খুব ভালোবাসি তুমায়

খুব ভালোবাসি তুমায়

— আমাকে দোষারোপ করার কোনো রাইট নেই তোমার। (তাসফিয়া)
—- আমি তো তোমাকে দোষারোপ করিনি।(আমি)
—- বাট তোমার পরিবার তো আমাকে দোষী মনে করে।
—- তারা যদি তোমার দোষ দেখে তবে তো দোষ দেবেই।
—- কি বলতে চাইছো তুমি?
—- যা বলার প্রয়োজন আমার।
—- তোমার সকল কথাই অপ্রয়োজনীয়।
—- হয়তো হ্যাঁ নয়তো না।

—- তুমি খুব ভালো করেই জানতে, এ বিয়েতে আমার মত ছিলো না।
—- সরি,জানতাম না। তবে জেনেছি!
—- ওই একই কথা।
—- না,এক কথা নয়। তুমি বিয়ের আগে এ কথা বলো নি কেনো?
—- বললে বাবা রাগ করতো, তাই চেপে গেছি।
—- ওহ্,তাই বুঝি বিয়ের পর সব রাগ আমার উপর দিয়ে ঝাড়তেছো? তাই না তাসফিয়া?
—- অনেকটা সেরকমই হয়তো।
—- হা হা হা!
—- হাসো কেনো?
—- তবুও তুমি নির্দোষ তাই!
—- মানে?
—- মানে নির্দোষ!

কথা কাটাকাটি করতে ভালো লাগে না। বারান্দায় চলে এলাম। বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। হালকা বাতাসের ঝটকায় বৃষ্টির ছাঁট বারান্দায় এসে পড়ছে। যেনো মনে হচ্ছে, কুচি কুচি তুষার কনা প্রবল আনন্দে আছড়ে পড়ছে আমার মুখে। শিহরিত করছে আমাকে ওই তুষার কনারা। বাইরে তাকালাম।

পাশের বাড়ির জানালা দিয়ে আলো এসে লেপ্টে গেছে নারকেল গাছের ভেজা পাতাতে। আর মনে হচ্ছে, হালকা বাতাসে কিছু বাতি দুলছে নারকেলের পাতার শিরে শিরে। অদ্ভুত এক অবয়ব প্রকৃতির, যা অবচেতন মনকেও নিয়ন্ত্রনে নিয়ে নেয়। “খোকা” বলে ডাকতে ডাকতেই মা চায়ের কাপ নিয়ে বারান্দায় এলো। আমি মায়ের হাত হতে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে হালকা চুমু দিচ্ছি, আর মা আলতো করে আমার পিঠে হাত রাখলেন। আমি কেঁপে উঠলাম! মায়ের এ স্পর্শ আমার চিরচেনা! এ স্পর্শে মিশে আছে পবিত্রতা! এ স্পর্শে লুকিয়ে আছে সাহস! এ স্পর্শ খুঁজে বেড়ায় ভরসা আর পূর্ণতা। মা চাচ্ছে, আবার যেনো পূর্ণতায় ভরে উঠে সব। য়েরা কিভাবে যেনো সন্তানদের লুকানো ব্যাথাটাও ধরে ফেলেন। বুঝে আসেনা! আমি সবসময় আমার মায়ের এই স্পর্শের মূল্য দিয়ে এসেছি। এবার পারবো কিনা জানিনা! বুকের ভেতর একদলা কষ্ট, কষ্টটা বারবার গলায় এসে আটকে যাচ্ছে। পেঁচিয়ে ধরে শ্বাসনালী আমার।

মাঝে মাঝে মনে হয় ছিঁড়ে ফেলি এ শ্বাসনালী। কিন্ত না, কষ্টটাকেই ফেলে দেই। বারকয়েক গলা খাঁকারি দিয়ে একদলা থু থু বারান্দার গ্রীলের ফাঁক দিয়ে নিচে ফেললাম। বেরিয়ে গেছে কষ্ট! একদলা কষ্ট, নীল কষ্ট। মা আমার হাত থেকে চায়ের খালি কাপটা নিয়ে নিলেন। পিঠ হতে হাত সরিয়ে নিলেন। মায়ের ঠোঁটের কোনে ঈষৎ হাসি। যে হাসি বোঝাতে চাইছে, “পারবে,আমার খোকা পারবে, কেননা খোকা হারতে শিখেনি।” মা চলে যাচ্ছে, আমি তাকিয়ে আছি মায়ের প্রস্থানের দিকে। ভরসা আর পূর্ণতার অপেক্ষায় অপেক্ষমাণ এক পবিত্র নারী, মনের অজান্তেই মুখ হতে বেরিয়ে গেলো, “মা”!

রাতে বিছানায় শুয়ে আছি, তাসফিয়া ঘুমিয়ে গেছে। আমার আবার একটু আধটু সিগারেট খাবার শখ জাগে রাতে। উঠে পড়লাম বিছানা হতে। ব্যালকনিতে দাড়ালাম, সিগারেট ধরালাম- আহ্ শান্তি। পৃথিবীতে সবাই হয়তো বেঈমানী করবে। কিন্ত এ সিগারেট করবে না! কেননা আপনি তাকে যতবার কিস করবেন, ঠিক ততবারই সে একটা দাগ রেখে যাবে ফুসফুসে। আমার মনে হয়, প্রিয়ার লিপের চেয়েও সিগারেটের ফিল্টার অনেক টেস্টি। আর একসময় স্মরন করিয়ে দেবে, এককালের পোড়া সিগারেট আমি, যে কিনা আজ তোমার বুকের ভেতরকার ব্যাথার মতো সুখের স্রষ্টা! সিগারেট শেষ করেই রুমে এসে শুলাম। বাতিটা অফ করতেই তাসফিয়া কথা বলে উঠলো-

—- অসহ্য! (তাসফিয়া)
—- কি? (আমি)
—- আবার বলে কি?
—- মানে?
—- বলেছি না স্মোক করে রুমে ঢুকবে না?
—- ওহ্ সরি।
—- যাও,ব্রাশ করে আসো।
—- ওকে,
—- আর শুনো।
—- হুম বলো,
—- অতো ঢং করে কথা বলবে না আমার সাথে।
—- আচ্ছা!
—- আর তুমি সোফাতে ঘুমাবে। আমার আনইজি লাগে তোমার সাথে ঘুমাতে।
—- ওকে,
—- হুম, এবার যাও।
—- হুম।

বাথরুম হতে ফ্রেশ হয়ে রুমে ঢুকলাম। তাসফিয়া ঘুমিয়ে গেছে। পাখার বাতাসে কপালের উপরের চুলগুলো ঠিক বৃষ্টিস্নাত নারকেল গাছের চিরল পাতার মতই সরসর করছে। আমি অবাক হয়ে দেখছি তাকে। জাস্ট অবাক মুগ্ধ আমি! খুব ইচ্ছে করছে তার চুলগুলোতে হাত বুলাই। ঠিক চিরুনির মতো করে, আঙ্গুল চালাবো তার চুলে। কখনো হয়তো থমকে যাবে আঙ্গুল, অবচেতন মনের ভুলে। আচ্ছা? আমি কি দুর্বল হয়ে পড়ছি তাসফিয়ার উপর? নাহ্, তার উপর দুর্বল হওয়া যাবে না। সে মরিচীকা! মরিচীকাতে মায়া জন্মাতে নেই। কষ্ট জন্মাবে মনে তাহলে। আমি তার মায়ায় জড়াবো না। জড়াতে চাই ও না।

