অমরপ্রেম

অমরপ্রেম

উফফ যা ঠাণ্ডা পড়েছে গত দিনদুই ধরে তাতে আরেকবার চা পান করলে মন্দ হতনা মনে মনে ভাবেন বিশ্বনাথবাবু।যদিও বিকেলে এক কাপ অভ্যাসমত খেয়েছেন তবু যদি আর একবার হয়।আসলে চায়ের প্রতি বড়ই দুর্বল বিশ্বনাথবাবু সেই কলেজে পড়ার সময় থেকে।বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছেও সেই অভ্যেস ছাড়তে পারেননি।সবে তো সন্ধ্যে এখন।রাতের খাবার খেতে বেশ দেরীই আছে।

আর খাবার বলতে ওই কখনো রুটি,পনিরের তরকারি কখনো বা শীতের নানা সবজি দিয়ে দালিয়ার খিচুড়ি।বিশ্বনাথ আর ওনার স্ত্রী মালিনীদেবী দুজনে থাকেন কসবার একটা তিন কামরার ফ্ল্যাটে।ওদের একমাত্র ছেলে নৈঋত কর্মসূত্রে মুম্বাইতে আছে বছর পাঁচেক হল।কাজের চাপ সামলে বছরে বার কয়েক আসে মা বাবার সাথে দেখা করতে।তাই সাবধানে পা মেপে ফেলতে হয় দুই বুড়োবুড়িকে। বারবার ওনারা অসুস্থ হলে কে দেখতে আসবে?আত্মীয়স্বজনরাও যে যার জগতে ব্যস্ত। হটাৎ কোনো কিছু হলে আবাসনের প্রতিবেশীরাই ওই যা একটু ভরসা।

যাইহোক আর পারা যাচ্ছেনা। সত্যিই চায়ের জন্য মনটা বড় আনচান করছে বিশ্বনাথবাবুর।কিন্তু মালিনীকে কি এখন বিরক্ত করা ঠিক হবে?ইদানিং ওর বাতের ব্যথাটা বড্ড বেরেছে। সকালে কাজের লোক এসে সমস্ত কাজ করে দিচ্ছে,রান্নার লোক এসে সময়মত রান্না করে দিয়ে যাচ্ছে।রাতে কোনমতে সেগুলোই মাইক্রোওভেনে গরম করে সেটাই খাচ্ছেন দুজনে।সন্ধ্যে হতেই মালিশের তেল নিয়ে টিভির সামনে বসে যান মালিনী।

নৈঋত অফিস থেকে রাত নটা নাগাদ বেরিয়ে ফোন করলে ছেলের কথা বলা শেষ করে তবেই একেবারে রান্নাঘরে যান মালিনী। তারপর খাবার খেয়ে সোজা বিছানায়। এই হল প্রতিদিনের বাঁধাধরা রুটিন। তবে মাস সাতেক হল মাইনর হার্ট অ্যাটাকটা হবার পর থেকে মালিনী যেন মনের দিক থেকেও দুর্বল হয়ে পড়েছেন একটু সেটা অনুভব করেন বিশ্বনাথ।নইলে আজকের দিনটা ভুলে যায় কি করে? এরকম তো আগে কখনো হয়নি। সে যাইহোক এতদিন না হয় এইদিনে মালিনীর থেকে সারপ্রাইজ পেয়ে এসছেন বিশ্বনাথ এবার কিছু অন্যরকম হোক।

আজ আর ওকে বিরক্ত না করে নিজেই চা বানাতে রান্নাঘরে যান বিশ্বনাথবাবু। কাপে চা ঢেলে সবে দুধটা মেশাতে যাবেন এমনসময় কলিং বেল বাজতেই উনি গিয়ে দেখেন খাদ্য সরবরাহকারী সংস্থার একটি ছেলে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে বলছে,”আঙ্কেল একটা ব্ল্যাক ফরেস্ট কেকের অর্ডার আছে এই ফ্ল্যাট নম্বর থেকে।”

__”তোমার বোধয় কোথাও ভুল হচ্ছে।স্বামী,স্ত্রী দুই বয়স্ক মিলে থাকি কে দেবে ওমন কেকের অর্ডার”;উনি বলেন।ওদের কথার মাঝখানে ততক্ষণে চলে এসছেন মালিনী।

__”না কোনো ভুল হচ্ছেনা। ঠিক ঠিকানাতেই এসছে ও”;এই বলে ছেলেটির হাত থেকে কেকের বাক্স নিয়ে নমস্কার জানিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে মালিনী। ঘাড়টা ঘুরিয়ে স্বামীর দিকে ফিরে বলেন,”কি ভাবছ?শরীর খারাপের কারণে আজকের এই বিশেষ দিনটার কথা ভুলে গেছি আমি?মোটেই তা নয়। দিনের শেষ তো কি?আমিই সন্ধেবেলা সারপ্রাইজ দেবার বন্দোবস্ত করলাম। অনলাইনে জিনিস কেনাটা নৈঋতই আমাকে শিখিয়ে দিয়েছে। আর আজ কেকটা কাটার সময় ও ওদিক থেকে ভিডিওকলে আমাদের সাথে যোগ দেবে।শুভ জন্মদিন কর্তামশাই।”

__”বাঃ সেতো খুব ভালো কথা।তবে এটাসেটা উপহার তো অনেক দিলে আমাকে সারাজীবন।এবার অন্তত কিছু হলেও আমার ফিরিয়ে দেবার পালা।নিজের হাতে চা বানিয়ে খাওয়াতে চাই তোমাকে। তোমার আনা জন্মদিনের কেক আর আমার বানানো চা।তাছাড়া ওবেলা বাজার থেকে কিনে আনা তোমার জন্য তাজা লাল গোলাপ।জন্মদিন উদযাপন একেবারে জমে যাবে কি বলো?”

__”ফুলগুলো কিনে এনে কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলে শুনি?ভীমরতি যতসব!”; মালিনী বলেন স্বামীর প্রতি কপট রাগ দেখিয়ে।

__”তুমি যখন সকালে ঠাকুরঘরে পুজো সারছিলে তখন চুপিচুপি বেরিয়ে নিয়ে এসে আমাদের খাটের নীচে বালতিতে জল ভরে রেখেছিলাম গো গিন্নী।পুরনো চালের মত বুড়ো বয়সে প্রেমটাও যে বাড়ে। একসাথে বুড়ো হতে পারাটাও যে আরেকরকম প্রেমের স্বরূপ।”, ফুলদানিতে গোলাপগুলো সাজাতে সাজাতে বলেন বিশ্বনাথবাবু।

টেবিলের উপর কেক, মোমবাতি ততক্ষণে সাজিয়ে ফেলেছেন মালিনীদেবী। ওনার পাশে এসে বসেন বিশ্বনাথ।ফু দেন মোমবাতিতে। ভিডিও কলে নৈঋত বলে,”হ্যাপি বার্থডে বাবা।বড়দিনের ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছি। তখন কিন্তু আরো একবার কেক কাটা হবে আমার জন্য।এখন কাটলাম।তোমরা দুজন মিলে আনন্দ করো।কাবাবমে হাড্ডি হতে চাইনা।”

সত্যি বড় হলেও ছেলেমানুষী গেলনা ওর। নৈঋতের কাণ্ডে হেসে ওঠেন মালিনী আর বিশ্বনাথ।নিরালায় একান্তে জমে ওঠে স্বামী স্ত্রীর দাম্পত্য যা অনেকগুলো বছর কাটিয়ে এসে আজও অমলিন।টিভি থেকে তখন গান ভেসে আসছে স্বর্ণযুগের কালজয়ী গান ,”যদি কাটেই প্রহর পাশে বসে মনের কথা কথা বলে ক্ষতি কি?”

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত