পাগলীটা

পাগলীটা

কথায় কথায় আফরিন আমাকে খোঁটা দিয়ে বেড়ায় তাকে কিডন্যাপ করে বিয়ে করেছি। যদিও সে মিথ্যে বলেনা, কিন্তু কিডন্যাপ করা লাগতো না যদি আমার ছোটবোন বাঁদরামি না করতো। জন্ম থেকে আমাকে জালাইতেছে অনন্যা। তার যন্ত্রনায় কয়েকবার ঘর ছেড়েও বের হয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু আমার পাগলী বোনটাকে ছাড়া থাকতেও পারিনা। তার খুনসুটি ঝগড়া আর ভাইয়ের কাছে হাজারো আবদার যেন আমাকে টেনে নিয়ে আসতো বার বার তার কাছে। পৃথিবীতে ভাইবোনের ভালোবাসার কীর্তিকলাপ বলে শেষ করা যায়না। তেমনি হাজারো অভিমান আর আবদারের এক ভাণ্ডার ছিলাম আমি অনুর কাছে। আমি অনন্যাকে ভালোবেসে অনু ডাকলেও সে আমাকে সব সময় ডেভিল ডাকতো। তার এই ডাকেও যেন আমি সুখ খুজে পেতাম। আমার সাথে আফরিনের সম্পর্ক থাকাকালীন আমাকে প্রতিনিয়ত ব্ল্যাকমেইল করে নিজের চাহিদা পুরন করেছে।

কখনো তার বন্ধুদের সাথে পার্টি দেবার জন্য টাকার দরকার হলে আমি এটিএম বুথ হয়ে যেতাম। শপিং করতে ইচ্ছে করতেছে আমাকে মাস্টারকার্ড বানিয়ে সাথে নিয়ে যেতো। আর তার সবকিছু আমাকে মাথা পেতে নিতে হতো, কারন বাবাকে অনেক ভয় পেতাম আর সে আফরিনের কথা বাবার কাছে বলে দেবার হুমকি প্রতিদিন একবার করে দিতো। বাবা আমাকে যে পকেট মানি দেয় তার ৮০% টাকা সেই খেয়ে ফেলে। সে তার ঈদের শপিং দুইবার করবে একবার বাবার টাকায়। আর একবার আমার টাকায়। এমনো ঈদ আমি পাড় করেছি দুই বছর আগের জামা কাপড় নতুন বলে চালাতে হয়েছে বন্ধুদের সামনে। আর আমার এমন পরিস্থিতি দেখে তার মুখে সর্বদা আমি হাসি দেখতাম। আমাকে জালিয়ে সে বোধহয় পৃথিবীর সর্বোচ্চ সুখ পেতো।

আজ থেকে পাচ বছর আগের কথা তখন আমি অনার্স শেষ করে হন্য হয়ে চাকুরী খুজে যাচ্ছি। এরই মধ্যে অনু কলেজে উঠেছে, গ্রীষ্মকালীন ছুটির দিনে সে ফুফুর বাসায় চিটাগাং বেড়াতে যাবে বলে বায়না ধরেছে। বাবা কাজের ব্যস্ততার জন্য যেতে পারছিলেন না বলে, আমাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন অনুকে। কিন্তু আমার যাবার ইচ্ছা মোটেও ছিলোনা, আমি জানতাম এখানে অনু নিজের লাভটাই খুজতেছে। তারপরেও বাবার কথামত তাকে নিয়ে আমার যেতে হলো চিটাগাং শহরে। পুরোটা রাস্তা আমাকে জালিয়ে মেড়েছে কোন কারন ছাড়াই। বাসের মধ্যে রাগী কন্ঠে ধমক দিয়ে চুপ করানোর চেষ্টা করলে পুরো বাসকে মাথায় তুলে ফেলে। শেষমেশ ঝাড়িও আমি দেই আর স্যরিও আমাকে বলতে হয়।

তখনো আমার আফরিনের সাথে পরিচয় হয়নি। আফরিনের আগে আমার জীবনে সুমাইয়া নামের মেয়েটি আসে, কিন্তু তাকে খুব বেশিদিন ধরে রাখতে পারিনি। কলেজ জীবনের প্রেম কলেজ জীবন শেষ হতেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো। যখন সুমাইয়ার সাথে আমার সম্পর্ক ভেংগে যায়, তখন আমার মানসিক স্থিতি মোটেও ভালোছিলোনা। তখন আমাকে নানা কাজে বিজি রাখতো আমার বোন অনু। আমাকে মন খারাপ করে থাকতে দেখলেই তার জ্বালাতন শুরু হয়ে যেতো। তাই মাঝে মাঝে মনে হয়, পাগলী টাইপ বোন যার নেই তারমত হতভাগা দুনিয়াতে একটাও নেই। একমাত্র বোন নামক মানুষটাই ভাইয়ের জন্য কলিজা কেটে দিতে পারে। বোন ছোট হোক কিংবা বড় ভাইয়ের জীবন আনন্দে ভরে দিতে তাদের জন্য নৈতিক কর্তব্য। এই কারনেই হয়ত অনুকে ছাড়া আমিও থাকতে পারিনা।

ফুফুর বাসায় আসার পর, বিকেলবেলা ছাদে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুকতেছিলাম। অনু ছাদে কখন এসেছে বলতে পারবো না, আমি মগ্ন ছিলাম প্রকৃতির মিলন দেখায়। কিভাবে নীল আকাশের সাথে উত্তপ্ত রশ্মি মিশে যায় আকাশের ওপারে। একটি সময় সুর্যের তেজ কমতে থাকে, তখন একটি গোলাকার চাদের মত রুপ নেয়। আমার কাছে এর থেকে সৌন্দর্যময় রুপ আর কিছু চোখে পড়েনি। যখন বৃষ্টি হয়, তখন মেঘের আড়ালে সুর্য থাকে। বৃষ্টি শেষ হতেই বের হয়ে আকাশে ছড়িয়ে দেয় রংধনুর মেলা।

কিন্তু আমার এমন ভাগ্য কোথায় একটু শান্তিমত প্রাকৃতিক রুপ দেখবো, পেছন থেকে অনুর কর্কশ কন্ঠে সব রুপ যেন বাতাসে উড়ে গেলো, “আরে ডেভিল তুই সিগারেট খাস, গাজা টাজাও খাস নাকি” হরবরিতে সিগারেট ফেলতে গিয়ে নিজের গায়েই আগুন ফেলে দিলাম। আর ঘাবড়ে গিয়ে বলতে লাগলাম “আরে না সিগারেট খাবো কেন? কে যেন এখানে খেয়ে সিগারেট না নিভিয়ে রেখে গিয়েছিলো আমি তা ফেলে দেবার জন্য হাতে নিছিলাম। আমি তো খাইনা এসব” অনু আরো রেগে বলতে লাগলো “হইছে হইছে আমার সামনে নাটক করিস না। আমি বাবাকে ফোন দিয়ে জানাইতেছি তোর কুকীর্তি। আমি ভয় পেয়ে গেলাম, তাকে বলতে লাগলাম “আমার লক্ষী বোন বাবাকে এসব বলেনা তোর কি লাগবে বল আমাকে?” সে কিছুক্ষন চুপ থেকে বলতে লাগলো “আমার মোবাইলের এমবি শেষ হয়ে গেছে ২৩৯ টাকা রিচার্জ করে দে তাইলে কিছু বলবো না।” আমি ক্ষিপ্ত হয়ে বললাম “তোকে না বাবা টাকা দিয়েছে সেগুলো কই”।

সে দমে রইলোনা আমাকে উলটো বলতে লাগলো “আমার টাকার হিসেব তোকে কেন দিবো আমি? তুই আমার কথা শুনতে বাধ্য নয়ত আমি আমার কাজ করি তুই থাক।” কথাটি বলে অনু হাটা দিলো, আমি দৌড়ে তার সামনে গিয়ে বললাম “বাবা কে কিছু বলিস না, আমি টাকা রিচার্জ করে দিচ্ছি।” আমার মুখের উত্তর শুনে তার মুখে দুষ্টামির হাসি ফুটে উঠলো। আমি আর কোন কিছুর অপেক্ষা না করে নিচে নেমে দোকান থেকে তার মোবাইল এ টাকা রিচার্জ করে এলাকাটা ঘুরতে লাগলাম। মনের মত কিছু না পেয়ে চলে আসলাম উপরে। বাসায় আসতেই আবার সম্মুখীন হতে হলো অনুর সামনে, আমাকে অনু দেখেই ফুফুকে বলতে লাগলো “ফুফু ডেভিল আসছে একেই জিজ্ঞেস করে দেখুন”।

আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না। ফুফু আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আছে, এমন রাগ করে তাকানোর মানে টাও বুঝতে পারলাম না, ফুফু আমার সামনে এসে আমাকে বলতে লাগলো “ছাদে গিয়ে কি করেছিস তুই”। প্রশ্নটা শুনতেই হার্টবিট বেড়ে গেলো, একবার ভাবলাম হয়ত অনু ফুফুকে বলে দিয়েছে সিগারেট এর কথা, কিন্তু আমিও না জানার ভান করে বলতে লাগলাম “কই ফুফু কিছুই তো করিনাই”। ফুফু একবার অনুর দিকে তাকিয়ে আবার বলে উঠলো “অনু কাকে যেন ছাদে সিগারেট খাইতে দেখছে তুই কি খাইছিস? আমি একটু মৃদু শব্দে বলতে লাগলাম “নাহ নাহ ফুফু আমি এসব খাইনাই। অন্য ছেলে খেয়েছিলো আমি তো শুধু উপরে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিলাম।” ফুফু স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বললো “যাক তাহলে নিশ্চিত হলাম। এসব ছাইপাঁশ খাস না যেন কেমন।” ফুফু কথা বলে তার রুমে চলে গেলো। আমি যেন মহা প্রলয় থেকে বাচলাম দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে রাগী চোখে অনুর দিকে তাকালাম। আমাকে মুখ ভেংগিয়ে সে তার ঘরে চলে গেলো। আমার নিরব হয়ে তার অত্যাচার সয়ে যেতে হচ্ছে। তার অত্যাচারের মাত্রা দিন দিন এতই বেড়ে যাচ্ছে যে, আজকাল নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়।

আমি রাতের অন্ধকার কে খুব একটা ভালোবাসি না। অন্ধকার আমার আরেক শত্রু। প্রচন্ড ভিতু টাইপ একটা ছেলে রাতে ঘুমানোর সময় লাইট অন করে ঘুমাই। আর হরর মুভির নাম শুনলেও কলিজা কেপে উঠে। এদিক দিয়ে অনু আবার অনেক সাহসী, একা একা ভুতের মুভি দেখা তার কাছে ডাউলভাত। রাতের খাবারের পর অনুর ভুতের মুভি দেখার সখ হলো। আজ সে আমাকে নিয়ে দেখতে চায়, কিন্তু আমি যে ভুতের ছবি একদম অপছন্দ করি এটা সে খুব ভালো করেই জানে। আমি যখন লাগাতার না বলে যাচ্ছিলাম সে ততই বেশি আমাকে জোর দিতে লাগলো। এক সময় আমাদের দুজনের ঝগড়ায় অতিষ্ট হয়ে ফুফু বললো ” তোরা থামতো সারাদিন সাপ বেজির মত লেগেই থাকিস। অর্নব তুই ঘরে যা, আর অনু তুই ছবি দেখবি তাইতো, আমি পাশের ফ্ল্যাটের ভাবির মেয়েকে ডেকে দিচ্ছি তাকে নিয়ে দেখ। ” অনুকে দেখে মনে হলোনা সে খুব বেশী খুশী হয়েছে, তারপরেও ফুফুর কথা মেনে নিলো। আমি রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে রইলাম।

কিছুক্ষন পর অনু হরর মুভি ফুল সাউন্ড দিয়ে ছেড়েছে যার শব্দ আমার বন্ধ দরজা ভেদ করে কানে আসতেছে। আর ভয়ানক সেই শব্দে আমার রমটে বার বার নাড়া দিয়ে উঠছিলো ভয়ে। আমি দরজা খুলে ডাইনিং রুমে গিয়ে ঝাঁঝালো গলায় অনুকে বলতে লাগলাম “আরে বদ সাউন্ড কি কম দেওয়া যায়না। ” আমার কথা শুনে ভিসিয়ার এর গিডিও বন্ধ করে ঘুরে তাকালো “তোর সমস্যা কি আমি সাউন্ড কম দেই বা বেশী দেই।” অনুর সাথে তার পাশে বসা মেয়েটি ঘুরে তাকালো, আমার কানে অনুর শব্দ আসলেও চোখ দুটো অবাক হয়ে মেয়েটিকে দেখে যাচ্ছিলো। এমন সুন্দরী মেয়ে আমি কমই দেখেছি। বড়বড় চোখ লম্বা চুল।

কানে ঝুমকা ঝুলতেছে হাতে নতুন রাংগা মেহেদির রঙ ফুটে উঠেছে। অনুর কথায় কান না দিয়ে আমি তার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। কিছুক্ষন পর অনুর শব্দ আমার কানে আসতেছিলো না আর তার দিকে আমার নজর ও নেই। আমার নজর মেয়েটির দিকে পড়ে আছে। আমার এমন অবস্থা দেখে অনু উঠে এসে আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলতে লাগলো “কি হইছে কি সমস্যা তোর বল, আর কি দেখোস তুই হা করে?” তার ধাক্কায় আমার ধ্যানভঙ্গ হয়ে গেলে আমি যত্রতত্র নিজেকে সামলিয়ে নেবার চেষ্টা করলাম, আর বলতে লাগলাম “কিছু না, ছবির নায়িকাটা বেশ সুন্দর তাই তাকিয়ে ছিলাম” অনু যেন আকাশ থেকে পড়লো, আমার কথা শুনে। স্ক্রিনে নায়িকার ছবি নয় ভুতনির ছবি ভেসে ছিলো, আর এটা আমার কাছে নাকি অপুর্ব। অনু তখন বলতে লাগলো “তুই কি দেখেছিস স্ক্রিনে কি রয়েছে” আমি অনুর কথা শুনে স্ক্রিনে তাকিয়ে ভড়কে গেলাম।

চোখ বন্ধ করে অন্যমুখী হয়ে অনুকে বলতে লাগলাম “তুই সিন চেঞ্জ করেছিস কেন? ” অনু রাগী মেজাজে বলতে লাগলো “তোকে মাইরা ভুত বানাই ফালামু, শুরু থেকে এই ছবিই আছে। ভিতু জানি কোথাকার, তুই এত ভিতু যে তোকে আমার ভাই বলতে লজ্জা করে” আমিও একটু ক্ষেপে বলতে লাগলাম “হ্যা ভাই বলতে লজ্জা করে তো আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা নিতে লজ্জা করেনা” আমাদের ঝগড়া দেখে মেয়েটি হাসিতে লুটিয়ে পড়লো। তার হাসির শব্দে পুরো ঘরে যেন আনন্দের বৃষ্টি হতে শুরু করেছে। দুই ঠোটের ফাক দিয়ে মাঝে মাঝে সাদাদাত গুলো বিদ্যুৎ চমকানোর মত আলোকিত হয়ে উঠতেছে। হাসতে হাসতেই বলতে লাগলো মেয়েটি “আপনারা ভাইবোন কি সাপ বেঁজীর মত লেগেই থাকেন?” আমি কিছু বলার আগেই অনু বলে উঠলো “কে ভাই এ আমার ভাইনা। বাবা এতিমখানা থেকে নিয়ে এসেছিলো আমার দুর্ভাগ্য যে একটা হনুমানকে আমার ভাই বলতে হয়।

” অনুর কথা শুনে মেজাজ এখন আকাশ ছোঁয়া, তার এক হাত ধরে মচকে ধরলাম খানিকটা আর বলতে লাগলাম “দেবো নাকি হাত ভেংগে? বড় ভাইয়ের সাথে বেয়াদবি করিস।” অনু যতটুকু না ব্যাথা পেয়েছিলো তার চেয়ে দ্বিগুন জোরে চিৎকার দিলো, তার চিৎকার শুন্র ফুফাফুফু ঘর থেকে হরবরিয়ে বের হয়ে আসলো। ফুফু এসেই আমার পিঠে তাল ভাঙলেন ঠাসঠাস করে। আমি অনুর হাত ছেড়ে দিলাম ফুফু আমাকে বলতে লাগলো “বড় হয়ে ছোট বোনের গায়ে হাত তুলতে লজ্জা লাগেনা” আমি খানিকটা নিচু স্বরে বলতে লাগলাম “আপনি যদি এই বদমাইশ এর ভাই হইতেন তাইলে বুঝতেন কত বড় পেইন এইটা একটা। আমাকে বলে আমাকে নাকি বাবা এতিমখানা থেকে নিয়ে আসছে” আমার কথা শুনে ফুফুও হাসিতে মেতে উঠলেন। আর বলতে লাগলেন “আল্লাহর ওয়াস্তে দুইজন একটু শান্তিতে থাক। রাত অনেক হইছে ছবি দেখা লাগবে না যাহ গিয়ে ঘুমা। ”

ফুফুর কথা শুনে আমি আমার রুমে চলে গেলাম। বিছানায় গড়াগড়ি করছি কিন্তু ঘুম আসেনা। বার বার মেয়েটির মুখ আমার সামনে ভেসে উঠতেছে। যেমন তেমন করে রাত কাটালাম। ঘুম থেকে উঠতে উঠতে দশটা বেজে গেছে, উঠেই ছাদে গেলাম। অনেকক্ষণ ছাদে এইভেবে কাটালাম মেয়েটা হয়ত আসবে তার সাথে একটু কথা বলা যাবে। কপাল খারাপ হলে নাকি বর্ষাকালেও বৃষ্টি নসিব হয়না। আমার অবস্থা তেমনি, কিন্তু একটি রাস্তা আছে মেয়েটির সাথে কথা বলার, আর তা হচ্ছে অনু। অনুর কথা মনে আসতেই নিচে চলে গেলাম, ফুফুর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম “ফুফু অনু কই গেছে?” ফুফু ঘরের কাজ করতে করতে উত্তর দিলেন “অনু পাশের ফ্ল্যাটে গেছে”। আমি আর ফুফুকে কিছু জিজ্ঞেস করলাম অনুর মোবাইল এ ফোন দিলাম, সে রিসিব করেই বললো “কি হইছে?” আমি শান্ত সুরেই বললাম “তোকে দেখছিলাম না তাই ভাবলাম একবার ফোন দেই”।

০- আহারে দরদ একেবারে উলটাই পড়তাছে দেখি বোনের জন্য।
— আমি তো তোর ভাই তাইনা?
০- বল কেন ফোন দিছিস?
— তুই কই আছিস জানার জন্য।
০- পাশের ফ্ল্যাটের আপুর সাথে গল্প করতেছি।
— ওখানে কেন আছিস, তাকে নিয়ে বাসায় আয়, সবাই মিলে গল্প করা যাবে।
০- তোর মতলব আমি কালরাতেই বুঝছিলাম। আর এখন আমাকে ফোন দিছিস নিজের স্বার্থ আমারে দিয়া হাসিল করতে।

— আরে নাহ নাহ কোন মতলব নাই এমনি বলছিলাম আর আকি। “অকে রাখ বায়” কথাটি বলে অনু ফোন কেটে দিলো আমার কথা আমার মুখেই রয়েগেলো। মেজাজ টাও খারাপ হয়ে রইলো, আচ্ছা মেয়ে মানুষ একটু কম বুঝলে কি ক্ষতি হয়। এত কেন বুঝে এরা। যাক কপালের দোষ দিতে দিতে রুমে গিয়ে শুয়ে রইলাম।

কিছুক্ষন পর অনুর কন্ঠের শব্দ শুনতে পারলাম। উঠে ডাইনিং রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম, সে মেয়েটিকে নিয়ে এসেছে আমাদের বাসায়। বোন যেমনি হোক ভাইয়ের কথা এরা খুব সহজেই বুঝতে পারে আমাকে একবার চোখের ইশারায় অনু মেয়েটিকে দেখিয়ে মুচকি হেসে দিলো। আমিও হেসে দিলাম, তারপর তাদের সাথে গল্প করতে চলে গেলাম।

কথায় কথায় মেয়েটির পুরো জীবন বৃত্তান্ত জেনে নিলাম। নাম আফরিন, পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি তে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং করতেছে। সেদিন এর পর থেকে কখনো বাসায় কখনো ছাদে তার সাথে কথা হতো আমার। দেখতে দেখতে ১০ দিন কিভাবে কেটে গেলো খবরই পেলাম না। এখন আবার অনুর বায়না সে ঢাকায় চলে আসবে। আমার আবার ঢাকায় যেতে ইচ্ছে করছেনা। মন বড় আজব প্রানী কখন কি চায় কেউ বলতে পারেনা, এইতো কিছুদিন আগেও আমার চিটাগাং আসার ইচ্ছে ছিলোনা। কিন্তু এখন চিটাগাংই যেন আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হয়ে আছে। আমি আর অনু ব্যাগ গুছিয়ে চলে বাসা থেকে বের হলাম। ফুফু এর সাথে আফরিন ও এসেছে হানিফ পরিবহনের কাউন্টার পর্যন্ত।

সুযোগ পাচ্ছিলাম আফরিনের নাম্বার নেবার, তাই একটি কাগজে লিখে ময়লার মত ছুড়ে ফেললাম তার পায়ের কাছে। আর চোখের ইশারায় জানিয়ে দিলাম তা নেবার জন্য। তখন সে তার হাতের নোকিয়া মোবাইল ইচ্ছে করে মাটিতে ফেলে দিলো। মোবাইলের সাথে কাগজটিও তুলে নিলো সবার অগোচরে। বাসের সময় হয়ে এসেছে আমরা বাসে উঠে বসলাম তখন তারা চলে গেলো। আমার মাথায় একটা থাপ্পড় দিয়ে অনু বলতে লাগলো “নাম্বার দেওয়ার পদ্ধতি তো ভালোই শিখেছিস” আমি তখন অনুকে বললাম “ছোট মানুষ বেশি বুঝবি না বসে থাক” সে আমাকে প্রতিউত্তর দিলো “এই কথা তাইলে চল আগে ঢাকায় চল। তোরে মজা বুঝাবো” তারপর আমি আর তার সাথে তর্ক করলাম না। কারন অনুকে দিয়ে কোন ভরসা নেই, কখন যে কি করে বসবে আল্লাহ মাবুদ জানে। আমি চুপচাপ সিটে বসে রইলাম ইতিমধ্যে গাড়ি ছেড়ে দিলো।

তারপর প্রতিদিন আফরিনের সাথে কথা হতে লাগলো। বছর খানেক সাধারণ কথা বলার পর আমাদের মাঝে প্রেমের সম্পর্ক হয়। আর সেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য খাজনা দিতে হয় অনুকে। এভাবেই কেটে গেলো আরো দুটি বছর। আফরিন গ্রাজুয়েশন শেষ করেছে। তার বিয়ের জন্য বাসায় চাপাচাপি চলছে, আমি তখন ছোট একটি প্রাইভেট জব করি। বাবা মাও আমার বিয়ের কথা ভেবে চলছেন হরগোল। কিন্তু আফরিনের কথা তাদের জানাইতে পারতেছিলাম না।

আমার দুর্বলতার কারনে যা করতে পারতেছিলাম না। সেই সুযোগ অনু নিতে ভুল করেনি, অনু আমাকে খুব সুন্দর করে বুঝালো সে চিটাগাং যাবে। ফুফুকে দিয়ে আফরিনের কথা বাবা মা কে জানাবে। তার কথায় যেন প্রান ফিরে পেলাম। তাকে নিজের টাকায় চিটাগাং পাঠালাম, সাথে নগদ টাকাও দিয়ে দিলাম। সে চিটাগাং গিয়ে আমাকে যা বলেছিলো করলো তার উলটো, ফুফুকে দিয়ে বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব তো পাঠালো, কিন্তু আফরিনের না। সেই বাড়িতেই নিচতলায় আরেকটি মেয়ে থাকতো সে মেয়ের নাম আফসানা। এটা সম্পুর্নই অনুর ফাজলামি ছিলো, সে সব কিছুই ঠিক বলেছে কিন্তু আফরিনের নামের জায়গায় শুধু আফসানা নাম দিয়ে পুরো গেইম টাই পালটে দিয়েছে। ফুফু বাবাকে ফোন দিয়ে আমার আর আফসানার কথা জানালো, বাবা আফসানা কে দেখতে চাইলে সে আফসানার ছবি পাঠায়।

বাবা আমাকে কিছু না জানিয়ে একদিন বললো আমরা সবাই চিটাগাং যাচ্ছি। বাবার ভাবভঙ্গি আমার বুঝতে বাকিনাই। আমি তো মহাখুশি ছিলাম আমার পছন্দের মানুষের সাথে বিয়ে হবে ভেবে আমার আনন্দের শেষ ছিলোনা। কিন্তু চিটাগাং গিয়ে যখন আমি আফরিনের জায়গায় আফসানা কে দেখতে পেলাম তখন আমার মাথায় আকাশ ভেংগে পড়লো। আমি অনুকে জিজ্ঞেস করলাম সে এটা কেন করছে। তখন সে আমাকে জানায় “জীবনে তো একবারই বিয়া করবি, বিয়ের মত যদি বিয়ে না হয় তাইলে পোলা মাইয়ারে গল্প শোনাবা কি? এবার বাচাও তোমার ভালোবাসা দেখি কেমনে কি করো” বলে উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো। ইচ্ছে করতেছিলো ফাজিলটাকে দুই ঘন্টা পিটাই কিন্তু তাকে মারার থেকে এই ঝামেলা মেটাতে হবে আগে।

অপর দিকে জানতে পারলাম আফসানার একজনের সাথে রিলেশন আছে, আর এদিকে আফরিন আমার সাথে কোন কথা বলেনা। আর মাঝখানে অনু নাটক দেখতাছে। কি করা যায় কিছুতেই কিছু ভেবে পাচ্ছিলাম না। তারপর অনু আমাদের বললো “ভাইয়া সহজ বুদ্ধি তুমি আফরিন আপুকে নিয়ে পালিয়ে যাও” আমার মাথায় যা ঘুরতেছিলো তা হচ্ছে যেভাবেই হোক আফরিন কেই পেতে হবে আমার। আমার আর আফসানার বিয়ে যখন প্রায় সবাই ঠিক হয়ে যাচ্ছিলো, তখন আমি আর কোন রাস্তা না পেয়ে আফরিন কে বললাম “চলো পালিয়ে যাই” আফরিন আমাকে বললো “সে পালিয়ে বিয়ে করবে না” ধীরে ধীরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাহিরে চলে যাচ্ছে। আর আফরিক আমাকে হুমকি দিয়েই চলছে যদি আমি আফসানার সাথে এংগেজড করি সে তার বাবা মায়ের পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করে নিবে। তারপর আমার মাথায় ফন্দি আসলো আফরিন কে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবো ঢাকায়।

একদিন সকাল বেলা আফরিন কে বললাম চলো আমরা একটু ঘুরে আসি কোথাও থেকে। রাতের বেলা এক বন্ধুকে ফোন দিয়ে প্রাইভেট গাড়ির ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম। অনেক কষ্টে আফরিন কে রাজি করালাম বের হবার জন্য। আমাদের প্ল্যান অনুযায়ী আমি গাড়িকে জিএসসি চত্তর এর উলটো দিকের মার্কেটের সামনে থাকতে বলেছিলাম। কিছুক্ষন মার্কেটে ঘোরাঘুরি করে দুজনে বাহিরে আসলাম, আমি পিপাসা পেয়েছে বলে দোকান থেকে কোক কিনলাম এবং তাতে কয়েকটা ঘুমের ট্যাবলেট মিশিয়ে দিলাম। এসে আফরিন এর কাছে কোকের বোতল দিলাম সে কোন কিছু না ভেবেই ঢকঢক করে অনেক টুকু খেয়ে নিলো।

প্রায় ১০ মিনিট পর আফরিন বাসায় যেতে চাইলো তার নাকি মাথা ঘুরতেছে। বুঝতে পারলাম ওষুধের এফেক্ট এটা। আমি আমার বন্ধুকে ইশারা দিয়ে ডাকলাম। আফরিন আগে থেকেই তাকে চিনতো আফরিনের সাথে একবার দেখা করিয়েছিলাম তার সাথে। আফরিন কে তার গাড়িতে বসতে বললে সে কোন কিছু না ভেবেই বসে যায়। গাড়ি ১০ মিনিট চলতেই আফরিন ঘুমে তলিয়ে যায়। আর গাড়ি সোজা ঢাকা রোড ধরে ঢাকা আমার বাসার সামনে এসে থামে। বাবা মা সবাই চিটাগাং এ ছিলো, তারপর আমি বাবাকে ফোন দিয়ে সব কথা জানাই। বাবা ফোনেত মধ্যেই আমাকে উত্তমমধ্যম দিলো অনেক। তারপর তিন পরিবার মিলে সবকিছু রাতের মধ্যেই সুরাহা করলো, আর অনুকেও বেশ বোকাঝকা করলো।

তারপর আমার আর আফরিন এর বিয়ে পারিবারিক সম্মতিতেই হয়। কিন্তু আফরিন সেদিনের ঐ কাজের জন্য আমার উপর প্রচণ্ড রাগ। উনিশের থেকে বিশ হলেই আমাকে শুনতে হয় আমি তাকে কিডন্যাপ করে বিয়ে করেছি।

আমাদের বিয়ের বছর দুই হলো। আমাদের কোল জুড়ে ছোট এক ফুটফুটে মেয়েও রয়েছে। আজ আমার সেই পাগলী বোন অনুর বিয়ে। মাঝে মাঝে ভাবি এই পাগলী বিয়ে করে অন্যের বাসায় চলে গেলে আমি থাকবো কি করে। এখনও বরপক্ষ আসেনি তাই অনুর পুরানো গল্প কথা আমার আর আফরিনের বিয়ের কথা বলছিলাম সবাইকে সময় কাটানোর জন্য। ইতিমধ্যে বরপক্ষ চলে আসলো। আমার বোনকে বউ সাজিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। বিয়ের সমস্ত কাজ ভালোমতোই শেষ হলো। এক সময় অনু সবার থেকে বিদায় নিয়ে নতুন জীবনে অগ্রসর হলো। সে চলে যাবার আগ মুহুর্ত আমার মনেতে শুধু কষ্ট পাবার ভয় ছিলো। যখন সে চলে গেলো বুকের ভিতর খাঁখাঁ করতে লাগলো।

সবার থেকে আড়ালে গিয়ে চোখের কোনে জমা জলের ফোটা মুছতে লাগলাম আফরিন আমাকে দেখে কাছে এসে বলতে লাগলো “বোন তো আর সারাজীবনের জন্য যায়নাই। কান্না করার কি আছে” আমি কিছু না বলে আফরিন কে জড়িয়ে ধরলাম আর বলতে লাগলাম “এই পাগলীটা না থাকলে ঘর কেমন জানি কবর কবর লাগে। সারাদিন ওর হাসি উল্লাস আর আমাকে জ্বালানোর স্মৃতি আমাকে ঠিকমত ঘুমাতেও দিবেনা। এমন আদুরী বোনকে ছেড়ে কোন ভাই থাকতে পারে বলো” আফরিন আমাকে শক্ত করে জরিয়ে ধরে বললো “সে তো আসবে আবার অযথা কেন এসব বলছো” আমি শুধু হুম বলে তাকে জড়িয়ে ধরে রইলাম।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত