ভালোবাসার গল্প

ভালোবাসার গল্প

– বলছিলাম যে কি খাবেন আজকে?
– যা রান্না কর তাই।
– আসলে কি রান্না করব বুঝতেছি না। এমনিতে তো রান্নাটাও ঠিক করে করতে পারি না।
– আহা কে বলল ঠিক করে রান্না করতে পার না? তোমার রান্না অনেক ভাল হয়।
– আপনি সবসময় বেশি বলেন। এক ডিম ভাজী কদিন খাবেন?
– কেন ডিম ভাজী কি খাবার না? আচ্ছা মাছ আছে না? মাছের ভাজী করতে পারবা?
– আচ্ছা দেখি আপনি উঠে দাঁত ব্রাশ করেন।
– উম।

উর্মীলা শোবার ঘর থেকে রান্নাগঘরে পা বাড়াল। লুকিয়ে বিয়ে করলে যা হয়। লুকিয়ে না পালিয়ে বিয়ে করেছে বললে ঠিক হয়। ছয় মাস আগেও তারা একজন অন্যজনকে চিনত না। মুহুর্তেই সব কিছু পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। ছয় মাস আগের কথা। ঝলমল বিয়ের আয়োজন চলছে। আসিফের বন্ধুর বিয়ে। আসিফ তার বন্ধুর সাথেই যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু সময়ের ভিড়ে আর যাওয়া হয়নি। যথেষ্ট পিছিয়ে গিয়েছে।

আসিফ ভেবে নিয়েছে বিয়ে শেষ কিন্তু বিয়ে বাড়িতে গিয়ে দেখল এখনো বিয়ে সমাপ্ত হয়নি। আসিফকে দেখেই আসিফের বন্ধু আসিফকে আড়ালে নিয়ে যায় একটু। আড়ালে দাঁড়িয়েই কাঁদতে লাগল আসিফের বন্ধু রানা। সে চাঁদনী নামের একটা মেয়েকে ভালবাসে আর তাকে ছাড়া আর কাউকেই বিয়ে করবেনা। আসিফের কপালে চোখ উঠে কারণ এর আগে সে চাঁদনীর কথা কখনো শুনেনি। রানা তার যথেষ্ট কাছের বন্ধু। এখন এই মুহুর্তে আসিফ কি করবে বুঝতে পারছেনা। গোপনীয় ভাবে কথাটা পাত্রীর কানে গেলে পাত্রীও খুশী। আরো জানা যায় পাত্রীর বান্ধবীই ছিল চাঁদনী। সে বিয়ের অনুষ্ঠানে চাঁদনীও ছিল। ভয়ে ভয়ে রানা চাঁদনীকে নিয়ে পালায়।

আসিফ ব্যাবস্থা করে দিয়েছিল। পাত্রী আর আসিফ তাদের দুজনকে এগিয়ে দিয়ে একা দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর তারা কেন কাজী অফিসে যায় আর কেনই বা বিয়ে করে তারা নিজেরাই জানেনা। এখানে আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে পাত্রীর পরিবার রানার সাথে তাকে বিয়ে দিচ্ছিল টাকার লোভে। না না পরিবার বলতে মা বা বাপ চাচারা না। দুঃসম্পর্কের মামারা।উর্মীলা মাছের ভাজী করছে। তাছাড়া ফ্রিজে ফলমূল আছে খাবারের সমস্যা তাদের হয়না। রান্না শেষ করে আসিফকে ডাকতে এল উর্মীলা। আসিফ অবশ্য ফ্রেশ হয়েই আছে। আসিফকে টেবিলে খাবার বেরে দিয়ে উর্মীলা ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার ভয় হচ্চে ভাজী ঠিক করে হল কি না।

একেবারে পুড়িয়ে ফেলেছে লাগছে উর্মীলার কাছে। আসিফ স্বাভাবিক ভাবেই খেয়ে নিল। উর্মীলা একটু হাতে কৈ মাছের টুকরো মুখে নিল। সে নিজেই ভাবতে পারছেনা এরকম বাজে  কেউ রাঁধতে পারে? আর এই খাবার আসিফ প্রতিদিন খায় তবুও কোন ধরনের কথা বলেনা। মন খারাপ করে টেবিলে বসল উর্মীলা। আসিফ হাসছে। বলল ‘ মন খারাপ করার কি আছে? আজকে পারনি কালকে পারবা। যেটুকু হয়েছে এটুকুই অনেক। আমি তো তোমার ইন্টার্ভিউ নিয়ে বিয়ে করিনি। ‘ উর্মীলা জবাবহীন। কি বলবে বুঝতে পারছেনা। অবুঝ আর লজ্জা মিশ্রিত চাহনী দিয়ে তাকাল আসিফের দিকে। উর্মীলা বলল ‘ একটা কথা।

এত বড় বাড়ি আর আমি একা থাকি আপনি যাওয়ার পর আমার ভয়ভয় করে ‘ আসিফ উর্মীলার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল ‘ অফিস শেষ হলেই চলে আসব চিন্তা করনা। আর দুপুরে রান্না করে খেয়ে নিও আর ইচ্ছে না হলে ফ্রিজ থেকে কিছুখেয়ে নিও ‘ উর্মীলা মাথা নাড়াল। আসিফ অফিস যাওয়ার পর উর্মীলার মন উদাস হয়ে যায়। মনে ভয় কাজ করে। যদি মামারা জেনে যায়  তাহলে একটা গণ্ডগোল বাঁধবে। সে বাসার রুমগুলো হেঁটে দেখছে। না সে প্রথমবার দেখছেনা। প্রতিদিনই দেখছে তবুও তার কাছে বাসার প্রতিটা রুম নতুন করে আপন মনে হয়। দক্ষিণ দিকের দেয়ালে একটা ছবি টানানো বড় করে। এর আগে উর্মীলা খেয়াল করেনি। কোন পাঁচ ছয় বছরের বাচ্চার ছবি। উর্মীলা সেই কখন থেকে দেখছে ছবিটা তবুও কেন যেন ছবিটা থেকে চোখ সরছেনা।

না এটা আসিফের ছবি না। আসিফের বাবার ছবি। ছবির নিচে দেয়া ছবি তোলার তারিখ দেখে বুঝতে পারল উর্মীলা। অনেক আগের ছবি নতুন করে বাঁধানো। উর্মীলা কখনো আসিফের কাছে তার পরিবার সম্পর্কে জানতে চায়নি। আসলে আসিফ মানা করে দিয়েছে একমাত্র পরিবার সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারবেনা একটাই আজীবনের জন্য শর্ত। তার অনেক জানতে ইচ্ছে করে কিন্তু কি আর করা। উর্মীলা দুপুরে রান্না করেনি তাছাড়া প্রায়ই করেনা। টিভিতে তার মন বসেনা তবুও সময় কাটানোর জন্য টিভি দেখে। ইচ্ছে হলে কিছু খায় নাহলে খায়না। এর জন্য আসিফ তাকে অনেক সময় বকাঝকা করে। উর্মীলার মাঝেমাঝে ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করে কিন্তু সেই মামাদের ভয়ে আর ঘুরতে যাওয়া হয়না। তার নিজের থেকে আসিফের জন্য বেশি চিন্তা হয়।

হঠাৎ দরজার বেল বাজল। চমকে উঠল উর্মীলা। দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করেই যায় আসিফ। এমন দুপুরবেলা কেউ কোনদিন আসেনা। ভয়ে ভয়ে দরজার কাছে গেল। দরজার কাছে যেতেই তার বুঝতে অসুবিধে হলনা এটা আসিফ। তার শরীরের গন্ধ সে দরজার এপাশে থেকেই বুঝতে পেরেছে। সে দরজা খুলে আরো অবাক। আসিফের হাতে অনেকগুলো শপিং ব্যাগ। হাতের শপিং ব্যাগ দেখেও বুঝা যায় আসিফ আজকে অফিসে যায়নি। উর্মীলা অবাক হয়ে বলল ‘ কি ব্যাপার? হাতে এত শপিং ব্যাগ! অফিসে যাননি কেন? ‘ আসিফ বলল ‘ ইচ্ছে হল তাই। আমার যা ইচ্ছে করে আমি তাই করি। ‘

উর্মীলার হাতে ব্যাগগুলো দিয়ে গোসল করতে গেল আসিফ। উর্মীলা যতই একটা একটা করে ব্যাগ খুলছে আর অবাক হচ্ছে। সবই উর্মীলার জন্য কেনা। উর্মীলার মনে আছে উর্মীলা যখন দশম শ্রেণীতে ছিল তখন তার বাবা চাকরীর বেতনের অর্ধেক টাকা দিয়ে তারজন্য এত কাপড়চোপড় কিনে দিয়েছিল। এরপরে আর কেউ ভালবেসে কিনেই দেয়নি। নিজের অজান্তে চোখ দিয়ে পানি ঝড়ছে। এই ছেলেটা কেন এত ভাল? কেন তাকে এত ভালবাসে? খুব ভাল করে তো চিনতনা। এসব ঘুরপাক খাচ্ছে উর্মীলার মনে। গোসল শেষে আসিফ উর্মীলাকে একরকম জোর করেই বলে আজকে উর্মীলাকে রেডি হয়ে আসিফের সাথে ঘুরতে যেতেই হবে। কোন অজুহাত সে শুনতে চায়না।

উর্মীলারও খুব ইচ্ছে করছে কিন্তু সেই ভয় করছে। কিন্তু আজকেও যদি উর্মীলা এই কথা বলে তাহলে আসিফ অনেক রাগ করবে ভাল করেই বুঝতে পারছে। উর্মীলা বলল ‘ আচ্ছা আমি কি পরব? ‘ আসিফ বলল ‘ শাড়ি? ‘ উর্মীলা প্রথমে কিছু বললনা তারপর আবার তাড়াহুড়ো করে বলল ‘ না না শাড়ি-টাড়ি পরে পরেও ঘুরা যাবে আজকে বোরকা পরি। ‘ আসিফ হাসল। আসিফ ভাল করেই জানে কেন উর্মীলা বোরকা পরতে চাইল। দুজনে ঘুরতে বের হয়েছে প্রথবারের মত। রিকশা চলছে। আসিফ যতটা না উর্মীলার হাত ধরে আছে উর্মীলা আর শক্ত করে ধরে আছে ভয়ে। বের হতে না হতেই উর্মীলা বারবার বাসায় ফিরে আসার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগল। আসিফও তাকে বাসায় নিয়ে এল। সে জানে জোর করে কাউকে নিয়ে ঘুরা যায়না।

সকালের সূর্য অনেক আগেই উঠে গিয়েছে। উর্মীলার অনেকক্ষণ পর খোঁজ হল। সে আজকে একটু বেশিই ঘুমিয়ে ফেলেছে। কোনরকম চোখের ঘুম সরিয়ে বিছানায় তাকাতেই সে চমকে উঠল। আসিফ পাশে নেই! এসময় আসিফ ঘুমায়। ভাল করে তাকিয়ে দেখল পাশে চা রাখা। গরম চা থেকে ধোঁয়া উড়ছে। উর্মীলা বুঝতে পারছে কে এসব করেছে। দৌড়িয়ে রান্নাঘরে গেল। গিয়ে সে ঠিকই দেখল আসিফ রান্না করছে। উর্মীলা বুঝতে পারছে সে বেশি ঘুম ছিল বলেই আর আসিফ তাকে জাগায়নি। সে স্তব্ধ প্রায়।

লজ্জালজ্জা ব্যাপার ছাড়িয়ে উর্মীলা আসিফকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল। চোখ দিয়ে টিপটাপ দুয়েক ফোটা পানিও পরছে। আসিফ হেসে বলল ‘ কি ঘুম ভাঙল? ‘ উর্মীলা চুপ করে আছে কিছু বলছেনা। আসিফ আবারো বলল ‘ কি হল ছাড়বানা নাকি? ‘ উর্মীলা সেভাবেই পিছন থেকে জড়িয়ে আছে মুখে কোন কথা নেই। আসিফ বলল ‘ দেখ ডিম ভাজী ছাড়া আর কিছুই পারিনা জান তাই ডিম ভাজীই খেতে হবে। ‘ উর্মীলা তখনও নিশ্চুপ। আসিফ এবার বলল ‘ তা যদি এতই জড়িয়ে রাখার শখ তাহলে সামনে থেকেই জড়িয়ে ধরনা? ‘ উর্মীলা এবার লজ্জাস্বরে বলল ‘ এহ আমার লজ্জা লাগে তো ‘ ||

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত