শুধু তোমায় ভালোবেসে

শুধু তোমায় ভালোবেসে

হটাৎ আসা নিম্নচাপের প্রভাবে সারারাত অবিশ্রান্ত বৃষ্টির পর সকালে বিছানায় উঠে বসে অন্ধকার আকাশ,ঝাপসা কাঁচ,ধোঁয়া ওঠা কফিকাপে চুমুক দিতে দিতে হেডফোনে নিজের প্রিয় একটি মিষ্টি রবীন্দ্রসঙ্গীত,”আজি ঝর ঝর মুখর বাদল দিনে”শুনতে শুনতে আবেশে মজে গিয়ে ব্ল্যাঙ্কেটটাকে নিজের গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিচ্ছিল ঝিলম এমন সময় শোনা যায় ওর মা তনিমাদেবীর গলা,”কিরে ঝিল এখনও শুয়ে আছিস তুই?বেলা দশটা বাজতে চলল এখনও ওঠার নামগন্ধ নেই। এমনিতেই শীতের এরো বেলা। ঠিক চারটে নাগাদ আবির আসবে আমাদের বাড়ি। কতক্ষণে তৈরি হবি তুই?”

__”উফফ মা আবার শুরু করলে তুমি?একটা দিন অফিস থেকে ছুটি পেয়েছি তাও শান্তি নেই।আমাকে ঘাড় থেকে নামাবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছ একেবারে। এর আগে দশজন ভেগেছে আমার চাকরির কথা শুনে। বারবার ওই রংচং মেখে পাত্র পক্ষের সামনে ইন্টারভিউ দিতে বসা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়।তাছাড়া আমার খরচ আমি নিজেই চালিয়ে নিতে সক্ষম।কোনোভাবেই আমি স্পোর্টস জার্নালিস্ট এর কাজটা আমি ছেড়ে দিতে পারবনা।এইতো সবে বছরখানেক হল চাকরিটা পেলাম,স্বপ্নের উড়ান আকাশে ডানা মেলতে এখনও অনেক বাকি।আমাকে বোঝা বলে মনে হলে স্পষ্ট বলে দাও অন্য কোথাও চলে যাব। ”

মেয়ের কথায় একটু আহত কণ্ঠে তনিমা বলেন,”এরকম ভাবে কেন বলছিস রে? নিজে মা হয়ে দেখিস তারপর বুঝবি কতটা চিন্তা হয় শেষবয়সে সন্তানকে নিয়ে। আজ তোর বাবা বেঁচে থাকলেও এই একই কথা বলতো।প্লিজ লক্ষ্মী সোনামা আমার।আচ্ছা কথা দিলাম এটাই শেষ বার।আর তোকে বলবনা দেখে নিস। তাছাড়া তোর রাঙামামীর ছোট ননদের ছেলে এই আবির বসু। যতদূর শুনেছি ওর চিন্তাভাবনা নাকি একদম আলাদা।তাইতো ও নিজে বলেছে আগে নিজে পাত্রী দেখতে আসবে।ওর পছন্দ হলে তারপর ওর মা বাবা আসবে।অযথা একদল লোক ডেকে মিষ্টি খাওয়া ওর পছন্দ নয় একেবারেই।”

__”ঠিক হ্যায় এটাই শেষ তবে”;বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে বলে ঝিলম।

বেলা এখন চারটে।ঘোর কালো আকাশ আর অঝোরে ভাসছে মহানগরী। বেচারা আবিরের আর আসা হলনা নিজের বিয়ের সম্বন্ধ দেখতে। যাক ঝিলমকেও আর আয়নার সামনে রূপচর্চায় বসতে হলনা।বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে জলের ফোঁটাগুলো ধরতে ধরতে ঝিল যখন এটা ভেবে ভীষণ আনন্দ পাচ্ছে তখন হটাৎ নীচে থেকে একটা অপরিচিত যুবকের কণ্ঠ,”এটা কি শ্রীমতী তনিমা মিত্রের বাড়ি?”

চমকে ফিরে সেই যুবায় দিকে তাকায় ঝিলম।ইসস বৃষ্টিতে ভিজে পুরো চুপচুপে হয়ে গেছে বেচারা।এই কি তবে সেই ব্যক্তি?তাহলে তো এলেম আছে বলতেই হয় এই কনকনে ঠান্ডার মধ্যে ঝড় ঝঞ্ঝা উপেক্ষা করে চলে এল পাত্রী দেখতে। ভাবনার জগৎ ছেড়ে নিজেকে কোনোমতে সামলে নিয়ে ঝিলম বলে,”হ্যাঁ এটাই তনিমা মিত্রের বাড়ি। কিন্তু আপনি?”

__”নমস্কার আমি আবির মানে আবির বসু”,ছেলেটি জানায় নীচে দাঁড়িয়ে।

__”কিরে কার সাথে কথা বলছিস রে ঝিল?”মেয়ে কার সাথে কথা বলছে সেটা দেখতে ততক্ষণে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েছেন তনিমাদেবী। মুখ বাড়িয়ে আবিরকে দেখতে পেয়েই তড়িঘড়ি নীচে ছোটেন উনি। ইসস একজন এই পরিবেশের মধ্যেও বাড়ি চলে এল আর ও এখনও বাড়ি থেকে তৈরি হলনা,এটা ভেবে ঈষৎ লজ্জা পেয়ে তৈরি হতে যায় যায় ঝিল। কাঁচা হলুদ রঙের কুর্তিটা ঝটপট গায়ে চাপিয়ে চোখে আলতো করে কাজল পেন্সিলটা বোলানো আরম্ভ করেছে ও এমনসময় শোনা যায় তনিমাদেবী বলছেন,”একটা ফোন করে দিতে পারতে আবির।দেখ দেখি কি কাণ্ড! পুরো কাকভিজে হয়ে গেছ। পরে নাহয় একদিন দেখা করে নিতে তুমি আর ঝিল দুজন মিলে।নাও এই তোয়ালেটা দিয়ে তাড়াতাড়ি মাথাটা মুছে ফেল নইলে ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে…”

__”না আন্টি আসলে ঝিলম যে ধরনের কাজ করে বলে শুনেছি তাতে যেদিন সেদিন চাইলেই ছুটি নেওয়া যায় না। আর ওর পেশাটাকে আমি ভীষণভাবে সম্মান করি। একটা ভালো সম্পর্ক তৈরি হতে গেলে সবকিছু মিলিয়েই সেই মানুষটাকে আপন করে নিতে জানতে হয়।ছোট থেকে আমি এটাই শিখেছি বাড়ির লোকজনের কাছে।তাই নিজের কথা রাখতে আজই চলে এলাম।”

কাজল পেন্সিল ছেড়ে একটু থমকে দাঁড়ায় ঝিলম এবার। সত্যি তো বলেছে আবির। বেশ রুচিশীলতার ছাপ স্পষ্ট ওর কথায়।না আর দেরি করা উচিত হবেনা। এবার যেতেই হচ্ছে আবিরের সামনে।পরিচিত কায়দায় চশমার ফ্রেমটা ঠিক করতে করতে ড্রইংরুমের দিকে এগোয় ও।

__”ঐতো ঝিল এসে গেছে। আচ্ছা তোমরা কথা বলো। আমি চা নিয়ে আসছি”, ওদের কথা বলার সুযোগ দিয়ে বেরিয়ে যান তনিমাদেবী।

__”নমস্কার আমি ঝিলম মিত্র। দুঃখিত আপনাকে এতটা সময় বসিয়ে রাখার জন্য। আসলে ভেবেছিলাম এই জলকাদার মধ্যে”;ঝিল বলে কিন্তু কিন্তু করে।

মিষ্টি হেসে আবির বলে,”কি ভেবেছিলেন আমি আসবনা তাইতো?আসলে আমি মনে করি নারী পুরুষ নির্বিশষে সকলের সময়ের একটা মূল্য আছে।আপনার আজকের সময়টা নষ্ট করে আরেকদিন অযথা হ্যারাজ করতে চাইনা। নিন যা জিজ্ঞাসা করবার করে ফেলুন দেখি। তবে তার আগে একটা কথা না বলে পারছিনা চশমা ছাড়া কিন্তু আপনাকে বেশ মিষ্টি লাগে। তখন নীচে থেকে দেখলাম যে বলে কি ছেলেটা!এর আগে যতগুলো পাত্র এসছে সবাই তো ঝিলমের ইন্টারভিউ নিতেই ব্যস্ত ছিল।ওর মনের কথা, চাকরির প্রতি ওর ভালোবাসার কথা এতদিন কে শুনতে চেয়েছে?কথা বলার সুযোগ পেয়ে ঝিলম এবার বলে,”প্রথমেই আপনার পছন্দ অপছন্দগুলি জেনে নিই কি বলুন আবিরবাবু?”

__”হ্যাঁ একদম আপনি শুরু করুন।আমি রেডি বাউন্সার সামলানোর জন্য। তারপর যা থাকে কপালে”,আবির বলে।

ঝিল:কফিশপে কফি,নাকি মাটির ভাঁড়ে চা?

আবির: মাটির ভাঁড়ে চা।

ঝিল: আইনক্স নাকি নন্দন?

আবির: নন্দন।

ঝিল: স্প্যাগেটি অথবা চাউমিন?

আবির: চাউমিন উইথ চিলি চিকেন।

ঝিল: “ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে” না….

এবার ওর কথা শেষ হবার আগেই আবির বলে,”প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস/তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ।” ঈষৎ লজ্জাবনত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে অন্য ঘরে চলে যেতে চাচ্ছিল ঝিলম।তার আগেই ওর হাতদুটো ধরে ফেলে আবির বলে,”সেকি আপনার ইন্টারভিউতে আমি পাশ না ফেল সেটা বলে যান তো অন্তত।”

রবি ঠাকুরের গানের কথা দিয়েই ঝিলম গেয়ে ওঠে, “এই তোমারি পরশরাগে চিত্ত হল রঞ্জিত, এই তোমারি মিলনসুধা রইল প্রাণে সঞ্জিত । এই জনমে ঘটালে মোর জন্ম-জনমান্তর, সুন্দর হে সুন্দর ।। এই লভিনু সঙ্গ তব সুন্দর হে সুন্দর, পুণ্য হল অঙ্গ মম ধন্য হল অন্তর।।। ততক্ষণে গরম চা আর স্ন্যাকসের ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছেন তনিমাদেবী।ওদের দুজনের চোখের ভাষাই বলে দিচ্ছিল অবশেষে বিয়ের ফুল ফুটলো তবে, মা হিসেবে সেটা আর বুঝতে বাকি থাকেনা ওনার।ধূমায়িত চায়ের কাপ নিয়ে শুরু হয় ঝিলম আর আবির দুই নতুন বন্ধুর আড্ডা,হাসি,খুনসুটি।।।

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত