– আচ্ছা নীলা তুমি ছেলে হলে বেশি খুশি হবে নাকি মেয়ে?
– আমার শুধু একটা বাচ্চা চাই। কচি কচি হাত পা একটা মিষ্টি দেখতে বাচ্চা।
– তবুও! একটা আলাদা শখ থাকতেই পারে!
– দেখো অরুণাভ আমাদের বাচ্চা ছেলে হবে নাকি মেয়ে সেটাতে আমার কিন্তু কোনো হাত নেই। কারণ আমার জিনে দুটোই এক্স ক্রমোসোম।
আর তোমার জিনে এক্স ওয়াই দুটোই আছে। এখন ফিটাসের লিঙ্গ নির্ধারণ হবে তোমার জিনের দ্বারা। তাহলে….
– দোহাই তোমার! এখানে আর বিজ্ঞানটাকে টেনে এনো না। প্রাণীবিদ্যা আমার জীবনটাকে পুরো নরক বানিয়ে ফেলেছিল। জানি না কি করে সবচেয়ে অপছন্দের বিষয় নিয়েও কেন আমি পড়াশুনা শেষ করলাম!
– প্রাণীবিদ্যায় না পড়লে আমার দেখা কেমন করে পেতে শুনি! অবশ্য আমার সংস্পর্শকে যদি তুমি নরক ভেবে না থাকো!
– হ্যাঁ, সেটাও ঠিক। তবে তোমার সংস্পর্শকে যদি নরক ভাবি তাহলে স্বর্গের দেখা আমি কোনোদিনই পাব না।
– হয়েছে, এখন আর সাহিত্যিক হতে হবে না। এখন শুধু ক্ষণ গুণো। আর কিন্তু মাত্র দু’টো মাস।
– নীলা তোমার আর আমার ভালোবাসার ফসল আমাদের সন্তান এই পৃথিবীতে আসছে আর কিছুদিনের মধ্যেই।
তুমি বুঝতে পারছো আমি কতটা এক্সাইটেড! প্রথমবার নিজের সন্তানের মুখ দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি আমি। তুমি ভাবতেও পারবে না মাঝরাতে আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি অনুভব করি আমার সন্তান আমায় তার কচি কচি দু’হাত দিয়ে ঝাপটে ধরে আছে। তুমি জানো নীলা তখন আমি নিজেকে সামলাতে পারি না। আমার কান্না আমি আটকাতে পারি না। তুমি দেখো খুব ভালো বাবা হবো আমি। পৃথিবীর সেরা বাবা হবো। আমাদের সন্তান কোনোদিন আমার দিকে কোনো অভিযোগ তুলতে পারবে না এই বলে যে আমি তার কোনো কিছুর কমতি রেখেছি। তুমি দেখে নিয়ো।
– আমি জানি। তুমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা হবে তুমি।
নিজেদের অনাগত সন্তানের আগমনের অপেক্ষায় বিভোর হয়ে আছে অরুণাভ আর নীলা। নিজেদের অনাগত সন্তানের জন্য অরুণাভের এই ভালোবাসা ব্যাকুলতা দেখে মাঝে মাঝে খুব হিংসে হয় নীলার। যদিও গর্ভে ধারণ করছে নীলা, প্রত্যেকটা স্পন্দন টের পাচ্ছে ও কিন্তু অনুভূতিটা যেন অরুণাভের। মাঝে মাঝে নীলা নিজের পেটে হাত রেখে অনাগত অতিথিকে বলে,
– দেখিস পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান সন্তানদের একজন হবি তুই। তোর বাবার মতো এমন পাগলাটে বাবা আর দ্বিতীয়টা খুঁজে পাবি না।
একদিন সকাল বেলা অরুণাভ কলেজে গিয়েছে। হঠাৎই নীলার তলপেটে একটা চিনচিনে ব্যথা উঠতে লাগলো। ও ঘড়িতে দেখলো ন’টা বিশ। ন’টা পঁয়তাল্লিশে অরুণাভের ক্লাস নেওয়া শেষ হবে। নীলা চাচ্ছিল না অরুণাভকে ক্লাসের মাঝে ফোন দিতে। অরুণাভের ছাত্রদের মতো স্বভাব। একবার মনোযোগ হারালে ও আর পড়াতে পারে না। ব্যথা বাড়তে লাগলো নীলার। ক্রমেই ক্রমেই অসহ্য হয়ে উঠতে লাগলো। সেইসাথে শুরু হলো রক্তক্ষরণ। আর সহ্য করতে না পেরে ফোন দিলো অরুণাভকে। ফোন পেয়েই ডিপার্টমেন্টাল হেডকে বলে দ্রুত বাসায় ফিরল অরুণাভ। কিন্তু বাসায় গিয়ে দেখে ততক্ষণে নীলা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। আর মেঝে ভেসে যাচ্ছে রক্তে। দ্রুত নীলাকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটলো অরুণাভ।
ওটির বাইরে ক্রমাগত খোদাকে ডাকছে অরুণাভ। নীলার মা, বাবা, বড় ভাই, ভাবী সবাই উৎকণ্ঠার মাঝে বসে আছেন। প্রায় এক ঘন্টা হয়ে গেছে এখনো অপারেশন শেষ হয় নি। এমনকি ভেতরে কি হয়েছে ওদেরকে কেউ জানাচ্ছে না পর্যন্ত। শুধু দু’বার ওদেরকে দু ব্যাগ রক্তের জোগাড়ের জন্য বলেছে। নীলার বড় ভাইয়ের রক্তের গ্রুপ আর নীলার গ্রুপ একই। আগে থেকেই ঠিক করা ছিল নীলার ডেলিভারির সময় রক্তের প্রয়োজন হলে ওর বড় ভাই নিলয়ই রক্ত দেবে। কিছুক্ষণ পর ওটি থেকে বের হয়ে এলেন ডাক্তার। অনেকটা একঘেয়ে ভাবেই বললেন,
– সরি, আমরা বেবিকে বাঁচাতে পারি নি।
অরুণাভ ভেবে পাচ্ছিল না ওর সন্তান পৃথিবীর মুখ দেখে নি তাই ও কাঁদবে নাকি নীলা বেঁচে আছে তাই খুশি হবে। নীলাকে বেডে শিফট করার পর ডাক্তার অরুণাভকে চেম্বারে ডাকলেন। সেখানেই ডাক্তার খুলে বললেন আসল সমস্যা।
– আমি ভীষণ অবাক হচ্ছি আদিল সাহেব এটা ভেবে যে আপনার স্ত্রীকে যে ডাক্তার দেখছিলেন তিনি এত বড় একটা ব্যাপার বুঝতে পারেন নি কেন!
– একটু খুলে বলবেন প্লিজ! নিজেকে সামলে নিয়ে বললো অরুণাভ।
– দেখুন আপনাদের বাচ্চাটা ম্যাচিউর ছিল না। ওর শারীরিক বিকাশ পরিপূর্ণ ছিল না। ওর মস্তিষ্ক মানে মাথাটা পুরো অসম্পূর্ণ ছিল। মাথায় খুলির অস্তিত্ব ছিল সামান্যই। তাছাড়া আরো বেশ কিছু ত্রুটি ছিল। যেগুলো আরো অনেক আগেই ধরা পড়ে যাওয়ার কথা ছিল।
– এ ব্যাপারগুলো আগে ধরা পড়ে গেলে কি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যেত?
– ব্যবস্থা বলতে বাচ্চাটা এভোয়েট করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকত না।
তাহলে হয়তো আপনার স্ত্রীর এরকম প্রাণসংশয় হতো না। বিধ্বংস চেহারা নিয়ে ডাক্তারের কেবিন থেকে বের হয়ে এল অরুণাভ। ওর আর নীলার স্বপ্ন আশা আকাঙ্ক্ষাগুলো এক নিমিষে শেষ হয়ে গেল। যদি প্রাথমিকভাবেই ওরা জেনে যেতে পারতো তবে হয়তো কষ্টটা কম হতো । নীলার কেবিনে গিয়ে দেখতে পেল ওকে । পুরোটা মুখ নীল হয়ে আছে। কতটা কষ্ট ব্যথা সইতে হয়েছে ওকে!
রিসিপশনে ডাক পড়লো অরুণাভের। কিছু ফর্মালিটিজ বাকি আছে।
– আমি আদিল আহসান।
– হ্যাঁ, এই কাগজ দুটোতে সই করুন। আর পেমেন্ট কি এখনই পে করবেন নাকি পরে একসাথে করবেন?
– পুরো পেমেন্ট একসাথেই করবো।
ধীরে জবাব দিল অরুণাভ। কলেজ থেকে ফিরেই গোছগাছ করতে শুরু করে দিল অরুণাভ। বেশ অবাক হলো নীলা। ধীরে ধীরে পাশে এসে জিজ্ঞেস করলো,
– কি ব্যাপার হঠাৎ ব্যাগ গুছাচ্ছো?
– কলেজ থেকে ছুটি নিয়েছি। সজীবরা সবাই বান্দরবন যাচ্ছে। গতবার কাপ্তাই গিয়েছিল। কলেজের পরীক্ষার ব্যস্ততার কারণে যেতে পারি নি। এবার তাই ট্যুরটা মিস করছি না। তোমায় বাবার বাড়িতে দিয়ে আমি যাবো।
– কবে ফিরবে?
– সঠিক বলতে পারছি না। ফিরলেই তোমায় গিয়ে নিয়ে আসবো।
অরুণাভের এমন আচরণে বেশ অবাক হলো নীলা। অরুণাভ তো কখনো এমন ছিল না। এসময়টাতে ও সত্যি সত্যি বান্দরবন যাচ্ছে ঠিক যেন বিশ্বাস করতে পারলো না নীলা। এখনো প্রায় প্রতিটা রাতেই মাঝরাতে একটা চাপা কান্নার আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় নীলার। যদিও পাশে তাকিয়ে দেখতে পায় অরুণাভ ঘুমিয়েই আছে তবুও নীলা বুঝতে পারে কান্নাটা অরুণাভেরই ছিল। আর ও ঘুমের ভান ধরে নীলার কাছ থেকে কষ্টটা লুকাতে চাচ্ছে। নীলাকে সকাল বিকাল ওর মা, বাবা, ভাই, ভাবী সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছেন। ওর পাশে থাকছেন। অরুণাভ বাসায় একা থাকবে বলে নীলা ওর মা বাবার জোরাজুরি সত্ত্বেও রয়ে গেছে এখানে। তারা সর্বক্ষণ আগলে রাখছে নীলাকে। কিন্তু অরুণাভকে কেউ সান্ত্বনা দিতেও আসছে না। ছেলেরা কি আর এত সহজে ভেঙে পড়ে! তাও অনাগত সন্তানের মৃত্যুতে, যে কি না পৃথিবীর আলোই দেখেনি! তাছাড়া অরুণাভের মা বাবাও কেউ নেই। নীলা ভাবলো হয়তো বন্ধুদের সাথে ঘুরে একটু রিফ্রেশ হতে চাইছে ও।
শেষ বিকেলের রোদ এসে পড়ছে অরুণাভের চোখে মুখে। রোদের রক্তিম আভা যেন ফুটে উঠেছে ওর মুখেও। ধীরে ধীরে চোখ খুলল অরুণাভ। ডান হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ দুটি একবার কচলে নিয়ে একটা হাই তুলে উঠে বসল। জানালার দিকে তাকাতেই দৃষ্টি চলে গেল সামনের মাঠটাতে দুদ’ল ছেলের দিকে। একদল ফুটবলে শট লাগাতে ব্যস্ত আর আরেকদল ব্যাটে বল লাগাতে। অরুণাভ নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে তাকলো ওদের দিকে। চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা কোমল মুখ, কচি কচি ছোট ছোট দু জোড়া হাত পা। একটা সদ্য জন্মানো নবজাতকের ঘুমন্ত নিস্পন্দিত শরীর। অরুণাভের দু চোখ বেয়ে পড়তে লাগল জল। কলেজের মাঠের গোলবারটার কাছ থেকে সহাস্য মেয়েটা প্রায় দৌড়ে এলো ক্যান্টিনের সামনে।
– নীলা ভাবি কেমন আছেন? আগে বলেন আমায় চিনতে পেরেছেন কি না!
– তুমি জুঁই না! দক্ষিণ পাড়ের জুলহাস ভাইয়ের ছোট বোন।
– হ্যাঁ, ভাবি ঠিক চিনতে পেরেছেন।
– তা তুমি এখানে! এই কলেজে ভর্তি হয়েছো নাকি?
– জ্বি অনার্সে প্রাণীবিদ্যায়। আপনিও তো প্রাণীবিদ্যায় ছিলেন তাই না!
– হ্যাঁ, তা তোমার বাড়ির সবাই কেমন আছে? জমির চাচা,চাচি, জুলহাস ভাই,শান্তা ভাবি আর তোমার ছোট ভাইপোটা?
– সবাই আলহামদুলিল্লাহ ভালো। ভাইপোটা যা দুষ্ট হয়েছে কি বলবো আপনাকে, একাই পুরো বাড়ি মাথায় করে রাখে। ভাবির তো আবার বাচ্চা হবে। চার মাস চলছে।
– বাহ্, খুশির সংবাদ দেখছি। তা শুধু আমার কুশলই জিজ্ঞাসা করলে তোমার ভাইয়ের কথা বললে না!
– অরু ভাইয়ের কথা কি জিজ্ঞেস করবো! অরু ভাই তো সপ্তাহখানেক হলো বাড়িতে। আপনি বাপের বাড়ি চলে গেছেন বলে অরু ভাই বাড়ি চলে এলেন। আপনি বাসায় ফিরলে নাকি বাসায় ফিরবেন তিনি। কেন আপনাকে কিছু বলে নি অরু ভাই?
– বলেছিল তো। দেখেছো আমিই সব ভুলে বসে আছি। তোমার বাড়ি আর অরুণাভের বাড়ি যে একই গ্রামে। শুধু উত্তর পাড় আর দক্ষিণ পাড়…
– আরে বাদ দেন তো ভাবি। ভুল কার না হয়!
– তারপরেও। আচ্ছা বসো তো দেখি, সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কথা বলে যাচ্ছি। বলো কি খাবে?
– না ভাবি আজকে না অন্য আরেকদিন। পাঁচ মিনিট পরেই ক্লাস শুরু হবে। এখন চলি।
– আচ্ছা ঠিক আছে। ভালো থেকো।
– আপনিও ভালো থাকবেন।
জুঁই ক্যাম্পাসের দিকে পা বাড়ালো। নীলা চেয়ারটাতে বসে এক কাপ চা দিতে বললো ক্যান্টিনের মামাকে। ওর যখন খুব মন খারাপ থাকে তখন ও কলেজ মাঠে চলে আসে। চা খায় ক্যান্টিনে। অবশ্য তখন সাথে অরুণাভ থাকে। কিন্তু আজকে ও একাই এসেছে। অরুণাভ বলেছিল ও একটু রিফ্রেশ হতে চায়। বন্ধুদের সাথে নীলগিরি ঘুরতে যাবে। নীলা একা একা বাসায় না থেকে যেন ওর বাবার বাড়িতে চলে যায়। অথচ অরুণাভ এখন গ্রামের বাড়িতে গিয়ে একা একা বসে আছে। নীলাঞ্জনা, চোখ দুটো তার টানা টানা। যেন জমে আছে এক বিল জল, সারাক্ষণ করে টলমল, সে জলে কভু পদ্ম ফোটে না, ফোটে না কোনো শাপলা, কচুরিপানা। সে জলে গল্প ভাসে, হাজারো স্বপ্ন লুকিয়ে আছে, ভালোবাসা ডুবে আছে তাতে অতলে, আমি জাল বুনছি একমনে। ভালোবাসা ছেঁকে তোলার জাল, অজানা এক মোহে হারাচ্ছি তাল, নামহীন কোনো নেশায় হচ্ছি মাতাল!
তার কন্ঠে কোনো সুর খেলে না, সুরের মূর্ছনায় আমিও মাতি না, হাসিতেও সে ভুবন জুড়ায় না, রিনঝিন কোনো তাল বাজে না। সে কাঁদতে জানে, চক্ষুবিলের সমস্ত জল একেবারে দেয় গড়িয়ে, এক চিলতে ভালোবাসার প্রবল আকুতি তার মাঝে, একটু স্পর্শ শুধু পেতে চায় সে। যার সমস্ত গল্প জুড়ে পদচারণা শুধু আমার, যার ভালোবাসার নগরে বিচরণ আমার, সে আমার ভালোবাসা,আমার নীলাঞ্জনা। কি সাথে নেবে আমায়,রাখবে তোমার পথচলায়, শেষ বিকেলের রক্তিম আভা ছড়াতে দেবে আমায়, ক্লান্ত বলাকার সুখ নীড়ের বাসিন্দা হওয়ার সুযোগটা কি দেবে আমায়!
কবিতাটা বাজতে লাগল নীলার কানে। সেই সাথে পুরো দৃশ্যটা ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল। নরসুন্দা নদীর তীর ঘেঁষে ওদের কলেজ। নদীর উপরে পায়ে চলার যে ব্রীজটা সেখানেই এমনই এক শিশিরভেজা সকালে নীলাকে নিজের করে চেয়েছিল অরুণাভ। সেদিন একবারের জন্যও না বলতে পারে নি নীলা। সেদিনই লেখা হয়েছিল অরুণাভ – নীলার পথচলার নতুন অধ্যায়। ব্রীজ পার হতে মূল সড়কে চলে এলো নীলা। হাটতে লাগলো। কলেজ থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ ওর বাসা। আর ভাবতে লাগলো অরুণাভ এমন কেন! নিজেকে লুকিয়ে রাখতে এতো পটু কেন ও! সকাল বেলা গ্রামের পথ মেঠো পথ ধরে নদীর পাড় ঘেঁষে হাঁটছিল অরুণাভ। এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রিনে ভেসে উঠলো নীলার নাম। ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরতেই ভেসে উঠলো নীলার ঝাঁঝালো কন্ঠ,
– কি করছো তুমি?
– হাঁটছি। পাহাড়ি নদীর পাড় ঘেঁষে।
– জানি জানি কি পাহাড় ঘেঁষে হাঁটছো। বান্দরবন না ত্যান্দোড়বন যেখানে আছো সেখান থেকে আজ রাতের মধ্যে যদি বাসায় না ফিরেছো তবে বুঝবে আমি কি জিনিস!
– অ্যাঁ, বান্দরবন থেকে এক রাতের মধ্যে কি করে আসবো!
– তুমি তো ত্যান্দোড়বন আছো।
সেখান থেকে বিকেলের মধ্যেই ফিরতে পারবে। রাতের মধ্যে যেন বাসায় পাই তোমায়। মনে থাকে যেন। রাখছি। কট করে ফোন কেটে দিল নীলা। অরুণাভ কতক্ষণ থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কিন্তু এটা ভেবে পেলো না নীলা জানলো কি করে যে ও বান্দরবন না গিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে এসেছে! ভাবতে ভাবতে বাড়ির পথে চলল। দ্রুত বাসায় ফিরতে হবে। নয়তো কপালে শনি আছে।
সন্ধার পর পর বাসায় ফিরল অরুণাভ। নীলা আগেই চলে এসেছে তাই দরজায় তালা নেই। কলিং বেল চাপলো ও। বেল বাজার প্রায় সাথে সাথেই দরজা খুলে দিলো নীলা। অরুণাভ সম্মুখ যুদ্ধ থেকে বাঁচতে সরাসরি রুমে চলে গেল প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে। নীলাও ধীরেসুস্থে অরুণাভের পিছু পিছু গেল। অরুণাভ হাতঘড়িটা খুলে ড্রেসিংটেবিলে রাখলো সবে। এরই মাঝে নীলা ওর শার্টের কলার ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলতে শুরু করলো,
– কি ভাবো কি তুমি নিজেকে! তোমার কষ্টগুলো কি আমি বুঝতে পারি না। আমার ছোঁয়ায় তোমার কষ্ট প্রশমিত হয় না! আমায় জড়িয়ে তুমি একবারও কাঁদতে পারলে না। মাঝরাতে একা একা কেঁদেছো। আমি জেগে যেতেই ঘুমের ভান ধরে সটান হয়ে পড়ে রয়েছো। একা একা কষ্ট গুলোকে কাছে টানবে বলে বান্দরবনের কথা বলে গ্রামের বাড়ি চলে গেছো। আমি কি তোমার কেউ না! আমার চারপাশে মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার মতো অনেকেই আছে তাই বলে কি তোমার মাথায় হাত বুলানোর মতো আমি ছিলাম না! এতটুকু ভালো কি আমি তোমায় বাসি নি! কি হলো কিছু বলছো না কেন! কথা বল! এদিকে অরুণাভ শুধু কেঁদেই চলেছে। কোনো কথা বলছে না। এতদিন যে দুঃখটা নিজের মাঝে জমিয়ে রেখেছিল সেটা আজ টুপটাপ ঝরে পড়ছে। অশ্রুজলে ভিজছে নীলাও। দু’জনের অশ্রুসমুদ্রে।