ওই মায়া মায়া নয়, ওই মায়াতে অলীকতা! ওরে মায়া, মায়া রে……! তুই আসলে কি গো আমি কার সাথে শুই, কার সাথে ঘুমাই? পুরোনো ব্যাথার কাছে ফিরে আসি, বারবার ফিরে যাই। মুক্তি চেয়েছো তুমি আর- মুক্ত করেছো আমায়। সেই আমি জানিনা আজও, আমার মুক্তি কোথায়? শূন্যতার শেওলা ভেঁজা স্মৃতির দেয়াল চারপাশে- প্রতিটি মুহূর্তে পাই আমি, যাবজ্জীবন কারাদন্ডের স্বাদ! নাহ্,আমি কারাদন্ড চাই নাহ্, চাই নাহ্! বুকশেলফের দিকে এগিয়ে যাই।তার পাশের ড্রয়ারটা হাতড়ে বেড়াই।বের করি গোটা কয়েক ঘুমের ট্যাবলেট। ঢকঢক শব্দ হয় রুম জুড়ে। পিনপিন নীরবতার বুক ছেঁদ করে বেরিয়ে আসে “আহ” নামক প্রশান্তির শব্দ।নিজেকে এলিয়ে দেই সোফার উপর।অবসন্নতায় নুইয়ে আসে শরীর।

চোখের পাতারা ভারী হয়ে আসে। রাজ্যের সকল ভার চাপে আমার চোখের পাতায়। ধীরে ধীরে বিলীন হয় রুম চাপা মৃদু আলো।আমি বুঝতে পারি, বিষন্ন নগরী হতে ধেয়ে আসছে আসন্ন ঘুম। ঘুম! একটু ঘুম!! আহ্ শান্তি!!! মায়ের ডাকে ঘুম হতে উঠলাম। আরেহ্, নয়টা বাজে?!আমার অফিস?! ওহ্ নো ধড়ফড় করে উঠেই বাথরুমে দৌড়। গোসল শেষে পোষাক পরে ডাইনিংয়ে বসলাম। আমি আর মা মুখোমুখি। কিন্ত তাসফিয়া কই? মা কে কথাটা জিজ্ঞেস করার আগেই মা বলে উঠলেন-

—- বউ মা তাদের বাসায় গিয়েছে।(মা)
—- কখন? (আমি)
—- এই তো,ঘন্টাখানেক আগে।
—- কিছু বলে গেছে তোমাকে?
—- হুম,
—- কি বললো?
—- তুই যেনো বিকেলে একবার তাদের বাসায় যাস।
—- আচ্ছা।
—- আর শোন,
—- বলো
—- বউ মা কে উল্টাপাল্টা কিছু বলবি না।
—- ওকে,
—- এবার খেয়ে অফিসে যা,এতো বেলা অবধি কেউ ঘুমায়?
—- সরি মা,
—- নো সরি কুম্ভকর্ণ।
—- হি হি হি…

আমি এখন বসে আছি ধানমন্ডির এক অভিজাত বাসার ড্রয়িং রুমে। মনে হচ্ছে এটা আমার শ্বশুর বাড়ি। হা হা হা হ্যাঁ, অফিস শেষ করেই আমি তাসফিয়াদের বাসায় আসলাম। তাসফিয়ার বাবা আমার সামনে বসা,এই লোক আসলে ভদ্রলোক, শ্বশুর নাহ্।যদি শ্বশুর হতো,তবে তো কথা বলতো।চুপ করে থাকতো না। আমার কিন্ত ব্যাপারটা ভালো লাগছে না। আগে তো কখনো ন হয়নি। অবশ্য বিয়ের পর মাত্র দুবার এ বাড়িতে এসেছি আমি।এবার সহ তিনবার।আমি গলার খাঁকারি দিলাম, উদ্দেশ্য আমার বড়লোক গম্ভীর শ্বশুর ফাদারের দৃষ্টি আকর্ষন করা।

—- এহেম এহেম(আমি)
—- পানি খাবে? (শ্বশুর ফাদার)
—- না,জ্বী… জ্বী…!
—- সামনেই আছে, খেয়ে নাও।
—- জ্বী,
—- কি জ্বী জ্বী করছো?
—- সরি,
—- সরি কেনো?
—- না মানে…
—- ইট’স ওকে। তোমাকে কিছু কথা বলার আছে আমার।
—- জ্বী বলুন।
—- তুমি তো জানো, তাসফিয়ার মা নেই।

—- জ্বী
—- আমার মেয়েকি কি তোমার পছন্দ নয়?
—- জ্বী বাবা,অনেক পছন্দ।
—- আমার মেয়ের ব্যাবহার কি খুব খারাপ?
—- না বাবা।
—- আমার মেয়ে কি তোমাদের পরিবারের লোকদের সম্মান করে না?
—- করে তো বাবা।
—- তাহলে আমার মেয়ের এতো কষ্ট কিসের?
—- তা তো জানিনা বাবা!
—- তা জানবে কি করে? তুমি নাকি অনেক রাতে বাসায় ফিরো?
—- না তো বাবা!
—- বেডরুমে সিগারেট খাও?

—- না বাবা,
—- সোফাতে ঘুমাও,আর তাসফিয়াকে নাকি তোমার অসহ্য লাগে?
—- না তো বাবা!
—- তাহলে হ্যাঁ কোনটা?
—- হ্যাঁ হলো আমি এসবের কিছুই করিনা। তবে তাকে আমি ভালোবাসি, অনেক অনেক অনেক ভালোবাসি।
—- এসব ভালোবাসার নমুনা নয়, আর আমার মেয়ে মিথ্যে বলে নাহ্।
—- বাবা!
—- আমি কিছু শুনবো না, শুনতে চাইও না। তুমি আসতে পারো।
—- আমি কি তাসফিয়ার সাথে একবার দেখা করতে পারি?
—- না।
—- কিন্ত বাবা…
—- কোনো কিন্ত নয়, যাও এখন।

—- ওকে বাবা, আসসালামু আলাইকুম।
—- ওয়ালাইকুম আসসালাম। বাসায় ঢুকতে না ঢুকতেই মা বলে উঠলো-
—- কি রে খোকা?বউ মা আসে নি?
—- না মা, ও আজ থাকবে সেখানে।
—- তুই ও তো আজ থেকে যেতে পারতি তাহলে।
—- মা কখনো তোমায় ছেড়ে একা কোথাও থেকেছি?
—- ধুর পাগল, যখন আমি মরে যাবো,তখন কি করবি?
—- বাজে বকবে না একদম!তোমার সাথে আমিও মরে যাবো।
—- কি যে বলিস না তুই, যাহ্,ফ্রেশ হয়ে নে।

মা চলে গেলেন, মায়ের শেষের কথাটা বলার সময় মায়ের কন্ঠটা কেমন জানি শোনাচ্ছিলো। অনেকটা কাঁপা কাঁপা! মা ভেতরে ভেতরে কাঁদছে। আমি তো সবই বুঝি, এই মায়েরই তো সন্তান আমি।বাট সবটাই নিয়তি। ভাগ্যের লিখন কি করে খন্ডাই?আমি আর দাড়ালাম না, রুমের দিকে চলে এলাম। নিজেকে সোফায় এলিয়ে দিলাম। চোখ বন্ধ করে বসে আছি সোফাতে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে তাসফিয়ার মুখ। এই স্বচ্ছ,এই ঝাপসা। লুকোচুরি এক অবকায়া! মনের মাটিতে দীর্ঘ মায়াময় ছায়ামূর্তি নিরবে চক্ষু তুলে তাকায়!দীর্ঘ হতে দীর্ঘশ্বাসে তপ্ত হয় হৃদয়- খোঁজে আকাশের ওপারে আকাশ,বাতাসে প্রিয় গন্ধ, খোঁজে স্পর্শ, শিহরণ। নিবিড়মেঘের দল খোঁজে কোলাহল। খুঁজে পায় শুন্যতা, পাণ্ডুর, বিবর্ণতা ।

হঠাৎ খামচে ধরে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে হৃদয় আমার!মায়াবি স্বপ্নের আঘাত প্রতিক্ষন। নিঝুম রাত্রির নিগুড় নীরবতা আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। ভীষন ভীষন একা লাগছে আমার।একবার কি কল করবো তাকে? ফোনটা হাতে নিতে গিয়েও থমকে যাই। বারবার তাসফিয়া নামটা ক্লিক করি করি করেও করা হয় না। কিসের যেনো এক দূর্বোধ্য বাঁধা। বুঝে আসে নাহ্। একসময় এরকম করতে করতেই কল করে বসি, ফোনটা কানের সাথে চেপে ধরে রাখি। রিং এর সাথে আমার হার্টের বিট পরস্পর সমানুপাতিক। একসময় কলটা রিসিভ হলো।

—- হ্যালো (তাসফিয়া)
—- কেমন আছো? (আমি)
—- বেঁচে আছি।
—- ডিনার?
—- না
—- শরীর খারাপ করবে তো।

—- তাতে তোমার কি?
—- এভাবে কেনো বলছো?
—- কিভাবে শুনতে চাও?
—- আচ্ছা,একটা কথা বলবো?
—- দশটা বলো,বাঁধা তো দিচ্ছিনা।
—- এতগুলো মিথ্যে কেনো বললে বাবা কে?
—- ইচ্ছে হয়েছে,তাই বলেছি।
—- বাবা আমাকে কি ভাববে?
—- বাবার যা ইচ্ছে।

—- তাসফিয়া!
—- বলো
—- আমি কি একবার তোমার সাথে দেখা করতে পারি?
—- এখন?
—- না,কাল সন্ধ্যায়।
—- ওকে, এই একবারই। ফিউচারে আর নাহ্।
—- আচ্ছা।
—- হুম বাই।
—- ডিনার করে নিও।
—- টা টা
—- লাভিউ!

বলেই ফোনটা কেটে দিলাম। বুকের ভেতর ঢোল পেটাচ্ছে যেনো কেউ।বাপ রে! ফোনটা রেখে শুয়ে পড়লাম। মনের ভেতর রাজ্যের সব জল্পনা! আমার কল্পনার ঘাসে কিবা জল্পনার ক্যানভাসে সবটাতেই সে। রাতের মায়া বদলে গেছে,বদলে দিয়েছে মন পরিবেশ। ভীষণ চেনা রাত্রিগুলুও মাঝে মাঝে ভীষণ অপরিচিত লাগে।অন্ধকারে পেঁচার চিত্কারে আমি যেনো কারো কান্না শুনতে পাই।

ভর দূপুরটাকেও মাঝে মাঝে অচেনা লাগে ভীষণ! ঘূঘুর একঘেয়ে ডাকে আমি তোমার বিচ্ছেদের ডাক শুনি।তুমি কি একবারও ভেবে দেখনি-আমার বুক ছাড়া পৃথিবীর সব পুরুষের বুকে এসিডের খনি!একটুখানি মুখ ছোয়ালেই ঝলসে যাবে তুমি! আমি অনুভব করেছিলাম, লাল পলাশের মত আগুনের ফুলকি তোমাকেহাতছানি দিয়েছিল বিচ্ছেদের দিনে। সেদিন তোমাকেও লেগেছিল ভীষণ অপরিচিতা এক! প্রজাপতির মতো বিলাসী ডানা মেলে ,উড়ে চলে গেলে আগুনের ফোয়ারায়, ওফ কি ভীষণ সুন্দর লেগেছিলো সেদিন তোমায়! আমি আজও ভুলতে পারিনা কিছুতেই। সকালে ঘুম হতে উঠে অফিসে গেলাম। এর ভেতর মা কয়েকবার ফোন করেছে। আজ যেনো তাসফিয়া কে নিয়ে আসি।

আমি বলেছি নিয়ে আসবো। কিন্ত তাসফিয়া কি আদৌ ফিরবে? কি যে করি?! যাই হোক, অফিস শেষে তাসফিয়াদের বাসায় চলে গেলাম। তাসফিয়ার বাবা পত্রিকা পড়ছেন বসে বসে। এই ভদ্রলোকের কি আর কোনো কাজ নেই?সারাক্ষণ খালি পত্রিকা আর পত্রিকা!আমি সালাম দিলাম উনাকে। তিনি পত্রিকা হতে মুখ তুলে চাইলেন একবার,সালামের জবাব নিয়েছেন কিনা আল্লাহ্ মালুম।যাক,হয়তো মনে মনে জবাব নিয়েছেন।আমি চলে এলাম তাসফিয়ার রুমে। বাহ্, তাসফিয়া আজ সাজুগুজু করেছে!চেনাই যাচ্ছে না।আমি আজ আবার দ্বিতীয়বারের মতো অবাক মুগ্ধতায় তাকে দেখতে লাগলাম।তাসফিয়া বললো,ছাদে যাও। আমি আসছি।আমি ছাদে চলে এলাম। পড়ন্ত বিকেল, মেঘলা আকাশ। হালকা বাতাস,বেশ ভালোই লাগছে।একটা সিগারেট ধরালে কেমন হয়?বিকেলটা পূর্ণতা পেতো। একটা সিগারেট নিলাম, লাইটারটা জ্বালাবো, এমন সময় তাসফিয়া এসে হাজির।

—- স্মোকিং চলবে না আমাদের বাসায়।(তাসফিয়া)
—- ওহ্ সরি (আমি)
—- হুম বলো, কি বলার ছিলো তোমার?

—- আমাকে তোমার কেনো অসহ্য লাগে?
—- এটা কেমন প্রশ্ন?
—- প্রশ্ন যেমনই হোক,উত্তর চাই।
—- আসলে আমি সবসময় অন্যরকম একটা মানুষ চেয়ে এসেছি।
—- কি রকম?
—- তুমি শুনে কি করবে?
—- সেরকম হতে পারি কিনা দেখবো।
—- তোমার এতো দায়বদ্ধতা কিসের?
—- কেননা আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।

—- বিলিভ করিনা।
—- করতে বলছিও না।
—- আমি কেমন মানুষ চাই জানো?
—- না,বলো।
—- যে আমার মনের কথা বুঝবে।
—- হুম,তারপর?
—- যে কোনো কথা লুকাবে না।
—- হুম, তারপর?
—- যে ভয় পাবে আমাকে হারানোর।
—- হুম,তারপর?

—- যে তার অগ্রাধিকারে আমাকে রাখবে।
—- হুম, তারপর?
—- যে ভরসা রাখবে আমার খারাপ সময়ে।
—- হুম,তারপর?
—- যে ঝগড়া করবে দূরে চলে যাবার জন্য নয়, আমাদের মধ্যকার দূরত্ব কমানোর জন্য।
—- হুম,তারপর?
—- যে ভুল করলে অকপটে তা স্বীকার করে নেবে।
—- হুম,তারপর?
—- যে কখনো অজুহাত খুঁজবে না চলে যাবার।
—- হুম,তারপর?
—- যে আমাকে চিরদিন ভালোবাসার জন্যই ভালোবাসবে, সেরকম কাউকেই চেয়েছি আমি।
—- আর কিছু?

—- আপাতত না।
—- আমি রাজি।
—- মানতে পারছি না।
—- মানতে হবে না, সুযোগ দাও।
—- সুযোগ করে নিতে হয়,দিতে হয় না।
—- তাসফিয়া!
—- বলো,
—- খুব বেশী ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে।
—- কি জানি?!
—- বিলিভ মি,
—- তুমি বাসায় যাবে কখন?
—- এই তো,তুমি যাবে না?
—- নাহ্,আচ্ছা আর কিছু বলবে?
—- নাহ্,বাসায় চলে যেও। পারলে খেয়ে যেও।
—- তাসফিয়া!

নিরুত্তর তাসফিয়া হেঁটে হেঁটে ছাদ হতে নেমে যাচ্ছে। আমার বুকের বামপাশে গড়ে উঠা ভালোবাসা তার দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়নি। কষ্ট! অপরিসীম কষ্ট!! বুকের বামপাশটা মনে হচ্ছে তিক্ত নীল বিষাদের ঝুলি। সে এতোটা অনুভূতিহীন কেনো আমার বেলায়?তুমি একবার এসে দেখে যাও তাসফিয়া, কেমন আছি আমি?যে হংস খোঁজে বন হংসীর প্রতিটি পালকে পালকে ভালোবাসা, সেই হংসটাকে। যেই শশকটার সকল ব্যস্ততা তার সঙ্গিনীকে ঘিরে, সেই শশকটাকে। তুমি দেখে যাও সেই জোনাকটাকে, যে আলো জ্বেলে প্রতীক্ষার প্রহর গুনে জোনাকির তরে, যে চিলটা বাজখাঁই গলায় ডাকে তার প্রিয়াকে।এই সব তুমি এক এক করে দেখে যাও তাসফিয়া।

আমি জানি, কোন কিছুই তোমার কাঁপাবে না বুক। তুমি যদি দেখে থাকো শাহজাহানের প্রেমের সমাধি, আমি নিশ্চিত, তুমি তাজ মহলটাকে বলবে এক গাঁদা পাথরের স্তূপ! তোমার কাছে জোছনা রাতের কোন বিশেষত্ব নেই, রাঁধা ফারহাদ, রোমিওর অনুভূতি তোমার কাছে অর্থহীন। আমি নিশ্চিত, মিশরের পিরামিডে – আমার ভালোবাসার মমী দেখেও তুমি চমকে উঠবে না, কিন্তু তোমার এই নির্লিপ্ততা দেখে চমকে উঠবেবিশাল প্রস্তরস্ফিংস গুলি! তোমার জন্য কি কোন নির্ঘুম রাত অপেক্ষা করে তাসফিয়া? তোমার ও কি প্রতিটা রাত এতো দীর্ঘ হয়? তুমি ও কি কারো জন্য এক বার দেখবো বলে প্রতীক্ষার প্রহর গুনো? খেই হারিয়ে ফেলো কারো কথা ভাবতে গিয়ে? তুমি যদি এতোই অনুভূতিহীন, তবে কেন মূর্তি হলে না? আমি কিনে নিতাম তোমাকে পাঁচ পয়সা দিয়ে।

—- একি? এখনো বাসায় যাওনি? (তাসফিয়া)
—- না (আমি)
—- তাহলে ছাদে ভিজতেছো কেনো? রুমে গিয়ে বসতে পারতে।
—- এম্নি,ভালো লাগতেছে ভিজতে।
—- পাগল হয়ে গেছো তুমি।
—- হুম,পাগল হয়ে গেছি। তোমার জন্য!

—- গলাবাজি বাদ দাও,রুমে যাও।
—- না।
—- তাহলে বাসায় যাও।
—- না।
—- তো করবে টা কি শুনি?
—- দাড়িয়েই থাকবো।
—- পাগলামী করো না, শরীর খারাপ করবে।
—- করুক,প্রবলেম নেই।
—- ওকে,আমিও ভিজবো।এই যে ফেলে দিলাম ছাতা।
—- ভিজো,বৃষ্টিতে ভিজতে আমার খুব ভালো লাগে।
—- হুঁহ্!

—- একটা কথা বলি তাসফিয়া ?
—- বলো।
—- কখনো ঘাসফড়িঙ এর পেছনে ছুটেছো?
—- না।
—- কখনো কদমতলে বৃষ্টিতে ভিজেছো?
—- না।
—- কখনো শীতের ভোরে খালি পায়ে শিশিরস্নাত ঘাসে পা রেখেছো?
—- না।
—- একই চাদরের নিচে দুজনে কখনো কফির মগ হাতে দাড়িয়েছো শীতের বিকেলে?
—- না।
—- হা হা হা !
—- হাসো কেনো?
—- এখনো তো তুমি কিছুই পাওনি জীবনের।

তাসফিয়া,এখনো কারো কাঁধে মাথা রাখার বাকি আছে। এখনো কারো সাথে শিউলি ফুল কুড়ানো হয়নি তোমার। এখনো সমুদ্রপাড়ে দাড়িয়ে কারো হাতে হাত রেখে সূর্যাস্ত দেখা হয়নি তোমার। এখনো পূর্ণ বিশ্বাসে কারো বুকে লুকাও নি মাথা। জীবনে কি পেয়েছো? কিছুই তো পেলে না।

—- কিন্ত….
—- তুমি চাইলে কিন্ত আমি রাজি।
—- আসলেই কি তুমি আমাকে ভালোবাসো?
—- সীমাহীন।
—- ভালোবাসা কেমন?
—- অনুভূতিহীন।
—- পারবে আগলে রাখতে আমায়?
—- হুম,বুকের ভেতরেই।
—- আমি কি একবার তোমার হাত ধরতে পারি?
—- অবশ্যই।

তাসফিয়া আমার হাত ধরে আছে। টুপটাপ বৃষ্টিতে ভিজতেছি আমরা। আমার কেনো যেনো মনে হলো, তাসফিয়া আরো একটু সরে আসলো আমার দিকে। প্রথমে ভাবলাম মনের ভুল,পরে দেখলাম না তো! আমি তাসফিয়াকে জড়িয়ে ধরলাম। তাসফিয়া আমার বুকে মুখ লুকালো। বুকে গরম জলের উত্তাপ টের পাচ্ছি। তাসফিয়া কাঁদছে, খুব করে কাঁদছে।

আকাশও যেনো কান্নাটা বাড়িয়ে দিলো, চিলেকোঠার আড়াল হতে কেউ একজন সরে গেলো। হুম,তাসফিয়ার বাবা। আমি জানি,তিনিও কাঁদছেন। কাঁদুক তাসফিয়া,কাঁদুক তার বাবা,কাঁদুক প্রকৃতি। আমি নাহয় আজ জল ঝরাবো না। সব জল তারা ঝরাক! বাম পকেটে ফোন বেজে উঠলো, ওয়াটারপ্রুফ ফোন,তাই এখনো বাজতেছে। আমি ফোন না ধরেই বুঝতে পারছি, মা ফোন করেছে।আমি শিওর, ফোনটা রিসিভ করলেই মা বলে উঠবে, “আর ভিজতে হবে না,অনেক ভিজেছো।” মা সবই বুঝে যায়, কোথাও যেনো বাজ পড়লো। তাসফিয়া আরো জোরে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি আলতো করে হাসলাম। হয়তো চোখের কোনে জল এসে গিয়েছিলো। ঝরুক না কিছু জল, ঝরুক! আকাশ হতে বৃষ্টির সাথে ঝরে পড়ুক স্রষ্টার অপার করুনা।

আমি ডুবে থাকি আপাতত তাসফিয়ার মাঝে। তার মাঝেই ঘিরে আছে আমার সকল পূর্ণতা। তাহার চেনা মুখ, কন্ঠস্বর, তাহার চুল, চেনা ঘ্রাণ, আমাকে চিরকালের জন্য নেশায় বুঁদ করে রাখলো! কত পাখি আর খুঁজে পেলোনা তার হারিয়ে যাওয়া নীড় কত পথিক পথ হারিয়ে পায় শুধু জিরোবার ছাঁয়া সুনিবিড়, তার পরিসংখ্যান শরতের সুখী আকাশ রাখেনি কখনো। রাখেও না, রাখবেও না।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত