বান্ধবীরা যখন বলতো তোর স্বামী বুড়ো আমার তখন খুব খারাপ লাগতো। লাগবেই না কেন আমার বয়স মাত্র আঠারো আর আমার উনার বয়স চৌত্রিশ।ধরতে গেলে আমার বয়সের দ্বিগুণ।!মনে মনে কতো স্বপ্ন দেখতাম স্বামীর বুকে মাথা রেখে চাঁদনী রাতে খোলা আকাশের নিচে মাথায় বেলি ফুল দিয়ে বসে থাকবো। একদিন আমার ইচ্ছেটার কথা প্রকাশ করলাম এতে তিনি ভীষণ রেগে গেলেন “ধমকের সাথে বলল, বাহিরে শীত পরেছে শীত করবে চুপচাপ ঘুমাও। “মনটা সেদিন খুব খারাপ হয়ে গেলো।
নিজের ইচ্ছায় উনি আমার কাছে আসতেন না। আমি উনার কাছে না গেলে উনি কখনো আমায় ডাকতেন না।মনে মনে বাবা মাকে খুব বকতাম এমন একজনকে স্বামী হিসাবে চয়েস করার জন্য।তিনি শিক্ষকতা করতেন সেই সুবাদে আমায় সব কাজেই জ্ঞান দিতেন যা আমার একটুও সহ্য হোত না। আসিফ আহমেদ! মানে আমার স্বামী উনার বাবা মা অনেক আগেই মারা গিয়েছে। পরিবারে ও আর ওর বড় বোন আসফিয়া ছাড়া আর কেউ নেই।লেখক ফারিহা জান্নাত অরিদ্ধি।
আসফিয়া আপু বিবাহিত ওনার চার বছরের একটা ছেলে রয়েছে। তিনি চট্টগ্রাম এ থাকেন আর আমরা ঢাকায়। মুলত বেশীর ভাগ সময় আমার বাসায় একা থাকতে হয় যা একজন মেয়ের পক্ষে সত্যি কষ্টকর। উনি বাসায় আসলে ঘুম নয়তো কলেজের কাজ নিয়ে পড়ে থাকতেন। বাসায় যে উনি ছাড়া আরো একজন মানুষ আছে তার বউ সে কথা আসিফের চেতনা অবদি মনে হয় যেতো না। বান্ধবীরা বলতো তাদের স্বামী নাকি ছুটির দিন গুলোতে বাসায় থাকে বউয়ের সাথে রোমান্টিক কথা বলে বিকালে বেড়াতে নিয়ে যায় আর আমার উনি!! ঘুম নিয়েই পড়ে থাকে।
একদিন মনে হলো ওনার জন্য সাজতে।অমনি যেই ভাবা সেই কাজ আলমারি থেকে সবুজ কাতান শাড়ি বের করে পড়ে নিলাম ,চুল গুলো হাত খোপা করে তাতে বেলি ফুলের মালা গুঁজে দিলাম। চোখে গারো কাজল, ঠোঁট এ লাল টুকটুকে লিপস্টিক, হাতে লাল সবুজ কাঁচের চুড়ি দিলাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে লাগলাম সব ঠিকঠাক আছে কিনা! কপালে একটা লাল টিপ দিলে ভালো লাগতো কিন্তু উনি পছন্দ করেন না তাই নিজের ইচ্ছে সংবরণ করলাম। রাত বারোটা কলিং বেলের আওয়াজে গেট খুলে দিলাম। উনি আমায় একটি বারের জন্যও দেখলেন না। ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে এসে বসলে আমি উনার প্লেটে ভাত বেরে দিচ্ছি। উনি আমার দিকে না তাকিয়েই বলতে লাগলো “আহ্ এসব কি পরেছে যে ঝুনঝুন শব্দ করছে “আমি আর এক মুহূর্ত দেরী না করে রুমে এসে ড্রেসিং টেবিলে একটা বারি মারলাম যার ফলে আমার হাতের কাচের চুড়ি গুলো ভেঙ্গে হাত কেটে রক্ত পড়তে থাকে।
বিকট আওয়াজ ও হয় কিন্তু তবুও উনি আসে না। আমি ঐ হাত নিয়ে রুম অন্ধকার করে অপর দিকে মুখ করে বেডে শুয়ে কাঁদছি, খাবার খেয়ে এসে উনি আমার অপর পাশে শুয়ে পড়লেন “এরকম পেত্নীর মতো করে সেজেছ কেন? “আর কখনো এরকম সাজতে জেন না দেখি। লেখক ফারিহা জান্নাত অরিদ্ধি। সেদিনে পর থেকে টানা সাতদিন আমি ওনার সাথে ঠিক মতো কথা বলি নি। হঠাৎ একদিন ওনার বুকে মাথা রেখে শুয়ে বললাম “আপনি এমন কেন? বউয়ের সাথে মিষ্টি কথা বললে কি এমন হয় ।”উনি আমার মাথায় হাত দিয়ে বললেন “নীরু পেঁয়াজের দাম আজকে 250 টাকা কেজি গেছে। “এই কথা শোনার পরে আমি কি বলবো বা আমার কি করা উচিত আমি বুজে উঠতে পারছি না। আমার মাথাটা ওর বুক থেকে নামিয়ে বালিশে রাখলাম।
এভাবে দিন গুলো চলতে থাকলো উনি ব্যস্ত থাকেন আর আমি থাকি উনার দেওয়া অবহেলা নিয়ে। একদিন বুজতে পারি আমার ভিতরে আর একটি প্রাণ রয়েছে যে কিনা আমার ও আসিফের অংশ। ভাবলাম আসিফ ডক্টরের কাছে নিয়ে গিয়েছিল ছিলো রির্পোট ত ওর কাছে ও হয়তোবা সব জানে আমায় এবার সারপ্রাইজ দিবে কি রোমান্টিক সিনটাই না হবে আমার এসব আশায় জল ঢেলে দিয়ে আসিফ ইয়া বড় এক ঝুড়িতে বিভিন্ন রকমের ফল এনে আমার মুখে পুরতে শুরু করে দিলো। আমি বাধ্য হয়ে ওকে বললাম –আসিফ আমি আর পারবো না খেতে! সে আমার মুখে দিকে এক নজর তাকিয়ে বললো কি ভাবছো আমি এসব তোমার জন্য এনেছি? এসব আমি আমার সন্তানের জন্য করছি। ওর বেশি পুষ্টিকর খাবার দরকার তাহলে স্বাস্থ্যবান হবে ।মনে মনে বললাম বাহ্ খুব ভালো বউ এখানে খেতে খেতে পেট ফেটে মরে যাওয়ার মতো অবস্থা আর উনি বাচ্চার স্বাস্থ্য ভালো করছেন।
যখন আমি চার মাসের গর্ভবতী হঠাৎ একদিন ওয়াশরুমের সাবানের উপর পা দিয়ে পিছলে পড়ে যাই। তারপর আমার কিছু মনে নেই যখন জ্ঞান ফিরল তখন নিজেকে হসপিটালের বেডে দেখতে পারি সব কিছু মনে পড়তেই আমার হাত পেটে দিয়ে অনুভব করতে পারি আমার বাচ্চাটা নেই। আমার দু হাতে ক্যানল, স্যালাইন ও ব্লাড চলছে। আমি চিৎকার দিয়ে উঠি আমার বাচ্চা আমার বাচ্চা বলে কাঁদতে থাকি আমার চিৎকার এ ডক্টর নার্স সবাই এলো কারণ আমার অবস্থা খুব একটা ভালো ছিলো না। লেখক ফারিহা জান্নাত অরিদ্ধি। আজ তিন দিন পর নাকি আমার জ্ঞান ফিরেছে। এ তিন দিন নাকি আমি মৃত্যুর সঙ্গে লড়েছি। প্রচুর ব্লিডিং নাকি হয়েছিলো যা অফ করা সম্ভব ছিলো না। আমার উনি নাকি এই তিনদিন পাগলের মতো কেঁদেছে ডক্টরের পা অবধি ধরেছে আমার জন্য অথচ দু ঘন্টা পেরিয়ে গেলো এখনো দেখতে আসলো না।
দরজা খুলার শব্দ পেয়ে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি আসিফ এসেছে ওর চোখ দুটো লাল, চুল উস্ক ,মুখ শুকনো ,ফর্সা মানুষ ওর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে রয়েছে ওর এ অবস্থা দেখে আমি কেঁদে দেই। আমার এভাবে কাঁদতে দেখে উনি তড়িঘড়ি করে আমার বেডে এসে জড়িয়ে ধরে উনিও কাঁদতে থাকে। এতো বছর সংসার জীবনে এই প্রথম উনাকে কাঁদতে দেখলাম তাও আবার আমার জন্য।ওকে এভাবে পেয়ে আমার কান্নার বেগ আরো বেড়ে যায়। উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন– নিশু! এভাবে কেঁদো না পাগলী । তোমার ত কষ্ট হচ্ছে। আল্লাহ যা করে ভালোর জন্য করেন। দেখবে আমাদের আবার সন্তান হবে ওনার ইচ্ছায় !!!আমি আসিফের চোখে আমার প্রতি লুকানো ভালোবাসা দেখতে পেরেছিলাম এই প্রথম।
সেদিনের ওর কথা গুলো সান্তনা দেওয়া হলেও পরে বুজতে পারলাম শুধু সান্ত্বনা ছিল না কারন আজ আমি দুটো জমজ মেয়ের মা আর ও বাবা। ইশা ও আশা আমাদের মেয়ে বেশ বড় হয়ে গেছে। আজ আমি আবার আমার উনাকে সারপ্রাইজ দিবো আমাদের আবার নতুন অতিথি আসবে এবার উনি কি করবে আল্লাহ ভালো জানেন!!!!