় ফেরার পরে রিক্তা একবার ও আমার মুখের দিকে তাকায় নি।কত বার ডাকলাম খাবার খাওয়ার জন্য কিন্তু পারলাম না খাওয়াতে।পরের দিন যখন অফিস থেকে ফিরি তখন দেখি বিছানা রক্তে ভরে আছে।আমি কিছুটা ভয় পেয়ে পাশের বাসার এক ভাবী কে ঢেকে আনি।উনি বললেন হাসপাতালে নিয়ে যেতে।পকেটে তখন মাত্র আমার পাচশ টাকা।কি করব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।একটা বন্ধু কে ফোন দিলাম টাকার জন্য।ও বল্লো কাল মেনেজ করতে পারবে আজ না।এর মাঝে রিক্তা আমাকে ডাকতে শুরু করল।কানের দুল ছিল ওর গোল্ডের ওটা হাতে দিয়ে বল্লো এটা দিয়ে টাকা ম্যানেজ কর।আমি নির্লজের মত তাই করলাম। কারন তখন আমার রিক্তাকে বাচানোটাই জরুরী ছিল।এই ঘটনার পর থেকে রিক্তা আর আমার সাথে ঠিক মত কথা বলতো না।এক দিন রাতে খুব কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে শুইলাম।একটু কাছে টানতে চাইলাম।রিক্তা ঘাড় বাকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বল্লো,যে ছেলে সন্তান জন্ম দিতে
.পারে না তার বউয়ের শরীর উপভোগ করা ও মানায় না।উফফফ মনে হচ্ছিল আমি পুরুষ না কাপুরুষ।এভাবে মাসের পর মাস রিক্তা আমাকে তিরস্কার করেছে ওর ভালবাসা থেকে।একদিন বলেই ফেল্লো স্বামিত্ব দেখাচ্চো!! মুরোদ নেই তো এক পয়সার ও।আমাদের মাঝে দুরত্ব বাড়তে থাকে দিন দিন।
সে দিন আমাকে রিক্তা বল্লো তুমি চাকরির পাশা পাশি ব্যাবসা ও তো করতে পার,অনেকে ই তো করে।আর তারা ভাল ও আছে।কে যে কি ভাবে ব্যাবসার ভুত মাথায় ঢুকালো রিক্তা এখন বাসায় এলে ই এই নিয়ে আলোচনা জুড়ে দেয়।আমি ও ভাবলাম যদি করি খারাপ তো না।রিক্তা এর পর দুটো টিউশনি নেয়।ভাল টাকা দেয়।দুইটায় দশ হাজারের মত।কারন ও ইংলিশে ভাল ছিল তাই ইংলিশ মিডিয়ামের বাচ্চাদের পড়াত।ওর এক ছাত্রের বাবা বিশাল বড় ব্যাবসায়ী।ওনাদের একটা হাউজিং কম্পানি আছে।মেলায় কয়েকজন মেয়ে খুজতেছে একটু স্মার্ট ও লুকেটিভ।রিক্তা কে বলেছে কেউ পরিচিত থাকলে তাকে জানাতে।সাত দিন মেলায় ডিউটি সাত হাজার টাকা দিবে।আমি বল্লাম তুমি ই তো করতে পার।প্রথমে ও রাজী হলো না।পরে আমি বললাম দেখো তোমার একটু অভিজ্জগতা ও হবে সাথে একটু চেইঞ্জ ও আসবে।হুম রিক্তা এখন ভীষন ব্যাস্ত,কাজ আর কাজ।দেখে ভাল ই লাগছে মানষিক যন্ত্রনা হয়ত ভুলে উঠতে পেরেছে।মজার ব্যাপার ছিল ওর মেলার স্টলে কাজ করার সময় মাঝে মাঝে কিছু খাবার টিস্যুতে পেচিয়ে আমার জন্য নিয়ে আসত।ওর এমন ছেলে মানুষি দেখে আমি ভীষন হাসতাম।
সারা রাত কেন জানি আমার ঘুমটা ঠিক মত হলো না।দশ বছর কি এতটা লম্বা সময় যে সব কিছু ধুসর মনে হয়।যাই হোক আজ আমি সাকসেস আমার লাইফে, আমি মায়ের স্বপ্নের সেই ম্যাজিস্ট্রেট হতে পারিনি তবে সাক্সেস ফুল ব্যাবসায়ী।রিক্তা আমাকে ঠিক ই বুঝতে পারেছিল।তাই সারা দিন মাথায় ব্যাবসার ভুত মাথায় দিয়েছিল।হুম আজ মিটিংটা আমার একটা গ্রুপ ওফ কোম্পানি নিয়ে।আজ আমি স্বার্থক ব্যাবসায় ,শুধু মাকে মিস করছি।প্রথমে আমার কোম্পানীতে সাড়ে তিনশ লোক কাজ করতো |না দেশে আমি সেটেল্ড হবো না।মাঝে মাঝে আসব।নাড়ীর টান হয়ত।এখনো কত কাজ বাকী,এক মাসের টাইম নিয়ে এসেছি,জানি না কতটুকু করতে পারব।আমার সেক্রেটারি এসে বল্লো, আগামি কাল আমার চিটাগাং মিটিং আছে।প্লেনের টিকিট কনফার্ম।হ্যা চিটাগাং….. রিক্তা একবার ওই কোম্পানীর চিটাগাং মেলায় জয়েন করার জন্য রাজী হয়ে গেলো।আমি ও না করিনি।তবে বাসে তুলে দেবার সময় বার বার বলছিল, — আমার অনেক ভয় করছে,তুমি তো যেতে পারতে।আমি বলেছিলাম — ভয়ের কিছু নেই অন্য সবাইতো আছে।আসলে ওই দিনটার পর থেকে ই আমার জীবনের পাতায় লাল কালী দিয়ে লেখা শুরু হলো।রিক্তা ফিরে এসেছিল তবে আমার সেই মিস্টি গায়ের গন্ধ নিয়ে নয়।অন্য কারো হয়ে।ওর স্টুডেন্টের বাবা বিশাল শিল্পপতি কিন্তু তার বউ মারা গেছে অনেক বছর হলো।উনি ই রিক্তাকে কাজের সুযোগ করে দিয়েছিল।জানতাম না তখনো আমার সোহাগ সে কেড়ে নিবে।আমি শুধু হতবাক হয়ে ছিলাম, আমার সেই রিক্তা আজ অন্য কারো।আচ্ছা ওর কি একবার ও মনে হয়নি আমি ওকে ছাড়া কি করে থাকব!! কি করে নিঃশ্বাস নিব।আমারতো ও ছাড়া আর কেউ ছিল না।
পাগলের মত করেছি ফিরিয়ে আনার জন্য।কিন্তু পাইনি খোজ নিয়ে জানতে পারি ওরা হানিমুনে দেশের বাইরে চলে গেছে।তারপর চাকরী টা ছেড়ে দিলাম।কতদিন না খেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুড়েছি মনে নেই।সময় ই মানুষ কে বাচতে শিখায়,আমি ও শিখে গেলাম, রিক্তাকে ছাড়া বাচতে।তারপর একদিন পথে আমার কলেজের বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে গেলো।বিটিভিতে কাজ করে।আমার অবস্থা দেখে হয়ত ওর মায়া হলো।তারপর বিটিভির এক টিম আমেরিকা যাচ্ছে তাদের মাঝে আমার নামটা ঢুকিয়ে দিয়ে দেশ থেকে পাঠিয়ে দিল।আসলে জীবন কখন যে কার দাথে কি ভাবে গেইম খেলবে কেউ জানে না।
আপনাদের কি মনে হয়, আমি এর পর রিক্তার কোন খোজ নিয়েছি??
নাহ নেয়ার প্রয়োজন মনে করিনি।তবে কোথায় জানি একটু হাহাকার টের পেতাম মাঝে মাঝে।অনেক সাধনা, অনেক কস্ট করে প্রতিষ্ঠা পেয়েছি।।মাঝে মাঝে নিজের হাতে মেরে ফেলা সন্তানের মুখটা কল্পনা করি।আহা, যদি একটা সুযোগ দিতাম ওকে আমাদের জীবনে আসতে, তবে হয়ত রিক্তা আমারই থাকত।আমি কাধে নিয়ে ঘুড়ে বেড়াতাম, একটা সাইকেল কিনে দিতাম।প্রতি বিকেলে আমি ওকে নিয়ে রাস্তায় বের হতাম সাইকেল চালানো শিখাতে।সব মিথ্যে সব, রিক্তা আমার না আজ এটা চরম সত্য।আমি চাইনা আজ এই দশ বছর পর ও রিক্তার সাথে আমার দেখা হোক।রিক্তা আমার সেই নতুন বেনারশির মত ভাজ না ভাংগা নতুন বউ।