-মিস রুবা আজ আপনার আন্ডারে আমার একজন রিলেটিভ জয়েন করবে। ছেলেটা অনভিজ্ঞ, একটু কাজ দেখিয়ে দিবেন।
আমার ইচ্ছা করছে হাতের সবগুলি ফাইল বুড়া বসের মাথাই ছুড়ে মারি। একে তো নিজের কাজ করেই ফুসরত পাই না তার উপর একজন আনাড়ি লোক আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছে। আমাকে খুন করতে চায় নাকি বুড়ায়? আপ্রাণ চেষ্টা করে মুখের ভাব স্বাভাবিক রাখলাম, ‘জ্বী স্যার আমি চেষ্টা করব।’
-ওকে,রফিক আসবে ১১ টার দিকে। এবার তবে আসুন। নিজের ডেস্কে এসে ফাইলগুলো ঝপাত করে ফেলে দিলাম, তবুও রাগ কমছে না। ধ্যাৎ করবোই না এই চাকরী,যত্তসব!
-কি রুবা এত রাগ কেন?
শানু আপার গলা শুনে ঘাড় ঘুরালাম, ‘ না কিছু না। ‘ লাঞ্চ টাইম হয়ে এল এখনো আসার নাম নেই নবাবজাদার। আসলে আসুক, না হলে নাই আর অপেক্ষা করতে পারব না। বের হওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছি এমন সময় আসলেন উনি।
-এক্সকিউজ মি ম্যাম,আপনি কি ছেলেটাকে দেখেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সময়মত তো আসেইনি তার উপর পড়ে এসেছে রঙচঙে টিশার্ট। বসের আত্নীয় বলে কি কোন রুলস মানবে না নাকি!
-এতক্ষণে আপনার আসার সময় হল? ১১ টায় আসার সময় ছিল আপনার, ১ টায় না। আর শুনুন বসের আত্নীয় বলে ছাড় পাবেন না। কাল থেকে ফরমাল অফিস ড্রেসে আসবেন, সাথে অবশ্যই টাই। ‘
-জ্বী আমাকে বলছেন!
এই ছেলে বলে কি! আমি তবে কাকে বলছি? শত চেষ্টায়ও বিরক্তি ডাকতে পারলাম না, ‘হ্যা আপনাকেই। যান বসের সাথে দেখা করে আসুন, উনি অফিসেই আছেন। আমি লাঞ্চের পর আপনাকে কাজ বুঝিয়ে দিব।’
-আর ইউ শিউর?
-ইয়েস আইয়্যাম। রুলস সবার জন্যই সমান।
ছেলেটাকে দাড় করিয়ে রেখেই চলে এলাম। খুব মুশকিল হবে একে নিয়ে কিন্তু কি আর করার সবই আমার কপাল। লাঞ্চ করে এসে ছেলেটাকে আর দেখলাম না। নামটা যেন কি ছিল ভুলে গেছি। ইচ্ছা করেই খোজ করলাম না, যেখানে যায় যাক। কাজ করছি এমন সময় বস আর ছেলেটা আমার ডেস্কের দিকে এগিয়ে এলো।প্রস্তুত হলাম গাধা পিটিয়ে মানুষ করতে হবে।
-মিস রুবা রফিক নামের যে ছেলেটা আসার কথা ছিল ও আসছে না। আপনার অপেক্ষা করার দরকার নেই।
বলেই উনি চলে গেলেন একজিটের দিকে। ছেলেটার মুখে দেখছি মিটিমিটি হাসি, বেশ কয়েকবার ফিরেও তাকাল। কি হল এটা? রফিক আসবে না তবে ওই লোকটা কে ছিল?উনারা চোখের আড়াল হতেই বসে পড়লাম ধপ করে।
-শানু আপা বসের সাথে লোকটা কে?
-এখনো চেন না? উনি ইঞ্জিনিয়ার রেজাউর করিম সাহেব। বসের নতুন প্রজেক্টের কাজ দেখছেন। খুব হ্যান্ডসাম না?
শূন্য চোখে তাকিয়ে রইলাম শানু আপার মুখের দিকে, ইঞ্জিনিয়ার রেজাউর করিম সাহেব ! আর আমি তাকে তখন কি কি বলেছি? ইয়া মাবূদ! বেশ উৎপাত শুরু করেছেন ইঞ্জিনিয়ার রেজাউর করিম সাহেব। প্রতিবার যখনি অফিসে আসেন আমাকে দেখলেই মিটিমিটি হাসেন। উনার এই ফিচলে মার্কা হাসি দেখে আমার আত্না উড়ে যায়, আজি বুঝি বস ডেকে পাঠালো সেদিনের ঘটনার জন্য। অবশ্য সেরকম কিছু ঘটেনি কখনো। তবে অমন কিম্ভুত করে হাসে কেন লোকটা?
-হ্যালো মিস রুবা! চোখ তুলেই দেখি ইঞ্জিনিয়ার সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন হাসিমুখে। ভদ্রতাসূচক হাসি টানলাম মুখে।
-হ্যালো!
-আজ আমার ড্রেসকোড ঠিক আছে না?
টাই টা একটু উঁচু করে ধরে জিজ্ঞাস করলেন। আহা, নিজের যন্ত্রণায় বাঁচি না উনি আসছেন মশকারি করতে। তবুও বললাম, ‘ আপনার জন্য ড্রেসকোড প্রযোজ্য নয়, সেদিন আমি অন্যজনের সাথে আপনাকে গুলিয়ে ফেলেছিলাম। দুঃখিত। বলেই ইচ্ছা করে কাজ নিয়ে বিজি হয়ে যাওয়ার ভাণ করলাম। যদিও আমার সবটুকু মনোযোগ উনার দিকে। কয়েক মুহূর্ত উসখুস করে বসের অফিস রুমের দিকে চলে গেলেন। নাহ এই লোকের ভাবগতিক সুবিধার ঠেকছে না। মোবাইলের রিংটোনে কাঁচাঘুম ভেঙে গেল, অফ ডে গুলাতেও শান্তি নাই। নাম্বার অপরিচিত ধরলাম না। আবার এল কল, রিসিভ করতেই একটা ছেলে কন্ঠ ভেসে এল,
-রুবা বলছেন?
-হ্যা বলছি, কে?
-রেজা বলছি।
-চিনতে পারছি না কোন রেজা?
-রেজাউর করিম। চিনেছেন?
এই ব্যাটা আমার নাম্বার পেল কই? ফোনই বা দিয়েছে কেন? ভালোরকম যন্ত্রণা শুরু হল তো! আমি চুপ করে আছি দেখে ওপাশে হ্যালো হ্যালো শুরু করলেন উনি।ইচ্ছা করছে বলি না চিনি নাই।
-হ্যা চিনেছি কিন্তু আমি তো অফিসে না, কোন কাজ থাকলে অফিস নাম্বারে কল দিন। আজ আমার ডে অফ।
বলেই কেটে দিলাম। উনার কাজের সাথে আমার কাজের কোন সম্পর্ক কোনভাবেই নেই, আমাকে ফোন করার কারন বেশ ভালই বুঝছি। কয়েকদিনের মধ্যেই আমার আশংকা সত্যি হল। শানু আপা বেশ ঘটা করেই উনার পক্ষ থেকে প্রস্তাব দিলেন। কি আশ্চর্য! কবে শানু আপার সাথে উনার এত ভাব হল আমি টেরই পেলাম না। না করে দিলাম, এসবের জন্য এখনো প্রস্তুত নই,পুরানো ক্ষত এখনো কাচা রয়ে গেছে। কিন্তু রেজা সাহেব যে নাছোড়বান্দা তা বুঝে গেলাম কয়দিন পরেই।
কথা ছিল আজ আমি আর শানু আপা বাইরে খাব। আমি রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করছি এই সময় শানু আপা জানালেন উনি আসবেন না। অথচ উনিই আমাকে প্রায় জোড় করে রাজি করিয়েছেন। খাব নাকি চলে যাব ভাবছি হঠাৎ দেখি রেজা সাহেব আসছে এদিকে,ইনি আসলেন কই থেকে? সোজা এসে আমার সামনে বসলেন যেন জানতেন আমি এখানেই আছি। ওয়েটার এসে কফি দিয়ে গেল, অথচ আমি অর্ডার করিনি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমিই শুরু করলাম কথা,
-তোহ রেজা সাহেব এসব কিছুর ব্যাখ্যা নিশ্চয় আছে আপনার কাছে?
-দায় স্বীকার করছি ।
-কি দরকার এসবের? আমি তো বলেছিই।
-আমি এত জলদি আশা ছাড়তে রাজি নই।
-আমার আগ্রহ নেই একদমই।
-কেউ না কেউ তো একজন তো আপনার লাইফে আসবেই। আমি হলে প্রব্লেম কি? সত্যিই তো প্রব্লেম কি? প্রব্লেম হচ্ছে উনি ফয়সাল নন, যাকে ভালবাসতাম এখনো বাসি বৈকি । ঠিক ঘৃণা করতে পারি না এত বড় প্রতারণার পরও।
-আমাকে পছন্দ করার কোন কারন না থাকতেই পারে। কিন্তু যদি দয়া করে অপছন্দ করার কারনটা জানাতেন নিজেকে শোধরানোর চেষ্টা করতাম।
-আসলে রেজা সাহেব প্রব্লেম আপনার নয়, আমার।
-শেয়ার করা যায় কি?
রেজা সাহেবের দিকে তাকালাম, কতটুকু বলা যায় তাকে? তার প্রশান্ত মুখ দেখে মনে হল হ্যা একে বলা যায়। মুখ ফিরিয়ে নিলাম, চাই না আমার বেদনাটুকু তার চোখে পড়ে যাক।
-একজনকে ভালবাসতাম।
-তারপর?
-আমার সাথে সম্পর্ক থাকাকালীন আরেকজনের সাথে জড়িয়ে যায়, তাকেই বিয়ে করেছে।
-সবাই তো এক নয়।
-মন ভেঙে গেছে, জানেনই তো ঝড়ের কবলে পড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পায়।
-ও আপনার জন্য ভুল মানুষ ছিল। আমি আপনার সঠিক মানুষটা হতে চাই তার জন্য অপেক্ষা করব। অপ্রস্তুত লাগছে নিজেকে, এর আমি কি উত্তর দিব?
-আচ্ছা রুবা আমরা আরেকদিন দেখা করতে পারি না?
যেন নিজের অজান্তেই উত্তর দিলাম, ‘পারি। ‘ বেশ দ্রুতই রেজার সাথে সহজ হয়ে উঠলাম। সম্পর্ক এখন তুমিতে। চমৎকার একজন মানুষ,বন্ধুসুলভ।উইকেন্ডে প্রায়ই দেখা হয় আমাদের,কিন্তু দ্বিতীয় বার ও ফয়সালের বিষয়ে আর কিছু জানতে চায়নি।রেজার সাথে থাকলে সময়গুলো যেন উড়ে চলে যায়।আশ্চর্য হলেও সত্যি ওর সঙ্গ আমার ভাল লাগে।আমি কি ওর প্রেমে পড়তে চলেছি? ঠিক বুঝি না। নাকি মনের কোনে আশা ফয়সাল ফিরবে আবার? এটাও বুঝি না। কি দুর্বোধ্য আমি নিজের কাছেই।
রেজা কি অসীম ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করছে ভেবে অবাক হই। ও কখনওই আর ওই বিষয়ে কিছু বলে না।আমার খারাপ লাগে ওর জন্য কিন্তু মনের সায় পাই না এগুতে। এটা ঠিক হচ্ছে না, যেকোন সিদ্ধান্ত আমাকে খুব শীঘ্রই নিতে হবে। রেজার নিজেরও একটা লাইফ আছে। ফয়সালের কল দেখে ভীষণ চমকালাম। নাম্বার টা সেভ নেই কিন্তু কোনদিন তা স্মৃতি থেকে মুছে যাওয়ার নয়। এতটা হতভম্ব হয়ে গেছি যে প্রথমবার ধরতেই পারলাম না। দ্বিতীয় বারে ধরলাম।
-রুবা কেমন আছ?
-ভাল,তুমি?
-আমি ভাল নেই।
-ভাল থাকার জন্যই তো এতকিছু করলে। ভাল থাকার তো কথা।
-ভুল মানুষের সাথে ভাল থাকা যায় না। তুমিই আমার জন্য সঠিক মানুষ ছিলে। তোমার সাথে করা অন্যায়ের জন্য আমি অনুতপ্ত। সঠিক মানুষ, চোখের সামনে রেজার চেহারা ভেসে উঠল অকারনেই।
-তোমার বউ কোথায়?
-ও চলে গেছে আজ। আর ফিরবে না।
-শুনে খারাপ লাগল।
-খারাপ লাগার কিছু নেই। ওই আমাকে মোহাবিষ্ট করে তোমার থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। রুবা বিশ্বাস কর আমি সব সময় তোমাকেই ভালবেসেছি। প্লিজ রুবা চল না সব নতুন করে শুরু করি। আমি ওকে ডিভোর্স দিব।
ভীষণ হাসি চলে এল। এত স্বার্থপর লোকটাকে আমি কেন এত ভালবেসেছি? যে শুধু নিজে ভাল থাকার জন্য যাকে খুশি তাকে ব্যবহার করে। ভালবাসা অপাত্রে দান করেছি। ২ বছরেও যাকে ভুলতে পারিনি এই ২মিনিটেই যেন ফয়সালের প্রতি থেকে সব ভালবাসা ম্যাজিকের মত গায়েব হয়ে গেল।
-সরি ফয়সাল। কেন ভাবছ এখনো আমি তোমার আশায় বসে আছি? তুমিও ছিলে আমার সবচেয়ে বড় ভুল।
বলেই খটাং করে কেটে দিলাম। এখন কল দিচ্ছি আমার জন্য সঠিক মানুষ হওয়ার অপেক্ষায় থাকা লোকটাকে। কেমন হয় যদি তাকে চমকে দিয়ে বলি, উইল ইউ ম্যারি মি?