আদিবকে বলেছি রাত ১০টায় রেলস্টেশনে অপেক্ষা করতে, নিম্মি সময় মতো পৌঁছে যাবে। হ্যাঁ, আমিই নিম্মিকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করছি। কারণ আমি চাই না ওর ও আমার মতই পরিণতি হোক!! নিম্মি আমার ননদ। বিয়ের পর থেকে কোনদিনই ওর সাথে ভালো ব্যবহার করিনি আমি। সহ্য করতে পারতাম না ওকে। যদিও এজন্য ওর পরিবারই দায়ী।
ক্লাস এইটে পড়ার সময় আমার চেয়ে ২০-২২ বছরের বড় একজনের সাথে বিয়ে হয়ে যায় আমার। প্রথম দেখায় সে বড্ড অপছন্দ ছিল। কিছুতেই রাজি ছিলাম না তাকে বিয়ে করতে। সদ্য কিশোরী ছিলাম তখন। মেট্রিক পাশ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরিবারকে রাজি করাতে পারিনি। তারা কিছুতেই দুবাই ফেরত অমন ভাল পাত্র হাতছাড়া করতে রাজি নয়। নিন্দুকেরা বলতো, তার নাকি আগে একটা বউ ছিল, লোকটা নাকি তার বউকে খুব পেটাতো । তাই একদিন সুযোগ বুঝে বউটা পালিয়ে গেলো। যদিও আমার পরিবারের তাতে কিছু যায় আসে না। তাদের মতে বউ একটা কেন, দশটা থাকলেও এই লোক যে আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে তা নাকি আমার সাত কপালের ভাগ্য!! পাশের বাড়ির আমেনা খালা বলেছিলো, “ওরে শান্তা, তুই পালিয়ে যা!!” কিন্তু কোথায় পালাবো?? কার সাথে পালাবো?? অমন কেউ থাকলে তো!! সত্যি বলছি কেউ যদি থাকতো ওইদিনই পালিয়ে যেতাম।
স্কুল থেকে আসা যাওয়ার পথে একটা ছেলে বিরক্ত করতো। বয়সে ২/৪ বছরের বড়ো হবে হয়তো, দেখতে শুনতে মোটামুটি। কখনো পাত্তা দিইনি। সেদিন ভাবছিলাম, ওই ছেলেটাকে পাত্তা দিলে আজকে ওর সাথেই পালাতে পারতাম!! ফাইনাল পরীক্ষা চলছিল সেদিন। বাড়ি থেকে বারবার নিষেধ করেছিল যেন বাড়ি থেকে না বেরোই। কিন্তু আমি পরীক্ষাটা দিতে চেয়েছিলাম। তাই লুকিয়েই বেরিয়ে যাই। কিন্তু পরীক্ষার হল পর্যন্ত যেতে পারিনি। মেজভাই আর ছোট চাচা মিলে টেনে হেঁচড়ে মারতে মারতে নিয়ে আসে। ওইদিনই বিয়ে হয়ে যায় আমার। কবুল বলার সময় কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে যাই আমি। জ্ঞান ফিরলে দেখি অচেনা একটা ঘরে আমি খাটে শুয়ে আছি। পরে জানলাম এটাই আমার শ্বশুর বাড়ি। কবুল বলার সময় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম, কবুল বলেছিলাম কিনা মনে নাই। কিন্তু আমার পরিবারের লোক বলেছিল মেয়ে কবুল বলেছে। অতঃপর যত দ্রুত সম্ভব বিয়ের যাবতীয় কার্যক্রম শেষ করে অজ্ঞান অবস্থায় বরযাত্রীর গাড়িতে তুলে দেয়।
আমি তখন কিশোরী ছিলাম। চঞ্চল, উচ্ছ্বল, ছটফটে টাইপের। কিন্তু শ্বশুর বাড়িতে কঠোর নিয়ম ছিল। স্বামী নামক প্রাণীটার সাথে মিশতে চাইতাম, গল্প করতে চাইতাম, বাইরে গেলে হাত ধরে হাঁটতে চাইতাম। কিন্তু তার এসব কিছুতেই আগ্রহ ছিল না, কারণ এই বয়স সে আরও ২০/২২ বছর আগেই পার করে এসেছে। তার শুধু একটাই চাহিদা ছিল। পৃথিবীর আর সব চাহিদার খবর রাখা সে প্রয়োজন মনে করতো না। অামি তারচেয়ে বয়সে ছোট ছিলাম, কম বয়সী ছিলাম। আর এটাই আমার জন্য কাল ছিল। সারাক্ষণ সন্দেহ করতো, মারধর করতো, গালিগালাজ করতো তার আত্মীয় স্বজন, পরিচিত অপরিচিত কারো সাথে মিশতে দিতো না।
শ্বশুর বাড়িতে কারো সাথে মিশতে পারতাম না আমি, কারণ কেউ মিশতেই চাইতো না। সবাই খুব খারাপ ব্যবহার করতো, সারাদিন খাটাতো, পান থেকে চুন খসলেই মারধর করতো। স্বামী, শাশুড়ি, ননাশ সবাই গায়ে হাত তুলতো। শাশুড়ি প্রায়ই শুনিয়ে শুনিয়ে বলতো, “ফকিন্নি ঘরের মাইয়া আনছি কি আর সাধে?? আনছিই তো যাতে গতর খাডাইতে পারে!! ” ঘেন্না ধরে গিয়েছিলো শ্বশুর বাড়ির লোকজনের উপর। সবাই খারাপ ব্যবহার করতো, একমাত্র নিম্মি ছাড়া। নিম্মি আমার সাথে মিশতে চাইতো, কিন্তু আমি ওকে এড়িয়ে যেতাম। আমার চেয়ে বয়সে ২/৪ বছরের ছোট নিম্মি। কিন্তু আমার মত অবহেলা অনাদরে বড় হয়নি সে, অনেক আদর যত্নে বড় হয়েছে সে। আমরা প্রায় সমবয়সী ছিলাম, ওর সব ছিল আর আমার কিছুই ছিল না। খুব হিংসা করতাম ওকে, খুউব!! সহ্যই করতে পারতাম না।
স্কুলে যাওয়ার বয়সে ও স্কুলে যেতো, আর আমি সারাদিন কলুর বলদের মতো খাটতাম। ও খেলতো, তখন আমি লাকড়ি কাটতাম, মাটি দিয়ে চুলা বানাতাম, পুকুর থেকে মাটি তুলে এনে ঘরের পিড়া লেপতাম। সন্ধ্যায় ও যখন বই নিয়ে পড়তে বসতো, আমি তখন পুকুর পাড়ে বসে এঁটো হাড়ি পাতিল বাসন কোসন ধোয়ার ফাঁকে আড়চোখে ওকে দেখতাম। খুব যন্ত্রণা হতো,হিংসা হতো। আমার ও তো পড়ার কত ইচ্ছে ছিল, কত অনুরোধ করেছিলাম, কেউ দিলো না পড়তে। ও তো দিব্যি পড়ছে, ওকে তো কেউ বাঁধা দেয় না!! চুপিচুপি গেলাম ওর ঘরে। ও ছিল না তখন ওখানে। গণিত বইটা পরে ছিল টেবিলের উপর, পরের দিনই পরীক্ষা তাই পড়ছিল। আস্তে করে বইটা নিয়ে দরজার পাশে রাখা বালতির পানিতে ভিজিয়ে রাখলাম। তারপর দ্রুত সরে গেলাম সেখান থেকে।
আমার শাশুড়ি চিৎকার করে পুরো বাড়ি মাথায় তুললেন। আমাকে ডেকে বললেন, “বউ, তুমি দেখছো বইডা পানিতে ভিজাইছে কেডা?? আমি আমতা আমতা করে বললাম, ” না, আম্মা, আমি কেমনে দেখমু?? আমি তো আসিই নাই এই ঘরে!! ” পাশে নির্বিকার ভাবে দাঁড়ানো নিম্মি আড়চোখে আমার দিকে তাকালো। ও হয়তো বুঝতে পেরেছিলো কাজটা আমারই। কিন্তু কাউকে কিছু বুঝতে দেয়নি। শুধু সকালে পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে আমার হাত ধরে বলেছিলো, “দোয়া কইরো ভাবী। ” আমি লজ্জায় ওর দিকে তাকাতে পারিনি।
বাড়ির সবাই অনেক অত্যাচার করতো আমার উপর, কিন্তু কিছু বলতে পারতাম না। সব প্রতিশোধ নিতাম এই মেয়েটার উপর। ও হয়তো সব বুঝতো, চুপ করে সহ্য করতো, কাউকে কিছু বলতো না। নিম্মি যখন এসএসসি পরীক্ষার্থী, তখন আমি ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আমার শাশুড়ি আগের দিনের মানুষ, কেউ একজন তাকে বুদ্ধি দিয়েছিল এই সময় বেশি বেশি ভারী কাজ করালে বাচ্চা সুস্থ থাকে। ব্যস, এমনিতে ও আমার উপর তাদের কোন মায়া দয়া ছিল না তার উপর এসব কুবুদ্ধি!! দিনরাত খুব খাটাতো কিন্তু পর্যাপ্ত খেতে দিতো না। এসময় বেশি খেলে নাকি বাচ্চা বড় হয়ে যায়, পরে ডেলিভারিতে সমস্যা হয়। কিন্তু আমার প্রচুর খিদে পেতো। নিম্মির টেবিলে দুধ, ডিম, ফলমূল, মিষ্টি , বিভিন্ন খাবার বাটিতে সাজানো থাকতো। ও রাত জেগে পড়তো, তাই ওর মা, ভাই, বোনেরা এত এত খাবার সাজিয়ে রাখতো যদি ওর খিদে পায় তাই। আমি প্রায়ই চুপিচুপি ঘরে ঢুকে ওর টেবিল থেকে খাবার চুরি করে খেতাম।
আমি জানতাম ধরা পড়লে আমার হাড়গোড় আস্ত থাকবে না, কিন্তু ওই সময়টায় খিদে সহ্য করা যায় না। নিম্মি হয়তো বুঝতে পারতো, তাই হয়তো খাবার টা একটু বেশি করেই রাখতো!! একদিন হাতেনাতে ধরা পড়ে গেলাম নিম্মির কাছে। ও কিছু না বলে মুচকি হেসে দরজা টেনে দিয়ে চলে গেল। একদিন রান্নাঘরের হাঁড়ি থেকে বিড়াল এসে মাছের মাথাটা নিয়ে যায়, আর সব দোষ এসে পড়ে আমার ঘাড়ে। অতঃপর শাশুড়ি ইনিয়ে বিনিয়ে নালিশ দেয় আমার স্বামীর কাছে। বেধড়ক মারধর করে, প্রায় ঘন্টা খানেক অজ্ঞান ছিলাম। জ্ঞান ফিরলে দেখি আমি নিম্মির কোলে শুয়ে আছি। নিম্মি যখন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে, আমি তখন দুই বাচ্চার মা। নিম্মি যখন সাদা কলেজ ড্রেস পরে আমার আশেপাশে ঘুরে বেড়াতো, তখন ওকে পরীর মত লাগতো। একদিকে খুশি হতাম, অন্যদিকে নিজের জন্য আফসোস লাগতো। এরপর অনার্সে ভর্তি হওয়ার পর একদিন নিম্মি ফোনে একটা ছেলের ছবি দেখায়।
– ভাবী, কও তো কেমন লাগে ছেলেটারে??
– আমারে জিগাও ক্যান?? আমি কি জানি!!
মহা বিরক্ত হয়ে কথাটা বললাম। আমি এখন তিন বাচ্চার মা, বাচ্চাদের সামলাতেই আমার হিমশিম খাওয়া লাগে, এসব ছবি দেখার সময় কই?? হঠাৎ একদিন কলেজ থেকে ফিরে নিম্মি আমাকে জড়িয়ে ধরে কাকুতি মিনতি করতে থাকে,
– ভাবী, আমারে সাহায্য করো। ভাইয়া আমারে আর আবিদরে একসাথে বাইকে দেখে ফেলছে। ভাইয়া দুই তিনজন লোক নিয়া যাইতেছে ওরে মারার জন্য। আমার ফোন টা ভাইয়ার কাছে। তুমি একটু আবিদরে ফোন দিয়ে বলো ওখান থেকে পালায়ে যাইতে। তুমি তো জানোই আমি আম্মা আর ভাইয়ারে কত ডরাই!!
– তোমাগো মামলায় আমারে ফাসাইয়ো না, তোমার ভাই জানলে আমারে অনেক মারবো!!
তবুও নিম্মি অনেক অনুরোধ করতে থাকে। অবশেষে আমার নম্বর থেকে আবিদকে ফোন দিয়ে সরে যেতে বলি। নিম্মির ফোন আমার শাশুড়ির কাছে জিম্মি। তাই রাতে আবিদ আমার নম্বরে ফোন দেয়। আমি নম্বরটা চিনতে পেরে বাইরে গিয়ে কথা বলি। আবিদ সবেমাত্র নিম্মির কথা জিগ্যেস করেছে ঠিক তখনই স্বামী নামক যমদূত এসে ফোন কেড়ে নিয়ে হ্যালো হ্যালো করতে থাকে। ওপাশে আবিদ বুঝতে পেরে ফোন কেটে দেয়।
– এত রাইতে ফোন দিছে কে??
– আ..আমি চিনি না।
– ব্যাডা মাইনষের গলা শুনলাম অহন কস চিনি না বলেই চুলের মুঠি ধরে মারতে মারতে ঘরে নিয়ে গেল।
সকালে নিম্মি অপরাধীর মত সামনে এসে দাঁড়ায়। চোখের নিচে কালশিটে পড়ে গেছে আমার, একপাশের গালটা ফুলে গেছে। সারা শরীরে ব্যথা।
– স্যরি ভাবী, আমার জন্য ভাইয়া তোমারে…
অভিমানে, ঘৃণায় ওর সাথে কথা বলিনি আমি। নিম্মির পড়ালেখা বন্ধ করে দিয়েছে ওর মা, ভাই বোনেরা। আবিদের সাথে সম্পর্ক তারা মেনে নিতে পারেনি। তাই তড়িঘড়ি করে ওর বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজছে তারা। যতটুকু জানলাম, আবিদ ছেলেটা খুব ভালো, শিক্ষিত, মার্জিত। নিম্মির চাইতে ৫/৬ বছরের বড়। তবে এখনও বেকার। কোন এক অজানা কারণে আবিদকে আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজনের পছন্দ না। তারা এক মধ্যবয়স্ক লোকের সাথে নিম্মির বিয়ে ঠিক করে। তার আগের ঘরের ২জন ছেলেমেয়ে আছে, আর বাজারে চালের আড়ৎ আছে। অন্তত আবিদের মত বেকার তো না!!
ওদিকে নিম্মি বিয়ে ঠেকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। সামনে ওর অনার্স সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল, কিন্তু বাড়ি থেকে ওকে আর পড়ালেখা করাবে না। হঠাৎ যেন আমি নিম্মির মাঝে আমাকেই দেখতে পেলাম। মুহূর্তেই আমার ভেতরের “আমি” টা পাল্টে গেলো। মনে মনে আমিও সংকল্প করলাম, যেই যন্ত্রণা আমি পেয়েছি তা আমি নিম্মিকে পেতে দেবো না। কাল নিম্মির গায়ে হলুদ, পরশু বিয়ে। বাড়ি ভর্তি মেহমান। নিম্মি ওর ঘরে বই খাতা জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।- কান্নাকাটি করার সময় নাই, বইখাতা জামা কাপড় যা যা নিবি গুছায়ে নে নিম্মি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
– ওই আধবুইড়া রে বিয়া কইরা কাম নাই। পালাইয়া যা বইন!!
– ভাবী, তুমি বলতেছো এগুলা??
– আবিদের সাথে কথা হইছে আমার। স্টেশনে অপেক্ষা করতেছে তোর জন্য। জলদি ব্যাগ গুছা…
অতঃপর আমরা তড়িঘড়ি করে ব্যাগ গুছিয়ে, দুজনে বোরখা পরে বেরিয়ে গেলাম। বাড়ির পেছনে ঝোঁপ পেড়িয়ে, ক্ষেতের আইলের উপর দিয়ে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে বড় রাস্তায় পৌঁছে রিকশা করে স্টেশন পৌঁছালাম। সেখানে আবিদ আগে থেকেই অপেক্ষমাণ ছিল। তার হাতে নিম্মি কে তুলে দিয়ে বললাম, “ঢাকায় আমার ফুফাতো ভাই থাকে, এইযে ঠিকানা, তারে বলা আছে সব, তিনি তোমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করে দিবে। শিক্ষিত ছেলে তুমি, পারবা না একটা চাকরি জোগাড় করতে??”
নিম্মি আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে, “তোমারে অনেক ভালোবাসি ভাবী!! আমি তোমার কষ্ট টা বুঝি” পৃথিবীতে এই একজন মানুষ আছে যে আমাকে মন থেকে ভালোবাসে। কিছু বলার আগেই ট্রেনটা হুইসেল বাজিয়ে উঠে। নিম্মি আবিদ হাত নেড়ে ট্রেনে উঠে যায়। আমি ও বাড়ির পথ ধরি। জানি আজকে আমাকে অনেক মার খেতে হবে। তবুও ভেতর টা খুউব হালকা লাগছে!!