চার ঘন্টা আরো অপেক্ষা করতে হবে এই এয়ারপোর্টে। বাইরে এতো ঘন কুয়াশা, বেশিরভাগ ফ্লাইট হয় দেরিতে চলছে না হলে ক্যানসেল হয়ে গেছে। তাও ভাগ্য ভালো যে আমার ফ্লাইট ক্যানসেল হয় নি ! এমনিতেই দশতঘন্টা টানা প্লেনের ভেতরে বসেছিলাম, সেই টোকিও থেকে মুম্বাই… কিরকম একটা করছে শরীরটা ! যদি ক্যানসেল হতো আমার মুম্বাই কলকাতা ফ্লাইট , আমি তো “আরর রে , তুই…আপনি তুলিকা না ? টুকু ? ” বলতে বলতে এগিয়ে এলো আমার দিকে এক ভদ্রলোক। মুখভর্তি দাড়ি, উঁচু লম্বা, এক হাতে একটা ট্যাব, আরেক হাতে রয়েছে ছোট একটা কেবিন ব্যাগ, বেশ দামী – চামড়ার তৈরী।
অবাক চোখে তাকালাম আমি, “আমি, আমি ঠিক চিনতে পুচু , পুচু মানে পারিজাত ! তুই ? তোকে তো চেনাই যাচ্ছে না রে। আয় আয় , বোস ! কোথায় যাচ্ছিস ? ” হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে, ধপ করে আমার পাশে বসে পড়লো পারিজাত, সেই কলেজের মতো। ট্যাব কেবিন ব্যাগের একটা চেনের ভেতরে ঢুকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে ওঠে, “আমিও তো তোকে দেখে…দাঁড়া দাঁড়া ; সিঁদুর ? মানে বিয়ে করে নিয়েছিস ? কবে হলো কেসটা ? আমি কিছুই জানতে পারিনি ! ”
পুচুর কথায় একটু লজ্জা পেলাম ভেতরে ভেতরে, শিউরে উঠলাম আমি ; লাস্ট দু সপ্তাহের হানিমুন, উদ্দাম শরীরী ভালোবাসা, প্রেম সব যেন চোখের সামনে হঠাৎ করে ভেসে উঠলো আমার। নিজের উত্তেজনা সামলে বলে উঠলাম, “এই তো ; মাস খানেক আগে বিয়ে হলো রে। অপ্রতিম – আমার হাসব্যান্ড ; ও টোকিও তে একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে কাজ করে। ওখানেই তো গিয়েছিলাম, হানিমুনে। ” “আরে বাহ্ ! মানে আমাদের সেই টুকু, এখন ইন্টারন্যাশনাল বৌ আর বৌমা ? আমি দেখতে পাচ্ছি আমাদের শহরের চারদিকে হোর্ডিং পড়লো বলে, ‘ইন্টারন্যাশনাল বৌমা’ ! ”
“ওহ, পুচু ! স্টপ ইট। তোর এইসব আজেবাজে ইয়ার্কি একদম ভালো লাগে না। সবকিছুতেই মজা ! কি করে পারিস তুই ?” “সেইজন্যই ম্যাডাম, আমি পুচু, আর তুই টুকু ! এই ছাড় না ওসব কথা। আমাকে বল, কেমন কাটলো তোদের হানিমুন ? বাইরে বেরিয়ে ঘোরা ফেরা হয়েছে ? না কি সারাক্ষণ , রুমের ভেতরে, দুজনে – একসাথে – মুচুচুমু…”
চোখ বড়ো বড়ো করে আমি একটা কিল মারি পারিজাতকে, “তুই আবার শুরু করলি ? আবার ? ভালো হচ্ছে না কিন্তু ! তবে, ভালো ছেলে রে, অপ্রতিম খুব ভালো। আমার তো খারাপ লাগছিলো ওকে ছেড়ে আসতে। কিন্তু কি করবো বল, আমার ও চাকরি, মা এখানে একা ! তবে ও এখানে ফিরে আসার কথা ভাবছে। দেখি কি হয়। ” “ততদিন আর কি, আমাদের ইন্টারন্যাশনাল বৌ কাম বৌমা , যাওয়া আসা করবে ! তা, তুই তো কলকাতা যাবি ! তোদের কলকাতার সব ফ্লাইট তো ডিলে দেখলাম। তোরটা কতক্ষণ ? ”
“চার ঘন্টা ! আমার তো ইচ্ছে করছে এখানেই শুয়ে পড়ি। ভালো লাগছে না, টানা দশঘন্টা ওই প্লেনের ভেতরে বসে , গা হাত পা সব ব্যথা হয়ে গেছে। আর ওই খাওয়ার। কি করে যে লোকজন খায় ! ” “তুই শুবি ? রেস্ট করবি ? এই আমি পা সোজা করছি, তুই মাথা রেখে শুয়ে পড়, রেস্ট কর ! ”
“পুচু, মার খেয়ে মরে যাবি আমার হাতে। আমরা এখন আর কলেজে পড়ি না ! তোর সাথে যদিও ব্যাপারটা আলাদা, সেই ছোট থেকে আমরা একসাথে বড়ো হয়ে, একইসাথে কলেজে, তবুও….আর তুইও তো বেশ ভালো কিছু করছিস মনে হচ্ছে তোকে দেখে। গ্রো আপ ! ” রেগে উঠি আমি। মাঝে মাঝে এমন আজে বাজে কথা বলে এই ছেলেটা ! উহ! পারিজাত আমার দিকে তাকালো, মাথা নামিয়ে বলে ওঠে, “সেটাই তো পারলাম না রে টুকু। সেটাই পারলাম না। ” হঠাৎ একটা অ্যানাউন্সমেন্ট ভেসে আসে , – অল দা প্যাসেঞ্জারস ফর রেড ফ্লাইট , ফ্রম মুম্বাই টু ডেলহি , আর রিকুয়েস্টেড তো প্রসিড অ্যাট গেট পারিজাত উঠে দাঁড়ায়, “আসি রে টুকু। আমার ফ্লাইট অ্যানাউন্স হলো। পরে আবার হয়তো দেখা হবে। ”
চলে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছে পুচু। হঠাৎ – একটা অপূর্ণতা, শূন্যতা এসে ঘিরে ধরলো আমাকে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “পুচু, ফোন নম্বর দে আমাকে তোর। আর তোর বৌ বাচ্চা কোথায় রে ? আমার সাথে আলাপ করবি না ? ওদের ফটো দেখা, তোর ফোনে নিশ্চয়ই… ”
আমার কথা শেষ হতে না হতেই ও ঘুরে তাকালো আমার দিকে , আমার চোখে চোখ রেখে বললো, “জানিস টুকু , অনেকদিন আগে, একটা মেয়ে ছিলো। তার নাম ছিলো…থাক, নাম জেনে কাজ নেই। তো সেই খেপি – পাগলি মেয়েটাকে আমি কতবার যে বলেছিলাম আমি তোকে বিয়ে করবো, তোকে ভালোবাসি। কিন্তু সেই মেয়েটা , ভাবতো আমি মজা করছি। আসলে সবসময় আমি মজা করতাম তো ! আর তারপর, তারপর কি যে হলো , আজ জানতে পারলাম সেই পাগলিটা বিয়ে করেছে। ভালো আছে। আমি সেই পাগলির জন্য অপেক্ষা করে করে” আবার ভেসে আসে অ্যানাউন্সমেন্ট – ডিস ইস দা লাস্ট অ্যান্ড দা ফাইনাল “যাই রে টুকু, এবার নাহলে এয়ারহোস্টেস নিজে এসে আমাকে কোলে তুলে নিয়ে যাবে। আর সেটা সবাই হাঁ করে দেখবে ; আমার প্রেস্টিজের ষাট সত্তর হয়ে যাবে একদম। ” হেসে চলে গেলো পুচু। অবাক হয়ে আমি তাকিয়ে থাকলাম ওর চলে যাওয়ার দিকে।
খেপি ! পাগলি? এই নামে শুধু দুজন আমাকে ডেকে এসেছে সারা জীবন , বাবা আর পুচু ! আমি, আমার জন্য ছেলেটা , এতদিন ধরে একটা মেসেজ আসে ফোনে , ভাইব্রেট করে। ফোনটা দেখলাম আমি, অপ্রতিম পাঠিয়েছে, “খুব মিস করছি আমার তুলিকে; এই কয়েকদিন যেন স্বপ্নের মতো কেটে গেলো। আজ অফিসে একদম ভালো লাগছে না। ইচ্ছে হচ্ছে , ইচ্ছে হচ্ছে তোমার কোলে মাথা রেখে, তোমার বুকের গন্ধ নিতে নিতে পাগল হতে আবার। প্লিজ ফিরে এসো। ”
ভালো লাগছে না অপ্রতিমের এই ভালোবাসা – শরীরের চাহিদা। এটাই কি ভালোবাসা ? তাহলে পুচু ? ওটা কি পাগলামি ? কেন পুচু? কেন তুই এলি আজ ? বেশ তো ছিলাম আমি আমার অলীক ভালোবাসার স্বপ্নের জগতে ! বেশ তো ছিলাম আমি বসে পড়ি, দুহাত দিয়ে ঢেকে দিই মুখ , দু চোখ ছাপিয়ে জল আসছে আমার। পারছি না আটকাতে কিছুতেই আমি !
সমাপ্ত