সুখী হওয়া

সুখী হওয়া

দেড় বছর আগে মেয়েটির সাথে আমার পরিচয়। সেদিন আমার প্রাইভেট ব্যাংকের চাকরির ইন্টারভিউ ছিল।ব্যাংকের সিঁড়িতে হঠাৎ মেয়েটির সাথে দেখা। আমিই আগে কথা বলেছিলাম। এক্সকিউজ মি, আপনি জন্মানোর পর পর আপনার নানি কি আপনার মুখে বেশি করে মধু দিয়েছিল নাকি আপনি চিনি বেশি খান? মেয়েটি কটমটে চোখে তাকিয়ে বললো কি বললেন? ঠিক বুঝলাম না।

ও কিছু না সরি বলেই দ্রুত প্রস্হান করলাম।নিজেই অবাক হয়ে গেলাম এই ধরনের কথা কিভাবে মুখ দিয়ে বের হলো? আমি তো কোন ফালতু ছেলে না, মেয়েদের সাথে তো আগ বাড়িয়ে কথা বলি না তাহলে? চাকরির ইন্টারভিউ এর টেনশনে নাকি মেয়েটার মিষ্টি মুখ দেখে মাথা আউলিয়ে গেছে।

ইন্টারভিউ খুব ভাল হয়েছে দুই দিন পর জানলাম আমার চাকরি হয়েছে আগামীকাল জয়েন করতে হবে।সাথে সাথে মেয়েটার মুখ আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো নিশ্চয়ই এই মেয়েটার মুখ আমার জন্য শুভ ঐ মুখ দেখেছিলাম বলেই আমার চাকরি হয়েছে। মেয়েটাকে ধন্যবাদ দিয়ে মিষ্টি খাওয়াতে হবে। কিন্তু মেয়েটাকে কোথায় পাবো? নাম ঠিকানা কিছুই জানিনা।

একমাস হলো ব্যাংকে চাকরি করছি হঠাৎ দেখি মেয়েটি ব্যাংকে। মেয়েটাকে দেখে হৃৎপিন্ড লাফিয়ে গলার কাছে চলে এসেছে, তড়িঘড়ি করে দুই লাফে মেয়েটার কাছে এসে বললাম চলুন আপনাকে মিষ্টি খাওয়াবো কবে থেকে আপনাকে মনে মনে খুঁজছি। মেয়েটি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না। আরে একমাস আগে আপনার মুখ দেখেছিলাম বলেই তো এই ব্যাংকে আমার চাকরিটা হয়েছে এজন্য আপনার মিষ্টি পাওনা। মেয়েটি ছোট্ট করে হেসে দিল মেয়েটির চেহারা যত মিষ্টি হাসি তারচেয়েও মিষ্টি। আজ না অন্য একদিন আপনার কাছ থেকে মিষ্টি খাব আজ আসি।যাওয়ার আগে নাম তো বলে যান।

আমার নাম নূপুর। কি সুন্দর নাম নূপূর! হৃদয়ের মাঝে রিনিঝিনি করে বেজে উঠলো। বাড়ি ফিরে দেখি মা আর ছোট দুই বোন খাটে বসে গল্প করছে।আমাদের বাবা পাঁচ বছর আগে মারা গেছেন মা প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষিকা। খাটের উপর মার কোলে মাথা রেখে শুয়ে বললাম, আমি যা দেখি তোমরা তাই দেখ?

তনু খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলো, ভাইয়া ছোটবেলায় এই খেলা অনেক খেলেছি। বল, তুই কি দেখিস? আমি দেখি অবিবাহিত একটা ছেলে, তার বিয়ে করতে মন চাই। হাসতে হাসতে তিনজনের আঙুল আমার দিকে তাক করলো। পাগল ছেলে বিয়ে করবি সেটা বললেই হয়, আছে নাকি পছন্দের মেয়ে? আছে মা কিন্তু সেই মেয়েকে কিছু বলার সাহস পাচ্ছিনা। দেখি একটু সাহস সঞ্চয় করে মেয়েটিকে বলবো তার আগে তুমি একটু দোয়া পড়ে গায়ে ফু দিয়ে সাহস বাড়িয়ে দাও।

প্রতিদিন নূপুরের অপেক্ষা করি কিন্তু মেয়েটার কোন দেখা নেই ও কি তবে পূর্ণিমার চাঁদ ? একমাস পর উদয় হবে? আমার ধারনাই সত্যি একমাস পর নূপুর কে আবার ব্যাংকে দেখলাম। এই মেয়েটাকে দেখলেই হৃৎপিন্ড লাফ দেয়। কেন এমন হয়? আপনি একমাস পরপর উদয় হন ঘটনা কি? নূপুর কিছুসময় অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে হেসে দিয়ে বলল,ও আপনি ! ঘটনা হচ্ছে আমার চাচা আমেরিকায় থাকেন উনি একমাস পরপর একশত ডলার আমার জন্য পাঠিয়ে দেন, সেই টাকা তুলতে ব্যাংকে আসি।

এত সুন্দরী মেয়ে একা না এসে বাবা কে সাথে নিয়ে আসতে পারেন। আমার বাবা মা কেউ নেই দুবছর হলো উনারা দু’জনই একসিডেন্টে মারা গেছেন।আমি মামার বাড়ি থাকি।আমি তো হড়বড়িয়ে সব কথা বলে ফেললাম। আপনার নামটাই তো জানা হলো না। সোহান বলেই সবাই ডাকে। হাতে সময় থাকলে চলুন আপনার পাওনা মিটিয়ে দিই। মানে কি? কিসের পাওনা? মিষ্টির পাওনা। বলেছিলেন অন্য একদিন খাবেন তাহলে আজকেই অফিস ক্যান্টিনে চলুন।

আমরা দু’জন মুখোমুখি বসে চা খাচ্ছি।সাহস করে বলে ফেললাম, নূপুর আপনাকে আমার খুব ভাল লেগেছে। আমাকে যদি আপনার এতটুকু ভাল লেগে থাকে তাহলে আপনার মামাবাড়ির ঠিকানা আমাকে লিখে দিন আর ভাল না লাগলে চুপচাপ চা খেয়ে চলে যান।দুরুদুরু বুকে বসে আছি। নূপুর কেমন ধীরে ধীরে চা খাচ্ছে। আমার ভিষণ টেনশন হচ্ছে নূপুর কি ঠিকানা দেবে? নূপুর চা খেয়ে চুপচাপ উঠে দাঁড়াল, যাহ্ মেয়েটা আমাকে পছন্দ করলো না। প্রথম চান্সেই রিজেক্ট হয়ে গেলাম, হঠাৎ আমার কানে মধু বর্ষিত হলো। কাগজ কলম আছে আপনার কাছে ? ঠিকানাটা লিখে নিন।

খুশিতে শূন্যে ভাসতে ভাসতে বাড়ি যেয়ে মাএর হাতে কাগজ খানা ধরিয়ে দিয়ে বললাম এই ঠিকানার মেয়েকে পুত্রবধু করে ঘরে নিয়ে আসেন আম্মিজান। অনু,তনু আর মা নূপুরের মামা বাড়ি গিয়েছিল মেয়ে দেখতে। ফিরে এসে তনু খুশিতে বলে উঠল, ভাইয়া তুই তো অনন্ত জলিলের মতো অসম্ভব কে সম্ভব করে ফেলেছিস, ভাবির তো দারুণ মিষ্টি চেহারা। বাজান তোর পছন্দ আছে। নূপুর অনেক লক্ষি মেয়ে আমার খুব পছন্দ হয়েছে শুধু একটাই সমস্যা ওর মামাদের অবস্থা খারাপ। তা হোক আমরা তো শুধু মেয়েটাই নেবো আর তো কিছুর প্রয়োজন নেই।

কয়েকদিনের মধ্যে নূপুরের সাথে আমার বিয়ে হল। বাসর রাতে হাসতে হাসতে বললাম , বুঝলে নূপুর তোমাকে বিয়ে করে বিশাল একটা লাভ হয়েছে , আমাকে আর চিনি কিনতে হবে না। চা,সেমাই, সুজিতে তুমি চিনি না দিলেও মিষ্টি হয়ে যাবে। স্বপ্নের মতো দিন পার হচ্ছে, নূপুর খুবই ভাল মেয়ে সংসারের প্রায় সব কাজ করে। অনু, তনুকে নিজের বোনের মতো ভালবাসে, মা কে যথেষ্ট ভালবাসে সম্মান করে।দেখতে দেখতে একবছর পার হয়ে গেছে।

সকালে বিছানায় শুয়ে নূপুরের মিষ্টি হাতের চায়ের অপেক্ষা করছি, হঠাৎ রান্নাঘর থেকে নূপুরের গগনবিদারী চিৎকার তাড়াতাড়ি সবাই রান্নাঘরে ছুটে যেয়ে দেখি সমস্ত রান্নাঘরে ধোঁয়ায় ভরা নূপুর অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে।দ্রুত হসপিটালে নিয়ে গেলাম, গ্যাস সিলিন্ডারের পাইপ লিক করে এই দূর্ঘটনা। নূপুরের গলা মুখের একপাশের কিছু অংশ আর ডানহাত ঝলসে গেছে।একমাস হসপিটালে থেকে নূপুর কে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।

নূপুর যেন কেমন হয়ে গেছে সবসময় গুটিয়ে থাকে।অনু,তনু কে বললাম আপু তোরা নূপুর কে বেশি বেশি সময় দিবি গল্প করবি এমন কোন কথা বলবি না যাতে মনে কষ্ট পায়।মা তুমি একটু খেয়াল রেখো। বাপ তুই ঠিক বলেছিস নূপুরের এখন পরিবারের সহযোগিতা বেশি দরকার। রাতে ঘুমাতে গেছি হঠাৎ নূপুর বললো,তুমি আরেকটা বিয়ে করো। আমার চেহারা পুড়ে খারাপ হয়ে গেছে।সবার সামনে আমাকে নিয়ে যেতে তোমার লজ্জা লাগবে, তুমি সুখী হতে পারবে না।

বেশ বিয়ে করবো, আমার বিয়ের পর তুমি কি মামাবাড়ি ফিরে যাবে? বাবা,মা থাকলে উনাদের কাছে ফিরে যেতাম কিন্তু মামাবাড়ি আর ফিরে যাবো না। তোমাদের বাড়ির এক কোণে পড়ে থাকবো তোমাদের সব কাজ করবো। তোমার বউকে ছোট বোনের মতো ভালবেসে মিলেমিশে থাকবো।

আচ্ছা নূপুর মনে করো এই দূর্ঘটনা তোমার সাথে না হয়ে আমার সাথে হলো, তাহলে তুমি কি করতে? আমাকে ছেড়ে আরেকটা বিয়ে করতে তারপর নতুন বর কে সাথে নিয়ে আমাদের বাড়ি বেড়াতে আসতে।আমি খুশিতে তোমার বরের হাত ধরে বলতাম, এসো ভাই তুমি আমার বন্ধুর মতো আমরা দু’জনে চা সিগারেট খেতে খেতে গল্প করি।

আমার কথা শুনে নূপুর খিলখিল করে হাসছে কতদিন পর নূপুরকে হাসতে দেখছি মুখের একপাশ পুড়ে গেছে তাতে ওর হাসি বিন্দুমাত্র অমলিন হয় নি।,করুণ মুখে নূপুর বললো, আমি কোন অবস্হাতেই তোমাকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবো না।

যে কাজ তুমি করতে পারবে না, সেকাজ আমাকে কিভাবে করতে বলো? শোন নূপুর মানুষের সুখী হওয়ার জন্য সুন্দর মুখের দরকার হয় না সুন্দর মনের প্রয়োজন। বুকভরা ভালবাসা একে অন্যের প্রতি বিশ্বস্ততা আর সহমর্মিতার দরকার যার সবকিছুই তোমার আছে। একথা ঠিক যে আমি তোমাকে মিষ্টি মুখ দেখে পছন্দ করেছিলাম কিন্তু তখন তো তুমি আমার স্ত্রী ছিলে না। স্ত্রীর প্রতি অনেক দায়িত্ব কর্তব্য আর ভালবাসা থাকে।দূর্ঘটনার উপর তো কারোরই হাত নেই তাহলে তার শাস্তি তুমি কেন পাবে?

নুপূর আমার হাত ধরে গাড় স্বরে বললো,আমি নিশ্চয়ই বড়ো কোন পূণ্যের কাজ করেছিলাম তারজন্য পুরস্কার হিসেবে তোমাকে পেয়েছি। যে সময়ে মানুষ ঘরে সুন্দরী স্ত্রী রেখে পরকীয়া করে, সামান্য কারনে সংসার ভেঙে যায় সেই সময়ে তোমার মতো স্বামী পাওয়া অনেক ভাগ্যের।

ধুরু কি সব গুরুগম্ভীর আলোচনা করছি একদমই ভালো লাগছে না। বাইরে তাকিয়ে দেখ আকাশে পূর্ণ চন্দ্র চলো নূপুর আমরা ছাদে যাই। ছাদে পাটি পেতে আমি আর নূপুর বসে আছি চাঁদের আলো নূপুরের মুখে পড়েছে নূপুরকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে মনে হচ্ছে ওর মত সুন্দরী পৃথিবীতে আর একটিও নেই। নূপুরকে নিয়ে আমি অনেক সুখী।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত