আজকে আমার ২২ তম বিবাহ বার্ষিকী এবং সেই সাথে ৩৫ তম জন্মদিন।মাত্র ১৩ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে এই বাড়িতে বড় বউ এর শুন্য আসন পূরণ করেছিলাম। আর আজ এই দিনে আমার স্বামী আমাকে ছেড়ে তার প্রাক্তণ এর কাছে একেবারে ফিরে যাচ্ছে৷তার এখন মনে হচ্ছে সে আমার থেকে বেশি সেখানেই, সেই মানুষ টার সাথেই সুখ অনুভব করে। আর আমিও তার সিদ্ধান্তে বাঁধা দেইনি। বাধা দেইনি বললে ভুল হবে। সে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আমাকে জানায়নি। সিদ্ধান্ত টা নেয়ার পর আমার উপর চাপিয়ে দিয়েছে তার মতামত,ইচ্ছা, চাওয়া।আর আমি তার মতামত আর চাওয়া কে সব সময় ই গুরুত্ব দেই।
কেক কাটা শেষ হওয়ার পর ই আমার স্বামী আমাদের শোবার ঘরে গিয়ে সব গুছিয়ে নিচ্ছে, মেয়ে এসে খবর দিল। শেষ বারের মত আমার জন্মদিন টা আমার ছেলে মেয়েরা, স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির সবাই খুব ধুমধাম করে পালন করলো। আমি মেহমান দের বিদায় দিয়ে ঘরে গিয়ে টুকিটাকি জিনিসপত্র তাকে গুছিয়ে দিতে সাহায্য করছি। এই যেমন তার ঔষধ, চশমা, হাতঘড়ি, ওয়ালেট আর আরো নানান জিনিস।
মানুষ টা ঔষধ খেতে ভুলে যায়। আমি তার হাতে পানি সহ গ্লাস টা আর ঔষধ টা এগিয়ে দিলেই কেবল খেয়ে নেয়। সে তো ঝাল খেতে পারেনা। আর ওদিকে আমি যত দূর জানি যেই মানুষ টার কাছে সে ফিরে যাচ্ছে সে নাকি প্রচুর পরিমাণে ঝাল খায়।এসব নানান ধরনের কথা ভেবে যাচ্ছি।
সব গোছানো শেষ হলে আমার স্বামী আমার আমাকে তার সামনে দাড় করিয়ে তার ডান হাতে আমার কাধে হাত রেখে বলতে শুরু করলো, জানো নিরু, আমি কিন্তু তোমাকে পাগলের মত প্রচুর ভালোবাসতাম। বিয়ের শুরুর দিকে তোমাকে দেখার জন্য কখন অফিস থেকে বাসায় ফিরব সেই জন্য ছটফট করতাম।আমি বললাম হ্যা, আমি কিন্তু বুঝতাম। সে বললো যদি বুঝতেই তবে আমি বাড়ি ফিরলে কাজের বাহানা দিয়ে কেনই বা দেওঘরে পরে থাকতে? আমি বললাম বা’রে, এত বড় সংসার।
একা হাতে সামলানো, ওত কাজ। তোমায় নিয়ে বসে থাকলে হতো!! কাজ পরে থাকলে সেই তো শ্বাশুড়িমার বকুনী শুনতে হতো আমাকে। সে আবার বলে উঠলো, আচ্ছা নিরু তোমার মনে আছে আমাদের মেয়ে যখন তোমার গর্ভে আমি সারারাত জেগে বসে থাকতাম। খুব টেনশন হত আমার। না জানি তোমার কত কষ্ট হচ্ছে এই ভেবে ভেবেই রাত পার করে দিতাম। আর পরের দিন অফিসে গিয়ে ঝিমুনির জন্য বস এর কাছ থেকে সে কি ঝাড়ি শুনতাম।
তার এসব কথা শুনে আমি পুরনো দিনে ফিরে যাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিলো এইতো সেদিন বিয়ে হল, প্রথম মা হলাম। স্বামী ভালোবেসে নিরুপমা থেকে নিরু ডাকতে শুরু করলো। খারাপ তো যাচ্ছিলোনা দিন গুলো। হঠ্যৎ কবে থেকে যেন আমার আঁচলে মাছের ঝোলের গন্ধ তার কাছে বিচ্ছিরি লাগতে শুরু করলো। আমার হাতে হলুদের দাগ তার চোখ দুটোকে কুচকে দিতে লাগলো। আমার চুলে তেলের গন্ধের জন্য তার নাক সিটকানোর কারণ হলাম। ভালোবাসা ফিকে হতে শুরু করলো। এর ই মাঝে তার ডিভোর্সি প্রাক্তণ এর সাথে তার আলাপ চারিতা বাড়তে থাকলো।
খানিক বাদেই আবার ফিরে এলাম বাস্তব এই জগতে। সে আমার দিক তাকিয়ে বললো, তোমাকে এত কাল বহু কষ্ট দিয়েছি নিরু। আজ তোমার জন্মদিনে সেরা উপহার টা দিয়ে গেলাম। আর তোমার জ্বালাবোনা। নিজের যত্ন নিও। আমি খেয়াল করে দেখেছি। সেলাই করার সময় চশমা টা পরোনা। এভাবে কিন্তু চোখের ক্ষতি হবে। চশমা পরে নিও। আসি নিরু.. আমি কিছু বলার শক্তি পাচ্ছিলাম না। সে ঘর থেকে বের হতেই ধপাস করে বসে গেলাম। দেয়ালে ঘেষে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম। এ চিৎকারের আওয়াজ আমি ছাড়া আর কারো কান অব্দি পৌছাতে দিবনা।
“আমিতো এমন মুক্তি চাইনি। তার চেয়ে বরং সারাজীবন পাশে থেকে না হয় কষ্ট দিয়ে যেতে মেয়ে এসে জড়িয়ে ধরে বললো, বাবা তো চলে যাচ্ছে। তুমি বাবাকে ফেরাও। আমি শুধু বললাম, যে চলে যেতে চায় তাকে কি আটকে রাখা যায় রে মা.. ঘন্টা খানিক পর সে ফেরত এলো। অবাক হয়ে তার দিক চেয়ে রইলাম। মানুষ টার চোখ দুটো ফুলে আছে!! যতই সে আমাকে ছেড়ে যাক তার চোখের পানি এখন ও আমার বুকে কাটার মত বিধে যায়। ফিরে এসে বললো, পারলাম না নিরু। তুমিও তো আটকে দিলে না। আমি বললাম ভালোবেসেই যদি বেঁধে রাখতে না পারলাম তবে আটকে দিয়ে কি বেঁধে রাখা যেত!! সে বললো আমিও তো বেহায়ার মত তোমার ডাক ছাড়াই ফেরত আসলাম। সে আবারো বলে উঠলো “শেষ বেলা যদি বেহায়াই না হলাম তবে ভালোবাসলাম কেমন!!৷