নীরা অশ্রু চোখে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।ফাতেমা বেগম কি বলবেন ভেবে পাচ্ছে না।রাহুল সাহেব নীরাকে ভেতরে আসতে বলে জাহিদের রুমে গেলো। ছেলেটা গভীর ঘুমে মগ্ন।দুনিয়ার সাথে আপাতত কোন যোগাযোগ নেই।এদিকে সকাল ঘনিয়ে দুপুর বয়ে এসেছে। রাহুল সাহেব রেগে জাহিদের কান ধরে টেনে তুলে বললেন “এটাকে কেমন ঘুম বলে?” জাহিদ কিছু বুঝতে পারলো না।রাত থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘুমানো তাঁর প্রতিদিনকার রুটিন।কিন্তু বাবা আজ এমন আচরণ করছে কেন কে জানে।”বাবা আর একটু ঘুমাই প্লিজ।”
রাহুল সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে বললেন “তোর ঘুম আমি ছুটাচ্ছি।নীরা কে?” নীরা নামটা শুনে জাহিদ এক লাফে উঠে গেলো।এই নাম সচরাচর বাসার কেউ জানার কথা না। “নীরা কে আমি কিভাবে বলবো?” রাহুল সাহেব চোখ গরম করে বললেন “সোফার রুমে চল।তোর সাথে কথা আছে।” জাহিদ বুক উঁচু করে সোফার রুমে প্রবেশ করে দেখে নীরা বসে আছে।পাশে মা বসা।বিষয়টা যে কোন ছেলের কাছে শকিং। ফাতেমা বেগম জাহিদকে দেখে বললেন “তোর কাছ থেকে এরকম কিছু আশা করিনি।” জাহিদ ভাবতে লাগলো সে কি এমন মহা পাপ করেছে।ভাবনার জগতে একে একে পাপ গুলো ভেসে উঠতে লাগলো।নাহ্ আর ভাবা যাবে না।
নীরা কান্নার বেগ বাড়িয়ে দিয়ে বললো “আন্টি আমি যদি জানতাম ও আমার সাথে প্রতারণা করবে তাহলে কখনও প্রেম করতাম না।কি এমন দোষ ছিলো আমার?প্রতিদিন পেছন পেছন ঘুরতো।প্রেম করতে চাইতাম না বলে সুইসাইড করার ভয় দেখাতো।পরে ভেবে দেখলাম ছেলেটা সত্যি আমাকে ভালবাসে।কিন্তু আমি ভুল ছিলাম।ও আর পাঁচটা ছেলের মতন টাইম পাস করতে এসেছিলো।বিষয়টা টাইম পাস পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলেও মেনে নিতাম।ও আমার সব শেষ করে দিছে আন্টি।রিক্সায় মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে হাত ধরছে।এরপর ফাতেমা বেগম নীরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন “থাক মা থাক।আমি বুঝতে পারছি।ও এতটা বিগড়ে গেছে জানা ছিলো না।”
জাহিদ হতভম্ব হয়ে একবার নীরার দিকে তাকাচ্ছে আর একবার ফাতেমা বেগমের দিকে তাকাচ্ছে।এই পরিস্থিতিতে কি কথা বলা ঠিক হবে? নীরা মিথ্যা বলছে না।আবার সত্যিও বলছে না।কারণ ব্রেকয়াপটা নীরাই করেছিলো। এরমধ্যে পাশ থেকে রাহুল সাহেব বললেন “যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে।এখন কি বা করার।তোমার বাসায় কে কে আছে মা?” নীরা চোখ মুছে বললো “শুধু বাবা আছেন।” ফাতেমা বেগম ছলছল চোখে জিজ্ঞাসা করলেন “আর মা?” নীরা মাথা নিচু করে জবাব দিলো “মা নেই আন্টি।জন্মে সময় ফাতেমা বেগম কোমল শুরে বললেন “আহারে মা ছাড়া মেয়েটা।তুমি কষ্ট পেওনা মামনি।আজ থেকে আমি তোমার মা।”
জাহিদ ধৈর্যের বাত ধরে রাখতে না পেরে চিল্লায়ে বললো “কি শুরু করছো তোমরা?এই মেয়ে কত ফাজিল জানো?একটা সেকেন্ড শান্তি দেয় না।সারাক্ষণ প্যারার মধ্যে রাখে।আর তারে মা মামনি বানায় ফেলতেছো।” রাহুল সাহেব জাহিদের কান ধরে বললেন “গলা নামিয়ে কথা বল।একে তো ভুল করছিস তার ওপরে চিল্লাচ্ছিস।” ফাতেমা বেগম রাহুল সাহেবের উদ্দেশ্যে বললেন “সব তোমার জন্য।ছেলে যখন যা চাইছে দিছো।বলছিলাম এত মাথায় তুলো না।এখন ঠেলা সামলাও।”
নীরা নাক টেনে বললো “আপনারা নিজেদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি কইরেন না প্লিজ।আমি বাসায় চলে যাচ্ছি।সরি আপনাদের ডিস্টার্ব করার জন্য।” জাহিদ দাত সবগুলো বের করে বললো “আমি ড্রপ করে দিবো?” ফাতেমা বেগম জাহিদকে ধোমক দিয়ে নীরার উদ্দেশ্যে বললেন “তুমি বাসায় গিয়ে কি করবা মামনি?আমি মেয়ে, আমি বুঝি তোমার কেমন লাগছে।কোন চিন্তা করো না।তোমার বাবার সাথে আমি কথা বলবো।”নীরা নিচু স্বরে বললো “না আন্টি।জাহিদ পরে আমাকে বকা দিবে।” রাহুল সাহেব বললেন “ও কিছু বললে সোজা আমাকে বলবা।তারপর দেখবো কি করা যায়।” জাহিদ নিরীহ দৃষ্টিতে নীরার দিকে তাকালো।একজন মানুষ এত শান্তশিষ্ট নম্র ভদ্র হয় কিভাবে?সে তো এর আগে কখনও দেখেনি।
নীরা জাহিদের তাকানো দেখে বললো “দেখছে আংকেল আমার দিকে কিভাবে তাকাচ্ছে?” জাহিদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চোখ সরিয়ে এমন ভাব করলো যেন সে কিছু শুনেইনি। রাহুল সাহেব জাহিদের দিকে এক নজর তাকিয়ে নীরাকে বললো “তোমার বাবার নাম্বার দাও।আমি কথা বলে দেখি কি করা যায়।” নীরা সেল ফোন বের করে সুরসুরিয়ে নম্বর দিয়ে দিলো। ফাতেমা বেগম নীরার চোখ মুছে দিয়ে বললেন “সকালে নাস্তা করেছো মামনী?” নীরা না সূচক মাথা নাড়লো। ফাতেমা বেগম জাহিদের দিকে তাকিয়ে বললেন “যা ফ্রেশ হয়ে আয়।একসাথে নাস্তা করবি।” জাহিদ হ্যা না কিছু বলার সাহস পেলো না।
নীরা আস্তে করে বললো “বেসিং কোথায় আম্মু?আমারও ফ্রেশ হওয়া দরকার।” নীরার মুখে মা ডাক শুনে ফাতেমা বেগম মুগ্ধ হয়ে গেলেন।অনেক দিনের স্বপ্ন যেন আজ পূর্ণ হয়েছে। জাহিদের বাবা এবং নীরার বাবা একসাথে বসে কথা বলছেন।দুজনের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে দুজনের মধ্যে দারুণ জমেছে। জাহিদ বার বার উঁকি দিয়ে তাই দেখে আতংকে পড়ে গেলো।এই মেয়ে নিজেকে যতটা সাধু প্রমাণ করতে চাচ্ছে আসলে ততটা সাধু না।হ্যা, জাহিদকে অনেক ভালবাসে কিন্তু সবসময় প্যারাও দেয়।সকাল ৮টার মধ্যে ঘুম থেকে না উঠলে ব্রেকয়াপ।দুপুরে ঠিকঠাক না খেলে ব্রেকয়াপ।না বলে কোথাও গেলে ব্রেকয়াপ।ফেসবুকে ভুলেও কোন মেয়ের ছবিতে লাইক দিলে ব্রেকয়াপ।
বন্ধুদের সাথে বেশি আড্ডা দিলে ব্রেকয়াপ।মোট কথা একটু এদিকওদিক হলেই ব্রেকয়াপ।স্বাধীন জীবনটা সম্পূর্ণ পরাধীন করে রেখে দিয়েছে। তাই ১৭৯০ তম ব্রেকয়াপের সময় জাহিদ নিজে থেকে প্যাচয়াপ করেনি।কিন্তু এই একটা ভুলের মাশুল যে এভাবে চুকাতে হবে তা কে জানতো? এদিকে নীরা খুশিতে আন্তহারা।প্রিয় মানুষকে নিজের করে পাওয়ার মধ্যে যে আনন্দ তা খুব কম মানুষ অনুভব করতে পারে। জাহিদ বিয়েটা ভাঙ্গার হাজার উপায় ভেবে অবশেষে কোন কূল না পেয়ে নীরার উদ্দেশ্যে বললো “তুমি সবকিছু আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে করে ফেলছো না?” নীরা হাসি মুখে বললো “হুম তো?”
– তো আবার কি?বিয়ের পর পস্তাবা।
– কে পস্তায় দেখা যাবে।
– জাস্ট গো টু হেল।
– ইউ গো টু হেল।
– আজাইরা মাইয়া।
– ফালতু পোলা।
– হুর।
– ধুর।
– যাও।
– ভাগো।
– ননসেন্স।
– ওই বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু?
– বেশি হলে কি করবা?বিয়ে ভেঙ্গে দিবা?দাও…
– উঁহু চান্দু।রিক্সায় বসে খুব পাপ্পি পাপ্পি করো না?এখন তো বেডরুমে থাকবো।আইসো কিছু করতে।
– দুনিয়ায় মেয়ের অভাব আছে?
– যাও।মানা করছে কে!
জাহিদ ভেবে পাচ্ছে না কি করবে।নীরাকেও যে সে অনেক বেশি ভালবাসে।সুতরাং অহেতুক ঝগড়া করে সময় নষ্ট করা লস।
– ওই।
– কি?
– সরি।
– ফর হোয়াট?
– দুদিন তোমার সাথে কথা বলিনি বলে।
– আমি এর জন্য রাগ করিনি।
– তাহলে?
– তুই আমার বান্ধবীর সাথে কথা বললি কেন?
– কথা বললাম কই?জাস্ট তোমার সম্পর্কে জানতে চাইছিলাম।
– কেন?সন্দেহ করিস?
– সরি।
– একটু আগে অনেক ভাব নিছিস।
– সরি।আর হবে না।
– হাহ্।
– সরি জান।
– এই দুই দিন কোথায় ছিলো তোর সরি?একবারও ফোন দিয়ে খোঁজ খবর নিছিস?
– নেক্সটে এমন হবে না।যদি হয় তাহলে ছেড়ে চলে যাইও।
– বিয়ের পর কোথায় যাবো?
– ভুল হলে তো যাবা।ভুলই হবে না।
– আচ্ছা ঠিক আছে।
– এখন একটু কাছে আসো।
– হুম বলো।
– আদর করি?
– হি হি হি।ওকে।
জাহিদ দেরি না করে নীরাকে বুকে জড়িয়ে নিলো।নীরা ভালবাসার মায়াবী ছোঁয়ায় অজানা এক ঘোরে হারিয়ে গেছে।
সব ছেলে সব মেয়েদের মাঝে ভালবাসা খুঁজে পায় না।আবার সব মেয়ে সব ছেলের মাঝে ভালবাসা খুঁজে পায় না।এটা সম্পূর্ণ বিধাতার হাতে।তিনি সবার জন্য স্পেশাল কাউকে সৃষ্টি করেছেন।