অনেক সেজেগুজে বাসর ঘরে বসে আছি, কিন্তু আমার বরের কোনো খবর নাই। এ ছেলে নির্ঘাত আনরোমান্টিক হবে। যাহোক উনি অবশেষে আসলেন। এসে ঘরে ঢুকেই বলল – “আমি কারো সাথে বিছানা ভাগ করে ঘুমাতে পারব না।” আমি তো আর অবুঝ নই ; না বলা কথাটুকু ঠিকই বুঝে গিয়েছি। বিছানা থেকে নেমে সালাম করে আবারও সেই বিছানাতেই বসেছি। উনি মনে হয় এরকমটা আশা করেন নি। এজন্যই হয়তো ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন “কথা কানে যায় নি??” আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম,
-“কানে গিয়েছে তো, আপনি এক কাজ করুন.. নিচে শুয়ে ঘুমিয়ে পরুন। আমি বিছানা পেতে দিচ্ছি।”
উনি আমার আস্পর্ধা দেখে বিরবির করে কি যেন বললেন, স্পষ্ট শুনতে পাই নি। উনি মনে হয় রেগে আছে খুব। রেগে থাকারই তো কথা। উনার জায়গায় আমি হলে হয়তো বিয়েটাই ভেঙে দিতাম। বিয়ের আগে যদি কোনো মেয়ে তার হবু বরকে বলে যে, “আপনি কি জন্ম থেকেই হাফ কানা?” তাহলে তো রাগ হবেই। ব্যাপারটা খুলেই বলি উনি, উনার বাবা, মা ভাই আর বোন গিয়েছিল আমাকে দেখতে। দেখাদেখির এক পর্যায়ে আমাকে আর উনাকে পাঠানো হল আলাদা করে কথা বলতে।
উফ্! কতক্ষন আর উনি উনি করব.. তারথেকে নামটা বলেই দেই। ওর নাম শুভ্র। যাহোক আলাদা করে কথা বলার সময়ই আমি উনাকে বলেছিলাম, “আপনি কি জন্ম থেকেই হাফ কানা? ” আমার এরকম অদ্ভূত প্রশ্ন করার কিন্তু কারন আছে। মেয়ে দেখতে এসেছে তাও চোখে চশমা পরে! চশমা চোখে না দিলে কি আমাকে দেখা যাবে না নাকি। এজন্যই তো হাফ কানা বললাম। ও আমার প্রশ্ন শুনে গোমরা মুখে বলেছিল, “হুম”। আমি তখনই বুঝেছিলাম এ ছেলে হাফ কানা তো বটেই, সাথে কিছুটা বলদ কিছিমেরও।
আমার কথাবার্তা, চিন্তাভাবনা কিছুটা অদ্ভূত। এজন্য বিয়ের আগে আম্মু বকত আর বলতো, “তোকে বিয়ে দিলে তো বিয়ের পরের দিনই পিছনের দরজা দিয়ে বের করে দিবে শশুরবাড়ির লোকেরা।” আম্মুর এ কথায় আমি বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বলতাম, “তাহলে যে বাসায় পিছনের দরজা নেই, ওরকম বাসায় আমাকে বিয়ে দিয়েন, হিহিহি।” আম্মু তখন রেগে গিয়ে বলত, “তুই আর আমাকে মা বলবি না”। আমি এ কথায় হিহিহি করে হেসে বলতাম, “ওকে আন্টি”। বিছানায় শুয়ে শুয়ে এসবই ভাবছিলাম হঠাৎ-ই রুমের লাইট অফ হয়ে গেল। না, নিজে নিজে হয় নি ;শুভ্রই করেছে। আমি মুচকি হেসে ভাবছি
– “এখন তো আমার পাশেই শুয়ে ঘুমাতে হবে। কতক্ষন আর দাড়িয়ে থাকবে হুহ”।
বেশ খানিকটা সময় কেটে গেছে। কিন্তু শুভ্রর কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছি না! ব্যাপারটা কিঅন্ধকারের মধ্যই বিছানা হাতরে ওকে খুঁজছি, কিন্তু পাচ্ছি না তো! আমার বর গেলো কই! এখনো কি বিছানার পাশে দাড়িয়ে আছে নাকি?! বালিশের নিচ থেকে আমার মোবাইলটা বের করে ফ্ল্যাশলাইট অন করলাম। এমা!! এ ছেলে তো সত্যিই বলদ টাইপ। ফ্লোরেই শুয়ে পরেছে, তাও কিছু না পেতেই।
–এই যে, উঠুন (আমি)
:–.. (কোনো সাড়াশব্দ নেই)
–উঠতে বলেছি তো এবার উনি উঠলেন। পাশে খুলে রাখা চশমাটা হাতে নিয়ে চোখে পরলেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
— তুমি হয়তো ভাবছো আমি কেন নিচে শুয়ে পরলাম কোনো প্রতিবাদ ছাড়াই। আমি মনে করি তুমি এ বাড়িতে ক্ষণিকের অতিথি মাত্র এটুকু শুনেই আচমকা এক ভয়ের স্রোত খেলে গেল আমার শরীরে। একটা শিরশিরে অনুভূতি হলো নিজের ভিতর.. উনি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বলতে লাগলেন,
— আমি জানি তুমি এ বিয়েতে খুশি নও। এজন্যই বিয়ে ভাঙতে ওরকম উদ্ভট প্রশ্ন করেছিলে, তাই না??
আমি উনার কথায় সম্ভিত হারিয়ে ফেললাম। স্বাভাবিক চিন্তাগুলোও এলোমেলো লাগছে। প্রচন্ড অভিমানে নিজের কান্নাটাকেও জোর করে দমিয়ে রাখলাম। কিন্তু উনি এসব কিছুই বুঝলেন না। মৌণতাকে সম্মতির লক্ষণ ভেবে নিলেন।
সেদিন আমরা পাশাপাশি শুয়ে রাত কাটালেও মাঝখানে ছিলো বাহ্যিকভাবে একহাত দূরত্ব আর মনের দিক থেকে কতটা দূরত্ব ছিলো সেটা না হয় নাই বা বললাম আমাদের বিবাহিত জীবনের বেশ কয়েক মাস কেটে গেছে সময়ের সাথে সাথে আমার আর শুভ্রর মানসিক দূরত্বটা কমে গিয়েছে। এতে অবশ্য আমার শাশুরী আর ননদের বিশেষ ভূমিকা আছে। এ দুজন মিলে আমাকে শুভ্রর পছন্দ অপছন্দের তালিম দিয়ে ওর মন জয় করতে সাহায্য করেছে। এতদিনে শুভ্র বুঝে গেছে যে আমি দুষ্টামী মাখা কথা এমনিই বলি, কোনো কুটিল উদ্দেশ্য নিয়ে নয়।
আমার আম্মু আমাকে একদিন বলেছিল যে, স্বামীর সাথে যতই মনোমালিন্য হোক না কেন, পরস্পরের বিছানা যেন আলাদা না হয়। কারন, বিছানা আলাদা হওয়াটাই নাকি সংসার ভাঙার সূত্রপাত ঘটায়। আম্মুর এ কথাটা আমি মেনে চলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। এখন পর্যন্ত শুভ্রর সাথে অনেকবারই ঝগড়া হয়েছে, কিন্তু দিনশেষে দুজন পাশাপাশি বালিশে মাথা ঠেকিয়েই রাত কাটিয়েছি। বিয়ের আগে বাস্তবিক কারো সাথে প্রেম করা হয় নি আমার, তবে কল্পনায় একজন ছিলো। শুভ্রর সাথে তার অনেকটাই মিল আছে, আবার অনেকটা অমিলও আছে।
কিশোরী বয়সে মনের মধ্য পুষে রাখা কাল্পনিক চরিত্রকে যদি কোনো এক ভাবে পরিণত বয়সে নিজের করে পাওয়া যায়, তাহলে মনে হয় তার প্রতি বিশেষ ভাললাগাটা একটু বেশি মাত্রায়ই কাজ করে। আমার ক্ষেত্রেও হয়তো সেটাই হয়েছে। নয়তো একসময়ের অচেনা, অদেখা ছেলেটা কিভাবে আমার সবটুকু দখল করে নিল?! খুব ঘুমকাতুরে হওয়া সত্ত্বেও এখন আমি রাত জাগি শুভ্রর সাথে গল্প করার লোভে। যে আমি খিদা লাগলেই খাওয়া শুরু করে দিতাম কোনো বাছবিচার না করে, সেই আমিই এখন শুভ্রর জন্য বসে থাকি খাবার নিয়ে।
আমি শুভ্রর জন্য না খেয়ে বসে থাকলে মা বকা দিলেও মনে মনে যে খুশি হয় সেটা বুঝি আমি। মা আমাকে একদিন গল্প করার ছলে বলেছিল সব ছেলেই চায় খাবার সময় তার স্ত্রী সামনে বসে থেকে পরিবেশন করে খাওয়াবে। এসব ছোটোখাটো জিনিসেও নাকি স্বামী স্ত্রীর মধ্য ভালোবাসা বাড়ে। আমি মাকে সেদিন বলেছিলাম, “আর কি কি করলে প্রেম বাড়বে বলুন না মা”। উনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, “ফাজিল মেয়ে শাশুরীর কাছে এসেছে প্রেমের তালিম নিতে “।
কে যেন বলেছিল, প্রেমে পরলে প্রিয় মানুষটার সবকিছুতেই সৌন্দর্য আবিষ্কৃত হয় নিজের কাছে ; এখন আমি কথাটার সত্যতা খুঁজে পাই নিজের কাছে। ওর ছোট ছোট কাজগুলোতেও আলাদা কিছু খুঁজে পাই আমি। আচ্ছা, শুভ্রও কি এভাবে আমাকে উপলব্ধি করে? নিজেকে প্রশ্ন করে কোনো উত্তর পাই না সঠিক। কখনো মনে হয় ও আমাকে খুব ভালোবাসে, আবার কখনো মনে হয় ও এতদিন পরেও কি যেন এক সন্দেহে ভুগে আমাকে নিয়ে। শুভ্র দোলনায় বসে আছে। আর আমি ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি। এ বিকেল বেলাটা কিরকম যেন বড্ড বেশি শান্ত লাগছে। নিস্তব্ধতা ভেঙে আমি শুভ্রকে বললাম,
— আচ্ছা, তুমি আমাকে কখনো ভুল বুঝবে না তো? শুভ্র কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললো,
:–ভুল বুঝার মতো কাজ যদি করো, তাহলে ভুল বুঝতেও পারি।
শুভ্রর এরকম স্পষ্টবাদীতা আমার ভাললাগে না। প্রেয়সীকে খুশি করতে কিছু নির্দোষ মিথ্যা তো বলাই যায়, এতে কি এমন ক্ষতি। অভিমান হলো খুব। ওকে রাগানোর জন্য দুষ্টামী করে বললাম,
–তোমার থেকে শামীম ভাই খুব ভালো ছিল।
কথাটা বলে নিজেই চমকে উঠলাম। আমারই এক বান্ধবীর বড় ভাই উনি। কিশোরী বয়সে বেশ কয়েকবারই আমাকে রঙিন খামে মুড়ে চিঠি দিয়েছিল। তখন চিঠির প্রচলন তো উঠেই গিয়েছিল। তবুও যে কেউ চিঠি লিখে এটা আমার ধারনার বাইরে ছিল। সেসব প্রেমময় চিঠির কোনোটারই জবাব দেই নি আমি। শুধু একবার সামনাসামনি উনাকে বলেছিলাম, “শামীম ভাই, আপনি আর এসব চিঠি কখনো দিবেননা”। উনি সত্যিই এরপর আর চিঠি দেন নি। এতদিন পর হঠাৎ উনার নামটাই কেন মুখে আসলো?!
:—এই যে ম্যাম, কোথায় হারালেন? (মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলল শুভ্র)
সম্ভিত ফিরে পেয়ে শুভ্রর দিকে তাকালাম। ওর চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে ও খুব করে চাইছে যে আমি আমার কথাটা ফিরিয়ে নেই। আমি কিছুটা লজ্জা পেলাম নিজের নির্বুদ্ধিতায়। শুভ্রকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
–তুমিই বেস্ট। আমি সরি, তোমাকে রাগানোর জন্যই ওটা বলেছিলাম।
শুভ্র মুচকি হেসে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। অনেকদিন পর ঘুরতে বের হলাম শুভ্রর সাথে। হঠাৎ করেই ও ছুটি পেয়ে যাওয়ায় সেটাকে কাজে লাগালাম। আমি শাড়ি পরেছি। অবশ্য নিজে নিজে নয়, মা পরিয়ে দিয়েছে। আজকে দুজন রাস্তায় দাড়িয়ে এক প্লেট ফুচকা ভাগ করে খেয়েছি। খুব ভালো লাগে শুভ্রকে নিয়ে ঘুরতে। ওর হাতে হাত রেখে হাটার লোভে রিকশা নিতে বারন করেছি। এখন নিজেকে মনে হচ্ছে সদ্য প্রেমে পরা কোনো লাজুক কিশোরী, যে তার প্রেমিকের হাত ধরে রাজপথে হাটছে কিছুটা ভাললাগার শিহরনে আর কিছুটা ভয়ে।
— এই স্বর্নালী..
পিছন থেকে কে যেন ডাক দিলো আমার নাম ধরে। গলাটা কেমন যেন চেনা মনে হচ্ছে। হাটা থামিয়ে পিছনে ফিরে দেখি শামীম ভাই! আমার সামনে এসে শুভ্রর দিকে বক্রদৃষ্টি হেনে তারপর আবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “বাহ!! আমাকে ভুলে গিয়ে ভালোই আছো দেখছি। তোমার মতো যদি নিজের অতীতটাকে ভুলতে পারলাম ঘটনার আকস্মিকতায় আমি আর শুভ্র দুজনই বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি। ঘোর কাটতেই দেখি শামীম ভাই চলে গেছে। শুভ্র আমার দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
–“তুমি তো কখনো বলো নি শামীমের সাথে তোমার সম্পর্ক ছিল..” আমি অস্থির গলায় বললাম,
–“তুমি ভুল বুঝছো। উনার সাথে কোনো সম্পর্ক ছিলো না। উনি কেন মিথ্যা বললেন আমি জানি না।”
শুভ্র অবিশ্বাসী গলায় বলল, “মিথ্যা তো তুমি বলছো। সেদিন তুমি এত ছেলে থাকতে শুধু শামীমের নামটাই কেন মুখে এনেছিলে? আমি ভেবেছিলাম তুমি সত্যিই দুষ্টামী করে বলেছিলে, কিন্তু এখন বুঝলাম আমার ধারনা মিথ্যে। তুমি শুধু মিথ্যে বুলিতে আমায় ভুলাতে।” আমি উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলাম শুভ্র আমাকে রাস্তায় সেখানে রেখেই চলে যাচ্ছে। আমিও ওর পিছু নিলাম। হঠাৎ দেখি বিপরীত দিক থেকে একটা বাস আসছে। কিন্তু ততক্ষনে আমি ভয়ে জমে গেছি। দিশেহারা ভঙ্গিতে একবার শুভ্রর দিকে আর একবার আমার দিকে ধেয়ে আসা বাসটার দিকে তাকালাম। তারপর একটা চিৎকার দিলাম শুভ্রর নাম ধরে..
[রাস্তায় একটা মেয়ের রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে। পাশেই একটা ছেলে বসে আছে মেয়েটির মাথাটা কোলে নিয়ে। আচ্ছা, ছেলেটি কি মেয়েটিকে বিশ্বাস করেছে? অবশ্য বিশ্বাস না করলেও মেয়েটির কিছু যায় আসে না, সে তো সব কিছুর উর্দ্ধে।