অনুভূতিরা অফলাইনে

অনুভূতিরা অফলাইনে

কালবৈশাখী ঝড়ের মতো কল্পকে তার মা ভীষণ রকম বকছে। সে সাথে বজ্রপাতের মতো দুয়েক গা পিঠে ও পড়ছে। সে বিকেল সন্ধ্যা পেরিয়ে এখন রাত, কল্প তার রুমে কাঁদছে। যাকে বলে অঝোরে কাঁদা। কিন্তু তাতে কারো কিছু আসে যায় না। রুমটি বাহির থেকে বন্ধ। ১৬’তে পা দিবে এমন মেয়ের ব্যাগে যদি তার মা লাভ লেটার পায়, তবে এমন করাইতো স্বাভাবিক। পরনে এখনো স্কুল ড্রেস।

কেঁদে কেঁদে বালিশ ভিজিয়ে ফেলেছে। আর কয়েক ঘন্টা পর তার জন্মদিন। সে ঠিক করেছিলো কাল স্কুল পালিয়ে সারাদিন কাব্যের সাথে ঘুরবে। প্রথম ভালবাসার হাত ছুঁবে। আশাটা অপূর্ণ থাকলো। মায়ের উপর ভীষণ রাগ তার। কাউকে ভালবাসা কি খারাপ? লাভ লেটার দেওয়া বা নেওয়া কি অপরাধ? টিন এইজের একটা মেয়ের মাথায় এই যুক্তিই বা কেন কাজ করবে ? রাত ১২:০৭ বারান্দার দরজায় মৃদু আঘাত। কল্প আধবোজা নয়নে তাকালো। কিছুটা ভয়, কিছুটা বিস্ময়, কিছুটা অনিচ্ছা নিয়ে দরজা খুলল! দরজার ওপাশে খোলা বারান্দায় দাড়িয়ে আছে কাব্য। অজানা এক ভয়ে নাকি খুশীর শিহরণে দৌড়ে এলো বারান্দায়।

– তিনতলায় উঠলে কেমনে? এত রাতে কেন এসেছো? জানো বাসায় চিঠিটা পেয়ে গেছে?
– সুসস।।।। কল্প চুপ হয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো।।।
– এত প্রশ্ন করছো কেন? এসেছি এটাই তো বড় কথা। জানতো আজ তোমার জন্মদিন?

বিস্ময় তার চোখে মুখে, এত দুঃখে সে সবই ভুলে গেছে। কাব্য আলতো করে হাত ছুঁলো কল্পর। আবেগে আপ্লুত হয়ে চোখ বুজে ফেলল সে। মনে মনে স্রষ্টাকে শত কোটি ধন্যবাদ জানাল সে, কাব্য তার মনের ভাষা বুঝতে পেরেছে বলে। কাব্যের মতো চমৎকার একজনকে পেয়েছে বলে।। চোখ বুজে আছে সে, অনুভব করলো তার শুকিয়ে আসা অশ্রু কণাগুলো এক হাতে মুছে দিচ্ছে কাব্য। হাতটা তার ঠোঁটের উপর এসে থামল। কল্পের চোখ খুলার সাহস হচ্ছে না। বুক আর ওষ্ঠদ্বয় থরথর কাঁপছে।

– এই মেয়ে চোখ খুলো, আমাকে দেখো।।

না ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালো কল্প। কাব্য হাসলো। চোখ বুজে থাকলেও কল্প বুঝতে পারছে কাব্যের মাথাটি আস্তে আস্তে তার দিকে ঝুকে পড়ছে। কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো সে। এবার কল্প চোখ খুলল। এক জোড়া মায়াময় চোখ তারদিকে  তাকিয়ে আছে।।

– তোমার জন্য কবিতা লিখেছি, শুনবে? হাসলো সে, মাথা ঝাকালো, শুনবো। ছোট একটা পৃষ্টা বের করল কাব্য পকেট হতে— “তোমার চোখে আছে এক মায়া যেন কালো কাজলে রাঙিয়েছে এক সুন্দরীতমা,, চশমা পড়া, সিল্কি চুলে হাসিতে বেলুন ছাড়া হয়েছে সুমধুর,, প্রান্ত থেকে প্রান্ত ভরে গেছে ফুলে তারই এক বিন্দুতে আছো পাপড়ির আড়ালে।।

মেয়ে তুমি শুনছো? তুমি বাগানের মধ্যে সদ্য প্রস্ফুটিত তাজা গোলাপ দেখার অনুভূতি, তুমি আলোকিত চাঁদ একটি নিটোল স্বপ্নের নীলাভ ভাজ।। কখনো মনে হয়, তুমি চির সজীব কাব্যের কবিতা, চির ঝংকৃত সুরের কিছু ছন্দের দ্যোতনা।। তুমি শিল্পীর আঁকা একটি জীবন্ত ছবি তোমার চোখে লিখা আছে আমারই নাম আমি তোমার কাব্যের কবি।। এতসব ভাবনার মাঝে ভাবনা সাজাই কাব্যের পন্ক্তিতে ভেলা ভাসাই সবই এসেছে এক বিশেষ দিনে, তুমি জানো ? এ ছিলো আমার থেকে তোমারই জন্মদিনে”।।।।

কাব্য খেয়াল করেনি, যখন সে কবিতা পড়ছিল কল্পর চোখ বেয়ে আবার শ্রাবণের ধারার মত অশ্রু ঝরছিলো। তবে এবারেরটা উৎস ছিল এক অপ্রকাশিত সুখ। কাব্য কবিতা পড়া শেষ করে তাকালো তার দিকে, মেয়েটা ছুটে এসে ঠোঁট জোড়া চিপসে দিলো তার ঠোঁট দুটোয়।। কাব্য তার চোখে মুখে অশ্রুর সিক্ততা অনুভব করছে। হুমম ভালবাসার নোনা জল। মেয়েটাকে ভীষণ ভালবাসে সে, কখনো তাকে ছাড়বে না, ছাড়বে না সে। যেন নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞা করছে।।। কল্প এতক্ষণ ২০’বছর পেছনের অতীত ভাবছিল। কারণ তার মেয়েটা সবে ১৬’তে পা দিয়েছে, আর একটু আগে তার মেয়ে ছন্দ’র ব্যাগ থেকে লাভ লেটার পেল। ছন্দ থরথর কাঁপছে। এই বুঝি তার মা তাকে কি না কি করে।। তবে অবাক করার বিষয় হলো তার মা’র মুখটি অস্বাভাবিক শান্ত রূপ ধারণ করে আছে।

– রুমে যাও, গলাটা কেঁপে উঠলো কল্পর। ছন্দ ভুল দেখলো কি না বলতে পারছে না, যখন এটা বলছিল তখন মায়ের চোখ ছলছল করছিলো। কল্প অনেকদিন পর কাব্যের দেওয়া পুরানো ডায়েরি খুলল। ডায়েরি থেকে একটা ছবি আর কিছু কাগজের টুকরো বেরুলো—,,,

“””তোমার কি সেদিনের কথা মনে আছে, যেদিন তুমি আমাকে ক্লাস থেকে বের করে বলেছিলে তুমি আমাকে এই ধরনের চিরকুট দাও কেন? আমাকে যখন তখন চোখ টিপ মার কেন? তোমাকে না বলেছি আমার আর এক জনের সাথে রিলেশন আছে, আর কখনো এগুলি করবেনা। উত্তরে আমি বলেছিলাম, আমি তোমার সাথে রিলেশন করতে যাব কেন, আমি ওই ধরনের চিরকুট আমার সব বন্ধুদের কাছেই পাঠাই। আমি ওইদিন মিথ্যে বলেছিলাম। ওইদিন আমার আত্মসম্মানের কাছে আমার ভাললাগা হেরে গিয়েছিল।

তুমি কি জান, আসলে তোমাকে আমি ভীষণ রকম পছন্দ করতাম। জান তোমাকে দেখার পর থেকে আমার রোজ ক্লাসে যাওয়ার উদ্দেশ্য হয়ে দাড়িয়েছিল। তোমাকে বারবার অতৃপ্ত চোখে দেখা। ক্লাসে যতবার দাড়িয়ে ছিলাম স্যারদের কাছ থেকে প্রবলেম সলভ করার নাম করে অথবা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়ার আড়ালে, শুধু তোমাকে একটু বেশি সময় ধরে দেখব বলে। তোমার কী মনে আছে, সবাই ক্লাসের মডেল টেস্ট না দিয়ে চলে যেত। কিন্তু তুমি দিতে বলে তোমাকে সঙ্গ দিতে আমি থাকতাম। উত্তর না লিখে আড় চোখে তোমাকে দেখতাম। কোন প্রশ্নের উত্তর না পারলে তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করতে, খুব চেষ্টা করতাম উত্তর দিতে। কিন্তু আমি সে সময়ের জন্য তোমার মাঝে আমার জানা উত্তর গুলো হারিয়ে ফেলতাম। তুমি কী জান? ছুটির পরে ও এক ঘণ্টা দেরি করে বাড়ি যেতাম, পড়াশুনায় সিরিয়াস ছিলাম বলে নয়, তোমাকে অন্তত এক ঘন্টা বেশি দেখব বলে।

বাসায় জিজ্ঞেস করলে বলতাম ইমপরটেন্ট ক্লাস ছিল। কিন্তু তুমিই ছিলে আমার সে ইমপরটেন্ট ক্লাস। তোমাকে তো বলেছি, তোমাদের বাড়ির গলিতে একবার কাজে গিয়েছিলাম। আসলে কোন কাজে নয়, শুধু তোমাকে দেখব বলে, তোমার অস্তিত্বকে অনুভব করবো বলে, আরো কাছ থেকে, আরো গভীর ভাবে। তোমার কি মনে আছে, সেদিন মালা কেনার কথা। মালা পড়ানোর ছলনায় প্রাণভরে তোমার চুলের ঘ্রাণ নিয়েছিলাম। ইচ্ছে করেছিল তোমার স্বর্নলতিকার মত কেশম্বরি গুলো ছুঁয়ে থাকতে। কিন্তু আমার সে সাহস বা অধিকার কোনটিই যে ছিলনা। তুমি কী কখনো বুঝতে পেরেছিলে আমার সে অনুভূতির কথা”””??

“””আজকে আর না পারলেও আমার কোন দুঃখ থাকবেনা। আজ আমি আমার আত্তসম্মানের উপরে আমার ভাল লাগাকে মূল্য দিয়েছি। আমার অনুভূতি গুলো প্রকাশ করেছি। কষ্ট হলেও এই ভেবে সান্তনা পাব যে “love is all about taking chances, Even if it hurts, I have hurted myself by my own fault. But i never ever hurt u and i will not. কখনো ভালবাসার অভাববোধ করলে আমাকে স্মরন করো। আমার অতৃপ্ত ভালবাসা তোমাকে খুজে ফিরবে। আদর করে স্পর্শ করলেই জীবন্ত হয়ে তোমাকে বলবে,, আজো তোমায় ভালবাসি সে আগের মতই”””।।।

“””প্রিয় কল্প,
কাল তোমার জন্মদিন। তোমাকে কতটা ভালোবাসি তা ইনিয়ে বিনিয়ে লিখা আমার দ্বারা সম্ভব না। তাই লিখছি না। তবে একটা কবিতা লিখেছি। কাল তোমায় শোনাবো, তুমি শুনবে তো? জন্মদিনের উপহার হিসেবে আমার ডায়েরিটা তোমায় দিব, কি নিবে তো??

ইতি,
তোমার কাব্য”””।।।
আর কিছু লেখা নেই ডায়েরিতে। সে সাথে কাব্যও আজ বেঁচে নেই। সেই রাতে তিনতলা থেকে তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে পা ফসকে যায় কাব্যের। প্রচুর ব্লিডিং হওয়ায় হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষনা করে। সে মরে গেলেও তার স্মৃতির পৃষ্টাগুলো আজো মনে সাড়া ফেলে কল্পের।

কল্প আজ তার মেয়ের মাঝে ২০’বছর পুরানো কল্পকে যেন দেখছে। ছন্দ’র চিঠিটা টেবিলে রেখে এসেছে।
বাইরে অনেক বৃষ্টি। ইচ্ছে করছে বৃষ্টি পানি দিয়ে চোখের জল গুলো মুছে দিতে। কিন্তু ভয় হয়, যদি তোমার স্মৃতি গুলো বৃষ্টির সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। থাকনা আমার চোখের জলের সাথেই। তারপর ও আজ কেন যেন সেই বৃষ্টিতে ভিজতে খুব ইচ্ছা করছে। হয়তো চোখের পানিটা লুকানো যাবে বলে। এই ভর সন্ধ্যাবেলা তুমুল বৃষ্টির মধ্যে আকাশপানে দু’হাত প্রসার করে দাঁড়িয়ে আছে কল্প।

বন্ধ চোখে অবাধ্য অশ্রু আর বৃষ্টির কণাগুলো মিলেমিশে একাকার। যেন কত নিবিড় সম্পর্ক। বৃষ্টির ঘ্রাণের সাথে কাব্যের অস্তিত্ব অনুভব করছে কল্প। তাই হয়তো অস্ফুটস্বরে বের হয়ে এল–“”তুমি চির সজীব আমার কল্পের কবিতা, চির ঝংকৃত সুরের কিছু ছন্দের দ্যোতনা।। তুমি আমার কল্পে আঁকা অম্লান জীবন্ত ছবি, আমার অস্তিত্বে লিখা রবে তোমারই নাম তুমি যে কল্পর অনুভূতির কবি””।।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত