বাসাটার সামনে এসে মনে হল ফিরে যাই। কি দরকার পুরানো কথা গুলো মনে করে আবার ! পাঁচ বছর এমনিতেও পার হয়ে গেছে। আমার জীবন চলছে আমার মত । নিশাতরাও নিশ্চয়ই ওদের জীবনে যাপন করছে। জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। নিশাতের জন্য যেমন আমার জীবন থেমে থাকে নি, আমার জন্যও নিশ্চয়ই ওর জীবন থেমে থাকে নি। এতো দিনে বিয়েও হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। ঐশীর কি খবর কে জানে! পিচ্চিটা নিশ্চয় অনেক বড় হয়ে গেছে এতো দিনে। আমি ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরতে যাবো তখনই দারোয়ান চাচাকে দেখতে পেলাম। তার চেহারার ভাব দেখেই মনে হল আমাকে চিনে ফেলেছে। আমার আর যাওয়া হল না। উনি এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। এতোদিন পর দেখা।
-কেমুন আছেন ভাইজান?
-এই তো ভাল । আপনি ভাল ?
-সেই যে গেলেন আর আইলেন না?
আমি হাসলাম কেবল। কোন জবাব দিলাম না। অবশ্য জবাব দেওয়ার মত কিছু নেইও। আমি কেন এই বাসা ছেড়ে চলে গেছি দারোয়ান চাচা জানতেন। আমি বললাম
-সবাই ভাল? আঙ্কেল ভাল আছেন?
-আছে। তয় আগের মত তো আর নাই। বয়স হইছে। আমিও বুড়া হইছি। যান যান দেখা কইরা আসেন।
আমি সিড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে উঠতে লাগলাম। বুকের ভেতরে কেমন করতে লাগলো। আগে এই সিড়ি এই রাস্তা দিয়ে কত শত বার যাওয়া আসা করেছি। আর আজকে সব কেমন অপরিচিত লাগছে। কলিংবেল বাজাতে গিয়েও থেমে গেলাম। কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করার পর চাপ দিলাম। দরজা খুলল ঐশী। আমি প্রথমে ওকে ঠিক চিনতেই পারি নি। ঠিক ও নিজেও আমাকে চিনতে পারে নি। কিন্তু যখন চিনতে পারলো চিৎকার করে উঠলো।
-ভাইয়াআআআ! আপনি?
-কেমন আছো ঐশী?
আমাকে দরজাতে দাড় করিয়েই হরবড়িয়ে কত কথা বলতে লাগলো। আমি মনে মনে হাসলাম। মেয়েটা একদম বদলায় নি। আগের মতই ছটফটে রয়ে গেছে। আমাদের কথা শুনে ঐশীর বাবা ঘরে ঢুকলো। আমার দিকে এক ভাবে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময়। সেখানে আমার জন্য রাগ কিংবা তিরস্কার দেখব আশা করেছিলাম কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম চোখের দৃষ্টি নমনীয় হয়ে এল। আমার তাকিয়ে বললেন
-কেমন আছো বাবা?
-আমি ভাল আছি। আপনার শরীর ভাল?
-এই বয়সে আর শরীর! তা তুমি এতো দিন পরে!!
-আসলে অফিসের একটা কাজে এসেছিলাম ঢাকাতে। যাওয়ার সময় ভাবলাম আপনাদের সাথে একটু দেখা করে যাই।
-ভাল করেছো খুব। দুপুরে খেয়ে যাবা কিন্তু। আমি বললাম
-না না আঙ্কেল এতো সময় নেই। আমি একটু পরেই চলে যাবো।
এই কথা বলতেই ঐশীর বাবা আনাকে ধমক লাগিয়ে দিলেন। ঐশী ফিক করে হেসে ফেলল। মুখের কথা না, ঐশীর বাবা যে আসলেই মন থেকে আমাকে দুপুরে খেয়ে যেতে বললেন এটা বুঝতে পেরে কেন জানি ভাল লাগলো। তবে কিছু একটা যেন ঠিক মেলাতে পারছিলাম না। নিশাত কোথায় কথাটা জানতে চাইতে গিয়েও জানতে চাইলাম না। এতো কিছুর পরে এই কথা জানতে চাওয়া ঠিক হবে না।
-কি কর তুমি?
-তেমন কিছুই না। এখনও পড়ছি।
-তাহলে বাসা ভাড়া কিভাবে দিবা? বাসা থেকে আসবে?
একবার মনে হল বলি যে ভাড়া কিভাবে দিবো সেটা আমার ব্যাপার। আপনার বাসা ভাড়া সময় মত পেয়ে গেলেই হল। কিন্তু ঢাকা শহরে বাড়িওয়ালাদের ক্ষেপিয়ে দিতে নেই। আর আমি চিলেকোঠা টা ভাড়া নিতে চাই। তাই যথা সম্ভব নরম গলায় বললাম
-আঙ্কেল টিউশনি করি।
আর কিছু জানতে চাইলেন না। উঠে গেলাম নতুন বাসাতে। সপ্তাহ না ঘুরতেই আমার কাধে নতুন দায়িত্ব পড়লো। বলা হল যে আমাকে বাড়িওয়ালার দুই মেয়েকে পড়াতে হবে। একজন এবার ইন্টার দিবে অন্যজন ফাইভে পড়ে। আমার কোন সমস্যা ছিল না। দুজনকেই পড়ানো শুরু করলাম। বড়জন খুব কম কথা বলতো। সেই তুলনায় ছোট জন এতো কথা বলতো যে আমার মাথা ধরে যেত। নিশাতকে খুব বেশিদিন পড়ানোর সুযোগ পেলাম না। ওর ইন্টার পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। মেয়েটার সাথে আমার খুব বেশি কথাও হত না। কেবল মাঝে মাঝে দেখতাম নিশাত আমার দিকে একভাবে তাকিয়ে আছে। একটা সময় আমি বুঝতে পারলাম যে সেই তাকিয়ে থাকার মধ্যে কিছুটা অস্বাভাবিকত্ব আছে।আমি তবুও নিজেকে খানিকটা গুটিয়ে রাখলাম। সব কিছু সবার জন্য না। আমার আদকে নিশাতের সাথে সম্পর্ক করাটা মোটেই মানায় না।
এভাবে দুই বছর পার হয়ে গেল। নিশাতের সাথে আমার এর মাঝে খুব একটা কথা হয়ে ওঠে নি তবে নিয়ম করেই সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো। আমিও তাকাতাম ওর দিকে। আমাদের চোখে চোখেই কথা হত। যখন ঐশীকে পড়াতে যেতাম আমাদের আসে পাশেই ঘোরাঘুরি করতো। মাঝে ছাদে উঠতো। ওকে জিজ্ঞেস করতাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা কেমন চলছে। ও টুকটাক উত্তর দিত। দিন গুলো ভালই যাচ্ছিলো। কিন্তু সুখের দিন খুব বেশি দিন যায় না। আমারও গেল না। বাড়িওয়ালার বাসায় ডাক পড়লো রাতের বেলা। আমি তখনও কিছুই জানি না। আমাকে দেখেই আঙ্কেল বললেন
-তুমি কালকেই বাসা ছেড়ে দিবা। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। কি এমন হল। আমি কিছু না বুঝতে পেড়ে বললাম
-কি হয়েছে? আমি কি করলাম? আমার কথা শুনে বাড়িওয়ালা আঙ্কেল যেন চিৎকার করে উঠলো।
-কি করেছো তুমি? আমার মেয়ে পটিয়ে এই বাড়ির মালিক হওয়ার স্বপ্ন দেখছো তাই না? তোমাকে তো আমি ভাল ছেলে মনে করেছিলাম, এই হচ্ছে বিশ্বাসের প্রতিদান!! আর খারাপ ভাষায় আমাকে তিরস্কার করতে লাগলো। এতোটা অপমানিত বোধ করলাম যে পারলে তখনই বাসা ছেড়ে চলে যাই। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আমার সাথে কেউ এতো খারাপ ব্যবহার করে নি। রাতের বেলা দরজায় নক পড়লো। জানতাম কে এসেছে। একবার ভাবলাম দরজা না খুলি কিন্তু না খুলে পারলাম না। নিশাত কোন কথা না বলে আমার ঘরে ঢুকলো। ওর চোখ দেখেই মনে হচ্ছিলো কান্না কাটি করেছে। আমার বিছানার উপর বসলো চুপ করে। কিছু সময় আমরা কেউ কোন কথা বললাম না। তারপর আমি বললাম
-এখন বুঝতে পেরেছো তো আমি কেন নিজে এগিয়ে যেতে পারি নি তোমার দিকে। আজকে তোমার বাবার জায়গাতে আমি থাকলে আমিও হয়তো এরকম করতাম। বামুন হয়ে আকাশেত দিকে হাত বাড়ানো ঠিক না।
নিশাত বলল
-আপনি আমাকে ভালবাসেন না?
-ডাজ ইট ম্যাটার?
-ইট ডাজ। আপনি শুধু বলেন আপনি আমাকে ভালবাসেন কি না?
-তুমি এর উত্তর জানো।
-তবুও শুনতে চাই।
-হ্যা বাসি।
নিশাত আর কিছু বলল না। আরও কিছু সময় বসে রইলো। যাওয়ার আগে আরেকটা অদ্ভুদ কাজ করলো। আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। তারপর যেমন হঠাৎ করে ধরেছিলো তেমনি হঠাৎ করেই ছেড়ে দিলো আমাকে। তারপর দরজা দিয়ে বের হয়ে চলে গেল।
পর দিনই আমি বাসা ছেড়ে দেই। তার কিছুদিন পর ঢাকাই ছেড়ে দিলাম। মোবাইল নাম্বার বদলে ফেললাম যাতে নিশাত আমার সাথে আর যোগাযোগ না করতে পারে। তারপর নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। দেখতে দেখতে কিভাবে ৫টা বছর চলে গেল টেরই পাই নি। এর আগেও কয়েকবার কাজের জন্য ঢাকা আসলেও এইবার কেন জানি দেখা করতে মন চাইলো খুব।
খাবার টেবিলে আঙ্কেল অনেক কথা বলছিলেন। আমার কাছে কেন জানি মনে হল তিনি আমার কাছে খানিকটা লজ্জিত হয়ে আছেন। হয়তো ঐদিনের আচরনের জন্য। এমন সময়ে কলিংবেল বেজে উঠলো। ঐশী দ্রুত উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল। আমি বেশ অবাক হলাম নিশাতকে দেখে। আমি ওকে ঠিক আশা করি নি। আমি আসা পির্যন্ত কেউ নিশাতের নাম নেয় নি। আমিও কিছু জানতে চাই নি। ভেবেছিলাম হয়তো ওর বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামীর সাথে থাকে। তবে নিশাতের মুখ দেখে মনে হল ও জানে যে আমি এসেছি। আঙ্কেল নিশাতকে দেখে বললেন
-কিরে তুই এই সময়ে? অফিস থেকে এতো জলদি?
-নিশাত আমার দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল
-ছুটি নিয়েছি।
-আচ্ছা আয় আয়। খেতে বস। দেখ কে এসছে।
নিশাত কিছুই বলল না। আমিও কিছু বলতে পারলাম না। নিশাতের চেহারাটা আরেকটু ম্যাচুউর হয়েছে। কিশোরী ভাব থেকে নারীত্ব ভাবটা যেন আরও একটু বেড়েছে। একটু পরেই নিশাত খেতে এল। বসলো আমার পাশেই। ঐশী আমার পাশে বসে ছিল। কখন উঠে গেছে টেরই পাই নি। আমার কেমন যেন একটু অস্বস্থি লাগছিল। কেন জানি মনে হচ্ছিলো কিছু একটা আছে যেটা ঠিক নেই কিংবা আমি জানি না । খাওয়ার পরে আমি আমার সেই চিলেকোঠায় গিয়ে হাজির হলাম । ভেবেছিলাম হয় এটা অন্য কাউকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে নয়তো এখানে কেউ থাকে না । কিন্তু গিয়ে অবাক হতে হল । ঘরটা একদম পরিস্কার করে রাখা । কিছু আসবার পত্র রয়েছে, বই পত্র টেবিল খাট । পেছন থেকে ঐশী বলল
-এটা আপুর ঘর !
-আপুর ঘর মানে ? তোমার আপু কি …..
-ভাইয়া আপনি যেটা ভাবছেন সেটা না !
-মানে ?
-মানে আপু বিয়ে করে নি ।
-সেকি !
-হ্যা ! আপনি চলে যাওয়ার পরে আপু খানিকটা এবনরমার হয়ে গেছিলো । কারো সাথে ঠিক ঠাক মত কথা বলতো না, মিশতো না আগে তো কথা কম বলতো তারপর একেবারেই কথা বলা বন্ধ করে দিল । দিনের বেশির ভাগ সময়ে আপনার এই ঘরেই সে থাকতো !
-তারপর ?
-বাবা একবার বিয়ে দিতে চেয়েছিলো বছর দুয়েক আগে ।
সেদিন আপু নিজের হাতে রগ কেটে ফেলে । তারপর বাবাও আর সাহস করে নি ! আমি কোন কথাই বলতে পারলাম না । নিশাত এমন কিছু করবে সেটা আমি ভাবতেই পারি নি ! এমন শান্ত স্বভাবের একটা মেয়ে এই কাজ করবে ! একটু পরেই নিশাত কে দেখলাম ঘরে ঢুকতে । হাতে দুইটা কাপের কাপ ! ঐশীর দিকে তাকিয়ে বলল
-মা ডাকছে তোকে ! ঐশী মুখ ভেঙ্গিয়ে বলল
-ইস ! বললেই হয় চলে যা । মিথ্যা বলার দরকার !
-যা ভাগ !
-যাচ্ছি বাবা ! চায়ের কাপটা আমার হাতে দিয়ে নিশাত খাটের উপর বসল । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-তোমার ঘর আগের মতই আছে ! আমি গুছিয়ে রেখেছি ! নিশাত আগে আমাকে আপনি করে বলতো । এখন একেবারে তুমি ! আমি তখনও ঠিক ভাবে সব কিছু নিতে পারছি না । এখনও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না যে মেয়েটা আমার জন্য অপেক্ষা করছে । আমি বললাম
-আমি যদি কোন দিন না আসতাম ? আমার কথা শুনে নিশাত আমার চোখের দিকে তাকালো । তারপর বলল
-সেদিন তুমি কি বলেছিলে মনে আছে ? বলেছিলে তুমিও আমাকে ভালবাসো । আমি কিভাবে তোমার জন্য অপেক্ষা না করে থাকবো বল ? কিভাবে অন্য কারো সাথে ঘর করবো ? তারপর বেশ কিছুটা সময় কেউ কোন কথা বললাম না । নিশাত হঠাৎ বলল
-তুমি কেন হঠাৎ এতোদিন পরে এলে ?
-আমি ? সত্য কথাটা বলব কি বলব না ঠিক বুঝতে পারছি না । নিশাত বলল
-আমি ধারনা করতে পারি কেন এসেছো ?
-কেন এসেছি !
-সম্ভবত তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে কিংবা হচ্ছে ।
নতুন কোন সম্পর্ক জড়াতে যাচ্ছো ! তাই না ? কিন্তু তোমার মন সায় দিচ্ছে না । তাই শেষ বারের মত তুমি এখানে এসেছো আমার সাথে দেখা করতে । তাই না ? আমি খানিকটা চমকে উঠলাম । নিশাত ব্যাপারটা বুঝে ফেলবে সেটা আমি বুঝতে পারি নি । আমাকে চুপ থাকতে দেখে নিশাত এগিয়ে এল । আমার হাত ধরে বললাম
-ঐ মেয়ে কি আমার থেকেও বেশি সুন্দর ?
-আমি দেখি নি । বাসা থেকে দেখছে । আসলে আমি এতোদিন এড়িয়ে গেছি কিন্তু আর পারছিলাম না । কিন্তু …..
-অন্য কাউকে মনের ভেতরে বসাতেও পারছিলে না, তাই না ?
-হুম !
-তো ? এখন ? সেই মেয়েকেই বিয়ে করবা ?
-মাথা খারাপ !
আমি ভেবেছিলাম তুমি হয়তো নিজের জীবনে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছো, স্বামী সংসার নিয়ে সুখে আছো, এটা দেখে হয়তো আমি কিছু করতে পারবো ! মনকে বুঝাতে পারবো । এখন তো আমি আর কথা বলতে পারলাম না । কথা বলার সুযোগই পেলাম না । নিশাত মেয়েটা আমাকে হঠাৎ হঠাৎ এমন অবাক করে দেয় ! যাই হোক দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর কিছু পেতে যাচ্ছি । বড় প্রতীক্ষিত কিছু পেতে চলেছি !