কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে উঠল একদল ছেলেমেয়ে। একটা কামরা রিজার্ভ করা।উদ্দেশ্য চিটাগাং, সেখান থেকে নারিকেল জিঞ্জিরা – সেন্টমার্টিন দ্বীপ। বিশজন ছেলেমেয়ে আছে। কামরায় আরও দুইজন অতিরিক্ত লোক আছে। তাদের তোয়াক্কা না করে ছেলেমেয়েগুলো আনন্দ উল্লাস করেই যাচ্ছে। অপেক্ষাকৃত বয়স্ক লোকটা একটু বিরক্ত হচ্ছেন। তিনি তার পাশের সিটের মধ্যবয়সী লোকটাকে বললেন, আজকালকার ছেলেমেয়েরা কেমন উচ্ছৃঙ্খল, আমরা দুইটা বয়স্ক লোক এখানে বসে আছি, আর ওরা চিল্লাফাল্লা করেই যাচ্ছে। মধ্যবয়সী লোকটা বললেন, চাচা, এই বয়সে এরকম করবে, এটাই স্বাভাবিক।
-এই বয়সে এসব করবে? বেয়াদবি করবে? আর আপনি আমাকে চাচা বলেন কেন? আমার সাদাচুলে কলপ লাগালে আপনার চেয়েও বয়স কম মনে হবে।
-আমি দুঃখিত। আসলে আমার ছোট চাচা আপনার বয়সী হবে। এইজন্য চাচা বলেছি। আর চাচা বলাটা ভদ্রতার সাথে সম্মান দেওয়া।
-আপনি করেন কী?
-শিক্ষকতা করি। আপনি?
-শিক্ষকতা করতাম। এখন রিটায়ারমেন্টে আছি।
-ওদের এমন আচরণে মন খারাপ করবেন না।
আপনি হয়তো এই বয়সে ওদের চেয়ে বেশি দুরন্ত ছিলেন। বয়স্ক লোকটা কিছুক্ষণ থম মেরে গেলেন। তারপর বুকভরা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন, আমার বয়স যখন আঠারো, তখন জেলা পর্যায়ে ফুটবল খেলতাম। অনেক ভাল খেলোয়াড় ছিলাম। জাতীয় টিমে খেলার একটা সুযোগও এসেছিল। কিন্তু আর্থিক সংকটে ছিলাম। বাবা প্রান্তিক কৃষক, আর আমি বড় ছেলে। বাবার সাথে কাজকর্ম করে লেখাপড়া শেষ করলাম। তারপর নিজেদের গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতার চাকুরী নিলাম।
-আপনার নামটা?
-মোল্লা আজহার উদ্দিন।
-আমি মিসবাহ উদ্দিন, নারায়ণগঞ্জ সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করি।
-কিছু মনে করবেন না। আমার তখন এটা বলা উচিৎ হয়নি।
-আরে নাহ, ঠিক আছে। আপনি পেপার পড়েন, আমি ওদের সাথে একটু কথা বলি। আসলে ওদের দেখে আমার ওই সময়টা মনে পড়ছে।
-আচ্ছা, যান।
মিসবাহ এগিয়ে গেলেন। একটা ছেলে গিটার বাজাচ্ছে আর বাকিরা গান গাইছে তার সাথে। মিসবাহর আগমনে তাদের আনন্দ উল্লাসে ভাঁটা পড়ল। ইতস্তত করছে সবাই।
-আমি এসে মনে হয় তোমাদের বিরক্ত করছি।
-না, না। ঠিক আছে বসেন।
-একা একা বোর হচ্ছিলাম, তাই ভাবলাম তোমাদের সাথে কথা বলি।
একটা ছেলে সরে গিয়ে মিসবাহকে বসার জায়গা করে দিল। মিসবাহ গিটারটা নিয়ে বাজানো শুরু করল আর গান ধরল, আমি খোলা জানালা তুমি ঐ দখিনা বাতাস আমি নিঝুম রাত তুমি কোজাগরী আকাশ উধাও সাগর তুমি অঢের নীলে আমি অস্তরাত শেষ বিকেলে তুমি কথা না রাখা নিরালা দুপুর আমি বিমনা অবকাশ। আমি খোলা জানালা সবাই হা করে তাকিয়ে আছে। ছেলেমেয়েগুলোর কাছে মনে হচ্ছে শ্রীকান্ত আচার্যের গলায় গান শুনছে। গান শেষ হওয়ার পর সমবেত করতালিতে মুখরিত হল ট্রেনের কামরা।
মিসবাহ বললেন, পরিচয় হওয়ার আগেই গান গেয়ে নিলাম। আসো, পরিচয়টা সেরে নেই। আর হ্যাঁ, তোমাদেরকে তুমি করে বলছি, রাগ কর না। সবাই একসাথে বলল, ঠিক আছে। আপনি আমাদের তুমি করেই বলেন।
-ওকে, আমি মিসবাহ উদ্দিন। অধ্যাপনা করি। বাসা নারায়ণগঞ্জ। তোমাদের প্রত্যেকের নাম বল। সবাই একে একে তাদের নাম বলল। সুমি, রিয়া, পল্লব, মাহিন সুমি একটু বেশিই চঞ্চল আর বাকপটু। সেই সবচেয়ে বেশি কথা বলছে।
-তাহলে আপনাকে স্যার বলে সম্বোধন করাই উচিৎ। আমরা সবাই তিতুমীর কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের স্টুডেন্ট। সবাই পিকনিকে যাচ্ছি দারুচিনি দ্বীপ।
-ওয়াও, খুবই ভাল। আমি একবার গিয়েছিলাম।
-একা?
-না, আমি আর আমার স্ত্রী গেছিলাম। বিয়ের পর হানিমুনে গেছিলাম।
-আপনি ম্যারিড?
সুমি এমন অবাক হয়ে প্রশ্ন করল যে মিসবাহ ইতস্তত বোধ করা শুরু করল। তার বন্ধুবান্ধবীরা তাকে খোঁচা দিচ্ছে। মিসবাহ ব্যাপারটা ঠিক ঠাওর করতে পারছেন না।
-কেন? আমার ম্যারিড হওয়াটা কি দোষের? বয়স তো কম না আমার। বিয়াল্লিশ বছর বয়স। রিয়া বলল, স্যার, ওর কথায় কিছু মনে করবেন না। আপনার ব্যক্তিগত বা পারিবারিক গল্প বলবেন? অবশ্য যদি আপনার আপত্তি না থাকে।
-না, আপত্তি নেই।
-স্যার, তাহলে শুরু করেন। আপনাদের কি প্রেমের বিয়ে, মানে লাভ ম্যারিজ?
-হুম, লাভ ম্যারিজ বলা যায়। তবে তা একতরফা ছিল প্রথমে।
-কেমন?
-আমি তখন প্রথম চাকরি পেয়েছি।
চাকরির দুদিনের মাথায় আমাদের গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গেলাম। খুব সুন্দর একটা গ্রাম। কবিসাহিত্যিকদের লেখায় বা চিত্রশিল্পীদের ছবিতে গ্রাম যেরকম সুন্দর থাকে, ঠিক সেরকম একটা গ্রাম। আমি চাকরি পেয়েছি- এই খুশির খবরটা আমি নিজে আমার খুব প্রিয় একজন ব্যক্তিকে জানাতে গেলাম।
পল্লব জিজ্ঞেস করল, কে তিনি?
-আমার স্কুলের শিক্ষক। আমার জীবনের সবচেয়ে সেরা শিক্ষক তিনি। যাইহোক, স্কুলে গিয়ে সব শিক্ষকদের নিজের হাতে মিষ্টিমুখ করালাম। চাকরি পেয়ে যতটা খুশি হয়েছিলাম, তার চেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলাম আমার শিক্ষকদের প্রতিক্রিয়া দেখে। আমার সেই প্রিয় শিক্ষক বললেন, মিসবাহ, আজ তুমি আমাদের স্কুলে একটা ক্লাস নাও। কী করব, বল? শিক্ষকের কথা তো ফেলতে পারি না। তাই ক্লাস নিতে গেলাম। আমাকে ওই শিক্ষকের সাবজেক্ট ক্লাস টেনের ম্যাথ নিতে বললেন।
-আপনি কি স্যার ম্যাথের অধ্যাপক?
-না, আমি ইংরেজির অধ্যাপক।
কিন্তু ম্যাথম্যাটিকস ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় সাবজেক্ট। আমি ম্যাথ পড়তে চেয়েছিলাম, কিন্তু পড়তে হল ইংরেজি। সে গল্প থাক। যা বলছিলাম, তখন আমার বয়স খুব কম। সবেমাত্র মাস্টার্স পাশ করেছি, প্রভাষক হিসেবে চাকরিও পেয়েছি। কিন্তু মনটা ছিল কিশোর। ক্লাসে ঢুকে সব ছাত্রছাত্রীদের এক পলক দেখে নিলাম। কিন্তু আমার চোখ আটকে গেল সামনের বেঞ্চে বসা গোলগাল মুখের একটা মেয়ের দিকে। খুব সাধারণ চেহারা- কিন্তু সেই সাধারণের মধ্যে এমন অসাধারণতা আছে যা পৃথিবীর সেরা সুন্দরীদের মধ্যেও নেই। এটা অবশ্য তার প্রতি আমার ভালবাসার প্রতিক্রিয়া বলতে পার। তাকে দেখে আমি অবাক হচ্ছি। তার মধ্যে একটা ভাবলেশহীন ভাব ছিল। পড়া ছাড়া অন্যকিছু বোঝে না টাইপ ব্যাপার। আমি এরকম একটা সুদর্শন, হ্যান্ডসাম ছেলে তাদের পড়াতে এসেছি- সব মেয়ে ফিসফাস করছে কিন্তু তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সবাই হো হো করে হেসে উঠল। পিছনের দিকে বসা আজহার উদ্দিন উঠে এসে বললেন, কী ব্যাপার মিসবাহ সাহেব? ছেলেমেয়েদের সাথ্র দেখি ভালই খোশগল্প শুরু করলেন? আমি কি আপনার গল্পের শ্রোতা হতে পারি?
-হাহাহা, হ্যাঁ, প্লিজ বসেন। গল্প কি আবার প্রথম থেকেই শুরু করব?
-না, না। এতে ছেলেমেয়ে বিরক্ত হবে। মুখে না বললেও মনেমনে বলবে, এই বুড়ো লোকটা কোত্থেকে এসে আমাদের গল্পের মধ্যে বাগড়া দিচ্ছে?
-আচ্ছা, আচ্ছা।
-আমি অবশ্য ওখানেই বসে শুনেছি। আপনার গল্প বলার ভঙ্গি দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না। তাই চলে এলাম।
-স্যার, তারপর বলেন। সেই মেয়েটা কী করল?
-আমি একটা অংক ব্লাকবোর্ডে করে দিলাম। পরে সেই নিয়মের কয়েকটা অংক সবাইকে করতে বললাম। আসলে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকতেই ইচ্ছে করছিল। দেখলাম মেয়েটা বাম হাত দিয়ে লিখছে। আমার অবাক হওয়ার দ্বিতীয় পর্ব। এত সুন্দর হাতের লেখা!
-স্যার, আপনার কাছে নিশ্চয় তার লেখা কোন চিঠি বা চিরকুট আছে, রাইট? মাহিন প্রশ্ন করল।
-ঠিক বলেছ। আছে।
-দেখানো যাবে?
-অবশ্যই। তবে মাত্র একটা লেখা দেখাব।
-ওকে।
মিসবাহ মানিব্যাগ বের করে একটা চিরকুট বের করল। বলল, সবাই দেখবে কিন্তু টানাটানি করবে না। ছিঁড়ে যায় না যেন। সবাই এক এক করে দেখল। হাতের লেখায় যদি নোবেল প্রাইজ দেওয়ার সিস্টেম থাকত, তাহলে এই মেয়ে নোবেল পেত। সব ছেলেমেয়ের এই মন্তব্য। সবাই মনেমনে চিরকুটটা পড়লেও সুমি জোরে পড়া শুরু করল, “তোমার এই পাগলের মত ভালবাসা ধারণ করার ক্ষমতা আমার নেই। আমি হয়তো এত ভালবাসা পাওয়ার যোগ্যও না। তাই একটা কথা যা এতদিন বলে এসেছি, আজ আবার বলি, আমি তোমাকে ভালবাসি। তুমি আমাকে আরও অনেক বেশি ভালবাস। Happy anniversary…”
-স্যার, এটা কি আপনাদের ফার্স্ট অ্যানিভারসারি ছিল?
-হ্যাঁ।
-স্যার, তারপর কী হল?
-আমি মেয়েটার খাতা নিয়ে অংক দেখলাম। পুরো খাতা উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখতে লাগলাম। হাতের লেখায় যেন সম্মোহনী শক্তি আছে। যাইহোক, খাতাটা ফেরত দেওয়ার সময় আমার বুকটা ধক করে উঠল।
-কেন?
মিসবাহ সময় নিচ্ছে, মনে হচ্ছে গল্পে ভাঁটা পড়েছে। কিছুক্ষণ পর বলল, আসলে জানি না। মনে হল তখন আমার জীবনে এই মেয়েকে দরকার। ক্লাস শেষ করার মত ক্ষমতা ছিল না। আমার কেমন যেন লাগছিল। ঘণ্টা পড়ার আগেই বের হয়ে এলাম। বাড়িতে এসে বাবামাকে মেয়েটার কথা বললাম। সেই সময় আমার পরিবার থেকে চাচ্ছিল আমাকে বিয়ে দিতে। তাই বাবা দেরী না করে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেল।
-তিনি কি আপনাকে পছন্দ করেছিলেন?
-সেই সময়ে মেয়েদের পছন্দ অপছন্দকে মূল্যায়ন করা হত না। আর বাবামা ভাল ছেলের সাথেই বিয়ে দিত। তোমরা খেয়াল করে দেখলে বুঝবে, বেশিরভাগ লাভ ম্যারেজ স্থায়ী হয় না। কারণ বিয়ের সাথে সাথেই প্রেমিক প্রেমিকার ভালবাসা শেষ হয়ে যায়। আর অ্যারেঞ্জ ম্যারেজে বিয়ের পর ভালবাসাটা শুরু হয়। যাইহোক, আমাকে অপছন্দ করার মত কারণ ছিল না। দেখতে মোটামুটি সুন্দর, ভাল চাকরি, ফ্যামিলি ভাল। আমার শ্বশুর এতটা ভালও আশা করেননি। আর সব থেকে বড় কথা, সে আমাকে পছন্দ করেছিল।
-তারপর বিয়ে করে ফেললেন?
-হুম, একমাসের মাথায় আমাদের বিয়ে হল। খুব ধুমধাম করে বিয়ে হল। পরে আমার কর্মস্থলে ওকে নিয়ে চলে এলাম।
-ম্যাডামের নামটা কিন্তু বলেননি স্যার?
সুমি বলে উঠল, আমি খেয়াল করেছি, বেশিরভাগ সুন্দরীদের নামগুলো ততটা সুন্দর হয় না। মিসবাহ মুচকি হেসে বললেন, ওর নাম চাঁদনী। পল্লব বলল, সুমি সবসময় বেশি বুঝিস ক্যান? নামটা সুন্দর না? রিয়া বলল, আরে ওর নামে সমস্যা না, সমস্যা সুমির মাথার মধ্যে। মিসবাহ বুঝতে পারছে না, এরা কোন বিষয়ে কথা বলছে। এরপর মিসবাহ তাদের সংসার জীবনে মজার কয়েকটা ঘটনা বললেন। সুমি জিজ্ঞেস করল, স্যার, আপনাদের মধ্যে কখনো ঝগড়াঝাঁটি হয় না?
-না। কারণ আমাদের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং খুব বেশি। আমি ওকে বুঝি, আর ও আমাকে বোঝে। আর আমাদের ভালবাসাটা পুরোটায় শরীরের উপর নির্ভরশীল না। ভালবাসা যদি শুধুমাত্র শারীরিক হয়, তাহলে শরীরের জৌলুস শেষ হওয়ার সাথে সাথে ভালবাসাও কমতে থাকে। কিন্তু কারও মনকে ভালবাসলে সারাজীবন ভালবাসাটা ধরে রাখা যায়।
-খুব ইচ্ছে হচ্ছে সেই ভাগ্যবতী মহিলাকে দেখার। যে আপনার মত একজন আদর্শ স্বামী পেয়েছে।
-সে যতটা ভাগ্যবতী, আমি তারচেয়ে বেশি ভাগ্যবান। তার জীবনে আমাকে যতটা দরকার, তারচেয়ে বেশি দরকার তাকে আমার জীবনে। স্যার, আমরা দুইমিনিট একটা মিটিং করতে চাই। আমাদের একটু সময় দিবেন?
-ওহ, শিয়র। তোমরা মিটিং কর। আমি আর আজহার সাহেব একটু চা নাস্তা সেরে আসি। মিসবাহ আর আজহার সাহেব ক্যান্টিনের দিকে গেলেন। পল্লব বলল, সেন্টমার্টিন সারাজীবন থাকবে। আমরা যদি একটা দিন পরে যাই, কারও কোন আপত্তি আছে?
-মানে কী?
-আমি চাচ্ছি, স্যারের ওয়াইফকে দেখতে যাব। তোরা কে কী বলিস?
সবাই ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিল, তারা সবাই দেখতে যাবে। রাতের ট্রেনে চিটাগাং যাবে। মিসবাহ আর আজহার সাহেব চলে এলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই নারায়ণগঞ্জ এসে পড়ল। মিসবাহ নামতে যাবে, তখন পল্লব বলল, স্যার, আমরা সবাই যদি আপনার বাসায় বেড়াতে যাই, আপনার কোন সমস্যা হবে? মিসবাহ অবাক হলেন। এরা সবাই এমন ছেলেমেয়ে, যাদেরকে কোনকিছুতে না বলা যায় না। কিন্তু এদের যাওয়ার উদ্দেশ্যটা মিসবাহ বুঝতে পারছেন না। ইতস্তত করতে করতে মিসবাহ সম্মতি দিলেন। আজহার সাহেবকে বিদায় দিয়ে সবাইকে নিয়ে বাসায় এলেন মিসবাহ। কলিং বেল নেই। মিসবাহ দরজার সামনে দাঁড়ালেন। দরজার উপরে একটা সিসিটিবি ক্যামেরা। রিয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, এটা কেন?
-সব বাসায় কলিং বেল থাকে। আমি একটু ভিন্নতা রাখার চেষ্টা করলাম।
-একটু ব্যাখ্যা করেন স্যার।
-কলিং বেল টিপলে বোঝা যায় না কে এসেছে। কিন্তু ক্যামেরা থাকলে দেখা যায়। এই আর কী?
দরজা খুলে গেল। সবাই ভেবেছিল দরজা খোলার পর স্যারের স্ত্রীকে দেখতে পাবে। কিন্তু না, কাউকে দেখা গেল না। স্বয়ংক্রিয়ভাবে দরজা খুলেছে। সবাই অবাক হয়ে মিসবাহর দিকে তাকালো। মিসবাহ বললেন, আসো, ভিতরে আসো। সবাইকে নিয়ে সরাসরি বেডরুমে চলে গেলেন। চাঁদনী খাটে বসে আছে। গায়ের উপর একটা নকশীকাঁথা। চোখ ফেরানো যায় না- এরকম ভাবা ছাড়া আর কিছু মাথায় আসছে না ওদের। আসলেই খুব সুন্দর আর মায়াবী চেহারা।
-চাঁদনী, এরা সেন্টমার্টিন যাচ্ছিল। ট্রেনে আলাপ হল, তাই তোমাকে দেখতে এসেছে।
-তুমি নিশ্চয় বানিয়ে বানিয়ে আমার অনেক গল্প করেছ।
-না। বানিয়ে বলিনি। এই, তোমরা সবাই বস।
-তুমি এদের সাথে গল্প কর। আমি এদের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করি।
-না, থাক। তুমি গল্প কর। আমি নাস্তার ব্যবস্থা করছি।
-হুঁ, পরে এরা বলবে বরকে দিয়ে সব কাজ করায়।
-হাহাহা, আচ্ছা, যাও।
খাটের পাশে রাখা ক্র্যাচ নিয়ে অনেক সাবধানে উঠল চাঁদনী। ছেলেমেয়েগুলোর মুখ হা হয়ে গেল। তারা নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। একটা পা আর একটা হাত ছাড়া চাঁদনী হেটে যাচ্ছে। যার মধ্যে কোন জড়তা নেই।
থমথমে একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে গেল এক মুহূর্তে। এরা ভাবতে পারেনি যে এরকম কোন দৃশ্য দেখবে। এদের এই অবস্থা দেখে মিসবাহ বলল, আমি যখন তাকে প্রথমবার দেখি তখন তার মায়াবী মুখটাই দেখেছিলাম। কিন্তু যখন তাকে বাম হাত দিয়ে লিখতে দেখি, তখন খেয়াল করলাম যে তার ডানহাত আর ডানপা নেই। ও যখন ক্লাস ফাইভে পড়ে, একটা দুর্ঘটনা হয়। বিদ্যুতের শক লেগে তার এক হাত, এক পা কাটা যায়। তাকে আমি প্রথম দেখায় ভালবেসে ফেলি। যাকে বলে Love at first sight. ওর বাসায় যখন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যায়, ওর পরিবারের সবাই ভেবেছিল, হয়তো করুণা করেই তাকে বিয়ে করতে চাচ্ছি। তখন তাদেরকে বললাম, যদি ভাবেন যে আমি করুণা করে বিয়ে করব, তাহলে দয়াকরে আমার সাথে ওর বিয়ে দিবেন না। আমি ওকে প্রথম দেখায় ভালবেসেছি। ও যদি আমাকে ভালবাসতে পারে, পছন্দ করে, তাহলেই বিয়ে করব। আপনারা হয়তো কোন ছেলেকে অনেক যৌতুক দিয়ে ওর বিয়ে দিতেন। আমি ওকে চাই, আর কিছু না।
-সত্যিই স্যার। আজ আপনার কাছ থেকে শিখলাম ভালবাসা কী। সত্যিই, ম্যাডাম খুবই ভাগ্যবতী।
-না, আমি আগেও বলেছি। আমিই ভাগ্যবান। আমি যদি অন্যকোন মেয়েকে বিয়ে করতাম, সে হয়তো আমার টাকাপয়সাকে ভালবাসত কিন্তু এই মানুষটাকে না। কিন্তু চাঁদনী এই মানুষটাকে অনেক অনেক অনেক ভালবাসে।
মিসবাহর চোখ ভিজে উঠছে। আর এদিকে সব ছেলেমেয়ে চোখের জল ঝরানো শুরু করেছে।
রান্নাঘর থেকে চাঁদনী ডাকল, এদিকে একটু আসো তো। মিসবাহ চোখ মুছে ওদিকে গেল। সুমি চুপচাপ রান্নাঘরের দরজার পাশে দাঁড়াল। রান্নাঘরের পরিবেশ দেখে সে অবাক। ইলেক্ট্রিক চেয়ার বসানো যাতে চেয়ারে বসেই সব কাজ করা যায়, এদিকওদিক যাওয়া যায়। ঘরের সব জিনিসপত্র খুব ভালভাবে সাজানো। খুব ডিজিটাল একটা রান্নাঘর। বাংলাদেশে এরকম রান্নাঘর দ্বিতীয়টা নেই। কারণ এ দেশে মিসবাহ স্যারের মত ভালবাসার মানুষ দ্বিতীয়টা নেই।