বয়স সিক্ত ভালবাসা

বয়স সিক্ত ভালবাসা

মাত্র ১৬ বছর বয়সে জামান সাহেবের সাথে আমার বিয়ে হয়।তার বয়স তখন চল্লিশার্ধো হবে।সৎ মায়ের জ্বালাতনে জামানকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি।তবে মন থেকে মানতে পারিনি কখনও।মানতামই বা কি করে,যেই বয়সে পাড়ার সমবয়সী ছেলেদের সাথে টাঙ্কি মারার কথা সেইখানে কিনা বাপের বয়সী এক বুড়োর সাথে সংসার করতে হবে।বিষয়টা আমি কেন কোনো মেয়ে হলেই মানতে পারবেনা।তাকে দেখার সময় আমি ভ্রু কুচকে বিরক্তিভাব নিয়ে দেখতাম।আবার কথা বলার সময় চোখ,নাক,মুখ বাঁকা করে ভঙ্গিমায় কথা বলতাম।এক প্রকার তাকে আমার সহ্যই হত না,মাঝে মাঝে চিন্তা করতাম এই বুড়োকে ছেড়ে পালাতে পারলে বাঁচি। বিয়ের প্রথম দিন আমি ঘোমটা তুলে বসে আছি বিছানায়।জামান সাহেব বিছানার উপর বসতেই আমি তেড়ে উঠলাম,,

–একদম আমার কাছে আসবেন না।তাহলে কিন্তু আমি চিল্লানি শুরু করে দিবো।
–তুমি চাইলেও সেটা পারবে না।কারন তুমি আমার বিয়ে করা বউ।চিল্লাতে চিল্লাতে গলা ফাটালেও কেউ তোমাকে বাঁচাতে আসবেনা।

তার কথা শুনে আমি বড় মাপের এক ঢেকুর গিললাম।মনে মনে ভয় পেতে লাগলাম।বুইড়াটা তো ঠিকই বলতেছে।আমি তার বিয়া করা বউ।আমার কাছে আসা তার রাইট আছে কিন্তু আমার চিল্লানোর রাইট নাই।আর চিল্লাইলেও মানুষ খারাপ বলবে।এসব চিন্তা করতে করতে দেখলাম তিনি বালিশ নিয়ে সোফায় আরামে শুয়ে পড়লেন।আমাকে বললেন,,

–লাইট টা অফ করে ঘুমাইও। পরেরদিন সকালবেলা ঘুমের ঘোরে শুনছি কেউ আমার কানের কাছে বলছে,,
–মাফি,চা ঠান্ডা হয়ে গেলো খেয়ে নাও।

আমি হাই টানতে টানতে বললাম এত সকালে আমি চা খাইনা।চোখ খুলে তাকাতেই দেখি জামান হাতে চায়ের কাপ নিয়ে দাড়িয়ে আছে।আমি একটু ইতস্ততবোধ করে উঠে বসে বললাম,,

—আপনি চা করেছেন?আসলে আগে তো কখনও এভাবে ঘুম থেকে তুলে কেউ চা খাওয়ায় নাই তাই অভ্যাস নেই।
—এখন থেকে অভ্যাস করবা।প্রতিদিন তোমায় চা খাওয়াবো।

আমি একটু একটু লজ্জা পেতে লাগলাম।তার চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না।আবার মনে মনে ভাবলাম এত আদর করে আমাকে বাগে আনার জন্য নিশ্চয়ই।এরকম একটা বুইড়া যদি এমন কচি বউ পায় তাহলে এরকম একটু আধটু ন্যাকামি করবেই।নাহ মাফি,গলে গেলে চলবে না।আমি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বিরক্তির সুর নিয়ে বল্লাম,,,

–ইয়াক,এই চা মানুষে খায়?
–কেন খুব খারাপ হয়েছে?
–আপনার চা আপনিই খান।আর হ্যা আমার জন্য আপনি আর কখনও চা বানাবেন না।
কথাগুলা বলতে না বলতেই আমার শ্বাশুড়ি মায়ের এন্ট্রি।
–ওরে আমার নবাবজাদি রে।নতুন বউ ঘুম থেকে উঠে সবার জন্য চা বানানোর কথা।সেখানে আমার ছেলে তাকে চা বানিয়ে খাওয়াচ্ছে তাও তার মুখে রচে না।মা মরা মেয়ে না হলে ঠাটিয়ে এক চর মেরে সোজা করে দিতাম।
–মা,হচ্ছেটা কি।মাফি বাচ্চা মানুষ।সংসারের সাথে এডজাস্ট হতে সময় লাগবে।সময়টা তো দিবা ওরে।

এরপর বুড়োটা অফিসে চলে যায়।অফিসে যাওয়ার পর নিয়ম করে আমাকে ম্যাসেজ দিতে থাকে আমি কি করছি,খেয়েছি কিনা।আমি শুধু সিন করেই রেখে দিই।বয়েই গেছে আমার বুড়োটার মেসেজের রিপ্লাই দিতে।এভাবেই প্রতিদিন সকালে আমাকে চা করে খাওয়াতেন আর রাতে এসে দেখতেন আমি তার জন্য অপেক্ষা না করেই খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পরেছি।তাতে অবশ্য তিনি কোনোদিনও টু শব্দও করেন নি।তবে প্রতিদিন আমার শ্বাশুড়ি মায়ের বকবানি শুনতে শুনতে আমার কান ঝালাপালা হয়ে যেত।অবশ্য আমি শেষমেষ কানের উপর বালিশ চাপা দিয়ে রুমের দরজা জানালা আটকিয়ে ঘুমাতাম।যাতে বাহিরে কি হচ্ছে না হচ্ছে সেটা আমার কান অবধি না আসে।
বিয়ের কারনে অনেকদিন আমার স্কুলে যাওয়া হয়ে ওঠেনি।সামনে মাধ্যমিক পরিক্ষা।এদিকে শ্বশুর বাড়ি থেকে কি করে স্কুলে যাবো সেটাই ভেবে পাচ্ছিলাম না।একদিন রাতে ইঙ্গিতে ওনাকে বলেই ফেল্লাম,,

–আমি কিছু বলতে চাই,
–আমিও শুনতে চাই।
–বিয়ের তো অনেকদিন হলো,এক্সামের বেশিদিন বাকি নাই।আমি আর স্কুলে যেতে পারবো,নাকি এখানেই আমার লেখাপড়ার সমাপ্তি।
–কারো ইচ্ছার উপর আঘাত আমি হানবো না।যদি পড়তে চায় পড়বে।সকালে আমি অপেক্ষা করবো,একজনকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে আমি অফিসে যাবো।

বিয়ের পর প্রথম আমি স্কুলে যাবো।তার মধ্যে আবার এই বুইড়াটাও নাকি আমার সাথে যাবে।ফ্রেন্ডসরা দেখে কিনা কি বলবে সেটা ভেবেই আমি নিজের উপর অতিষ্ট হচ্ছিলাম।উনি আমাকে স্কুলের গেটে নামিয়ে দিয়ে যেতে যেতে বললেন,,,

–যাওয়ার সময় দাঁড়াইয়ো,আমি যেভাবে হোক তোমায় বাসায় পৌঁছে দিয়ে আবার কাজে যাবো। আমি আচ্ছা বলে গেটের ভিতর ঢুকতেই সব চুন্নির দলগুলা আমাকে ঘিরে ধরে হাসি তামাশা করতে লাগলো,,

–কিরে মাফি?এই বুড়ো লোকটা তোর বর নাকি?
–কিরে মাফি শেষমেষ এই বুড়ো লোককে বিয়ে করলি? ওদের কথায় আমার কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছিলো।আমি চেচাইয়া বল্লাম,,

–উনি আমার কেউনা,হইছে?এখন ক্লাসে চল। ক্লাস চলাকালীন সময় খেয়াল করলাম আমার বান্ধবীরা আমার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করছে আবার মুখ চেপে হাসছে।আমার খারাপ লাগছিলো খুব।মনে মনে সৎ মাকে গালি দিতে লাগলাম,,

–হারামি তোর নিজের মেয়ে হলে কি পারতি এটা করতে।বেছে বেছে কিনা শেষে একটা বুড়োর সাথে আমাকে বিয়ে দিলি। স্কুল ছুটির পর জামান সাহেব আমাকে নিতে আসলে বল্লাম,,

–আপনি যান, আমি একা চলে যেতে পারবো। এরপর বাড়িতে গিয়ে জামানকে সাফ সাফ বলে দিয়েছি,,,
–আপনাকে আর কষ্ট করে আমাকে এগিয়ে দিতে হবেনা।আমি একাই যেতে পারবো।
–কিন্তু কেন,তুমি একটা বাচ্চা মানুষ।
–হ্যা এজন্যই।আমি একটা বাচ্চা আর আপনি একটা বুড়ো।আপনি যদি আমাকে জোর করেন তাহলে কিন্তু আমি আর স্কুলেই যাবো না।
–আচ্ছা ঠিকাছে যাবোনা,তবে সাবধানে চলাফেরা করবা।

কথাটা জামান সাহেব এক প্রকার মলিন মুখ নিয়েই বলল।মুখ তো মলিন হবেই।কোথায় এখন বউয়ের আদর ভালবাসায় সিক্ত হবে।উল্টো বাচ্চা বউয়ের মুখের ঝাড়ি চুপচাপ সহ্য করতে হচ্ছে তাকে। আস্তে আস্তে দিন কাটতে লাগলো।তবুও জামানের উপর থেকে আমার বিরক্তভাব গেলো না।আমার মাঝে মাঝে মনে হত সৎমায়ের থেকেও বড় শত্রু জামান সাহেব।উনি জেনে শুনে কেন আমার মত একটা বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করলেন।ওনার তো জেল হাজত হওয়া উচিত। একটা সময় আমার মাধ্যমিক শেষ হলো।কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।ঠিক তখনই আমার শ্বাশুরি মায়ের মাথায় ভুত চাপে তার নাকি খেলার সাথি লাগবে।

–আপনার মায়ের খেলার সাথি লাগলে একটা পুতুল কিনে দিলেই তো পারেন।আমাকে বলতেছেন কেন?
–মাফি তুমি এখনও বাচ্চাই রয়ে গেলা।তোমাকে আমি কি করে কি বুঝাবো।
–আচ্ছা চোখ বন্ধ করছি এখন বলেন জামান সাহেব আমার কানে কানে বলতে লাগলো,,
–আসলে আমার মায়ের একটা কৈতরী লাগবে।তোমার আমার কৈতরী।
–ওরে বুইড়া আপনার সাহস তো কম না।দরকার হয় আরেকটা বিয়া করেন তবুও এসব আমারে বলবেন না।

আমি বাচ্চা মানুষ,নিজেই নিজেকে সামলাতে পারিনা।আবার আসছে ওনার মায়ের নাকি কৈতরি লাগবে। রাগে গজ গজ করতে করতে আমি ওনাকে রুমের বাইরে বের করে দিয়ে খাটের উপর চিত হয়ে ঘুমিয়ে পরলাম।ভেবেছিলাম তিনি তো সবসময় আমার কথারই প্রায়োরিটি দেয়।সকালবেলা হয়ত আবার সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু ঘটলো কিছুটা হীতের বিপরীত।

পরদিন ঘুম থেকে উঠে সকালে আর চা পাইনি।অথচ আমার তো অভ্যাস হয়ে গেছিলো তার হাতে চা খাওয়ার আর ভ্রু কুচকে ঝগড়া করার।মনটা আনমনেই বিষন্ন হয়ে গেলো।অপেক্ষা করতে লাগলাম দুপুরের।যে সময়টাতে সে আমাকে মেসেজ দেয় খেয়েছি কিনা।নাহ,আজ আর তিনি আমাকে ম্যাসেজও দেয়নি।চিন্তায় পরে গেলাম লোকটার হয়েছেটা কি।আবার নিজে নিজে রেগে ফুলতে লাগলাম,, আমার সাথে ভাব নেয়া হচ্ছে না।আচ্ছা নিক ভাব।আমিও দেখে ছাড়বো।রাতে বাড়িতে ফেরার পরও সে আমার সাথে কথা বলেনা।চুপচাপ বালিশ নিয়ে সোফায় ঘুমাতে চলে যায়।

এভাবে পর পর দুদিন চলার পরে আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না।মনে হচ্ছিলো তেনার সাথে কথা বলতে না পারলে আমি মরেই যাবো।এরপর একদিন নিজেই বেহায়া হয়ে ঘুম থেকে উঠে তার জন্য চা বানিয়ে নিয়ে আসি।কিন্তু সে চা না খেয়েই চলে যায়।দুপুরে নিজেই আগ বাড়িয়ে মেসেজ দিলাম,,খেয়েছেন?সিন করে রেখে দিলো।উত্তর দেয়নি।সেদিন প্রথমবার অনুভব করেছিলাম টেক্সট সিন করে রিপ্লাই না দিলে কতটা যন্ত্রনা হয়।আর আমি এতদিন ধরে জামানকে এই যন্ত্রনাটাই দিয়ে আসছি।হোক তার বয়স বেশি, লিগালি তো আমি তার বিয়া করা বউ।

তারপর আসলো আমার জিবনে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত দিন।দরজার কলিংবেল বাজতেই দরজা খুলে দেখলাম জামান শাড়ি চুরি পড়া এক মেয়েকে নিয়ে দাড়িয়ে আছে।আমার আর বুঝতে বাকি রইল না।জামান যেমন আমার প্রত্যেকটা কথা মানে আজও তাই আমার উপর রাগ করে আরেকটা বউ ঘরে নিয়ে আসছে।কিন্তু সত্যি বলছি আমি মন থেকে জামানকে বিয়ে করতে বলিনি,এম্নিই বলে ফেলছি।তখন আমি অনুভব করলাম আমি আসলে জামানকে কতটা ভালবাসি।চিল্লায়া কান্না শুরু করলাম,,

–তুমি এইটা কি করলা।তোমার একটা কেন দশটা কৈতরি লাগলেও আমি দিতাম।তাই বলে আমার উপর রাগ করে সত্যিই আরেকটা বিয়া করবা?
–মাফি,মাফি,মাফিইইইই

আমি বেহুঁশ।যখন জ্ঞানন ফিরলো তখন দেখি জামান আমার পাশে বসা।আবার সাথে মেয়েটাও আছে।মেয়েটাকে দেখে আমি আবারও কান্না শুরু করে দিলাম।এবার জামান আমার মুখ চেপে ধরে বলল,,

–আস্তে মাফি,হুদাই চিল্লাইয়ো না।
–চিল্লাবেনা তো কি করবে?।আপনি কি করে আরেকটা বিয়া করলেন।বুড়ো বয়সে ভিমরতি হয়েছে আপনার?
–কে বলেছে তোমাকে আমি বিয়ে করেছি আরেকটা?
–কেন আমি তো দেখতেই পাচ্ছি।এই যে আপনার পাশে বসে আছে।
–হায় আল্লাহ।ওরে আমি বিয়া করবো কেন।ওর নাম হচ্ছে পারু।আমার এক ছোট ভাইয়ের প্রেমিকা।আজকে রাতটা আমাদের এখানে থাকবে।কালকে ওদের কোর্ট ম্যারেজ হবে।
–সত্যি বলছেন তো আপনি?
—হ্যা,সত্যি সত্যি তিন সত্যি।

এরপর সারারাত আমি জামান সাহেবের আঙুলের সাথে আঙুল ধরে ঘুমিয়েছি।কেন যেন সেদিন তার আঙুলটা আমার কাছে ভরসা আর বিশ্বাস,আস্থা মনে হয়ে ছিল। পরেরদিন ছোট ভাই আর পারুর কোর্ট ম্যারেজ করিয়ে দিলাম।ওদের বাসর দিলাম আমাদের বাড়িতেই।ফুল দিয়ে ঘর সাজাতে সাজতে জামানের দিকে আমার চোখ পড়তেই আমি লজ্জা পেতে লাগলাম। রাত গভীর।জামান সোফায় শুয়ে আছে,আমি বিছানায়।বাইরে খুব বৃষ্টি,আকাশে বজ্রপাত।বজ্রপাতের বিকট শব্দ আর আলোর ছটাতে আমার খুব ভয় হয়।জামানকে বল্লাম আমার খুব ভয় করছে আজকে বিছানায় শোবেন প্লিজ।এরপর দুজন দুদিকে মুখ করে শুয়ে আছি। কিছুক্ষন পর,,

–শোনেন,
-শুনছি
–কিছু চাইবো আপনার কাছে,দিবেন আমাকে?
–চেয়েই দেখো
–ইয়ে মানে,আমার না কৈতরী চাই।
–হাহাহা
–হাসলেন যে
–তুমি নিজেই তো বাচ্চা,আবার কৈতরী সামলাবা কি করে।
–অহ,এখন আগ বাড়িয়ে চেয়েছি বলে ভাব নিচ্ছেন না।আচ্ছা থাক লাগবেনা।
—উহু,তাহলে কি ধরে নেবো মাফি বড় হয়েছে?পারবে তো কৈতরী সামলাতে?
–মাফি যদি বড়ও না হয়,জামান সাহেব আছে কি করতে।পারবেনা কৈতরী সামলাতে?আস্তে আস্তে মাফিও না হয় শিখে যাবে।

–যদি মাফি সুযোগ দেয়,তাহলে জামান সাহেব সবই পারবে। জামানের কথা শুনে আমি লজ্জায় লাল হতে হতে বেগুনী হয়ে গেলাম।আবার বেগুনী হতে হতে লাল।হঠাৎই জামান মোড় ঘুরে আমার দিকে ফিরলো।

–কই দেখি মাফির লজ্জাবরণ মুখটা আমি জামানের দিকে তাকাতে পারছিলাম না।জামান আমার কপালে চুমু খেয়ে বলল,,
–চলো,আজ তোমাকে কৈতরী দিবো

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত