ষ্টেশনে আজ অতো বেশি ভীড় নেই বললেই চলে। প্ল্যাটফর্ম এ একটু দূরে দূরেই দুই একটা মানুষ দল করে দাড়িয়ে কিছু না কিছু নিয়ে গল্প করছে নিজেদের মাঝে। মাঝে মাঝে তাদের মুখে বিস্তীর্ণ হাসির রেখাও দেখা যাচ্ছে। যাক তাহলে আমার আশে পাশের মানুষগুলো তো আমার মতো নয় অন্তত। তাদের জীবনে আমার জীবনের মতো হতাশার ছায়া পড়েনি। আমি হতাশার পথের পুরনো পথিক। মা বাবা গত হওয়ার পর থেকেই বেচে থাকার অর্থ হারাচ্ছিলাম একটু একটু করে। আত্মহত্যা করবো বলেও ভেবেছি অনেকবার। কিন্তু প্রতিবার যখন ব্রিজ থেকে নিচে তাকিয়ে নিজের থেঁতলে যাওয়া দেহটার কথা কল্পনা করতাম, আত্মহত্যার ভূত আপনা থেকেই চলে যেত আর সেখানে ভর করতো একরাশ হতাশা। সেই হতাশার মাঝেই আশার আলো হিসেবে ত্রিণাকে পেয়েছিলাম। মেয়েটা অশেষ ভালবাসার কিছু দাবি নিয়ে এসেছিল আমার কাছে। আমার চোখের নাকি মায়ায় পড়েছিল সে। ভার্সিটিতে একই ক্লাসে থাকায় কোন কারণে তার দিকে নজর পড়ে গেলেই দেখা যেতো ত্রিণা আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। সেই মায়া আচ্ছন্ন মুখের আদলের প্রেমে যে আমিও পড়েছিলাম এটা ত্রিণা জানেনা। আর কখনো জানবেওনা। সব ভালবাসা প্রকাশ পায়না। কিছু ভালবাসা লুকিয়েই থেকে যায় সারাজীবন। হঠাত বীপ বীপ আওয়াজ করে মোবাইল টা বেজে উঠলো। যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই, ঊষার মেসেজ।
” কোথায় তুমি??? কতক্ষণ লাগবে আর আসতে??? প্লিজ একটু তাড়াতাড়ি এসো। আমি আর কতক্ষণ বাহানা দিয়ে আটকাবো সবাইকে??? ”
.
ঊষার আজ বিয়ে হওয়ার কথা। যার সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে তাকে সে মোটেও পছন্দ করেনি। কেননা তার পছন্দ আমি। ত্রিণা মারা যাবার ঠিক একমাস পরে যখন ত্রিণার কবরের পাশে এক প্রকার পাগলের মতো বসে বসে কান্না করছিলাম সেদিন প্রথম পরিচয় হয়েছিল এই মেয়েটার সাথে আমার। আমার তাতে কোন মাথা ব্যথা ছিলনা। যেই মেয়েটা বেচে থাকতে আমার এক ফোটা ভালবাসার জন্য প্রতিনিয়ত ছটফট করতো তাকে তখন আমি বোঝানোর চেষ্টায় ব্যস্ত ছিলাম যে আমি তাকে কতোটা ভালবাসতাম ।
.
ট্রেন এসে গেল। আমাকে যেতে হবে আমার গন্তব্যে। আর কাউকে আমি আমার ভালবাসা থেকে বঞ্চিত করতে চাইনা, আর কারও মৃত্যুর বোঝা আমি নিজের কাধে রেখে চলতে পারবোনা। কতোটা কষ্টের তা হয়তো কেউ বুঝবেনা।
ঊষা দের গ্রামে যেয়ে তাদের বাড়ি খুজে পেতে অনেক কষ্ট করতে হলো আমার। গ্রামে বিয়ে হলে সবাই তো জানার কথা। কিন্তু কেউই দেখলাম জানে টানে না ঊষাদের পরিবারকে। যখন খুজে কেটে পৌছালাম ঊষা দরজার বাহিরেই ছিল। ওকে নিয়ে ওদেরই গ্রামের ষ্টেশনে বসে রইলাম কতোক্ষন, কই কেউতো এলোনা খুজতে। ঊষা বোধহয় আমার মনের কথা বুঝতে পেরে হঠাতই বললো, ” কেউ আসবেনা অর্ক। ওরাতো আমাকে তাড়াতেই চাইতো। আমি নিজ থেকে চলে এলাম এবারতো ওরা মুক্ত। আমার বাবার সম্পত্তির কোনো অংশিদার রইল না। ওরা যা চাইতো তা ওরা পেয়ে গেছে। আর আমিও।”
ঊষার মুখে পরিতৃপ্তির হাসি দেখলাম। আচ্ছা ত্রিণা কি এখন দেখতে পাচ্ছে আমাকে ওই শূণ্য থেকে??? ও কি খুশি আমাকে এইভাবে কারও সাথে দেখে??? কেউ আমার হাত দুটিকে এইভাবে নিজের শেষ ভরসা বানিয়ে নিজের ঘর ছেড়েছে দেখে ত্রিণার কি হিংসা হয়??? ও কি আজও মাফ করতে পেরেছে আমাকে???
.
আজ থেকে ছয় বছর আগে ত্রিণা এক প্রকার জোর করেই আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে গিয়েছিল। ক্লাসে সবসময় তাকিয়ে থাকা, ক্লাস শেষে পিছু নিয়ে চোখে চোখে রাখা আমাকে, সবসময় আমার সাথে সাথে থাকা, আমার আশে পাশে অন্য যেকোনো ধরনের মেয়ের উপস্থিতি বহিস্কার করা। এই সবকিছুই ছিল তার কাছে ডালভাত। আমি কখনোই পাত্তা দিতামনা।তবে চার বছর ধরে তার এই পাগলামি দেখতে দেখতে একটা সময়ে আমিও অভ্যস্ত হয়ে গেলাম এইসবে। কিন্তু ত্রিণাকে জানালাম না। ভাবলাম অনার্স শেষ করে একটা জব পেয়ে গেলে মেয়েটাকে একবারে নিজের করে রেখে দিবো।
.
হঠাত ঊষার ধাক্কায় বাস্তবে ফিরলাম। ” ট্রেন এসেছেতো। চলো। ”
৫ ঘন্টা জার্ণির পর অবশেষে ঢাকায় ফিরতে পারলাম। ঊষার কথামতো আমরা বিয়ে করে নিলাম সবার আগে। আমার ছোটখাটো সংসার শুরু হলো। কিন্তু একপাক্ষিক। আমার জন্য এটা কোনো ভালবাসার কাহিনীর গল্প ছিলনা। কিছু চাপা কষ্ট যেন আবারো বুকে এসে না বিধে সেই ব্যবস্থা ছিল এটা আমার জন্য। ত্রিণা মেয়েটা ভালবেসে বেসে একটা সময় হতাশ হয়ে যাচ্ছিল বুঝতে পারছিলাম আমি।কিন্তু তবুও আমি ওর হতাশা দূর করিনি। ও যে আমার মনকে ওকে ভালবাসতে বাধ্য করে দিয়েছিল সেটা আমি ওকে অনেক ধুমধাম করে জানাতে চাচ্ছিলাম। যেদিন জানাবো বলে ঠিক করলাম সেদিনই আমার ত্রিণা নিজের ভালবাসায় হার মেনে আমাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেল। ওর মৃত্যুর দুইদিন পর পাগলপ্রায় আমি কুরিয়ার এ একটা চিঠি পেয়েছিলাম।
” অর্ক ভালবাসা কি তুমি কি জান??? জানোনা তাইনা??? হ্যা অর্ক তুমি জানোনা। আর জানোনা বলেই কখনোই আমার ভালবাসা বুঝলে না। ভালবাসা নিয়ে তোমার দিকে তাকিয়ে সেই ভাবলেশহীন চেহারা দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত। আমার কেউ ছিলনা অর্ক। আমিও তোমার মতোই সব হারিয়েছিলাম। তোমাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম অনেক আপন মনে হয়েছিল। আমার মনে হতো তুমিই সেই যার জন্য আমি এই পৃথিবীতে এসেছি। কিন্তু তোমার কখনোই এমন মনে হয়নি। অনার্স শেষ হয়ে যাবে আর কিছুদিন পরেই। তোমার সাথে আর দেখাও হবেনা। তুমিতো আমাকে কখনোই ভালবাসনি তাই তোমারতো হয়তো কষ্ট হবেনা, কিন্তু আমার যেই পরিমান কষ্ট হবে তা কেউ দূর করতে পারবেনা। তোমার এতো অপছন্দ নিয়ে আমি কিভাবে বেচে থাকবো বল??? তুমি বাস্তবে যদি নাই হয় তো ঠিক আছে আমি কল্পনায় নাহয় সারাজীবন তোমাকে নিজের করে রাখবো। আমি মরে যাওয়ার পর অন্তত আমার কবরে মাঝে মাঝে এসে দেখে যেও নিজে থেকে, আমি তাতেই শান্তি পাবো। নিজ থেকে তুমি অন্তত আসবেতো আমার কাছে। তোমাকে বলেছিলাম একদিন তোমার একটুখানি ভালবাসা পেতে আমি যেকোনো কিছু করতে পারি। তুমি কেমন তাচ্ছিল্য নিয়ে তাকিয়েছিলে আমার দিকে মনে আছে।। এখনতো তুমি বাধা পড়ে গেছ। এসো কিন্তু হ্যা আমাকে মাঝে মাঝে দেখতে!!!”
এই একটি চিঠি আমার এলোমেলো জীবনকে পুরোপুরি ছন্নছাড়া করে দিয়েছিল। পাগলের মতো কতো যে ঘুরতাম রাস্তায় রাস্তায়। সেই জায়গা গুলো যেখানে ত্রিণা জোর করে নিয়ে যেত আমায় সেখানে গেলেই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম, ভাবতাম এই বুঝি ত্রিণা চলে আসবে কোথাও থেকে আর হাত ধরে টানতে টানতে আবারো কোথাও নিয়ে যাবে। কিন্তু ত্রিণা আসতো না। আমার অপেক্ষাও শেষ হতোনা। ত্রিণার কবরে যেয়ে মাঝে মাঝেই ওকে বোকতাম খুব। আরেকটু কেন বুঝলেনা আমায়??? আমি সব হারিয়ে ভালবাসতে ভুলে গিয়েছিলাম, তুমিইতো শিখিয়েছিলে, না শুনে কেন চলে গেলে??? ত্রিণা জবাব দিতোনা। ঊষা তখন আমার পাশে এসে দাড়ায়। ঊষাও আমার ক্লাসমেট ছিল। ওকে আমি ত্রিণার কথা বলতাম। আরও কতো কি যে বলতাম ও চুপচাপ শুনে যেত। পাগলামির অন্তিম পর্যায়ে ছিলাম বলেই হয়তো এতো সহ্য করতো।
.
চিকিৎসার পরে আস্তে আস্তে সুস্থ যখন হলাম ঊষা বেধে রাখলো আমাকে। বললো তাকে ছেড়ে গেলে আমাকে আবারো কারও মৃত্যুর দায় নিয়ে বেচে থাকতে হবে। আমি অবাক চোখে ঊষার দিকে প্রায় অনেক্ষন তাকিয়ে থেকে ত্রিণা কে খুজলাম। কেন খুঁজলাম জানিনা। তবে পেলাম না।
.
৫ বছর পর,
একটা কবরস্থানের সামনে দাড়িয়ে আছি আমি আর ঊষা। আমার দিকে অত্যন্ত মায়াময় চোখে তাকিয়্র থেকে একটা সময়ে ঊষা আমার হাত ছেড়ে আমাকে এখানে একা রেখে চলে যায়। ত্রিণা তুমি কি শুনতে পাচ্ছো??? আমি বাবা হবো। তুমি কতো করে বাচ্চার কথা বলতে তোমার মনে আছে??? ত্রিণা আমি ওই নামই রাখবো আমার বাচ্চার যেই নাম তুমি রাখতে চেয়েছিলে।ত্রিণা তুমি খুশিতো বল??? বলোনা?? ও ত্রিণা!!!! জান আমি না এখন অনেক বদলে গেছি। তুমি আগে যে আমাকে খারুস বলতে আমি আর এখন একটুও তেমন নেই। একবার ফিরে এসে একটু দেখে যাবে ত্রিণা??? শুধু একবার???
ত্রিণা ফিরে এলোনা। ঊষা এলো। আমাকে শক্ত করে ধরে রাখলো।কিছুটা সময় পর আমাকে আস্তে আস্তে করে হাসপাতালের দিকে নিয়ে গেল।
.
আমি ঊষা। আর যেই ছেলেটিকে আমি ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছি সে আমার হাজবেন্ড। সে আজও জানেনা যে সে মাঝে মাঝেই এটা ভুলে যায় যে ত্রিণা বেচে নেই। সে যখন এটা ভুলে যায় তখন সে ত্রিণাকে খোজে এই কবরস্থানে, সে ভাবে এখানেই কোথাও তার ত্রিণা হারিয়ে গেছে। খুজে পায়না আর তখন বার বার হাজার বার করে সেই মেয়েটাকে হারানোর কষ্টে দগ্ধিত হয় যার সীমাহীন ভালবাসাকে একদিন সে অবহেলা ভরে ফিরিয়ে দিয়েছিল। একেই হয়তো প্রকৃতির প্রতিশোধ বলে। কিন্তু প্রকৃতি এটা হয়তো ভুলে যায় যে যাকে তারা কষ্ট দিচ্ছে তার ঢাল হয়ে আমি দাড়িয়ে থাকি। সে যতোবার কষ্ট পায় তাকে একটু একটু করে আমি ঠিক করি এবং করতেই থাকি। প্রকৃতি প্রকৃতির কাজ করুক, আমিও আমার কাজ করবো। আমার ভালবাসাকে আগলে রাখবো।
.
হাসপাতালে অর্ক শুয়ে আছে। একটু আগেই ডাক্তার তাকে দেখে গেছে। ঊষা এসে বসলো অর্কের পাশে।
” ঊষা, তুমি আমার একটা কাজ করতে পারবে??? একটু ত্রিণাকে খুজে বলতে পারবে যে আমি ওকে ভালবাসি, ও যতো ভালবাসে ততো হয়তো নয় একটুখানি কম। ওকে খুজেই পাচ্ছিনা। তুমি খুজতে সাহায্য করবে আমাকে???
ঊষা মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে অর্কের হাতে হাত রাখে আর আড়াই হাত মাটির নীচে একজনের জনম জনমের ভালবাসা নিয়ে খোজা এক মায়াময়ীর বুকটা কখনো প্রশান্তিতে আর কখনো কারও জন্য সীমাহীন ভালবাসার আর্তনাদ নিয়ে একটু খানি ধক ধক করে ওঠে।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা