“সম্পর্ক যখন জ্বরে পোড়ে তখন তার নাম হয় ভালোবাসা, আর ভালোবাসা যখন জ্বরে পোড়ে তার নাম হয় বন্ধুত্ব ।” এটা একটা প্রাচীন প্রবাদ। এখন হঠাৎ যদি প্রশ্ন করি , বন্ধুত্ব বা বন্ধু কি ? কি উত্তর হবে আপনার ? জানি ! হুট করে এর উত্তর দেয়াটা সহজ হবে না । অনেক কিছুই মনে হবে , অনেক কথা হৃদয়ে এলেও মুখে আসবে না। দার্শনিক এরিস্টটল বন্ধুত্বের সজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন , “দুটি দেহে একটি আত্মার অবস্থানই হলো বন্ধুত্ব। ”
সম্পর্কে যদি একজন আরেক জনকে আনন্দ দিতে পারে, খুশি রাখতে পারে, পারস্পরিক বোঝাপড়া ভালো হয় ; যদি সম্পর্কের কারণে জীবনের প্রতি ভালোলাগা গভীর হয় – তাহলে সেটা বন্ধুত্ব । ভালোবাসা, ভালোলাগা, সহযোগীতা, সহানুভূতি, সহমর্মিতা, সমবেদনা, স্নেহ , মমতা , সততা, পারস্পরিক বোঝাপড়া , আস্থা, একে অপরের সঙ্গ, অনুভূতি প্রকাশ, রাগ, অভিমান – এই ধরনের বৈশিষ্ট্য বন্ধুত্বের অন্তর্ভুক্ত । আর এই বন্ধুত্বে যদি শ্রদ্ধা আর বিশ্বাস বজায় রাখা যায় তাহলে সম্পর্কটা গভীর হতে বাধ্য।
এই বন্ধুত্বের সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা বস্তুই হলো বন্ধু। বন্ধু শব্দটি যতই ছোট হোক এর গভীরতা অনেক বেশি , যার কোন পরিমাপ হয় না সেই সাথে বন্ধুত্বের কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞা হয় না। এটা একেক জনের নিকট একেক রকম। এ সম্পর্ক আত্মীয়তার নয়, আত্মার । ফরাসি কবি জ্যাক দেলিল বলেছেন ” নিয়তি তোমার আত্মীয় বেছে দেয় আর তুমি তোমার বন্ধু। ” বন্ধু মানে বন্ধু। এমন মনে হতে পারে, বন্ধুর কোনো মানে নেই ! এর চেয়ে ভাল কিছু নেই।সত্যিকার অর্থে তা নেই। মাঝে মাঝে মনে হয় বন্ধুর কোনো নামও নেই। তাহলে কি নাম-অর্থ হীন মানুষগুলাই বন্ধু?
হ্যা। এজন্যই বন্ধুর সাথে অকপটে সব হৃদয়ের কথা- তা ভালো মন্দ যত খারাপই হোক আর গোপনীয়ই হোক, নির্দ্বিধায় বলা যায়। আর বন্ধুর সবকিছু সর্বদা গোপন রাখা প্রকৃত বন্ধুর পরিচয়। যে রাখতে জানে না, পারে না – সে বন্ধু হতে পারে না । বন্ধুত্বে গোপনীয়তা রক্ষার কথা বলতে গিয়ে চার্লস হেনরি ওয়েব লিখেছেন, ” বন্ধুর গোপনীয়তা রক্ষা করে না চললে , বন্ধুত্ব টিকে না। ”
সত্যিকার অর্থে এটা সত্য। আমি একজন কে জানতাম স্কুল জীবনে । যাকে কেউ বিশ্বাস করতো না। বাহ্যিক ভাবে তার সাথে সবাই সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখলেও তাকে পছন্দ করতো না কেউই। কোন গোপন বিষয়ে কথা হচ্ছে , কাউকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে – ওকে দেখলেই সকলে চুপ হয়ে যেত। ওর সঙ্গ চাইতো না কেউ , এড়িয়ে চলতো। ও কোন কিছু চেপে যেতে পারতো না – হাটে হাড়ি ভাঙতোই! তার এই হাটে হাড়ি ভাঙা স্বভাবের কারনেই সে নিঃসঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। জীবনে চলার পথে বিভিন্ন ধরনের বন্ধু হতে পারে । কেউ নামের বন্ধু, কেউ প্রকৃত বন্ধু। নামের বন্ধু বলতে বসন্তের কোকিল পর্যায়ের বন্ধু। সে বন্ধু গ্রীষ্ম পর্যন্ত গান শোনালেও শোনাতে পারে!
নিজের বিপদ হবে জেনেও যে বন্ধু, বন্ধুর বিপদে পাশে এসে দাঁড়ায়, সহযোগীতা করে, শান্তনা দেয় সে হচ্ছে প্রকৃত বন্ধু । এমন বন্ধু জীবনে খুব কম হবে এটা স্বাভাবিক। অবশ্য কবি গুরু বলেই দিয়েছেন, ” আমরা বন্ধুর কাছ থেকে মমতা চাই, সমবেদনা চাই, সাহায্য চাই ও সেই জন্যই বন্ধুকে চাই। ” তবে এমনটা নয় প্রকৃত বন্ধু হতে হলে নিজের বিপদ হবে জেনেও বন্ধুর বিপদে পাশে এসে দাড়ানো বা শুধু সহায়ক বা উপকারী ব্যক্তি হতে হবে। বরং বন্ধুত্বে বেশি প্রত্যাশা থাকা উচিত নয় ।
এজন্যই সম্ভবত হেনরি ডেভিড থিওরো লিখে গেছেন, “আমার বন্ধুর জন্যে সবচেয়ে বেশি যা করতে পারি তা হলে শুধু বন্ধু হয়ে থাকা। তাকে দেয়ার মতো কোন সম্পদ আমার নেই। সে যদি জানে যে আমি তাকে ভালবেসেই সুখী, সে আর কোন পুরস্কারই চাইবে না। এক্ষেত্রে বন্ধুত্ব কি স্বর্গীয় নয়?”। তাছাড়া আমরা অনেকেই মনে করি বন্ধুত্ব মানে শুধু সহায়ক উপকারী কোন ব্যক্তি ! আসলে বন্ধুত্ব মানে কি তাই ?
এ জাগতিক জীবনে আল্লাহর দেয়া একটা সেরা নেয়ামত হলো প্রকৃত বন্ধু। আলহামদুলিল্লাহ, আমি আমার জীবনে এমন বন্ধু বেশ ক’জন পেয়েছি। আমাদের সম্পর্কে প্রত্যাশার চেয়ে আন্তরিকতা বেশি। বন্ধুত্বে আন্তরিকতা ও শ্রদ্ধাবোধ থাকলে সস্পর্ক গভীর হতে বাধ্য। সামাজিক জীব হিসাবে আমাদের চলার পথে জীবনকে সুন্দর সুখী ও সাবলীল করতে আসা এই বন্ধুত্ব বিভিন্ন ভাবে হতে পারে। কিছু বন্ধুত্ব হয় একই ধরনের শখ বা পছন্দের স্থান হতে।
আমি কিছুটা সৌখিন! ফুলের বাগান আর পাখি পালন আমার সখ। বাড়িতে কিছু কবুতর আছে। এই কবুতরের সৌজন্যে বেশ কিছু ছেলের সাথে বেশ দহরমমহরম সম্পর্ক আমার । সখ ও পছন্দের স্থান হতে আমাদের বন্ধৃত্বের সৃষ্টি হয়েছে। আবার দেখা যায় পছন্দের মিল নেই, চিন্তাজগত ভিন্ন অথচ তারা বন্ধু ।
আমি মুসলিম। একটা ছেলে আছে সে হিন্দু । আমার পছন্দ হলো গরুর মাংস। শুধু পছন্দ বললে কম বলা হবে, বলতে হয় গরুর মাংস ছাড়া অন্য কোন পশু পাখির মাংস খাই না। ওর ব্যাপার পুরোটাই উল্টো , সে খাসির মাংস ছাড়া অন্য পশু পাখির মাংস খায় না। আমার বই পড়া – বাগান করা সখ হলেও এসব ওর ভাল্লাগেনা ! যেখানে আমি মেয়েদের এড়িয়ে চলি, ও মেয়েদের কাছে অতি পরিচিত একটা মানুষ। আমার অপছন্দের তালিকায় প্রেম সবার শীর্ষে থাকলেও সে প্রেমিক পুরুষ। অথচ আমরা দুজন খুব ভালো বন্ধু।
অনেকেই একসঙ্গে বড় হয়েছে এজন্য তারা বন্ধু। একই পেশায় নিয়োজিত আছে এজন্যও বন্ধু হতে পারে। আর আছে কলমি বন্ধু বা চিঠির বন্ধু। যুগের সাথে এ কলমি বন্ধুত্বেরও পরিবর্তন এসেছে । এখন ইন্টার্নেটের যুগ। সবার আনাগোনা ভার্চুয়াল জগতে- ফেসবুক, টুইটার, টিকটক, ইমো, হোয়াটস্ আপে। এখনকার এ বন্ধুত্ব মূলত ভার্চুয়াল কেন্দ্রিক – ভার্চুয়াল বন্ধু।
আমার ভার্চুয়াল বন্ধুর সংখ্যা খুবই কম। এই অল্প কজন এর মধ্যে আবার দু একজনের সাথে সম্পর্কটা বেশ ভালো। সেই দু একজনের তালিকায় একটা মেয়ে আছে। যদিও তার সম্পর্কে খুব বেশি জানি না, জানতেও চাই না। ব্যস্ততম সময়েও যদি কিছুক্ষণের জন্য ফেসবুকে আসি উনি আমার ভালো-মন্দের খোজ নেন , আমি ওনার ভালো-মন্দ সম্পর্কে জানতে চাই। যেখানে আমার স্কুল কলেজ জীবনের বন্ধুরা আমার ইনবক্সে ভুলেও নক করে না, খোজ নেয় না, সেখানে একজন অপরিচিত মানুষের নিয়মিত ভার্চুয়াল কথোপকথনই ভালো বন্ধুত্বের নিদর্শন।
সর্বোপরি, প্রত্যেক মানুষের জীবনে সবচেয়ে ভালো, প্রকৃত বন্ধু তার পিতা মাতা , শিক্ষক, ভাই বোন, স্বামী/স্ত্রী। যাঁদের জন্য জীবন সুখী সুন্দর ও বাস্তবমুখী হয়ে ওঠে, আমরা সাফল্য লাভ করি জাগতিক কর্মমুখী জীবনে। তাঁদের ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা, দিকনির্দেশনা আমাদের উৎসাহীত, অনুপ্রাণিত করে এগিয়ে চলার পথে।
সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে আমাদের জীবনে বন্ধুত্বের প্রয়োজনীয়তা আবশ্যিক। সে জন্যই আমাদের সবারই কমবেশি ভালো-মন্দ বন্ধু রয়েছে । এই বন্ধুদের মধ্যে দু এক জন থাকে যাদেরকে আমরা বেস্ট ফ্রেন্ড বলে থাকি । এখন আমি জানতে চাচ্ছি- আপনার জীবনে আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড কে? আপনার ভাবনায় বন্ধু মানে কি ? আপনাদের কার কাছে বন্ধুত্বের সংজ্ঞা কি? এই সম্পর্কটা সম্পর্কে আপনাদের ভাবনা কি?