আর একটু হলেই মিস হয়ে যাচ্ছিল এক লাফে লক্ষিকান্তপুর লোকালে উঠে পড়লাম। কপাল জোড়ে জানলার ধারে সিট পেয়ে বেশ হাত পা ছড়িয়ে আরাম করে বসে পরলাম এখান থেকে লক্ষিকান্তপুর পৌঁছতে আরো ঘন্টা দেড়েক লাগবে,শহরের সীমানা পেরিয়ে অন্ধকার ভেদ করে সর্পিল গতিতে হুহু করে ছুটে চলেছে ট্রেন। বেশিরভাগ প্যাসেঞ্জার নেমে গেছে,যাত্রী বলতে আমাকে নিয়ে মেরেকেটে সাকুল্যে জনা পনেরো। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ফেলে আসা দিনের সুখস্মৃতিতে ডুব দিলাম সালটা ঠিক মনে নেই সেই যেবার ইন্ডিয়া হিরো কাপ জিতলো সে বছর। সকাল থেকে লাল গোলাপের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরছি, বাজারে পছন্দসই দু একটা যে পাইনি তা নয় কিন্তু দাম আমার নাগালের বাইরে,পকেট প্রায় গড়ের মাঠ, কাজেই ওদিকে নজর দিয়ে লাভ নেই।
কিন্তু গোলাপ আমাকে যোগাড় করতেই হবে! হন্যে হয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে শেষমেশ বিমলজ্যেঠুর বাগানে দুটো দুর্দান্ত লাল গোলাপ আবিস্কার করলাম। জ্যেঠু একেবারে হাড় চিপ্পুস! যাকে বলে একেবারে মহা খরুষ! ওনার সাধের বাগানের ফুল ছেঁড়া দুরস্ত পাড়ার ছেলেরা ওদিকে তাকাতেই ভয় পায়, একটা ফুল ছিঁড়েছ কি পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে ছাড়বে হেব্বী ডেঞ্জারাস আমি নিরুপায়! ওই গোলাপ আমার চাইই চাই তাই দুঃসাহসিক সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললাম কাল যে তক্কে তক্কে রইলাম তারপর সন্ধেবেলা যখন পাখিরা দল বেঁধে কুলায় ফিরে যাচ্ছে তারও একটু পরে, যখন চারদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো, এ ঘর ও ঘর থেকে শঙ্খধ্বনি শোনা যেতে লাগল ঠিক সেই সময় পাঁচিল টপকে বাগানে ঢুকে পরলাম।
চোরের মতো পা টিপে টিপে গিয়ে সবে একটা গোলাপ ছিঁড়েছি মূর্তিমান বিভীষিকার মত জ্যেঠু এসে হাজির চমকে উঠলাম!হাত থেকে গোলাপটা মাটিতে পরে গেল,পালাবার জন্য পিছনে ফিরতেই খপ করে হাতটা ধরে বললেন তুই বিজয়ের ছেলে না? বললাম হ্যাঁ ফুল ছিঁড়েছিস কেন? মাথা নামিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি বাজখাই গলায় হুঙ্কার দিলেন বল ফুল ছিঁড়েছিস কেন? ভয়ের চোটে মুখ দিয়ে সত্যিটাই বেড়িয়ে গেলো সৌমীলীকে দেব কেন? সৌমীলীকে দিবি কেন? অস্ফুট স্বরে বললাম ওকে ভালোলাগে জেঠু চোখ পাকিয়ে বললেন তা জবা,রানী,শ্যামা ওরা কি দোষ করলো? ওদের বুঝি ভালো লাগেনা? নীরবে নখ খুঁটতে লাগলাম দেখে জ্যেঠু বললেন উত্তর দে মাথা চুলকে আমতা আমতা করে বললাম!কাল ওই ইয়ে ডে!
ইয়ে ডে? সেটা আবার কি? কাল যাকে ভালোলাগে তাকে ফুল দিতে হয় হাঃ হাঃ হাঃ জেঠু হঠাৎ আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন ভালো!ভালো!! সেদিনের ছোকরা বলে কি! ইয়ে ডে হাঃ হাঃ হাঃ জ্যেঠুর হাসি আর থামতেই চায়না কোনমতে হাসি থামিয়ে বললেন নে ফুলটা তোল নিয়ে যা, তোর কথা শুনে আজ বড় মজা পেলাম তাই ছেড়ে দিলাম, খবরদার আর যেন কোনদিন আমার বাগানের ত্রিসীমানায় না দেখি, যা ভাগ! গোলাপটা কুড়িয়ে থ্যাংকইউ বলে এক ছুটে পালিয়ে এলাম।
সবার অলক্ষ্যে সারারাত জেগে পুরো একটা খাতা শেষ করে আমার কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং মার্কা হাতের লেখায় অবশেষে পুরো পাঁচ পাতা জুড়ে একটা যুৎসই প্রেমপত্র লিখেই ফেললাম! কাল যে ভাবেই হোক চিঠিটা ওকে দিতেই হবে রাত্রী জাগরণের ফল স্বরূপ অকাতরে ঘুমাচ্ছিলাম, মায়ের চিৎকারের সঙ্গে বাছাই বাছাই বিশেষণ কর্ণগোচর হতে এক লাফে উঠে পড়লাম! বাপরে! অনেক বেলা হয়ে গেছে প্রায় নটা বাজে তাড়াতাড়ি স্নান সেরে রেডী হয়ে গোলাপ আর প্রেমপত্রখানি স্বযত্নে স্কুল ব্যাগে লুকিয়ে সৌমিলীর স্কুলের পথ ধরলাম। লাভ হলোনা! আমি পৌঁছনোর আগেই ও স্কুলে ঢুকে পরেছে অগত্যা স্কুল ছুটির পর দুরুদুরু বক্ষে সৌমিলীর ফেরার অপেক্ষায় মন্দিরের পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইলাম।
কি ব্যাপার! রোজই তো এই পথ ধরে ফেরে আজ এতো দেরী হচ্ছে কেন? তবেকি আজ ঘুরপথে ফিরে গেল!আশা নিরাশার দোলায় দুলতে দুলতে অপেক্ষা করতে লাগলাম, বুকের ধুকপুকানি ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে যখন ওর আসার আশা ছেড়ে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন গলির মুখে ওকে দেখতে পেলাম। আসছে! ওই তো পরিস্কার দেখা যাচ্ছে মলীকে টাটা বলে এ পথেই আসছে আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিল, সোজা গিয়ে ওর হাতে গোলাপ আর চিঠিটা ধরিয়ে দিয়েই দে দৌড়,দে দৌড় নাওয়া খাওয়া ভুলে পাক্কা দুটি বিনিদ্র রজনী কাটানোর পর মলী খবর দিলো সৌমিলী বিকেলে পুকুরঘটে দেখা করতে বলেছে!
আনন্দে আত্নহারা হয়ে ধেই ধেই করে খানিক উন্মাদের মত নেচে নিলাম এখনকার মতো মোবাইল সর্বস্ব দুনিয়া তখন ছিলোনা, প্রেমিকদের ভরসা বলতে কিছু বিশ্বস্ত সহপাঠী,ওদের হাত দিয়েই চিঠি চালাচালির মাধ্যমে স্বপ্ন দেখা শুরু হতো! স্কুলে আসা যাওয়ার পথে এক ঝলক দেখা আর কখনো সখনো বাড়িতে হাজার গন্ডা মিথ্যে বলে সকলের নজর এড়িয়ে সাক্ষাৎ প্রায় বছর দেড়েক এভাবে চলার পর ধরা পরে গেলাম, দু চোখে স্বপ্ন নিয়ে সৌমিলীর সাথে পুকুর ঘাটে বসে আগডুম বাগডুম বকছি পিছন থেকে সজোরে ধাক্কা খেয়ে মুখ থুবড়ে পরলাম, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি ওর দাদা সুদীপ! সাথে কালুদা, নিমাইদা, পার্থদা কি মারটাই না মারলো, মেরে মুখ ফাটিয়ে দিলো ভাগ্গিস সোনাকাকু দেখতে পেয়ে ছুটে এসেছিল নইলে সেদিন হয়তো মেরেই ফেলতো পাড়ার আমার নামে যা নয় তা রটিয়ে আমাকে বখাটে,বাঁচাল, ইচড়েপাঁকা ইত্যাদি বলে বাড়ি বয়ে এসে মনগড়া কথা শুনিয়ে মা বাবাকে অপদস্থ করে এককথায় আমার জীবনটাকে নরক করে তুললো। বাবা,মাও ওদের কথায় আমাকে অন্যায়ভাবে তিরস্কার করে প্রায় একঘরে করে দিলো।
আমি নাকি ওদের মুখে চুনকালী দিয়েছি! ওদের উঁচু মাথা হেঁট করে দিয়েছি। পাড়ার সকলে এমন ভাব দেখতে লাগলো যেন আমি প্রেম করিনি, মহাপাপ করেছি সৌমিলী গৃহবন্দী হলো,স্কুল থেকে শুরু করে প্রাইভেট টিউটর সর্বত্র ওর ওপর নজরদারির ব্যাবস্থা হলো। ওর বাবা,মা,দাদা কেউ না কেউ সর্বক্ষন ওর সাথে টিকটিকির মত লেগে রইলো কিন্তু ওদের সবরকম চেষ্টা ব্যার্থ করে আমাদের ভালোবাসা ভালোবাসা হয়েই রয়ে গেল! কালেভদ্রে দেখা হত কিন্তু সুযোগ পেলে আমরা গোপনে সকলের নজর এড়িয়ে দেখা করতাম। উচ্চমাধ্যমিকের পর ওর বাড়ী থেকে বিয়ের ব্যাবস্থা প্রায় পাকা করে ফেলল নিরুপায় হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা পালিয়ে যাবো!
পরিকল্পনা অনুযায়ী মন্দিরের পিছনে দাঁড়িয়ে আছি সৌমিলি আসলেই স্টেশন সেখান থেকে পালিয়ে যাব কলকাতায়! আমার এক বন্ধুর দাদার বাড়ীতে ও এলো কিন্তু ট্রেন ধরার আগে আমরাই ধরা পরে গেলাম মারতে মারতে আমাকে আধমরা করে রেল লাইনের ধরে ফেলে রেখে ওরা সৌমিলিকে নিয়ে চলে গেল এর কিছুদিন পর প্রবল আপত্তি স্বত্ত্বেও ওরা জোর করে ওর বিয়ে ঠিক করে, বিয়ের আগের রাতেই সৌমিলী বিষ খেয়ে সে যাক লক্ষিকান্তপুর এসে গেছে আমাকে নামতে হবে অনেক কাজ বাকি! বাড়ী ফিরে ঘরদোর সব সাজিয়ে গুছিয়ে পরিপাটি করে রাখতে হবে কাল যে আমার গোপন অভিসার।
আসলে আমি এখন এখানে থাকিনা, শুধুমাত্র এই একটা দিনের জন্যই গ্রামের বাড়ীতে ফিরে আসা। মা বাবা গত হয়েছেন অনেক আগেই কিন্তু ও বাড়ী আমি বুকে জড়িয়ে আগলে রেখেছি, শত প্রলোভনেও বেচিনি কেন জানেন? বছরের এই একটা দিনের জন্য! কাল যে ভ্যালেন্টাইন ডে! ভালোবাসার দিন হ্যাঁ নিয়ম করে প্রতি বছর এই একটা দিন সৌমিলী ফিরে আসে, মরণের পাড় থেকে ফিরে আসে আমাকে একটা লাল গোলাপ দেওয়ার জন্য না ওরা পারেনি আমাদের বিচ্ছেদ ঘটাতে হ্যাঁ ওরা হেরে গেছে আমাদের ভালোবাসার কাছে! শত চেষ্টার পরেও ওরা পরাজিত! পরাজয়ের গ্লানী ওদের রাতের ঘুম উড়িয়ে নিয়ে গেছে কাল আবার ওর দেখা পাব!
ওর শীতল হাতে হাত রেখে ফিরে পাব আমাদের সেই হারিয়ে যাওয়া দিন গুলোকে! ওর পাগল করা হাসি দেখে ওর চোখে চোখ রেখে কাটিয়ে দেব রাত্রির সমস্ত প্রহর তারপর! একরাশ অব্যক্ত যন্ত্রণাকে সঙ্গী করে আবার একটি বছরের দীর্ঘ অপেক্ষা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকিনা কেন?যে কোন মূল্যেই এই একটা দিনের জন্য গ্রামের বাড়িতে আমি ফিরবই ফিরবো। না! আজ আর পৃথিবীর কোন শক্তিই আমাদের আটকাতে পারেনা। এই একটা দিনের পথ চেয়ে বেঁচে আছি, বেঁচে থাকি বছরভর নইলে প্রাণ পাখি তো সেই কবেই সৌমিলীর মৃত্যু সংবাদ শোনার সাথে সাথেই বেরিয়ে গেছে, এই ক্ষয়িষ্ণু ভঙ্গুর দেহটাকে এখনো বয়ে বেড়াচ্ছি বছরের এই একটি দিনের জন্য।