শীত শুরু হতে না হতেই বউয়ের ঠাণ্ডা লেগে গেলো। ঠাণ্ডা হলেই বউয়ের গলা ব্যথা শুরু হয়ে যায়। বললাম, ‘আসো তোমার গলা টিপে দেই দেখবে ভালো লাগবে।’ কথা শেষ হতেই বউ এমন কটমট করে কেন তাকালো বুঝলাম না। আজকাল দেখি কারো ভালো করার জন্য কিছু বলতেও নেই। বউ তেড়ে এসে বলল, ‘খুব শখ তাই না আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলার। তারপর আরেক বেটিকে বিয়ে করে ঘরে আনার ফন্দি। আমি বুঝি না মনে করছো এসব। ব্যাটা বুইড়া খাটাস একটা।’ ‘ধুর কি সব বলো না। আমি তো তোমার ভালোর জন্য ‘চুপ একদম চুপ। আসছেন উনি আমার গলা টিপে আমার ভালো করতে। পুরুষ মানুষের মতিগতি আমার চেনা আছে।’ ‘তোমার আসলে মনের মধ্যে কু।’ ‘আচ্ছা আচ্ছা আমার মনের মধ্যে কু। আর তোমার মনের মধ্যে সু।’ ‘তো না তো কি৷ তোমার মাথা ব্যথা করলে যদি আমি মাথা টিপে দিলে তুমি আরাম পাও তাহলে গলা টিপে দিলে কি সমস্যা।’ ‘চুপ একদম চুপ। ব্যাটা বুইড়া খাটাস।’
বউ গটগট করে চলে গেলো। এই দুনিয়ায় আসলে কারো ভালো চাইতে নাই। সেটা বউ হোক আর প্রেমিকাই হোক। বিয়ের আগে বউয়ের সাথে চুটিয়ে প্রেম করেছি। একদিন ওর অনেক মন খারাপ ছিল। জিগ্যেস করলাম কি হয়েছে। বলল, ওর গ্যালারির সব ছবি ডিলিট হয়ে গেছে কিভাবে যেন। তাই ভীষণ মন খারাপ। বললাম, ‘আরে ধুর পাগলী এতে মন খারাপের কি আছে। এটা কোনো কথা। আমার ফোনে গ্যালারি আছে না। সেটা তোমার ফোনে শেয়ার করে দেই। আমার গ্যালারিতে অনেক ছবি আছে। দাও ফোনটা দাও। এখনই শেয়ার করে দিচ্ছি। এই সামান্য ব্যাপারে কেউ মন খারাপ করে বোকা মেয়ে।’
আমার কথা শুনে আজকের মতোই সেদিনও কটমট করে তাকিয়েছিল। এই একটা ব্যাপার বউয়ের বিয়ের আগে পরে একই রকম আছে। একটুও বদলায়নি। একদম একই ভাবে কটমট করে তাকায় আর গটগট করে চলে যায়। বলল, ‘তুমি কি ইচ্ছে করে আমার সাথে এসব বলো আমাকে রাগাবার জন্য? একে তো মন খারাপ ছবি সব ডিলিট হওয়ায় আর উনি আসছেন উনার গ্যালারি আমাকে দিতে। তোমার গ্যালারিতে তো তোমার হাত পা আর চা সিগারেটের ছবি দিয়ে ভরা। ওসব কি আমার ছবি। আমি বলেছি আমার ছবি ডিলিট হওয়ায় মন খারাপ আমার। তোমার এসব আজগুবি ছবি দিয়ে আমি কি করবো? এতো সুন্দর সুন্দর ড্রেস গুলো পরে তোলা ছবি গুলো। সব গেলো।’ ‘তোমার সব ছবি তো একই রকম। একই ভাবে ভেটকি দিয়ে ছবি তুলো। শুধু ড্রেস আলাদা থাকে।’
‘এই ব্যাটা এই কি বললা তুমি। আমি ভেটকি দিয়ে ছবি তুলি? আমি ভেটকাই। আমার হাসি নিয়ে কথা শুনালে। কাল হাঁটা নিয়ে কথা শুনাবা। পরশু আমার কথাবার্তা নিয়ে কথা শুনাবা। আমি তো এখন পুরান হয়ে গেছি তাই না। আমাকে তো আর ভালো লাগবে না তোমার। এখন তোমার নতুন নতুন পায়রা লাগবে। নতুন পায়রার সাথে সারাদিন বাক-বাকুম বাক-বাকুম করতে হবে তাই না। এসব ঘুরে তোমার মধ্যে বুঝি তো। নাইলে আগে তো কখনো এসব তোমার মুখে শুনিনি। এখন কেন শুনি। কোন ডাইনীর জন্য এসব করছো হ্যাঁ! কোথায় থাকে সেই মুখপুড়িটা? কতদিনের পরিচয়?’
‘যাহ বাব্বাহ! কি কথা কে টেনে কই নিয়ে গেলে। বললাম পানি। তুমি সেই পানিকে বুড়িগঙ্গায় ফেলে ভারতের গঙ্গায় নিয়ে ইনিয়েবিনিয়ে মিশরের নীল নদে নিয়ে গেলে। তুমি এক প্রতিভা। দুর্লভ প্রতিভা। আমার ভেটকাইন্না প্রতিভা রাণী।’ ‘চুপ একদম চুপ। আর একবার এই কথা বললে মুখ পাটাপুতা দিয়ে ছেঁচে দিবো।’ ‘হাহাহা তুমি পাটাপুতা কিভাবে ব্যবহার করতে হয় আগে শিখে নাও। নাইলে তোমার আনারি কাজ দেখে পাটাপুতা ভেটকি দিয়ে বলবে- আফা আমি বালতিতে ভিজাইন্না কাপড় না; আমারে আছড়াইয়েন না আস্তে আস্তে পিষেন।’
ঠিক আজকের মতোই সেদিনও গটগট করে চলে গেলো। যাওয়ার সময় শুধু বলে গেলো, ‘তোমার সাথে কোন সুস্থ মানুষ থাকতে পারে না।’ ও চলে যাচ্ছিল আমি জোরে করে বললাম, ‘আচ্ছা তুমি অসুস্থ হলে খবর দিও। সেদিন এক সাথে থাকবো কেমন।’ ও পিছন ফিরে রাগে দুই হাত ঝারা দিয়ে মাটিতে একটা পা আছড়ে গটগট করে চলে গেলো। মেয়েটা যে কেন আমার উপর বারবার রাগ করে সেটাই বুঝলাম না।
পরে আমার কথাটাই ফলে গেলো। কয়দিন পরে বাসা থেকে ওকে জোর করে ছেলে দেখালো বিয়ের জন্য। পাত্র পক্ষ নাকি অনেক পছন্দ করেছে। অনুষ্ঠান করে আংটি পরিয়ে যাবে। সেদিন রাতেই ওর প্রচন্ড জ্বর এলো। সকালে আমাকে ফোন করে বলল ওর বাসার নিচে আসতে সিএনজি নিয়ে। সিএনজি নিয়ে যেন দাড়িয়ে থাকি স্টার্ট বন্ধ না করে। ও বাসা থেকে নেমে সিএনজিতে উঠেই বলল, ‘মামা কাজী অফিস চিনেন কোন। সেদিকে যান।’ আমি শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। হাত ধরে বললাম, ‘কাজী অফিস কেন?’ হাত ধরেই বুঝলাম ওর গায়ে এখনো অনেক জ্বর। বলল, ‘কাজী সাহেবকে আমার অনেক পছন্দ। ওনাকে প্রপোজ করতে যাবো। এবার চুপ করে বসে থাকো।’
আমি আর কিছু না বলে চুপ করে বসে থাকলাম। বলল, ‘তুমি এমন ভেন্দা মাছের মতো কেন। দেখছো না আমার জ্বর। আমার কোমর জড়িয়ে ধরো। আমি তোমার কাঁধে মাথা রাখবো।’ আমি হেসে ওর দিকে তাকালাম। কোমরে হাত দিয়ে বললাম, ‘জ্বর হলে তোমার চেহারায় একটা জেল্লা চলে আসে। অনেক সুন্দর লাগছে তোমাকে। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে জ্বর বাধিও কেমন।’ বলে ওর মুখে হাত বুলিয়ে দিতে যাবো; ও আমার আংগুলে কামড় দিতে আসতেই হাত সরালাম। বলল, ‘তোমার সাথে থাকলে ভালো মানুষও অসুস্থ হয়ে যাবে। অসুস্থ বলেই তোমাকে বিয়ে করতে চাইছি। সুস্থ থাকলে কি আসতাম নাকি। কিসের এতো ঠ্যাকা পড়ছে আমার।’
বিয়ে করে ওকে বাসায় নিয়ে মাকে সালাম করে বললাম, ‘মা ওকে আমি বিয়ে করে ফেলছি। ওর অনেক জ্বর৷ বাসায় নাপা প্যারাসিটামল থাকলে দেন। আমি গেলাম।’ বলেই বাসা থেকে পালালাম। পালিয়ে বিয়ে করি নাই। কিন্তু বিয়ে করে পালিয়েছি। কাউকে কিছু বলার সুযোগ দেইনি। ছোটবোন বুবুনকে ফোন দিয়ে বললাম, ‘শোন বাসার ব্রেকিং নিউজ সব দিবি একটু পর পর। হিটলার এলে কি হয় না হয় সব জানাবি।’ বন্ধুর বাসায় গিয়ে মটকা মেরে শুয়ে থাকলাম। মা ওকে পছন্দ করে অনেক। বেশি পছন্দ করে বুবুন। কিন্তু এভাবে না বলে বিয়ে করে বউ নিয়ে বাসায় হুট করে যাওয়ায় আমার যে আস্ত রাখবে না সেটা আমি জানি। বউকে নিয়ে ভাবছি না। কারণ ওকে সবাই আমার চেয়েও বেশি ভালবাসে। আমি ভাবছি আমার কথা। নিজে বাঁচলে বাপের নাম। আমার বাপ তো আবার হিটলার। জমের মতো ভয় পাই। আব্বাকে ভয় পায় না শুধু বুবুন। বাসায় কি হচ্ছে কে জানে। অতি টেনশনে আমার ঘুম পায় অনেক। একটু পরে ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুম ভাঙ্গলো বুবুনের ফোনে। হায় আল্লাহ্৷ সন্ধ্যা সাতটা বাজে৷ এতো সময় ঘুমালাম। উঠে দেখি বন্ধু রুমে নাই। চিরকুট রেখে গেছে- চাবি রেখে গেলাম, তুই বাইরে গেলে তালা মেরে চাবি দারোয়ানকে দিয়ে যাস। ফোন ধরতে ধরতেই কেটে গেলো। কল ব্যাক করলাম। বুবুন ফোন ধরে ফিসফিস করে বলল, ‘দাদা তুই কই?’ বললাম, ‘আছি এক জায়গায়। তুই এভাবে ফিসফিস করে কথা বলছিস কেন?’ বলল, ‘তুই আজকে শেষ দাদা। আব্বা তোকে আজ বার্বিকিউ বানাবে। বার্বিকিউ বানাবার জন্য শিক কয়লা সব নিয়ে আসছে।’ ‘মানে কি বলছিস তুই?’ ‘বাসার অবস্থা খুবই খারাপ। ভাবী অনেক অসুস্থ। তারাতাড়ি আয়। ভাবীকে হাসপাতালে নিতে হবে। কেমন দায়িত্ব জ্ঞানহীন মানুষ তুই। অসুস্থ বউকে এভাবে রেখে কেউ পালিয়ে যায়। তোর মতো গাধাকে ভাবী কি দেখে বিয়ে করলো। তুই তো সারাজীবন ভাবীকে জ্বালাবি দেখছি।’
ফোন রেখে ছুট দিলাম। বুবুনের আর কোনো কথা মাথায় ঢুকছিল না আমার। বউ এতোই অসুস্থ যে হাসপাতালে নিতে হবে। আব্বার ভয়ও আর কাজ করছিল না। আমার সব এলোমেলো লাগছিল। আমি কি এতোই দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়ে গেলাম যে সারাদিন বউয়ের একটা খোঁজও নিলাম না। অথচ আমি ভেবেছি মা আছে বুবুন তো আছে। ওরাই সব দেখভাল করতে পারবে। নিজের কাছে নিজেই ছোট হয়ে গেলাম। বাসায় ঢুকতেই দেখি আশেপাশে যত আত্মীয় আছে আমাদের সবাই হাজির। বউ সুন্দর করে সেজে সোফায় বসা। সোফার এক পাশে বউয়ের বাবা মা ভাই বোন বসা। আমাকে দেখে শাশুড়ি বলল, ‘কি যে করো না তোমরা। আমাদের বললে কি আমরা তোমাদের বিয়ে দিতাম না। আমার ভাই হুট করে গতকাল এক ছেলেকে নিয়ে আসছে মেয়েকে দেখতে। মেয়েও তো কিছু বলেনি আমাদের। কি যে করো না…’
‘এই শোনো।’ বউয়ের কথায় আবার বাস্তবে ফিরে এলাম। সিনেমার মতো সবকিছু চোখের পর্দায় ভেসে উঠেছিল সব। কি পাগলামি করেই না আমাদের বিয়ে হয়েছিলো। বললাম, ‘কি বলো?’ সেসময় বুবুন রুমে এলো। বউয়ের হাতে ছোট একটা বাটি দিয়ে চলে গেলো। বউ কাছে এসে বলল, ‘এই তেল আমার গলায় আর এখানে ম্যাসাজ করে দাওনা একটু।’ বলে বউ পাশে এসে বসলো। বউকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে আংগুলে তেল নিয়ে গলায় নিচে আলতো করে ম্যাসাজ করে দিচ্ছি। বললাম, ‘ঠিকই তো গলা টিপাতে এলে শেষমেশ। তখন এতো ঢং করলে কেন হু?”চুপ একদম কথা বলবে না ব্যাটা বুইড়া খাটাস। সাবধান গলা যদি জোরে টিপে ধরো না একেবারে কাঁচা খেয়ে ফেলবো।’ ‘কাঁচা কেন খাবা? এই সরিষার তেল দিয়ে লবণ মরিচ দিয়ে ভর্তা বানিয়ে খেয়ো।’ ‘দরকার হলে তাই খাবো।’ ‘কতদিন তোমার জ্বর হয় না। জ্বর হলে তোমায় দারুণ লাগে দেখতে।’
এই প্রথম বউ আমার কথায় রাগ করলো না। আমার হাত কাঁধের উপরে নিয়ে ঠেলেঠুলে আমার বুকে হেলান দিয়ে আমার বুকে মিশে গিয়ে বলল, ‘অপেক্ষা করো। আর কিছুদিন পর ঠিকই আমার জ্বর হবে।’ বউয়ের মুখটা আমার দিকে ফিরিয়ে বললাম, ‘মানে?’ বউ কিছু বলে না। ওর মুখে কেমন এক লজ্জার আভা। কেমন এক স্বর্গীয় প্রশান্তি। আমার হাত ওর পেটে টেনে নিয়ে বলল, ‘টের পাও কিছু?’ ‘মা মানে?’ ‘টের পাচ্ছো না বুইড়া?’ ‘বা বাবা হবো। মানে তু তুমি প্রেগন্যান্ট। মা মা হবে।’
বউ আমার দিকে ফিরে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখলো। ওর চুলে হাত রাখলাম। আমার সারা দুনিয়া যেন এক নিমিষে বদলে গেল। সারা শরীরে কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতি। যা আগে কখনো হয়নি আমার। বুকটা ভরে গিয়ে আবার যেন ফাঁকাফাঁকা লাগছিলো। বউকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরতেই বুকটা আবার শান্ত হয়ে গেলো। চুলে নাকি ডুবিয়ে বললাম, ‘কার মতো হয়েছে দেখতে? আমার সাথে কথা বলতে চায়নি?’
বউ বুক থেকে মাথা উঁচু করে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। এরপরে ফিচ করে হেসে দিয়ে বুকে দুইটা কিল দিয়ে বলল, ‘তুমি এমন প্রশ্ন গুলো কোথায় পাও। এই খবর শুনে এই সময়ে কোন স্বামী এভাবে বউকে বলে কিনা আমার সন্দেহ। তুমি এমন খাটাস কেন হু?’ বলে বুকে আবার মাথা রেখে বলল, ‘দেখতে আমার বুইড়া খাটাসের মতোন হয়েছে। এবার থেকে সে তোমাকে আজগুবি সব প্রশ্ন করে তোমার মাথা খাবে।’
আমার সবকিছু নতুন লাগছে সব। বউকেও যেন নতুন করে আবিষ্কার করলাম। নতুন নতুন অনেক অনুভূতি হচ্ছে। বউকে বুকে জড়িয়ে আছি। কিন্তু মনে হচ্ছে এই প্রথম ওকে স্পর্শ করলাম। খুব ইচ্ছে করছে বলতে, ‘চলো বউ, আজ আমরা আবার পালিয়ে বিয়ে করি। তোমাকে আবার প্রেমিকার মত লাগছে আজ। সেই প্রেম করার সময়টায় ফিরে গেছি যেন।’ কিন্তু ঢোক গিলে কথাটা গিলে ফেললাম। একটা স্বর্গের ফুল এখন আমার বউয়ের পেটে। সে ঘুমাচ্ছে। স্বর্গের ফুলের স্বর্গটা আমার বুকে মাথা রেখেছে। ওকে এই মুহুর্তে কিছুতেই রাগ করতে দিবো না। আজ সারাদিন এভাবেই বুকে নিয়ে থাকবো বউকে।