“কিরে তিতির দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল এখনও ঘুম থেকে উঠিসনি।কত করে বলি ভাত খেয়ে উঠে ঘুমাস না। তো কে শোনে কার কথা? আর কখন যাবি তোর মামার বাড়ি?বেলা যে পড়ে এলো। তৈরি হয়ে নে ঝটপট”লেপের মধ্যে থেকে শুধু চোখ দুটো বার করে তিতির শোনে ওর মায়ের কথা। আসলে ওর ঘুম ভেঙেছে অনেক আগেই। তবুও ঘুমের ভান করে বিছানায় থেকে মায়ের মুখের এই মিষ্টি বকুনিগুলো শুনতে দারুণ লাগে। তাছাড়া কাজের চাপে কতদিন হল ছুটি পায়না। আজ অনেকদিন পর ওরই সমবয়সী মামাতো বোনের তিয়ার বিয়ে উপলক্ষ্যে দিন তিনেকের ছুটি নিয়েছে হেড অফিসের বড়বাবু থুড়ি বসকে ম্যানেজ করে।যদিও কথায় বলে “মামার বাড়ি ভারী মজা কিল্ চড় নাই” তবুও তিতিরের ভালো লাগেনা ওখানে যেতে।
গেলেই তো সেই ট্যারা চোখের চাউনি,নানা রকম বাঁকা কথা ভেসে আসবে ওর মোটাসোটা চেহারার উদ্দেশ্যে। তবু তিতির না গেলে যে ওর মাও যাবেনা সেটাই মুস্কিল। একটু পরেই মাকে নিয়ে বেরোতে হবে ওকে। তিতিরের বাবা কর্মসূত্রে এখন শিলিগুড়িতে। বিয়ের দিন সন্ধ্যেবেলা একেবারে ওখানে পৌঁছে যাবে। তাই তিতিরের কাঁধে তাই গুরুদায়িত্ব মাকে নিয়ে বসিরহাটে মামার বাড়িতে পৌঁছানো। ওখানে শ্রী তৈরি করা থেকে শুরু করে আলপনা আঁকা মায়ের অনেক কাজ। যাইহোক লেপ ছেড়ে উঠে মায়ের গালে চুমু দিয়ে ও বলে,”যাচ্ছি যাচ্ছি মাদার ইন্ডিয়া। তর যেন সইছেনা। ব্যস্ততার চাপে তোমার মিষ্টি মুখের বকাগুলো খুব মিস করি মা। তাই ইচ্ছে করেই শুয়েছিলাম।”
__”ধাড়ি মেয়ের কাণ্ড দেখ। সত্যি তুই একটা পাগলি। যা এবার”বলেন ওর মা মিতালি দেবী। ঝটপট গুছিয়ে মাকে নিয়ে গাড়িতে উঠে স্টিয়ারিংয়ে বসে তিতির। কলকাতা পেরিয়ে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলে ওদের গাড়ি। পৌঁছেও যায় ওরা ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে। মামার বাড়ির পরিবেশটা আজ সম্পূর্ণ অন্যরকম। রঙিন আলো, নহবতের সুরে ভরপুর।তিয়াকেও প্রজাপতির মত লাগছে হলুদ রঙের জামদানি শাড়িতে। এখন আবার মেহেন্দি অনুষ্ঠান শুরু হবে।অবশ্য এসব ছেড়ে তিতিরের এখন লক্ষ্য খাবার দিকে। এতটা পথ গাড়ি চালিয়ে এলো। পেটে খিদে চুইচুই করছে। ঐতো রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে লুচি ভাজার গন্ধ। ওদিকেই পা বাড়ায় তিতির। কাগজের প্লেটে গরম গরম লুচি, কাশ্মীরি আলুর দম আর অমৃতি। উফফ পুরো স্বর্গ যেন। একনিমেষে যেন পথের সব ক্লান্তি মিলিয়ে যায়।
__”সোনাদিদা আমার প্লেটটা রেডি করো, হাতমুখ ধুয়ে আসছি আমি”এইবলে মুখ হাত ধুয়েই চলে আসে তিতির হামলে পরে প্লেটের উপর। সবেমাত্র খান পাঁচেক লুচি শেষ করে ছয় নম্বর লুচির দিকে হাত বাড়িয়েছে ও এমনসময় শুনতে পায় ছোটমামীর গলা,”সত্যি বলিহারি যাই তোর!ইসস নিজের বেঢপ চেহারাটা একবার আয়নায় দেখেছিস তিতির?দেখলে বোধয় এভাবে গোগ্রাসে খেতে পারতিসনা। তোরই বয়সী মামাতোবোনের আজ বিয়ে হয়ে গেল আর তুই এখনও ধিঙ্গিপনা করে ঘুরে বেড়াচ্ছিস।এবার অন্তত একটু স্লিমট্রিম হ..”;বিয়েবাড়িতে একদল লোকজনের সামনে বক্রক্তিভরে ভাগ্নি তিতিরের উদ্দেশ্যে কথাগুলো ছুঁড়ে দেন ওরই ছোটমামী।
খাওয়া ছেড়ে এবার উঠে দাঁড়ায় ও।কাটাকাটা ভাবে বলে,”বর্তমান দিনে বিয়েটাই একজন নারীর জীবনে শেষ কথা নয় ছোটমামী।তাছাড়া বহিরঙ্গের রূপের থেকে অন্তরঙ্গের রূপটা আমার কাছে অনেক বেশি দরকারি।রেডিওজকির কাজটা নিয়ে আমি স্বাধীনভাবে আছি বুঝলে?”কাটা কাটা ভাবে জবাব দিয়ে চিলেকোঠার ঘরে চলে যায় তিতির। সত্যি কোন সমাজে বাস করছে ওরা।
যেখানে যোগ্যতার মাপকাঠি এখনও বিচার করা হয় চেহারা রোগা না মোটা, ফর্সা না কালো দিয়ে। সম্প্রতি কালো মেয়ের বিশ্বজয় করার কথাটা বোধয় এদের কারুর জানা নেই।অবশ্য বলতে বা বোঝাতে গেলেও মুখ নষ্ট। বছরের পর বছর ধরে ঘুণপোকার মত এদের মনের অন্তরমহলে বাস করে এমন নিরাশাবাদী চিন্তা ভাবনা। মেয়ে মানেই শান্তশিষ্ট সাত চড়েও যে রা কাটবে না, সর্বংসহা,রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী,সংসার সুখের হবে তার একার গুণে,সবাইকে খাইয়ে নিজে শেষ পাতে যা থাকবে খাবে আরো কত কিছু! থাক যে কদিন এইখানে থাকবে তিতির চুপ করেই থাকবে এই ঘরে। মামার বাড়ির এই জায়গাটা বেশ ভালো কেউ বিরক্ত করার নেই। বিয়ের দিন যথাসময়ে সব চলতে থাকে। সন্ধ্যেবেলা যখন বর আসে শঙ্খ উলুধ্বনি শব্দে চতুর্দিক ভরপুর ঘর ছেড়ে ছাদে এসে দাঁড়ায় ও একটু প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেবার জন্য।
__”কি ব্যাপার মনখারাপ বুঝি। চিকেন পকোড়াটা কিন্তু দুর্দান্ত হয়েছে।খাবেন নাকি একটু?আচ্ছা সামনের রবিবার আপনাদের রেডিও স্টেশনে কোন অতিথি আসছেন বলবেন? তাহলে কান রাখব।”; ভরাট গলার পুরুষালি কণ্ঠে চমকে ওঠে তিতির।ও রেডিও স্টেশনে কাজ করে সেটাও বা জানল কি করে?
__”কে আপনি?” ভীতু চোখে তাকায় তিতির।
__”আমি গৈরিক বসু,আপনার মামাতো বোনের তিয়ার বন্ধু।এখানে বাড়ি হলেও কর্মসূত্রে আপাতত বছর পাঁচেক কলকাতায় থাকি। আপনি আমাকে চেনেন না ঠিকই কিন্তু আমি আপনাকে দুর থেকে বহুবার দেখেছি। আপনাদের রেডিও স্টেশনের অনতিদূরেই আমার অফিস। আপনি যখন সিঁড়ি দিয়ে হুড়মুড় করে উপরে উঠছিলেন তখন আপনার বোনের থেকে সব ঘটনা শুনলাম। সেই থেকে কথা বলার একটা সুযোগ খুঁজছিলাম।
__”আপনি নীচে যান গৈরিক। এমনিতেই চেহারার জন্য নানা কথা শুনতে হয় আমাকে। এখন আবার আমাদের একসাথে দেখলে অন্য কথা রটবে”;তিতির বলে।
__”নিশ্চয় যাব নীচে তবে একা নয়।এভাবে সকলের থেকে সরে থেকে কি হবে তিতির? চেহারা দিয়ে কি ভালোবাসা মাপা যায় কখনো নয়। সেটা বোঝাতে হবে ওদের। যদি আপত্তি না থাকে আসুন আমার সাথে”, এই বলে গৈরিক ওর হাত বাড়িয়ে দেয়। তিতির অস্ফুটে বলে,”কিন্তু কি বলবেন ওদের কিছু ভাবলেন?”
__”ভরব না ভূষণভারে/সাজাবো না ফুলের হারে/প্রেমকে আমার মালা করে গলায় তোমার দোলাবো/ আমি রূপে তোমায় ভোলাব না ভালোবাসায় ভোলাবো/”,এটাই বোঝাব ওদের।রবিঠাকুরের গানে ওর মনের কথা জানায় গৈরিক।
ওর হাত থেকে এবার চিকেন পকোড়ার প্লেটটা নিয়ে তিতির বলে,”নবরূপে আমার এই আমিটাকে নতুন করে চেনালেন গৈরিক। চলুন এবার যাওয়া যাক”; এই বলে গৈরিকের হাতদুটো শক্ত করে ধরে তিতির নামতে থাকে সিঁড়ি দিয়ে।শুরু হয় এক নতুন পথ চলার কাহিনী।।।