যদি কেউ জিজ্ঞেস করে আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু কে, তাহলে অনেক্ষন হেসে কিছু না ভেবে হুট-হাট করে বলে ফেলবো আমার ছেলে আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। ওর মায়ের মৃত্যুর পর আমি যখন একা পড়ে যাই তখন সেই ছিল আমার একমাত্র বেচে থাকার অবলম্বন। আমার জন্মের পর আমি বাবাকে হারাই, উনাকে দেখিও নি কিরকম দেখতে। আর এখন আমার ছেলেটাও জন্মের পর তার মাকে দেখতে পারেনি। ওর মা মারা যাওয়ার পর ওর জন্য এতটা কষ্ট হয়নি যতটা কষ্ট হয়েছে মা-হারা ছেলেকে নিয়ে কিভাবে থাকবো তা ভেবে!
কয়েকবছর আগের কথা, আমি তেমন একটা ভালো ছেলে ছিলাম না। সারাদিন-রাত,,মারপিট, জুয়া, চাঁদাবাজি, মাতলামী এসবে মত্ত থাকতাম। কয়েকবার জেলেও গিয়েছি তবুও শুধরালাম না। এদিকে আমার যন্ত্রনায় মা ভিষন কষ্ট পেত। মায়ের মাথায় হাত রেখে প্রতিদিন-ই কসম কাটতাম যে আর খারাপ কাজ করবো না। কিন্তু মাথায় নেশা চড়ে থাকায় সব কসম ভুলে গিয়ে পিনিকে পড়ে থাকতাম।
একদিন রাতে বাসায় ফিরে মাকে আওয়াজ দিচ্ছিলাম দরজা খুলতে। কিন্তু খুলে নি। মনে করেছি রেগে গিয়ে হয়ত খুলছেন না। তাই বারান্দায়-ই মরার মত শুয়ে পড়ি। সকালে ঘুম ভাঙে পাড়া-পড়শির চিৎকারে। আমার নেশা তখনও কাটে নি। কেউ একজন এসে আমাকে বললো তোমার মা মারা গেছে। নিভু নিভু চোখ বড় করে ওই মানুষটার দিকে তাকালাম। কিন্তু কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি। মায়ের পাশে গিয়ে বসে মায়ের হাত ধরে থাকি। তখন এক ভদ্রমহিলা বললো আমার মা নাকি আমার জন্যে মারা গেছেন। আমি নাকি উনাকে মেরে ফেলেছি। আমি নির্বাক হয়ে বসে সব শুনছি। উনি আরো বললেন মায়ের শেষ ইচ্ছে ছিল নাকি আমি ভালো হয়ে চলি। যা কু-সঙ্গ ধরেছি সব যেন ছেড়ে দিই। কি করবো তখন বুঝতে পারছিলাম না। মাকে দাফনের আগ মুহুর্তে উনার চেহারাটা দেখে শেষবারের মত কসম কাটলাম আমি ভালো মানুষ হয়ে যাবো। মা যেমনটা চেয়েছিলেন তেমন হবো। নিজের মনটাকে অনেক শক্ত রাখলাম। আর যাই হোক মায়ের শেষ ইচ্ছে পূরন করতে হবে। উনি বেঁচে থাকতে উনার জন্য কিছুই করিনি। এবার না হয় মরার পর কিছু একটা করি।
যে এলাকায় থাকতাম সেখানে কেউ আমাকে কোন কাজ দেয়নি। আমার অতীত দেখে সবাই ভয়ে কোন কাজের ভার আমার হাতে শপে নি। অনেক চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু কোন কাজ হল না। তাই বাধ্য হয়ে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেলাম। নতুন জায়গায় আসার পর নিজের গেট-আপ পুরোটা চেঞ্জ করলাম। একটা অফিসে কম বেতনের চাকরী পেলাম। আস্তে আস্তে আমার কাজের গতীশীলতা আর আমার চাল-চলনে অফিসের সিইও প্রমোশন লেটার দিয়ে বড় একটা পদে চাকরী দিলেন। আমি অনেক খুশি ছিলাম। কারনটা আমি চাকরী পেয়েছি সেজন্য না, মায়ের কথাটা রাখতে পেরেছি সেজন্য।
কয়েকদিন পর কাজের সুবাদে দশদিনের জন্য চট্টগ্রাম যেতে হয়। সেখানে একটা মেয়ের সাথে দেখা হয়। আমার চেয়ে চার-পাঁচ বছরের জুনিয়র হবে। মেয়েটা দেখতে বেশ সুন্দর, সুন্দর বললেও কম হবে অনেক সুন্দর। টান-টান দুইটা চোখ, তাতে অনেক যত্ন করে কাজল লাগানো তার ওপর আবার চশমা। আমি এত সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলাম যে মাইনাস পাওয়ারের চশমার গ্লাস পার করে চোখের কাজল পর্যন্ত পৌছলাম। এক কথায় অসাধারন ছিল মেয়েটা দেখতে। নিজের মাথা চুল্কাতে চুল্কাতে ভাবছিলাম প্রথম দেখায়ও যদি এতটা ভালো লেগে যায় তাহলে পরের নয়দিন কি হবে!!
যা ভেবেছিলাম সেটাই হল। পরের দিন অরিনকে আরো ভালো লেগে যায়। বুঝ হবার পর যতটা মেয়েকে দেখেছি তারমধ্যে যদি কোন মেয়েকে সিলেকশন করে প্রথমে রাখা যায় তাহলে সেই হবে। আমি আস্তে আস্তে ওর কাছা-কাছি যাচ্ছিলাম কথা বলার জন্য। কিন্তু লাজ-লজ্জার জন্য পারিনি। আবার ভয়ও ছিল একটা, যদি চাকরী হারিয়ে ফেলি। তাই আর বেশি রিস্ক নিই নি।
কিন্তু পরের দিন থেকে সবকিছু আপনা-আপনি বদলে গেল। অরিন নিজে এসে আমার সাথে কথা বললো। আমি প্রথমে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সে কি সত্যি-ই আমার সাথে কথা বলছে! স্বপ্ন নয়ত এসব! নাহ! এসব স্বপ্ন ছিল না। আমি লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ওর সাথে কথা বলার মাত্রা বাড়ালাম। ধীরে ধীরে আমরা অনেকটা ক্লোজ হয়ে গেলাম। এ বয়সে প্রপোজ করা আমার জন্য শোভা পায় না। তাই ডাইরেক্ট বিয়ের কথা বলেই ফেললাম। একবার নয় দু-বার নয় সে অনেকবার প্রপোজাল রিজেক্ট করে। তার উত্তর ছিল শুধু আমরা বন্ধু, এর চেয়ে বেশি কিছুনা। আমি নিরাশ হতে হতে একসময় হাল ছেড়ে দিলাম।
এভাবে চলতে চলতে প্রায় ৭-৮ মাস চলে গেল। হঠাৎ একদিন অরিন ফোন করে জানালো ওর বাসায় যেতে। গিয়ে জানতে পারলাম অরিন বিয়ের জন্য রাজি হয়েছে। আমি সেদিন অনেক খুশি হই। মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সব সুখ একসাথে আমার ওপর ঝর্ণার পানির মত ঝড়ছে। বিয়েটা তেমন ঘটা করে হয়নি। অফিসের কয়েকজন কলিগ আর ওর কিছু আত্মীয়স্বজন উপস্থিত ছিলেন। খুব ভালো ভাবে আমাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। বাসর রাতে আমি ওকে আমার পুরনো অতীতের সব কথা খুলে বলি। সে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিল। ওর স্পর্শে আমি যেমন মৃত থেকে জীবিত হই। ওর ছোঁয়ায় আলাদা একটা জাদু আছে। নয়ত আমি ওর হাতের ছোঁয়ায় আমি পৃথিবীতে স্বর্গ দেখিনা।
এভাবেই হাসি-খুশি জীবন চলছিল আমাদের। বিয়ের কয়েকমাস পর সে প্রেগনেন্ট হয়। ওর যত্ন-আত্মিতে কোন খসুর রাখিনি। অফিস থেকে হাফবেলা ছুটি নিয়ে ওর সাথে সময় কাটিয়েছি। ছেলে বা মেয়ে হলে তার কি নাম রাখা হবে, দেখতে কার মত হবে, বড় হলে কি করবে হেনতেন নিয়ে ওর সাথে খুনসুটি ঝগড়া করি। আস্তে আস্তে ওর পেট ভারী হচ্ছিল। যত দিন যাচ্ছিল ওর কষ্ট বাড়ছিল। এগুলো আমি সইতেও পারছিলাম না। রাত হলে যখন সে ব্যথায় গুঙিয়ে উঠে তখন চোখের পানি আটকাতে পারিনা। সে এসব দেখে হাসতো আর পেটে হাত ধরে বলত বাবু দেখো তোমার আব্বু কত্তো ভিতু। শেষে আমি ওর মুখে হাসি দেখে সব কষ্ট ভুলে যাই।
অপারেশন রুমে অরিন প্রসব বেদনায় চিৎকার করছে। আমি বাইরে দাড়িয়ে সব শুনছি। বারবার ইচ্ছে করছিল দরজা খুলে ওর পাশে গিয়ে বসি। আমি যদি পাশে থাকি তাহলে সে একটু শান্তি পাবে। কিন্তু ডাক্তাররা সে সুযোগ দিবে না। তাই বাধ্য হয়ে বাইরে দাড়িয়ে ওয়ালে আস্তে আস্তে ঘুষি মারছি। ঘুষিতে যে ব্যথা হাতে পাচ্ছি সেটা ওর প্রসব বেদনা থেকে অনেক ক্ষুদ্র ব্যথা। দু-তিন ঘন্টার অপারেশনের পর ডাক্তার বাইরে এসে খুশির সংবাদ দিল আমি ছেলের বাবা হয়েছি। আমি হাত দুটো তুলে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম। তখন ডাক্তার আমার কাধে হাত রেখে কেমন জানি মুখ বানিয়ে তাকিয়ে রইলো। মনে হচ্ছে খারাপ কিছু একটা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি ডাক্তারকে বললাম কি হয়েছে! সব ঠিক আছে তো! অরিন কেমন আছে!
ডাক্তার চুপ করে থাকলো। আমি ফোর্স করছিলাম কি হয়েছে সেটা জানতে। তখন ডাক্তার বললো। আর যা বললো তা বিশ্বাস করার মত না। তিনি বললেন আমার অরিন নাকি মারা গেছে। আমি হাসলাম। উনাকে বললাম আমি কি আপনার দুলাভাই লাগি যে মজা করছেন! সত্যি করে বলুন কাহিনী কি! তিনি বললেন ডেলিভারীর সময় নাকি অরিন মারা গেছে। আমি কিছুই বিশ্বাস করলাম না। কেবিনের ভেতর ঢুকে দেখি তার মুখ কাপড়ে বাধা। দৌড়ে গিয়ে সেটা সরাই। তার নিশ্বাস বন্ধ ছিল। আমি আতঁকে উঠি। তাহলে কি ডাক্তারের কথা ঠিক ছিল! আমি পিছপা হতে থাকি। তবুও আমি মেনে নিতে পারছিনা। এটা কিভাবে সম্ভব! সে বলেছে সে আমায় কোনদিনও ছেড়ে যাবে না। তাহলে এখন কিভাবে চলে গেল! আমি চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করি। কিন্তু সে শুনলো না আমার কান্নাগুলো। তবুও আমি কেঁদে যাচ্ছি।
একটু পর ডাক্তার এসে আমার কোলে বাচ্চাটাকে তুলে দিলেন। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। বাচ্চাটাকে একা কিভাবে সামলাবো! আর নিজেকেও কিভাবে সামলাবো! আবার বিয়েও করতে পারবো না। অরিনের জন্য যে ভালোবাসা জমা ছিল সেটা আমি অন্য কারোর হাতে তুলে দিতে পারবো না। একদিকে অরিনের চলে যাওয়ার দুঃখ আর নবাগত শিশুর পর্যাপ্ত দেখাশুনার দায়িত্ব আমাকে ডিপ্রেশনে ফেলে দিয়েছে। আমি যে ফ্লাটে থাকতাম সেখানের পাশের ফ্লাটে অরিনের এক বিবাহিত বান্ধবি শিমু থাকতো। ওরও দুটো বাচ্চা আছে। আমি যখন চিন্তার ডুবে যাচ্ছিলাম আমার বাচ্চাটাকে কিভাবে রাখবো তখন শিমু দেবদূতের মত এসে আমাকে সাহায্য করলো। আমি যখন অফিসে থাকতাম সে আমার ছেলেকে দেখতো। দাইমায়ের মত হলেও নিজের সন্তানকে যেভাবে আগলে রাখতো সেভাবেই আমার বাচ্চাটাকেও রাখতো।
অরিনের সাথে যখন ঝগড়া করতাম ছেলে বা মেয়ে হলে কি নাম রাখবো তখন প্রায়ই সে মুখ ভার করে বসে থেকে আমাকে হারাতো। তাই ওর পছন্দ করা নামটা ছেলের জন্য রাখলাম। নাম আফরান। ও দেখতে ওর মায়ের মত হয়েছে। অরিনের যেমনটা চোখ-নাক ঠিক একইরকম । ও চলে যাওয়ার পর কয়েকমাস পর চাকরীটা ছেড়ে দেই। কারন সেখানে ওর স্মৃতিগুলো আমায় কুকঁড়ে খায়। কাজে ভালো করে মন বসাতে পারিনা। ওর চেয়ার আর আমার চেয়ার পাশা-পাশি ছিল। এদিক ওদিক যেদিকেই তাকাই সেদিকেই অরিন দেখতে পাই। তাই এসব বেহেম-স্বপ্ন আমায় যেন দুর্বল না করে তাই চাকরী ছেড়ে ছোট একটা ব্যবসা খুলি। বেশ ভালোই সাফল্য পেয়েছি।
আস্তে আস্তে কয়েকটা বছর কেটে গেল। অরিন ছাড়া আফরানকে অনেক কষ্ট করে বড় করলাম। ওর যখন যা দরকার সব দিয়েছি। খেলতে বললে নিজে ঘোড়ার মত হয়ে সারাঘর চড়ি। গোসল করানোর সময় ঘন্টার পর ঘন্টা ওর সাথে পানিতে মাতি। খেতে বসলে পুরো বাসা কয়েকবার ঘুরে ওকে খাইয়ে দেই। রাতে ঘুমোনোর সময় ওকে জড়িয়ে ঘুমাই। আফরানও ওর মায়ের মত অন্ধকারে ভয় পায়। তাই লাইট জ্বালিয়ে ঘুমোতে হয়। একদম ওর মায়ের স্বভাব পেয়েছে।
ফ্লাট একটা কিনে ওইখানে শিফট হওয়ার জন্য বাসার সব জিনিসপত্র গুছানো হল। তখন আমার রুমের দেয়ালের ওপর থেকে লোহার বাক্স নামালাম। বাক্সে আমার পুরনো কিছু জিনিসপাতি ছিল। কি মনে করে বাক্সটা খুললাম। পরিপাটি করা একটা শাড়ি দেখতে পেলাম। এটা অরিনের শাড়ি। এখানে এল কিভাবে! শাড়িটা যেই হাতে নিলাম তখন ওটা থেকে কি একটা পড়লো। একটা ডায়েরী। শাড়ির ভেতর প্যাচানো ছিল। এ ডায়েরীর বিষয়ে আমি কিছু জানিনা। কার ডায়রী জানিওনা। খুলে দেখি একটা লাভ শেইপের ওপর অরিন আর আমার নাম লেখা। আর নিচে লেখা ছিল মাই ওয়ার্ল্ড ইজ ইউ। আমি একটু চমকালাম। কারন অরিন থাকতে কোনদিন-ই ডায়েরী তো দেখিনি। আজ হঠাৎ!!!
তখন আফরান ডাক দিল। আমিও আর খেয়াল করিনি। বাসা বদলানোর কাজ খুব ভালো ভাবে সম্পন্ন করলাম। নতুন বাসায় উঠে বেশ ভালোই লাগছিল। অরিন চেয়েছিল আমরা দুজনে একটা বড় বাসা কিনি যেখানে শুধু আমাদের রাজত্ব চলত। কিন্তু সে তো নেই, তবে তার ইচ্ছেটা পূরণ করলাম। আফরানের বাসা পছন্দ হয়েছে। ওর পছন্দই আমার পছন্দ।
সারাদিনের ক্লান্তিতে শরীরটা বেশ দুর্বল দেখাচ্ছে। আফরানকে ঘুম পাড়িয়ে যেই ঘুমোতে যাবো তখন ডায়েরীর কথা মনে পড়লো। ড্রয়ার থেকে ডায়েরী বের করলাম। ডায়েরীটা নাকের কাছে নিতেই অদ্ভুত এক ঘ্রান আমার হ্নদয় স্পর্শ করলো। কিন্তু বুঝতে পারলাম না কি ঘ্রান। আস্তে আস্তে ডায়েরীর পাতা উল্টালাম। অনেকদিন পর ওর লেখাগুলো দেখলাম। ওর হাতের লেখা খুব সুন্দর। মনোমুগ্ধকর লেখা। যাই লেখুক পড়তে খুব ইচ্ছে করে।
কয়েকটা পাতা উল্টানোর পর দেখলাম শিরোনামে “আমাদের প্রথম দেখা” লিখা। ধীরে ধীরে পড়া শুরু করলাম। লিখাটা এরকম ছিল; “আমি সবসময় চাইতাম আমার জীবনে এমন এক মানুষ আসুক যাকে দেখলে মনে হবে সে সারাজীবন আমাকে ভালোবাসার জালে আটকে রাখতে পারবে। দেখতে যেরকমই হোক না কেন শুধু ভালোবাসতে পারলেই হয়েছে। আমার ভাগ্যটা খুব ভালো । খুব তারা-তারি আমি সেই মানুষটার দেখা পেলাম। অফিসে এত লোকের ভিড়ে সেই এমন একজন ছিল যে সবার থেকে আলাদা। বেশি কথা বলে না, সবার সাথে মিশে না, শুধু কাজ নিয়ে পড়ে থাকে। আমি ওকে খেয়াল করতাম কিন্তু সে করতো না। বড্ড ইগো ছিল বোধহয়।
কিন্তু না, আমি যেভাবে খেয়াল করি সেও আমাকে আড়চোখে দেখে। আমি তখন খুব খুশি হই। ওকে পটাতে আমার আর বেগ পেতে হল না। সে সবসময় আমার আশে-পাশেই থাকতো। কিন্তু লজ্জার ভারে মুখ থেকে কথা বের করতে পারতো না। আমিও আর পারছিলাম অপেক্ষা করতে। তাই হুট করেই ওর সামনে গিয়ে কথা বলতে শুরু করি। সেও ভালোভাবে জবাব দিল। ব্যস, সেদিনের পর থেকে আমার জীবনটা অন্য একটা জীবনে মোড় নিল। অফিস শেষে প্রতিরাতে বাসায় ফিরার আগে ফুসকা খেতাম। সে বলেছিল তার ফুসকা ভালো লাগে না। আর আমি বলেছিলাম আমার খুব ভালো লাগে। তখন থেকে সে আমার সাথে ফুসকা খাওয়া শুরু করলো। আমি বুঝতে পারছিলাম সে আমার পছন্দে মিল রাখার চেষ্টা করছে।
আমাকে যে তার ভালো লাগে সেটা সে বলতে পারে না। আমি অনেকবার চেয়েছিলাম ওর মুখ শুনতে কিন্তু লজ্জার ভারে সে নেতিয়ে পড়ে। তাই মনে মনে তাকে হাবলু ডাকতাম”। আমি ওর লিখাগুলো দেখে বেশ হাসলাম। আমার কথাই বলছিল সে। আমার ওকে ভালো লাগার আগে তার আমাকে ভালো লেগেছে সেটা পড়ে অনেক আনন্দিত হলাম। পাতা বদলিয়ে পরের শিরোনামে গেলাম। কিন্তু কোন শিরোনাম লেখা ছিল না। তবুও পড়তে লাগলাম।
“একদিন আমি বাসায় ফিরে আচমকা মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাই। ততক্ষনাৎ আমাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। কিছু মেডিকেল চেকআপ করে বাসায় ফিরে আসি। সেদিনের পর থেকে আমাকে অন্যরকম লাগতো। খাবারের মধ্যে তেমন রুচি নেই, বাইরে গেলে কেমন জানি হাহাকার লাগত। কিছুই ভালো লাগত না। তখন শান আবার চট্টগ্রামে আসলো। আমার সাথে দেখা করলো। ও যখন সাথে থাকে তখন আমি ভালো থাকি। আর চলে গেলেই,,,। আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না আমি ওর ভালোবাসায় পড়ে গেছি। সে তো আমাকে মুখ ফুটে বলতে পারবে না কিন্তু আমি বলবো। সেদিন খুব ভালো মুড নিয়ে অফিসে যাওয়ার জন্য বের হই। তখন আম্মু বললো ডাক্তারের কাছে যেতে। ডাক্তার ফোন করে বলছে আমার সেইদিনের রিপোর্ট টা আনতে হবে। তাই অফিসে পরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলাম।
ডাক্তার রিপোর্ট কার্ড আমার হাতে দিয়ে চুপ করে থাকলো। বিষয়টা আমার কেমন জানি অদ্ভুত লাগলো। আমি রিপোর্ট কার্ড খুলে দেখলাম আর ডাক্তারের দিকে তাকালাম। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আম্মু বললো কি হয়েছে রে! রিপোর্টে কি লিখা! আমি বলার বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। কিভাবে আমি বলবো রিপোর্টে লেখা আমার ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে। ডাক্তার আমার ভাব-ভঙি দেখে বুঝতে পেরেছে আমার কি অবস্থা হয়েছে। পানি এক গ্লাস আমার সামনে এগিয়ে দেয়। আমি পানি পান না করেই চেম্বার থেকে বেরিয়ে পড়ি।
কিছুক্ষন পর আম্মুও বের হলেন। আম্মুর মুখ গম্ভীর ছিল। তারমানে ডাক্তার হয়ত আম্মুকে সব বলে দিয়েছেন। আম্মু আমাকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলেন। তখন শানের কল আসলো। আমাকে জিজ্ঞেস করলো আমি কোথায়! আমি বলার মত কিছু পাচ্ছিলাম না। শুধু বলেছি আমি আসছি।
আম্মুকে বাসায় পাঠিয়ে আমি অফিসে গেলাম। অফিসে যা ঘটলো তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। শান আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। কয়েক ঘন্টা আগে আমি যাকে প্রপোজ করার জন্য উতলা হয়েছিলাম সেই এখন আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে। কিন্তু আমি কিভাবে তার প্রপোজাল এক্সেপ্ট করবো! কয়েকমিনিট আগে ডাক্তারের রিপোর্টে আমার সব স্বপ্ন নষ্ট করে দিল। এখন আমি কিভাবে তাকে না করবো! আমি যে তাকে বড্ড ভালোবাসি। আর সেও।
সে যদি জানতে পারে আমার কি হয়েছে তাহলে সে অনেক কষ্ট পাবে। তার মন ভেঙে যাবে। তাই তার প্রপোজাল রিজেক্ট করে বলি আমরা শুধু বন্ধু। আমি জানি এটা শুনে সে অনেক মর্মাহত হয়েছে কিন্তু তার চেয়ে বেশী আমি কষ্ট পেয়েছি। আমি চাই না আমার একটা জীবন আরেকটা জীবনকে নষ্ট করে দিক। তাই আমি তাকে আমার ভালোবাসায় জড়াইনি।
কিন্তু আমি এও বুঝতে পেরেছিলাম সে আমাকে ভালোবেসে অনেক কষ্ট সহ্য করছে। আর সেটা আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। তাই একদিন তাকে বাসায় ডাকি আর বলি আমি ওকে বিয়ে করার জন্য রাজি আছি। তখন সে আমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে একটা চুমু দেয়। বিয়েটা সম্পন্ন হওয়ার পর আমার একটাই উদ্দেশ্য ছিল আমি মারা যাওয়ার আগে ওকে একটা সন্তান দিয়ে যাই। আমি জানি যদি আমি মারা যাই তাহলে সেই কষ্ট সেই যন্ত্রনা সে সইতে পারবে না। কোনদিনও পারবে না। আর উদ্দেশ্যটা সফল হল। কয়েকটা দিন পর আমি বাচ্চার মা হবো। আল্লাহর কাছে শুধু দোয়া করেছি বাচ্চাটাকে জন্ম দেওয়ার পর যেন আমি মারা যাই। এর আগে না”।
আমি আজ প্রথম জানতে প্রথম জানতে পারলাম আমার অরিনের ক্যান্সার হয়েছে। এজন্যই সে বারবার আমার প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছিল। আমি দাঁতগুলো দিয়ে কিড়-মিড় খাচ্ছিলাম। সে আমাকে বলে নি কেন তার ক্যান্সার হয়েছে। সত্যিটা আমায় বললে কি হত!!! আরেক পাতা উল্টালাম “আমার লক্ষি শান, ডাক্টার যখন প্রথমে বললো আমি আর বেশিদিন বাঁচবো না তখন আমি এতটা আঘাত পাইনি যতটা আঘাত তুমি আমার জন্য পাবে যদি এই নিউজটা শুনো। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। আমার মাথায় কাজ করছে না তোমাকে কিভাবে সামলাবো!
তাই ডিসিশন নিলাম আমি তো মারা যাবো নিশ্চিত কিন্তু তুমি যেন আমার মৃত্যুতে একটুও কষ্ট না পাও সেজন্য তোমাকে বিয়ে করে তোমার কাছে বাচ্চা চাই। আমি জানিনা আমি বাচ্চটাকে দুনিয়াতে আনতে পারবো কি না কিন্তু আল্লাহর কাছে তোমার জন্য দুয়া করেছি তিনি যেন তোমাকে সাহায্য করেন। তুমি হয়ত মনে করবে আমি তোমাকে ধোকা দিয়েছি কিন্তু বিশ্বাস করো আমি তোমাকে ধোকা দেয়ার চেষ্টা করিনি। আমি শুধু তোমাকে ভালো রাখার প্রয়াস চালাচ্ছিলাম।
আমি যদি বাচ্চাটাকে পৃথিবীতে না আনি তাহলে এর পরে বড়জোর আমি ৪-৫ মাস বাচবো। এর পরে তো তুমি আমার হারিয়ে যাওয়ার কষ্টে মারা যাবে। কিন্তু বাচ্চাকে আনলে তোমার একটা জীবন পার হয়ে যাবে আমাকে ছাড়া। তাই আমার জীবনকে উৎসর্গ করে তোমাকে নতুন একটা জীবন দিব এটাই আমার শেষ ইচ্ছে। আমি জানিনা আমি বাচ্চাটাকে পৃথিবীতে আনতে পারবো কি না। যদি আনতে পারি তাহলে ওর দেখভালের জন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করে নিও আর নতুন করে সংসার গুছিয়ো আর তোমার পছন্দ মত বাচ্চার একটা নাম রেখে দিও।
হয়ত আমি আর লিখার সুযোগ পাবো না। তবে এতটুকুতে আমি যা বলেছি সেটা করবা কিন্তু। তোমাকে খুব খুব খুব ভালোবাসি। ভালো থেকো শান”। আমি ওর লিখাগুলো পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়লাম। অনেকদিন হল এই শুকনো চোখ থেকে জল ঝড়ায় নি। আজ মনে হচ্ছে এত বছরের জমানো জল সব গড়িয়ে পড়বে। আমি ভাবতে পারছিলাম না একটা মেয়ে আমার জন্য এতকিছু করলো, আমার জন্য নিজের জীবনটাও বিলি করে দিল। আমি মনে করতাম আমি তাকে বেশি ভালোবাসি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে আমাকে বেশি ভালোবেসেছে।
ওর ডায়েরীটাকে বুকে ধরে রাখলাম। হঠাৎ আফরানের ঘুম ভাঙলো। আমার চোখে জল দেখে বললো আমি কাঁদছি কেন! আমি তাকে কি বলবো খুজে পাচ্ছিলাম না। শুধু তাকে জড়িয়ে ধরে রাখি। তাকে কিভাবে বলবো তার জন্যই তার মা পৃথিবী ছেড়েছে! বারান্দায় দাড়িয়ে তারা গুলো দেখছিলাম। একটা তারাকে অরিন ভেবে মনে-মনে বললাম তোমার সব ইচ্ছে আমি পুরণ করতে পারি কিন্তু তোমার জন্য আমার যে ভালোবাসা সেটা অন্যের হাতে তুলে দিতে পারবো না, এজীবনেও পারবো না। আমাকে ক্ষমা করে দিও।