শুধু তোমার জন্য

শুধু তোমার জন্য

রিচি সবেমাত্র আমাকে গরম গরম চা দিল।ঠিক সে মুহুর্তে পাশের ফ্ল্যাটের তানিশা ভাবী আসলো।আমি ওদিক এদিক না তাকিয়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছি আর ফেসবুকিং করতেছি।এমন সময় ভাবী আমাকে বলল। “ভাইয়া আপনার কাছে একটা রিকোয়েস্ট করবো?রাখবেন কিনা সেটা বলেন। “রাখতে পারবো কিনা জানিনা।তবে রাখার মত হলে রাখবো।বলতে পারেন? ” ভাবীকে নিয়ে একটু শপিং করতে যাব।একটা জামদানি শাড়ি কিনার জন্য।ভাবীর চয়েজটা অনেক ভাল।তাই আর কি।

-“আমি রিচির দিকে ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে দেখি।রিচির মুখটা যেন কালো হয়ে গেছে।কালো করার তো অবশ্যই কথা।কম দামীর মধ্যে সুতি টাঙ্গাইল কিনে দিতে পারিনি কখনো।যে কোন দামী জিনিস কিনতে গেলে তানিশা ভাবী রিচিকে নিয়ে যাবে।ভাবীটা অনেক ভাল।তবে মাঝে মাঝে খুব রাগ হয় , তার প্রতি।যে কোন কিছু কিনতে গেলে আমার বউকে নিয়ে যাওয়ার দরকার কি।ওর আর আত্নীয়স্বজন নাই।আর পাশের ফ্ল্যাটে আর অনেক জনের স্ত্রী আছে।ওদেরকে নিয়ে যেতে পারে না।শুধু কি আমার বউকে দরকার হয়।আমি রিচির দিকে তাকিয়ে বললাম।

“যাবে কি?
“তুমি বললে যাব।
“ভাইয়া মাঝে মাঝে আপনাদের ভালবাসা দেখলে খুব হিংসে হয়।একজনকে ছাড়া আরেকজন থাকতে পারেনা।
” আপনাদের আসতে কতক্ষণ লাগবে?
“ভাইয়া ধরেন!রাত দশটা লাগবে মিনিমাম।
“পুরো দোকান কিনে ফেলবেন নাকি?
“কি যে বলেন ভাইয়া!জানেন তো মেয়েদের একটু সময় লাগে শপিং করতে।
” আচ্ছা এখন ছয়টা বাজে।দু’ তিন ঘন্টার মধ্যে চলে আসবেন।
“ অন্তত ২-৩ ঘন্টাও ভাবীকে ছাড়া একা থাকতে পারবেন না।

“থাকতে পারবো।তবে খুব কষ্ট হবে।যে মানুষ বাবা মায়ের হাত রেখে সারাজীবনের জন্য আমার হাত ধরে চলে আসছে।তাকে ছাড়া দু’ঘন্টা না এক নেনো সেকেন্ড থাকতেও আমার খুব কষ্ট হবে।এখন এসব কথা থাক। তাড়াতাড়ি চলে আসলে হবে। “আচ্ছা আচ্ছা।ঠিক আছে। একটু পর ভাবী যে বোরকা পড়ে আসলো।দেখে বুঝা যাচ্ছে।ইরানী বোরকা। দশ হাজারের টাকা অধিক হবে না।বোরকার সাথে কফি কালারের একটা হিজাব পড়ে আসলো।আর রিচি কালো একটা বোরকা পড়লো। নিজের পছন্দ করে সেলাই করতে বলছি।ট্রেইলার কে। ইরানীর বোরকার চেয়েও কম না।শুধু দামটা ভিন্ন।আর হালকা একটা নেবু ব্লু এর মধ্যে ওড়না পড়ে আসলো।চিকন করে একটা গোমটা দিল।কিছু মেয়েকে সিম্পল এর মধ্যে অনেক সুন্দর দেখায়।গর্জিয়াস স্মার্ট এর চেয়ে সিম্পল স্মার্টকে সবাই পছন্দ করে।

“কি দেখতেছ?
” কিছুনা।
“আমি যাচ্ছি।আর যদি আসতে দেরী হয় আমার।খেয়ে নিও কেমন। “কি মনে হয়।কখনো কি একা খেয়েছি।
“না।তাহলে আমি আসা ছাড়া বসে বসে টিভি দেখো। কেমন।
” সাবধানে যাবে?
“ঠিক আছে।এত টেনশন কেন।আমিতো আর কোথাও হারিয়ে যাচ্ছিনা। “হারিয়ে যেতে কতক্ষণ।
“আমি যাব না।
” না গেলে ভাবীর খুব মনে কষ্ট যাবে।
“আচ্ছা ঠিক আছে।তুমি মনের সুখে তোমার প্রিয় অভিমানী তিশার নাটক দেখো।
“আচ্ছা।অপেক্ষায় আছি।এই অপেক্ষার প্রহর শেষ হওয়ার আগে চলে আসবে।
“আচ্ছা।

বিশিষ্ট মেঘা ব্যবসায়ী হারুন খানের মেয়ে রিচি খান। রিচির সাথে আমার পরিচয় আদিম যুগের মত।চিঠির মাধ্যমে।তার পাশের ফ্ল্যাটের ক্লাস নাইনের এক ছাত্রীর প্রাইভেট স্যার ছিলাম আমি।প্রতিদিন বাসা থেকে বের হওয়ার সময় দুই ইঞ্চির কাগজের নীল চিরকুট পেতাম। প্রথন দিন চিরকুটে লিখা ছিল? “পৃথিবী জোড়া মানুষগুলো মায়াপুরীর স্বপ্নজাল বুনে। “আর আমি তোতেই বহমান! এই নীল চিরকুটের লেখা কে লিখতে পারে।খুব সুন্দর করে দুটি লাইনে প্রিয় একটা কথা বুঝিয়েছে।চারপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পাইনি।চিরকুট টা পকেটে নিয়ে মেসের দিকে চলে গেলাম।পরেরদিন যখন আবার টিউশনি করাতে গেলাম। দ্বিতীয় চিরকুটে লিখা ছিল। “এক মহারাজা প্রতিদিন এই গরম রোদে আসে যুদ্ধ করার জন্য।সে যুদ্ধ হচ্ছে তার নিজের সাথে।তবে আজ দ্বিতীয় দিন হয়ে গেল।প্রথম চিরকুটের উত্তর কি আমি আজও অবধি পাবো।

আবারও এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখছিনা।মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন আসলো।এসব ফাইজলামি কি আমার ছাত্রী করছে।না না সে তো এখনো ছোট।সহজ সরল মেয়ে।দূর।এসব না ভেবে দ্বিতীয় দিনের চিরকুট টা নিয়ে বাসায় চলে যাই।এভাবে প্রতিদিন একটা একটা করে কিছু শব্দের চিরকুট পাই।যা বুঝা খুব মুশকিল।সব মিলে দশ দিনে দশটা চিরকুট পাই।বিরক্ত হয়ে একটার উত্তর দিয়েছি। ” আপনি কে তা আমি জানিনা।আমি মধ্যবিত্তের ছেলে আমাকে ফাঁদে ফেলবেন না।যেদিন আপনি দেখা করবেন সেদিন সব চিরকুটের উত্তর দিব।তার আগে না ,আর না হয় এসব না দিলে আমি খুব খুশী হব।যাক এই চিরকুট টি গেটের সাথে টাঙিয়ে আমি বের হয়ে যাই বাসায় থেকে।এগারো দিনের মাথায় আবারও চিরকুট। “আপনার ভয়। সহজ সরলতা।আপনার তাকানো।কোন দিকে না তাকানো।আপনার অভিমানী করে থাকেন আপমার স্টুডেন্ট প্রিয়ন্তীর সাথে , পড়া না পারলে।খুব ভাল লাগে স্বভাব গুলো।দেখা করতে চান।তাহলে আজ সন্ধ্যা ছয়টা হাতিরঝিল চলে আসবেন।আমি অপেক্ষায় করবো।আপনি আমাকে ডাক দিতে হবেনা।

আমি নিজেই আপনাকে ডাকবো।কি অদ্ভুত চিনলেতো ডাক দিব।আর এদিকে খুব চিন্তিত আছি।এই পর্যন্ত জবের জন্য বারোটা ইন্টারভিউ দেওয়া হয়ে গেছে।একটাতে চাকরি হয়ে গিয়েছিল।১২লাখ টাকা দিতে হবে।ঘুষের চাকরি।তাই আর করেনি।আর এত টাকা কোথায় পাব।ছোট ভেলা থাকতে মা বাবাকে হারিয়েছি।ছোট থেকে বড় হয়েছি অবহেলার মাঝে দূরসম্পর্কের এক খালার কাছে।তার পরেও তার কাছে অনেক ঋণী।পড়লেখা করে এত বড় করে দেওয়ার জন্য।সব সময় বলতো বাসায় থেকে বের হয়ে নিজে কামাই করে খাও।কিভাবে কামাই করবো।অনেক জনের গ্রেজুয়েনের দাম থাকে না।ব্যাংকে বা কোন ভাল প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে মামা খালু লাগে।আমারতো সেটুকুও নাই।যাক শেষমেষে আজ একটা ইন্টারভিউ দিয়ে মেয়েটির সাথে দেখা করতে যাব।।হলে হবে নাহলে আর কিছু করার নাই।ইন্টারভিউ দিয়ে মেয়েটির সাথে দেখা করতে চলে গেলাম।তার পরিচয় জেনে প্রথমে রাজি হয়নি।তার চোখ দুটি বলছে।সে আমার হবে।কিছু মেয়ের চোখ কথা বলে।এই ব্যস্ত শহরে আমার মত ছেলের প্রিয় একজন মানুষ নাই।তাই ভেবে চিন্তে রাজি হয়ে গেলাম।ঠিক এই কথাটির মত?

“একটি উত্তরবোধক চিহ্ন কেন হলো না।জীবনের উত্তরবোধক চিহ্ন কিংবা উত্তরের বড়বেশী প্রয়োজন !” অনেক ভেবে চিন্তা আর ফ্রেন্ড রাতুলের কথা শুনে রাজি হয়ে গেলাম।এভাবে শুরু হয়ে গেল নতুন করে দিবালার এক জোড়া শালিকের ভালবাসা।কোন সময় টি-শার্ট।আর কোন সময় পাঞ্জাবি , ঘড়ি থেকে শুরু করে ছোট ছোট অনেক গিফট পেতাম।ঘড়িটা দেওয়ার একটা কারণ।শুধু টাইম মেইনটেইন করে আসার জন্য। হাতিরঝিলে টঙ দোকানের সাথে প্রিয় বেঞ্চটি হয়ে যায় সদ্য দিবালোকে প্রেমিক প্রেমিকার।এই হচ্ছে রিচি আর ফাহাদের পরিচয়।এমন সময় কে ফোন করলো।ও আচ্ছা রাতুল ফোন দিয়েছে। “হ্যা!রাতুল বল?

“তোর বাসার সামনে দিয়ে যাচ্ছি।
” তাহলে বাসায় আয়।আড্ডা দিব।আর চায়ে চুমুক দিয়ে দু’বন্ধু হারিয়ে যাব আড্ডাতে।
“ভাবী আছেনা।মাইন্ড করবে।
“তোর ভাবী শপিং করতে গেছে।

পাশের ফ্ল্যাটের ভাবীর সাথে।আসতে একটু দেরী হবে। আচ্ছা তাহলে আসতেছি। রাতুলের সাথে আড্ডা দিচ্ছি আর চায়ে চুমুক দিচ্ছি। কবে বিয়ে করবে।নানান বিষয়ক নিয়ে।আমাকে একটা জবের ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য।অন্তত বউকে নিয়ে কিছু স্বপ্ন দেখার জন্য।`ফাহাদ তোর একটা ফোন আসছে।অচেনা নাম্বার থেকে।রিসিভ করছি কথা বল। ” হ্যালো আসসালামুআলাইকুম।কে বলছেন? আপনি রিচির কি হোন।ওর ফোনে আপনার নাম্বারটা লভ রিয়েক্ট দিয়ে সেভ করা।নিশ্চয়ই মনে খুব কাছের হবেন।

“আমি তার হাজবেন্ড বলছি।আমার রিচি কোথায়।তার কি হইছে।প্লিজ আমাকে বলেন। আপনি তাড়াতাড়ি করে স্কয়ার হসপিটালে চলে আসেন।আসলে দেখতে পারবেন। “রাতুল আমার রিচির কি হইছে।ভাই ওর কিছু হলে আমি থাকতে পারবোনা। “তুই কাঁদবিনা।আল্লাহ ভরসা।তুই আমার সাথে চল। রাতুলের অফিসিয়াল গাড়িটা নিয়ে তাড়াতাড়ি করে চলে যাই স্কয়ারে। হসপিটালের দেয়ালের সাথে ভাবী হেলান দিয়ে কাঁদতেছে। ” ভাবী কি হইছে।রিচি কোথায়।কিছু বলছেন না কেন। ভাবী চুপ করে থাকবেন না।প্লিজ। ভাইয়া হঠাৎ দুটি চিন্তাইকারী আসলো বাইক চালিয়ে ,ভাবীর পার্স নিয়ে টানাটানি করছিল।এক পর্যায়ে ভাবী রিকশা থেকে পড়ে যায়।এর পর থেকে ভাবী জ্ঞান হারায়।

“আপনার জন্য আজ আমার রিচি বিপদে পড়ছে।সপ্তাহে তিনদিন চলে যান শপিংমলে।কিসের এত শপিং। ফাহাদ তুই মাথা ঠান্ডা কর।আর কাঁদবিনা। রাতুলের কথার পর অটি থেকে বের হলো ডক্টর। স্যার রিচি কেমন আছে।একটু বলেন।প্লিজ। আমরা সব ধরনের ট্রাই করছি।যদি চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে রেজাল্ট না আসেন।মনে করবো আপনার স্ত্রী সারাজীবনের জন্য কমায় চলে গেছে। এভাবে চলে যায় দীর্ঘ দু’মাস।হ্যা রিচি কমায় চলে গেছে আর সুস্থতার মাঝে ফিরে আসেনি।তার সাঁজানো প্রিয় রুমটি আজ দু’মাস হসপিটালের রুম হয়ে গেছে।রুমের দেয়ালে আলতা রাঙানো পায়ে নুপুর পড়া মেয়েটি চুপ হয়ে গেছে দেয়ালের ছবির মত কোন কথা বলেনা।যে মেয়ে সারাক্ষণ চুল কাটার জন্য বিরক্ত হয়ে যেত।আর আমি তাকে চুল কাটার জন্য দিতাম না।কোমর পর্যন্ত চুল গুলো হয়ে গেছে অবুঝ শিশুর মাথার মত।

বাপের শেষ চার ডিশিমের জায়গাটা বিক্রি করে কিছু ফ্রেন্ডের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে ইন্ডিয়ার চেন্নাই থেকে শুরু করে বুনাই পর্যন্ত চিকিৎসা করিয়েছি।কোন ভাল ফলাফল প্রকাশ পাইনি।শুধু আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকে বোবা শিশুর মত।তার সাথে বিছানা করে আমাকে থাকতে হয়।সে খুব ভয় পায় একা থাকতে।না থাকলে খুব ভয় পাবে।হ্যা খুব ভয় পাবে। ফাহাদ ভাবী কেমন আছে। “আগের মত।যেমন দেখে গেছিস।যার কোন উন্নতি নাই ,ভাই যে মেয়েটি চঞ্চল হাসিমাখা ছিল।আজ সে মেয়েটি কিভাবে নিশ্চুপ আর চার দেয়ালে বন্দী হয়ে গেল।ভাই আমিতো জীবনে কারোর ক্ষতি করিনি।সব সময় ভাল চেয়েছি।আজ প্রকৃতি কেন আমার সাথে এত বড় বেঈমানী করলো। ভাগ্য বড় নির্মম।কাঁদতে কাঁদতে চোখের নিচে কালি করে ফেলছিস।এভাবে আর জীবন যাবেনা।নতুন করে আরেকটা সংসার কর।বিয়ে কর।

” আজ বন্ধু বলে তোকে কিছু বললাম না।জীবনে রিয়েলিটি প্রেম একবার আসে।।আর বিয়েও মানুষের জীবনে একবার।দ্বিতীয় বার সে অনুভূতি আরো কারোর প্রতি আসেনা।হোক প্রেম না হয় বিরহ।তুই কেন কাঁদছিস।আমার কষ্টের ভাগ কাউকে দিতে চাইনা।আমি তার দিকে তাকিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবো।তবে বিশ্বাস করি সে আমার মাঝে আবারও ফিরে আসবে। বন্ধু!তোর মত প্রেমিক হয়না।বেঁচে থাকুক তোর আর রিচির ভালবাসা চিরঅমর।এক যুগ নয় সাত যুগ একজন আরেকজনের প্রতি বেঁচে থাক।আচ্ছা তুই রিচির কাছে যা।কোন কিছুর প্রয়োজন হলে বলিস।এই বন্ধু তোর পাশে সবসময় আছে।আচ্ছা আমি তাহলে যাই। রাতুল আমার সাথে কথা বলে চলে যায়।কথা শেষ করে রিচির বিছানাটা চেঞ্জ করতে গেলাম।সে মুখের দিকে তাকিয়ে আছে অপলক দৃষ্টিতে।

আমি আছিতো।আছি।থাকবো। কখনো হারাবোনা। “আমিতো জিবন্ত লাশ।যার কোনো দাফন হয়না। যার হৃদয় ভাঙ্গনে কারো হাহাকার নেই। যার দহনে কেউ দু-ফোটা অশ্রু ঝরায় না। অার তুমি কি করে বুঝবে ,আমি যে মরেও বেঁচে আছি আছি শুধু তোমার জন্য। || “সেও এক চাদরে জোড়া শালিকের গল্প শুনাতো একদিন! আর এখন মাঘ মাস এলেই হু হু করে কাঁদে!”

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত