পারফেক্ট কাপল

পারফেক্ট কাপল

টুং, টুং ধীর লয়ে মুঠোফোন থেকে বেশ কয়েকবার ভেসে আসে শব্দটা। তার সাথে সাথে টেবিলের ওপরে রাখা ফোনটা কেঁপেও ওঠে বেশ কয়েকবার। উত্তম বুঝতে পারে হোয়াটসঅ্যাপ এ মেসেজ এসেছে। ঘুম ভেঙে গেলো উত্তমের , পাশে তাকিয়ে দেখলো ও একবার। সঙ্গীতা এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সঙ্গীতার পাশে শুয়ে ওদের তিন বছরের সন্তান – ডিম্পি। ডিম্পির ডায়াপারটা বেশ ফুলে গেছে এর মধ্যে। সেই সকাল থেকে ঘুমোচ্ছে ও। সারা রাত ধরে জার্নি করে আজ সকালেই ওরা ঢুকেছে ওদের বাড়িতে। উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলের কাছে এগোয় উত্তম , ফোনটা টেনে নেয় নিজের কাছে।

ওদের দুজনের ফটোটা দেখে সুহিতা লিখেছে , “কি সুন্দর লাগছে তোমাদের দুজনকে , একদম যাকে বলে মেড ফর ইচ আদার। তোমাদের দেখেই মনে হয় তোমাদের মধ্যে খুব ভালো বোঝাপড়া আছে, একদম একজন আরেকজনের পরিপূরক। পারফেক্ট কাপল ! ” হাসি ফুটে ওঠে উত্তমের মুখে। সেই হাসিটা ছিলো যন্ত্রনার, কষ্টের, অভিমানের, দুঃখের।

গত সপ্তাহে ওরা তিনজনেই গিয়েছিলো একটা বিয়েবাড়িতে। সঙ্গীতার পিসীর মেয়ের বিয়ে ছিলো। ভীষণ হইহই করে কোথা দিয়ে যে কেটে গেলো কয়েকটা দিন। সবাই তো ডিম্পিকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা। আর ডিম্পিও এতো নতুন নতুন সব দাদু – দিদা। মামা – মামী , কাকু – কাকীমাকে পেয়ে ভুলেই গিয়েছিলো মা বাবাকে। ওদের কোলে কোলেই ও ঘুরেছে এই কদিন। আজ সকালে বাড়িতে ঢুকে , সারা দুপুর ধরে ঝিমিয়ে – পড়ে ছিলো ওরা তিনজনেই বিছানায়। ডিম্পি ঘুমিয়ে পড়েছিলো, কিন্তু উত্তম আর সঙ্গীতা পাশাপাশি শুয়ে শুয়ে ফোনে দেখছিলো সদ্য কাটিয়ে আসা বিয়ের নানান রঙ্গীন মুহূর্ত। বিয়েবাড়িতে আলাপ হয়েছিলো সুহিতার সাথে। সুহিতা, সঙ্গীতার দূর সম্পর্কের এক কাকীমার মেয়ে। কাকীমা খুব কষ্ট করে একা বড়ো করেছেন মেয়েকে। যখন সুহিতা ছোট ছিলো, ওর বাবা ওকে ছেড়ে, ওর মা কে ছেড়ে অন্য একজনের সাথে চলে যায়। সুহিতা এখন একটা ব্যাঙ্কে কাজ শুরু করেছে বছরখানেক।

সুহিতা একসাথে উত্তম আর সঙ্গীতাকে দেখেই এগিয়ে এসেছিলো , এসে জড়িয়ে ধরেছিলো সঙ্গীতাকে। অনেকদিন পরে দেখা হওয়ার পরে, দুজনের চোখেই ছিলো জল। কথায় কথায় সুহিতার মা ও চলে এসেছিলো ওদের মাঝে। কাকীমা সঙ্গীতা আর উত্তমকে দেখিয়ে মেয়ের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “দেখ তো, কত সুন্দর মানিয়েছে ওদের দুজনকে। আর তুই কিনা বিয়ে করবি না বলছিস ! ”

সুহিতা হাসতে হাসতে বলে ওঠে, “সে তো আমি জানি মা। দাদা আর দিদি প্রেম করে বিয়ে করেছিলো। আর দুজনকে দেখেই বোঝা যায় ওরা একে অন্যের পরিপূরক। কিন্তু এখনকার ছেলেগুলো না একদম ভালো নয় ! এখনকার ছেলেগুলো শুধু খেলবে , আর তারপরে বেরিয়ে যাবে। ” সঙ্গীতা সুহিতার মাথায় চাঁটি মেরে বলেছিলো, “তাই না ? তুই কি অনেকগুলো প্রেম করেছিস ? এতো রাগ কেন ছেলেদের ওপরে। সবে তো তোর জীবন শুরু হচ্ছে। তাড়াহুড়ো না করে অপেক্ষা কর, তোর রাজপুত্র ঠিক আসবে ! ” ফোন নম্বর আদান প্রদান হয়, ক্যামেরাম্যান কে ডেকে তোলা হয় ফটো। সেই সব ফটোওরা দুজনে দেখছিলো দুপুরে শুয়ে শুয়ে। একটু পরেই ক্যামেরাম্যান বেশ কয়েকটা ফটো পাঠায় ওদের দুজনকেই।

একটা ফটো দেখে সঙ্গীতা উঠে বসে বিছানার ওপরে , উত্তমকে ও টেনে তোলে, “এই দেখো , আমাদের দুজনকে কি ভালো লাগছে এই ফটোতে। আমি শাড়িতে , আর তুমি ধুতি পাঞ্জাবীতে, কি যে ভালো লাগছে। এই ফটোটা আমরা ফ্রেম করবো, কেমন ? ” “সত্যি ভালো লাগছে , কেউ তো কোনোদিন এভাবে আমাদের ফটো তুলে দেয় নি। ঠিক বলেছো। আমরা ফ্রেম করবো এই ফটোটা।” উত্তর দেয় উত্তম। রাতে খাওয়ার পরে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না কেউ। প্রচন্ড ক্লান্তি ওদেরকে টেনে নিয়ে যায় বিছানায়। যাওয়ার আগে উত্তম মুঠোফোন টেনে হোয়াটসঅ্যাপ এর স্ট্যাটাস এ দেয় ওদের দুজনের ওই ফটোটা।

উত্তম চুপ করে বসে পড়ে অন্ধকারের মধ্যে। ভেতরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ওর জীবনের সবথেকে প্রিয় দুটি মানুষ। উত্তম সুহিতাকে উত্তর দেওয়ার জন্য টাইপ করতে যায়। হঠাৎ ওর চেতনায় জেগে ওঠে কিছু ভাবনা চিন্তা, যেটাকে ও জোর করে ভুলে থাকতে চায় প্রতিদিন, প্রতিটি মুহূর্তে। ফোনটা পাশে রেখে, দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে থাকে ঠান্ডা মেঝের ওপরে। চোখ মুখ নাক কান সারা শরীর ঢেকে যায় গভীর অন্ধকারের মধ্যে। চারদিক থেকে ভিড় করে আসে অনেকগুলো শব্দ, শব্দের ধ্বনি – ওর ওপরে এসে পড়তে থাকে হাজার হাজার শব্দ, বাক্য – পারফেক্ট কাপল, মেড ফর ইচ আদার পরিপূরক লাভলি কি সুখী পরিবার রব নে বনা দি জোড়ি

তার মাঝে ও দেখতে পায় হঠাৎ করেই নিজেকে , ওর শরীর থেকে একটা ছায়া বেরিয়ে চলে গেছে সামনে, হামাগুড়ি দিচ্ছে ওর অবয়ব ; সেই অবয়ব বাঁচতে চাইছে ওই কথাগুলো থেকে, আশ্রয় খুঁজছে , কোনো এক নিরাপদ আশ্রয়, যেখানে আর শুনতে হবে না এই সব কথা ওকে। করতে হবে না মিথ্যে অভিনয় – অভিনয়,সবার সামনে ভালো থাকার। ভালো ? সুখী ? খুশী ?

অবয়বটা দাঁড়াতে চাইছে উঠে , পারছে না। কানের গভীরে তীরের মতো ঢুকে যাচ্ছে শব্দগুলো , দু হাত দিয়ে ঢেকে রেখেছে কান, বন্ধ করে রেখেছে চোখ ওর ছায়া-অবয়ব। হাসতে হাসতে অবশেষে সব বাধা অগ্রাহ্য করে উঠে দাঁড়ায় সেই ছায়া মানব, ওর দিকে আঙুল তুলে জিজ্ঞেস করে, “কি রে উত্তম ! তুই ভালো আছিস ? ” উত্তম সম্মোহিতের মতো, দৈনন্দিন অভ্যেসবশে মাথা নাড়ে, “ভালো আছি। ”

“মিথ্যে ! সব মিথ্যে। তুই ভালো নেই। সুখ, হাসি, খুশী – সব চলে গেছে তোকে ছেড়ে। জানিস আমরা সবসময় একজন আরেকজন কে কেন জিজ্ঞেস করি, ভালো আছেন ? আমরা কি আসলে সত্যি চাই যে অন্যজন ভালো থাকুক। চাই না, আসলে নিজেরাই যে ভেতরে ভেতরে ভালো নেই। আর তাই সেটা শুনতে চাই অন্যের মুখে , যে অন্যরাও ভালো নেই। কিন্তু আমরা কেউ পারি না সেকথা বলতে , সবার সামনে অকপটে। তাই মিথ্যে মিথ্যে বলি, আমি ভালো আছি। তুই, তোরা দুজনে কি সত্যি পারফেক্ট কাপল ? ”

মাথা নিচু করে উত্তম, কিছু উত্তর দিতে পারে না। “আমি বলছি। তোর তো গোড়াতেই গলদ রে। তুই কখনোই এইরকম জীবন চাস নি। তুই সবসময় চেয়েছিলিস নিজের শর্তে বাঁচতে। নিজের মতো করে ভালো থাকতে চেয়েছিলিস। হয়তো তুই একটু স্বার্থপর ছিলিস ! কিন্তু নিজেকে ভালোবাসা কি পাপ ? অপরাধ ? না রে গাধা ! আর সেটা তুই এখন বুঝতে পারছিস রোজ একটু একটু করে। তাই না ? সঙ্গীতা, তোর বউ, তোর ‘পরিপূরক’ ওর সাথে তোর কিরকম সম্পর্ক উত্তম ? “ককক কেন ? স্বামী স্ত্রী! ”

“কার কাছে মিথ্যে বলছিস তুই ? আমি যে তোর ভেতরেই থাকি উত্তম। আমাকে আর যাই হোক মিথ্যে বলিস না। তোদের সম্পর্ক এই পাঁচ বছরেই এখন হয়ে গেছে ভাই বোনের মতো না না , ভাই বোন না , আসলে প্রভু আর ভৃত্য ! সঙ্গীতা প্রভু আর তুই হাহাহাহা ! অস্বীকার করতে পারবি তুই ? তোকে দিয়ে জোর করিয়ে অনেক কিছুই করাচ্ছে ও, যেটা তোর নিজের পছন্দ নয় ! কিন্তু তবুও তুই বলতে পারিস না অশান্তি এড়ানোর জন্য ! সেটা কি আমি জানি না ? বিয়েতে যাওয়ার দুদিন আগে কি হয়েছিলো উত্তম ? মনে আছে ? অফিস থেকে ফেরার সময়ে, ও তোকে কিছু একটা জিনিস আনতে বলেছিলো ! কে যেন কি যেন একটা…ধুর ছাই ! দেখছিস? তোর ভুলে যাওয়ার রোগটা আমাকেও ছাড়ছে না? আর তুই যখন ঘরে ফিরে এলি অফিস থেকে, ও রেগে তোকে গুচ্ছের কথা শুনিয়ে, তোর কোমরে লাথি মেরেছিলো। মনে আছে তোর ? আর তারপরে রাতে আবার খাওয়ার সময়ে তোকে চড় থাপ্পড় মেরেছিলো কারণ “কারণ তখন আমি রাগ দেখিয়েছিলাম , ও আমাকে লাথি মেরেছিলো বলে ! ” বলে ওঠে উত্তম।

“ঠিক তাই ! আর মনে আছে, ও কি বলেছিলো তোকে ? আমাদের মধ্যে সব সম্পর্ক শেষ , তুমি অন্য রুমে একা ঘুমোবে। একা ! তাহলে বুঝতে পারছিস তুই ? এই বাড়িতে, তোর নিজের ও রাগ দেখানোর কোনো অধিকার-ই নেই। কিন্তু ও তোর ওপরে যত খুশি চোটপাট করতে পারে , মনের আনন্দে। কিন্তু তুই কিছু বললেই সেটা ওর গায়ে কিরকম চিমটির মতো লাগে ! ” চোখ থেকে জল বেরিয়ে আসে উত্তমের। কোনোরকমে বলে, “কিন্তু, কিন্তু আমি যে ওকে ভালোবাসি ! ”

“ভালোবাসা ? ভালোবাসা কি এরকম হয় ? ভালোবাসা একটা মিষ্টি সম্পর্ক উত্তম। দুজনেই কিছু নেবে, কিছু ছাড়বে। তার মাঝে এরকম ভাবে মারামারি, গালাগালি কেন আসবে তার মধ্যে ? ঝগড়া ঝাঁটি হোক, আর হবেও , কিন্তু এটা কি উত্তম ? কি হচ্ছে এটা ? তুই আসলে ভয় পাস ! ” “ভয় ? হ্যাঁ , সেটা সত্যি। আমি ভয় পাই। কিন্তু সে ভয়টা না পেলে যে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। এই সুন্দর সাজানো সংসার, সেটাও শেষ হয়ে যাবে। সাথে জড়িয়ে রয়েছে বাচ্চাটা। ”

ছায়াটা ধীরে ধীরে এসে বসে পাশে, উত্তমের শরীরের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে, “তুই হারিয়ে গেছিস উত্তম, নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে হারিয়ে ফেলেছিস। এই রাস্তা থেকে ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা তো আমি দেখতে পাচ্ছি না। নেই ফিরে আসার কোনো পথ খোলা তোর সামনে। তাহলে, যেভাবে সব চলছে, সেটাই চলুক। টেনে নে ওই যন্ত্রটা, লিখে দে সুহিতাকে , ‘থ্যাংক ইউ। ‘ সবাই জানুক , সত্যিই তোরা দুজনে একদম পারফেক্ট কাপল। ”

উত্তম উঠে দাঁড়ায় ধীরে ধীরে, ফোনে সুহিতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে যায় বিছানায়। পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে সঙ্গীতাকে। সঙ্গীতা ঘুমের ঘোরে, টেনে নেয় উত্তমের হাত, নিজের বুকের ওপরে। উত্তম এর হাত একটু অবাধ্য হয়, সঙ্গীতা সেই নরম আদর প্রকাশ করে মুখ দিয়ে কিছু অস্ফুট শব্দ বের করে। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে উত্তম।

সুহিতা অন্যদিক থেকে মেসেজ পাঠায়, “সত্যি বলছি দাদা, তোমাদের মতো কাপল আজকের দিনে দেখাই যায় না ! তোমাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং, তোমাদের মধ্যে যে ভালোবাসা, প্রেম, সেটা দেখা যায় বাইরে থেকে। তোমরা সত্যিই পারফেক্ট ! “

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত