রাত সাড়ে ৩টা !হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙ্গে গেল চারুর।বিছানার ওপাশে তাকিয়ে দেখলো নিষ্পাপ মুখে ঘুমাচ্ছে আকাশ।চারু ঘামছে।জানুয়ারী মাসের এই কঠিন শীতে কারোরই ঘামার কথা নয়। কিন্তু চারু ঘেমেই চলেছে। চারুর ঘুম আজ এমনি এমনি ভাঙ্গেনি।চারু আজকে তার স্বপ্নে শুভ্রের দেখা পেয়েছে।হ্যা,৫ বছর আগে জীবন থেকে চির অতীত হয়ে যাওয়া শুভ্রকে স্বপ্নে দেখে চারু আজ সত্যি বিচলিত…!
.
৬বছর ৩মাস আগের কথা
.
class 9,science এ পড়া একটা মেয়ে।ছোট চাচার দেয়া “চারু” নামেই সে সকলের কাছে পরিচিত।নামটার ভেতর কেমন যেন একটা মায়া আছে।কিন্তু,নাম অপেক্ষা বেশি মায়া চারুর চোখে লুকিয়ে আছে। চারু তার বাবা-মায়ের ২য় সন্তান।পরিবারে সে ই সবচেয়ে ছোট সদস্য।ছোট্ট এই চারু আকাশ নামের একটা ছেলেকে খুব ভালোবাসে।আকাশ হচ্ছে চারুর ক্লাসের first boy।চারু আকাশের প্রেমে পড়েছে আকাশে অপূর্ব সুন্দর হাসিটা দেখে। চারু আকাশকে অসম্ভব ভালোবাসে কিন্তু কোন উপায়েই সেটা আকাশকে বলা হয়ে উঠছে না। এরই মধ্যে একদিন চারু হঠাৎ করে আকাশের বাড়িতে উপস্থিত।
.
আকাশ:চারু তুমি হঠাৎ?
.
চারু:আসলাম-ঢুকতে দিবা না?
.
আকাশ:কি যে বলোনা তুমি।ভেতরে আসো।
.
চারু:thanks
.
আকাশ:বলো,কি বলবা?
.
চারু: এই chemistry সাবজেক্টটা আমি কিছুই বুঝিনা!ইলেকট্রন,প্রোটন ব্লাহ ব্লাহ…
.
আকাশ:ওহ্ এই ব্যাপার।ইলেকট্রন প্রোটন অনেকটা প্রেমিক প্রেমিকার মতো বুঝছো।এরা একজন আরেকজনের প্রতি তীব্র আকর্ষন উপলদ্ধি করে।
.
চারু:-ঠিক যেমন,আমি তোমার প্রতি আকর্ষন অনুভব করি সেই রকম?
.
আকাশ:মানে?
.
চারু:মানে আমি তোমাকে ভালোবাসি।পড়া লেখায় ব্যস্ত চুল আচরানোর সময় না পাওয়া তোমাকে আমি বড্ড বেশি ভালোবাসি,গো
.
.
আকাশ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো চারুর দিকে।চারু মেয়েটা যে তার হাতটা চিরদিনের জন্যে ধরতে চাইছে সেটা বুঝে উঠতেই আকাশের অনেক দিন লেগে গেলো। চারু আর আকাশের একটা স্বপ্নময় ভালোবাসার গল্প চিত্রায়িত হতে শুরু করলো। প্রতি বিকালে একজন আরেকজনের হাত ধরে সূর্যাস্ত দেখতো এবং নতুন স্বপ্নের খেলা সাজাতো।এদিকে class-9 এর ফাইনাল পরীক্ষা এগিয়ে আসলো।প্রেম নামক গ্যারা কলে পড়ে ২জনের রেজাল্টেরই বেহাল দশা।এতে অবশ্য চারু খুব একটা অখুশি নয়।চারুর কাছে জীবনটা যুদ্ধের ময়দান না।চারুর কাছে জীবন মানে এক ঝাক জোনাকীর মাঝে খিল খিল করে হেসে ওঠা।কিন্তু,আকাশ নামের ছেলেটার কাছে জীবন মানে প্রতিযোগিতার উন্মুক্ত ক্ষেত্র।তার কাছে জীবনের সার মর্ম হার-জিতের একটা গরল হিসাব মাত্র।আকাশ এর মস্তিষ্কের কোন এক প্রান্তে বার বার প্রতিফলিত হচ্ছিল একটা চিন্তা।তার এই পতনের জন্যে কোন না কোনভাবে চারু এবং চারুর ভালোবাসা দায়ী।আকাশ চিন্তাটাকে খুব একটা পাত্তা দিল না। তবে হ্যা,মানসিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে চারু এবং আকাশ সম্পূর্ন বিপরীত মেরুর ২টো মানুষ।চারু যখন রবী ঠাকুরের “জয়-পরাজয়” গল্প পড়তে পড়তে শিহরিত হচ্ছে,আকাশ তখন মুখ গুজে রয়েছে text book এর খসখসে বিদুঘুটে গন্ধমাখা কাগজগুলোতে।পূর্নিমার রাতে চারু যখন চিৎকার করে বলে উঠতো,”দেখো,কত সুন্দর চাঁদের আলো।রুপালী আলোতে সেজেছে পৃথিবী” আকাশ তখন বিরক্ত হয়ে জবাবা দিত “উফ চারু,তুমি জানো না,চাঁদ উপগ্রহ? উপগ্রহ আলো পাবে কথা থেকে!” চারু তখন একটু হতাশই হতো।অদ্ভূত পৃথিবীর রহস্যময় বিষয়গুলোর বৈজ্ঞানিক ব্যাখা একটুও ভালো লাগেনা চারুর।
.
.
আকাশ এবং চারুর সম্পর্কের ৭ মাস পূর্ন হয়নি এখনো।আকাশ জানিয়ে দিলো সে আর চারুর সাথে থাকতে চায় না।চারু অবাক হলো । অবাক হওয়ার পরিমান আরো বৃদ্ধি পেলো যখন চারু তার অপরাধটা জানতেও ব্যর্থ হলো।
.
চারু ভেঙ্গে পড়লো।জীবনের ১ম ভালোবাসার এরুপ বিমর্ষ ভাঙ্গন চারুর ভেতরকে নাড়া দিয়ে গেল।সব সময় হাসি খুশি থাকা চারু খুব দ্রুতই বদলে গেলো।নিজেকে চার দেয়ালের মাঝখানে আটকে রেখে কাকে শাস্তি দিল সেটা বিধাতা ব্যতীত আর কারো বোঝার ক্ষমতা নেই,উদ্ভট সব আচরন করতে শুরু করলো।বন্ধু মহলে চারুর নাম হয়ে গেলো “মিনি সাইকো”!
.
.
মার্চ ৭,২০_ _ ! চারু বেড়াতে এসেছে তার এক মামাতো ভাইয়ের বাড়ি।মামাতো ভাইয়ের নাম আরাফাত। আরাফাত এবং চারু উভয়েই তখন ক্লাস 10 এ…..! অবরুদ্ধ নিষ্ক্রিয়তায় হাফিয়ে ওঠা চারু আরাফাতের কাছে শহরটা ঘুরে দেখার দাবি জানায়।
.
.
চারু আর তার মামাতো ভাই আরাফাত রাস্তা দিয়ে হাঁটছে! রাস্তার ওপাশ হতে ধূলোর বলয় সৃষ্টি করে এগিয়ে আসছে একটা ছেলে! ছেলেটার নাম শুভ্র।শুভ্র আরাফাতের কাছের বন্ধু। শুভ্র চারুকে এক পলক দেখেই থমকে দাঁড়ায়। হলুদ পোশাকে এ যেন চন্দ্রলোকের কোন এক অজানা অপ্সরী পৃথিবীতে নেমে এসেছে। শুভ্র কিছুক্ষন পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নিলো।চারু সম্ভবত একবারের জন্যে শুভ্রের দিকে তাকিয়েছিলো।সম্ভবত সেটা ভুল করেই।
.
ওই ঘটনার ১মাস ৩দিন পরের কথা। বৃষ্টিমেঘলা একটা বিকাল বেলায় ফেসবুকে সময় কাটছে শুভ্রর। find friends অপশানে হঠাৎ করে চোখে পড়লো একটা নাম। নামটা “চারু” ! এক মুহূর্ত দেরী না করে শুভ্র রিকুয়েস্ট পাঠিয়ে দিলো। চারু সাধারনত unknown কাউকে accept করে না। কোন এক দৈব কারনেই শুভ্রের রিকুয়েস্টটা accept করলো!
.
প্রিয় পাঠক, আপনি কি এই লম্বা গল্প পড়তে পড়তে ক্লান্ত বোধ করছেন? আচ্ছা একটু জিরিয়ে নিন!আমি এই সুযোগে একটু শুভ্রের বর্ননা দিয়ে ফেলি
.
.
শুভ্র ক্লাস 10 এর ছাত্র! ছাত্র হিসেবে ভালো।লেখালেখির হাতও মোটামুটি ভালো,দেখতে একটুও handsome না। ছেলেটা উপন্যাসের পোকা।হাতে সময় থাকলে যেকোন উপন্যাস পড়তে তার আপত্তি নেই।
.
.
শুভ্র আর চারুর একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো।তাদের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ ৩/৪টা মেসেজ চালাচালি হতো। মাঝেমাঝেই চারু অদ্ভূত আচরন করতো। শুভ্র বুঝতে পারতো মেয়েটা অন্য সকলের চেয়ে আলাদা।শুভ্রের স্বপ্নের রাজ্যে কোন রাজকন্যা ছিল না।হঠাৎ করে,একদিন স্বপ্নের মাঝে সে এক হলুদ রাজকন্যাকে খুঁজে পায়।তার মুখ অনেকটাই চারুর মতো।কিছুদিনের মধ্যেই শুভ্র বুঝতে পারে ওটা চারুর মতো কেউ নয়,ওটা চারুই….চারু অদ্ভূত,চারু পাগলাটে!সম্ভবত একারনেই শুভ্র ভালোবেসে ফেলে চারুকে।শুভ্র সেটা চারুকে কোনদিন বলবে না প্রতিজ্ঞা করেছিলো।।।কারন দিনে ৩/৪ মিনিটের মেসেজিংয়ে প্রেম ভালোবাসা হয় এটা এই মর্ডান পৃথিবী মেনে নিতে পারবে না।এরই মধ্যে ২জনের মধ্যে অসংখ্য বিচিত্র ঘটনা ঘটলো! চারু অনেকদিন ব্লক লিস্টে ফেলে রাখে শুভ্রকে।আবার কোন এক মুহূর্তে শুভ্রের অজান্তেই আনব্লক করে। ৩-৪ মাস ২জনের কোন কথা হতো না…হঠাৎ,এক সন্ধ্যাবেলা চারু নক করে শুভ্রকে।অনেকগুলো কথা শেষে চারু শুভ্রকে “I love you” বলে বসে।শুভ্র চমকে যায়।শুভ্র চারুকে তার সকল কল্পনার কথা জানিয়ে দেয়।.
চারুর হাত ধরে আরেকবার বেঁচে উঠতে চায় শুভ্র।চারুকে নিয়ে পূর্নিমার রাতে বালুচরে হাঁটার স্বপ্ন দেখতে থাকে।চারুও জানায় একটা “গোলাপী জবা” ফুল দিয়ে সে শুভ্রের সামনে দাঁড়াতে চায়।শুভ্রকে নিয়ে পূর্নিমার রাতে হারিয়ে যেতে চায়।
.
শুভ্র শিহরিত হয়! একটু অবাকও হয়! সবকিছু এত ঠিকভাবে তো যাওয়ার কথা না। ভালোবাসার কাঙালদেরকে প্রকৃতি এত সহজে ভালোবাসা পাওয়ার সুযোগ দেয়না।কোথাও একটা গন্ডগোল আছে অবশ্যই।।।
.
.
চারু আর শুভ্রের জীবনে হঠাৎ করে আবার আকাশের আগমন। আকাশ চারুকে হারিয়ে বুঝতে পারে চারু তার কাছে ঠিক কি ছিল।উপলদ্ধি করে তার জীবনে চারুকে প্রয়োজন।সে হা হাকার তোলে। চারুকে ফিরে আসার আহ্বান জানায়।
.
এমন ই কোন রাতের বেলা চারু তার ঘরের লাইটটা বার বার অফ অন করছে এবং এক কঠিন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে।কি করা উচিত তার এখন? আকাশকে জীবনে ফিরিয়ে নেবে? তাহলে যে,শুভ্রের সাজানো স্বপ্নগুলো টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। চারু একটা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলে…! শক্ত হাতে মোবাইলটাকে ধরে। শুভ্রকে সে মেসেজটা লিখেই ফেলে,
.
“এতদিন,তোমার সাথে যা যা করেছি সবই ছিল তোমার মানসিক পরীক্ষার অংশ।আমার মতো একটা সুন্দরী মেয়ের propose পেলে তুমি কি করো সেটা দেখার জন্যেই ছিল এত আয়োজন।সরি শুভ্র।আমি শুধু আকাশের।আমি আকাশকে ভালোবাসি।”
.
মেসেজটা দেখে শুভ্র ছোট্ট করে লিখেছিলো, “ভালো থেকো তোমরা। আমাকে শেষ করে দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ ”
.
শুভ্রের মেসেজটা দেখে চারু হাউ মাউ করে কেঁদেছিলো।কেন কেঁদেছিলো কে জানে।সব “কেন” এর উত্তর সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টি করেন না।……চারু আর আকাশের বিয়ে হয়ে গেল ৩বছর পর! শুভ্রকে চিঠি পাঠানো হয়েছিলো! চিঠি ফেরত এসেছে! শুভর বাড়ির দরজা তালাবন্ধ ছিলে।লোকমুখে শোনা যায়,গত ২বছর এই দরজা কেউ খোলা দেখেনি এবং প্রায়ই মাঝরাতে এখান থেকে কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়….!
.
.
চারুর কান্নার আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল আকাশের….. “এই চারু কাঁদছ কেন?” আকাশের আওয়াজ পেয়ে চারু অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে আসে। চারু জবাব দিল, “কিছু হয়নি আকাশ।চোখে পোকা গেছে।তুমি ঘুমাও”…..চারু বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। আজ আর ঘুম আসবে না তার।আস্তে আস্তে ছাদে উঠে এলো চারু। ভোর হতে আর কিছুক্ষন মাত্র বাকি।আকাশে পূর্নিমার চাঁদটা এখনো রয়েই গেছে।চারুর মনে পড়ে যায়,শুভ্র ভোরের চাঁদ দেখতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতো।এমনই একটা চাঁদকে সাক্ষী রেখে শুভ্র চিরকালের জন্যে চারুকে পেতে চেয়েছিলো! সে সুযোগ শুভ্র পায়নি…
.
.
আকাশ ঘুম থেকে উঠেই বুঝতে পারে চারুর আজ মন খারাপ।সে চারুকে জানায়,আজ বিকালে অফিস শেষে তারা ২জনে মিলে শপিংয়ে যাবে….
.
সন্ধ্যা ৭টা! আকাশ এবং চারুর গাড়ির বহুতল শপিংমলের সামনে এসে দাঁড়ালো।গাড়ি থেকে নামতেই চারু চমকে উঠলো। শপিং মলের সামনে গোলাপী জবা ফুল হাতে একটা পাগল বসে আছে।বিড় বিড় করে কি যেন বলে চলেছে। চারুর কাছে মুহূর্তের জন্যে মনে হলো এটা শুভ্র। অকাশ গাড়ি পার্কিং করতে একটু দূরে যেতেই চারু ছুট্টে চলে গেল ওই পাগলটার কাছে! চারু একটা বড় রকমের ধাক্কা খেলো।এই ২টো চোখ শুভ্র ব্যতীত আর কারো হতে পারে না। মানুষের চেহারা বদলায়। চোখ বদলায় না। চারু আর্তনাদ করে উঠলো,
.
চারু: তুমি শুভ্র?
.
“হ্যা”
.
চারু:বলো তো আমি কে?
.
“তুমি চারু”
.
চারু:কি করে চিনলে?
.
“হলুদ শাড়ী পড়ে আছো তুমি।তুমিই তো আমার হলুদ রাজকন্যা”
.
চারু: কেমন আছো শুভ্র তুমি? আমি না এখন মিনি সাইকো থেকে পুরো সাইকো হয়ে গেছি।
.
“পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষই সাইকো।তুমি একা না”
.
চারু:এটা তো আমার ডায়ালগ।
.
“তুমি আর আমি তো একই”
.
চারু: তোমার হাতে ওটা কি?
.
“গোলাপী জবা ফুল।ওই যে তুমি আমাকে দিতে চেয়েছিলে…”
.
.
চারুর চোখে জল চলে আসলো।চারু শুভ্রের দিকে তাকিয়ে আছে।২ জনে মিলে হাঁটতে শুরু করেছে।একজনের হাত আরেকজনের হাতে।চারুর হাতে গোলাপী জবা ফুল।পূর্নিমার চাঁদ উঠেছে….শুভ্র উচ্চ স্বরে আবৃতি করে চলেছে,,,
.
“হাজার বছরে সাধনা আমার,
ওই যে জবা ফুল,
ফিরে আসবে তুমি,জানতাম আমি।
করিনি তো ভুল”
.
.
শুভ্র আর চারু হেঁটেই চলেছে।পূর্নিমার চাঁদের বাড়িত আজ ওদের নিমন্ত্রন!
.
.
আকাশ, চারুকে খুঁজছে।বৃথা প্রচেষ্টা করছে।শুভ্র আর চারু চিরকালের জন্যে নামহীন অজানা শহরে হারিয়ে গেছে! ওরা ২জনে একা যায়নি।সাথে একটা গেলাপী জবা ফুলও আছে….
.
.
………………………..ধন্যবাদ…………………….