বোবা ভালোবাসা

বোবা ভালোবাসা

মেয়েটি বোবা বলেই এখনো তার বিয়ে হচ্ছে না। আরেকটা দোষ হলো, তার গায়ের রঙ বাদামী। গায়ের রঙ তেমন সমস্যা নয়, যত সমস্যা কথা বলতে না পারায়। আমার রুমের জানালা দিয়ে ওদের বাসার ছাদ দেখা যায়। প্রতিদিন বিকেলে সে মন মরা হয়ে ছাদে বসে থাকে। মেয়েটির বাল্যকালের যত বান্ধবী ছিলো সবার বিয়ে হয়ে গেছে। তার থেকে বয়সে ছোট মেয়েদেরও বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। কয়েক জনের তো সন্তানাদিও হয়ে গেছে। সে যখন বান্ধবীর বাচ্চাদের কোলে নেয়, তখন তার কলিজায় হাহাকার করে ওঠে। আহা! কবে আমি আমার সন্তানকে কোলে নিবো!

আজও বিকেল বেলা সে ছাদে এসেছে। তবে মনে হলো আজকে তার মনটা ভীষণ খারাপ। মোটামুটি দূর থেকেও উপলব্ধি করতে পারছি তার চোখ দিয়ে বেয়ে পরা অশ্রুর ফোঁটাগুলো। আমি জানালার ঢালাটা কিছুটা চাপিয়ে দিলাম। যেন সে আমাকে দেখতে না পায়। মেয়েটির কান্না করার কারনও আছে। আজ সাত দিন হয়ে গেল তার ছোট বোনের বিয়ে হয়েছে। বয়সে তার বোন অন্তত পাঁচ বছরের ছোট। বড় বোন অবিবাহিত থেকে ছোট বোনের বিয়ে হওয়াটা যে কত কষ্টের, তা হয়তো শুধু ঐ মেয়েরাই বুঝতে পারে।

ওর চোখের পানি দেখে কেনো জানি না আমার চোখ থেকেও পানি ঝড়ছে। আমিতো কাঁদতে চাইনি! তাহলে কি আমি তাকে ভালোবাসে ফেললাম? মন যেন আমায় বলছে– হ্যাঁ, তুই ওকে ভালোবাসে ফেলেছিস। এমন একট দুঃখী মেয়ের পাশে থাক। ওর দুঃখগুলো বুঝে নে। হয়ত ঈশ্বর তোর দুঃখও কমিয়ে দিবেন। কিন্তু আমি যে ওকে ভালোবাসি তা বুঝাবো কীভাবে? কারণ আমার কথা সে বুঝবে না, আর তার ভাষাও আমি বুঝি না!

তাহলে ওর ভাষাটা আয়ত্ত করে নিতে হবে। ছুটে গেলাম এক বন্ধুর কাছে। যে বোবার ভাষা বুঝে এবং বোবার সাথে কথা বলতে পারে। কয়েক ঘন্টা নিরলস প্রচেষ্টার পর অনেকটা আয়ত্ত করতে পারলাম। পরদিন সকালে ফুলের দোকানে গেলাম। ওর কোন ফুল পছন্দ জানি না। তাই নিজের পছন্দেই ফুল কিনলাম। বাসায় এসে বিকেলের জন্য অপেক্ষা করছি। তবে চিন্তা করছি জানালা দিয়ে কীভাবে তাকে ফুল দিবো? কারণ দু বেল্ডিং এর মাঝখানে অন্তত চার পাঁচ হাত গ্যাপ আছে। ভাবলাম, ঢিল ছুঁড়েই ওর কাছে ফেলে দিবো। পরক্ষণে ভাবছি, যদি কেউ দেখে ফেলে! তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, ফুল দেওয়ার প্রয়োজন নেই, শুধু ফুলগুলো দেখিয়ে দিবো। তাহলেই হবে। বিকেল হলো। কিন্তু সে ছাদে আসছে না। বেচে বেচে আজকের দিনটাতেই আসতে লেইট করছে। এদিকে আমার অপেক্ষার প্রহর কাটছেই না।

এমন সময় ওর মায়ের ভয়ার্ত চিৎকার শুনলাম। ঐ মহিলা এমনই। তেলাপোকা দেখলেই হলো, মনে হয় বাঘ দেখছে। চিৎকার করে কান ফাটিয়ে দেয়। চিৎকার শুনে আমি খুশি হলাম। কি হয়েছে আপনার? এই প্রশ্নের উসিলায় ওদের বাসায় গিয়ে রিমিকে মনের কথাটা বলে ফেলবো। এক দৌড়ে ছুটে গেলাম ওদের বাসায়। তবে যা দেখলাম তাতে আমি নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গেছি। শরীরের লোম গুলো দাঁড়িয়ে গেছে। দেখলাম রিমি ফ্যানের সাথে ঝুলে আছে। ওড়নাটা ওর গলায় নিষ্ঠুরেরর মত ফেঁসে আছে। ওর গায়ে ছোট বোনের বিয়ের টুকটুকে লাল শাড়ি। মনে হয় মনের মাধুরী দিয়ে শেষবারের মতো সেজে ছিলো। রিমি হয়তো বোবা থাকার বোঝাটা বইতে পারেনি। মেনে নিতে পারেনি নিঠুর বাস্তবতা কে। রিমির মা বাবা অঝোর ধারায় কাঁদছে। আমি কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে থাকলাম। তারপর রিমিকে নামাতে সাহায্য করলাম।

আমার খুব চিৎকার করতে ইচ্ছে হচ্ছে। বলতে ইচ্ছে করছে, কী লাভ হলো তোর? নিজের প্রাণ কেড়ে নিয়ে কী বিনিময় পেলি? আর কয়েকটা মুহুর্ত অপেক্ষা করতে পারলি না? তোকে ভালো রাখার জন্য কি কাউকে সৃষ্টি করা হয়নি? উপর ওয়ালাকে এতই নির্দয় ভেবেছিস! কিন্তু কথাগুলো চিৎকার করে বলতে পারলাম না। বুকের চিৎকার গুলো বুকেই চেপে গেলাম।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত