বহুদিন নিজের ঘরটা গোছানো হয়নি। বাড়ির নানা কাজে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম যে কোনোদিকে তাকানোর সময় পাইনি । বুকসেল্ফের দ্বিতীয় তাকটা থেকে পুরোনো অঙ্কের বইগুলো বের করে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে দুটো বইয়ের মাঝ থেকে একটা পাতলা ডায়েরি টুক করে মেঝেতে পড়ে গেল ! এখানে আবার ডায়েরি কেন ? ডাইরিটা হাতে নিয়ে পাতা খুলতেই চমকে উঠলাম !
প্রথম পাতাতেই সীমার একটা পোস্টকার্ড সাইজের ফটো সুন্দর করে আঁঠা দিয়ে আটকানো ! নীচে নাম লেখা – সীমা সাহা । ফার্স্ট সেমিস্টার বাংলা অনার্স । মনটা কখন ফ্ল্যাশব্যাকে আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে কলেজ জীবনে চলে গেল ! কলেজের প্রথম দিন । কলেজ গেটটা পেরিয়েছি কি হুড়মুড় করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো । কলেজ ঢুকতে এখনো অনেকটা পথ ! ভিজবো নাকি ! আমার এমনিতেই ঠান্ডা লাগার ধাত । তাই কোনোকিছু না ভেবেই পাশে একটা মেয়ের ছাতার তলায় ঢুকে পড়লাম !
— প্লীজ , যদি কিছু মনে না করেন মেয়েটি হালকা হাসিতে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলল ,
— আরে না না , ভিজবেন নাকি আসুন ! তবে ছাতাটা আপনাকে ধরতে হবে । আপনি অনেক লম্বা !
ছাতাটা হাতে নিয়ে মাথা বাঁচিয়ে কলেজ ক্যাম্পসে পৌঁছে গেছিলেন দুজনে। সেই থেকে দুজনের বন্ধুত্ব শুরু, সময়ের সাথে সাথে আমাদের বন্ধুত্ব সুদৃঢ় হয়। সীমার কলেজ শেষ হওয়ার আগেই আমি চাকরি পেয়ে গেছিলাম কলকাতায়। সীমা, পুরোনো বন্ধু বান্ধব, বাবা মা, বোনকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছিল খুব,কিন্তু কাউকে বলিনি।বললেও হাস্যকর হোতাম হয়তো!ছেলে হয়ে জন্মেছি যখন বাইরে চাকরি পেলে যাবো, সে এমন আর কি! সীমা বললো তুমি চাকরি পেলে আমায় একদিন ট্রিট দেবেনা! নিজের মনের ভাবকে আড়ালে রেখে বললাম, নিশ্চয় দেবো, চল সামনের রবিবার কোথাও গিয়ে খেয়ে আসি। এক কথায় রাজি হয়ে গেল সে। ভাবলাম সেদিন ওকে বলবো যে ওকে আমি ভালোবাসি।
সারারাত ঐ টেনশনে ঘুমোতে পারিনি। একটা কফি সপে বসে আছি, সীমা এখানেই আসবে বলেছে, সে এলো পাক্কা চল্লিশ মিনিট পর, চোখমুখ কেমন যেন থমথমে, বল্লাম কি হয়েছে! কিছুনা বলে এড়িয়ে যেতে চাইছিল বললাম বলেই ফেল না সমস্যাটা, দেখবে ঠিক সমাধান করে দেবো। আশার আলো জ্বলে উঠল ওর চোখে। বললো জয়ন্ত এখন বিয়ে করতে চাইছেনা, এদিকে আমার বাড়ি থেকে চাপ দিচ্ছে। ও বলছে যতদিন না ওর ভাই একটা চাকরি পায় ততোদিন ও কিচ্ছু করবে না। পায়ের তলায় মাটি সরে যাচ্ছিল, কি বলবো আমি, জয়ন্তকে যে সীমা ভালোবাসে সেটাই আমি জানতাম না। সীমা অনেক কিছু বলে যাচ্ছিলো আমার মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো কথাগুলো।
কষ্টটা বুকে নিয়ে কলকাতায় চলে এলাম। আসার পর ওকে ফোন করিনি কদিন, একদিন অফিস থেকে ফিরছি দেখলাম সীমা ফোন করেছে, প্রথমটায় অভিমানে ফোন ধরিনি, পরে অনেক বার করতে দেখে ফোন তুলতেই ও বললো কলকাতা গিয়েই ভূলে গেলে, গিয়ে তো মানুষ একটা কুশল সংবাদ দেয়, তুমি তাও দিলেনা , কেন গো আমি কি এতোই খারাপ! অভিমান সরিয়ে বললাম তা না আসলে একটু ব্যস্ত ছিলাম আর দেখছিলাম তোমার আমার কথা মনে পড়ে কি না! মনটা হালকা হয়ে গেছিলো কথা বলে।
প্রায় কথা হতো তার সাথে, ও নিজেই ফোন করতো। একদিন বললো রেডি হও, সামনের মাসে আমার বিয়ে, তোমায় আমার পাশে থাকতেই হবে, তুমি আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড বলে কথা! বললাম নতুন চাকরি, ছুটি পাবোনা মনে হয়, দেখব চেষ্টা করে। ও বললো আমি কোনো কথা শুনবো না, সবার আগে তোমাকে জানালাম, তুমি যে করেই হোক ছুটি ম্যানেজ কর, আর না পেলে আমি তোমার অফিসে গিয়ে ঝামেলা লাগিয়ে দেবো তোমার বসের সাথে। হেসে ফেলেছিলাম ওর কথা শুনে, বললাম আমি দেখেছি। তারপর থেকে রোজ বিয়ের কেনাকাটা, হানিমুনে কোথায় যাবে, কি করবে সব কথা বলতো আমায়। ওর খুশি আর উচ্ছাস দেখে আমার মনের মেঘ সরে গেছিলো। ভাবছিলাম সুখী হোক।
বিয়ের আগেরদিন পৌঁছলাম, মা বললো যা দেখা করে আয় আগে, একটু আগেই ফোন করে খোঁজ নিচ্ছিলো তোর, আর এই আংটিটা দিয়ে বলিস আমি পাঠিয়েছি। আমি একটা সুন্দর শাড়ি এনেছিলাম। সীমা আমায় দেখে টেনে ওর ঘরে নিয়ে গেলো, বললো দাও আমার জন্য কি এনেছো! শাড়িটা দেখে দারুণ খুশি, বললো খুব সুন্দর, তোমার চয়েসটাও কিন্তু দারুণ, এটা আমি অষ্ট মঙ্গলায় পরে আসবো, তুমি কিন্তু থেকো।বললাম জয়ন্তর খবর কী, উতলা হয়ে আছে তাই না বিয়ের জন্য!ফোন করে তো রোজ!
সীমা বললো দেখো কেমন ছেলে, ফোন করলে বলে এতো ফোন কর কেন?মধ্যে মোটে কয়েকটি দিন,তারপর দুজনে সারাদিন সারারাত গল্প করবো।আমায় বলেছে বাড়ি ভর্তি লোকজন এখন,কথা বলার স্কোপ নেই,এখন বিয়েটা হতে দাও আগে, তারপর ওকে মজা দেখাবো! মায়ের আংটিটাও দিলাম ওটা পরে তার মাকে দেখাতে চলে গেল। বিয়ের দিন আমি সকাল থেকেই ও বাড়িতে, একবার এদিক একবার ওদিক ফাই ফরমাশ খাটছি, বিয়ের সময় হয়ে এলো তবু বরের পাত্তা নেই। যারা বর আনতে গেছিলো তারা ফিরে বললো ওদের বাড়িতে কেউ নেই, ওরা ওর ভাইয়ের চাকরির জন্য দিল্লি গেছে।
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো, হম্বিতম্বি শুরু করলো সবাই, মেয়ে মহলে কান্নার রোল উঠলো। সীমা শুনে চুপচাপ বসে রইলো, সবাই বললো বড্ডো বাঁচা বেঁচে গেলো মেয়েটা, কি চিটার রে বাবা, কথার কোনও দাম নেই, বাবা মা কেমন? এক ছেলের বিয়ের চেয়ে আরেক ছেলের চাকরিটাই বড় হলো! আর মেয়েটা যে লগ্নভ্রষ্টা হলো তার কি হবে!
লগ্ন থাকতে থাকতে আমার সাথে বিয়ে হয়ে গেল সীমার, তার আগে আমি অবশ্যই সীমার মতামত নিয়ে নিয়েছিলাম।
বেশ ভালোভাবেই আমাদের বৈবাহিক জীবন কাটছিলো, হঠাৎ এই ডায়েরিটা পৃষ্ঠা কয়েকটা উল্টে দেখি, লেখা আছে “জয়ন্ত আমি তোমাকে ঘৃণা করি, একসময় ভালোবাসতাম বোলে অভিশাপ দিতে পারলাম না, তোমার সাথে বিয়ে হলে আমার ভবিষ্যৎ কি হতো আমি জানতাম না, তবে আমার অনেক কিছু না পাওয়া রয়ে যেত। রাজকে স্বামী হিসেবে পাওয়ার পর মনে হয় মা বলতো”ভালো ঘর ও ভালো স্বামী “পাওয়া মেয়েদের ভাগ্যের ব্যাপার। আজ আমি এটাই বিশ্বাস করি। তোমার সাথে বিয়ে না হয়ে ভালোই হয়েছে, তাই আমি রাজ এর মতো একটা ভালো বন্ধু ও কেয়ারিং স্বামী পেয়েছি। আমি ভগবানের কাছে চির কৃতজ্ঞ! “এই নাও তোমার চা”সীমার গলা পেয়ে ডায়েরিটা সরিয়ে রাখলাম। আজ সত্যিই নিজেকে অনেক হালকা লাগছে।