প্রথম ছোঁয়া

প্রথম ছোঁয়া

পৃথিবী উল্টেপাল্টে যাচ্ছে। রাশেদের বুঝতে বেশ সময় লাগল যে এটা ভূমিকম্প। সে দোলনায় দোলার মত দুলছে। সবাই ছুটোছুটি করতে ব্যস্ত, আর সে দুলুনি গণনা করছে। কী অদ্ভুত! হঠাৎ করে দুলুনি বন্ধ। নিস্তব্ধ পরিবেশ। আবার শুরু। না ভূমিকম্প নয়, মোবাইলের ভাইব্রেশন। এই মোবাইলের ভাইব্রেশনে খাট পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। আধোঘুমে জড়ানো কণ্ঠে রাশেদ বলল, হ্যালো।

-তুমি এখনো ঘুমাচ্ছ?

কিন্নর কণ্ঠে ধমক শুনে রাশেদের ঘুমঘুম ভাব একেবারে কেটে গেছে। তবুও সে ঘুমজড়ানো গলায় বলল, তোমার ধমক খাওয়ার জন্য ঘুমাচ্ছি।

-হয়েছে। আর ন্যাকামি করা লাগবে না। আমি বের হচ্ছি। আর হ্যাঁ, মনে আছে তো?
-কী?
-আমি আমার বোন আর মায়ের সাথে বের হচ্ছি। আমার বোন হচ্ছে স্পাই আর মা হচ্ছে…
-হিটলার।
-গুড। এটা যেন মনে থাকে। টোটালি নির্বাক চলচ্চিত্র হবে।
-ওকে, ম্যাডাম। এখন বলেন, আপনারা কখন বের হচ্ছেন?
-দুপুর দুইটায়।
-তাহলে এখন রাখছি। আমি উঠে ফ্রেশ হয়ে নিই। তুমি নাস্তা করে নিও।
-ওকে। বাই।

রাশেদ আর মৌ, প্রথম দেখা করবে। ভার্চুয়াল তত্ত্বকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে তাদের ভালবাসার বছরপূর্তি হতে যাচ্ছে। ভার্চুয়ালে নাকি সত্যিকারের ভালবাসা পাওয়া যায় না, এখানে নাকি সবাই ফ্রড- এইসব কথা রাশেদ বা মৌ- কেউই বিশ্বাস করে না। তারা বিশ্বাস করে একে অপরকে। গতানুগতিক ভালবাসার চাহিদা তাদের মধ্যে না থাকায় সত্যিকারের ভালবাসার সাগরে ডুবছে দুজন। দুপুর দুইটায় খাওয়াদাওয়া করে বের হল রাশেদ। মৌয়ের আসতে কত সময় লাগবে কে জানে। খুবই অস্থির হয়ে আছে রাশেদ। এতটা অস্থিরতা তার মানায় না। ঠাণ্ডা মস্তিষ্কের অধিকারী সে। কিন্তু এইমুহূর্তে উত্তপ্ত মস্তিষ্ককে ঠাণ্ডা করতে নিকোটিনের ধোঁয়ার প্রবাহ চালানো দরকার।

বইমেলার প্রাঙ্গন। আজ ভিড় ভালই। শেষের দিকে মেলা বেশ জমে উঠেছে। স্বনামধন্য কবি সাহিত্যিকরা এখন বিভিন্ন স্টলে বসে থাকেন। পাঠক-ভক্তের সাথে কথা বলেন। অটোগ্রাফ-ফটোগ্রাফ এসব চলতেই থাকে। এসব ব্যাপারে যথেষ্ট উদাসীন রাশেদ। বড় লোকদের দেখার মধ্যে আনন্দ নেই যতটা আনন্দ থাকে চায়ের কাপের সুড়ুত করে চুমুক দেওয়াতে। প্রতি পাঁচ মিনিটের মধ্যে দুই তিনবার মোবাইলটা বের করছে রাশেদ। সময় দেখছে বারবার। আজ মনে হয় ঘড়ির কাটা ক্লান্ত। চলতেই চায় না। বাংলা একাডেমিতে রাশেদের বন্ধু, কিছু পরিচিত লেখক আছে। তাদের সাথে দেখা করার জন্য ভিতরে ঢুকল। কিন্তু বিপত্তি ঘটল গেটে।

-আপনার পকেটে কী? বের করেন। পুলিশের এমন প্রশ্নে রাশেদ বুঝে ফেললো যে তার সিগারেটের প্যাকেটের স্থান হতে যাচ্ছে পাশে রাখা ডাস্টবিনে। তবুও রাশেদ বলল, সিগারেট।

-ওটা নিয়ে ভিতরে যেতে পারবেন না।
-এই আইন কি শুধু আমজনতার জন্য নাকি সবার জন্য?
-সবার জন্য।

রাশেদ পুলিশটার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসল। তারপর পুলিশের পকেটকে লক্ষ্য করে বলল, ওটা এখনো পকেটে কেন দাদা? থতমত খেয়ে বেচারা অসহায় দৃষ্টিতে তার বড় কর্তার দিকে তাকালো। রাশেদ নিজেই এগিয়ে গিয়ে বলল, আসসালামু আলাইকুম। আমি রাশেদ।

-ওয়ালাইকুম।

রাশেদ ইশারায় কিছু বলল। পুলিশের বড় কর্তা উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিল। হাসি বিনিময় করে সেখান থেকে চলে গেল লিটলম্যাগ চত্বরে।

-নীল দা, কেমন আছেন?
-ভাল, আপনি কেমন আছেন?

নীলের বাড়ি সিরাজগঞ্জ। তার আঞ্চলিক টান শুনতে ভালই লাগে। পাশে ছিল গল্পকার খন্দকার ফিরোজ আহমেদ।
রাশেদ ফিরোজ আহমেদের সাথে কথা বলে দুজনকে নিয়ে টিএসসি চলে এলো। নিকোটিন খোর সবাই। তার সাথে যদি চা হয়, তাহলে তো কথাই নেই। খুব ভিড়। ভিড় ঠেলে একটা দোকানের সামনে জায়গা করে নিয়েছে তারা। হালকা নাস্তা সেরে নিয়ে চা খেলো। প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল, ফিরোজ ভাই, আপনার বই কেমন চলছে?

-আপনার দোয়ায় ভাল চলছে।
-নীল দা, আপনি নিজের বই বের করবেন না?
-আমি কি কবি নাকি?
-হাহাহা, আপনি কবি না হলে কে হবে? অন্তত দুই ইঞ্চি জায়গা নিয়ে যা লিখেছেন, তাতে তো কবি বিশেষণ আপনার জন্যই।

-হাহাহা, ওগুলো অশ্লীল কথা।
-অশ্লীল কথাই কাব্য। চা পর্ব শেষ করে ফিরোজ ভাই আর নীল মেলায় যাবে। রাশেদ বলল, না ভাই। আমার একটু কাজ আছে।
-কী কাজ?
-একজন আসবে। তার সাথে দেখা করব।
-আপনি ভাই পারেনও। আপনি একটা লিভিং লিজেন্ড।
-হাহাহা, যান। ও এলে আসব।

রাশেদ একা একা ঘুরছে। খারাপ লাগছে না। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হরেক রকম মানুষ তাদের নানান কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত। সবচেয়ে আকর্ষণীয় হল একটা বল দিয়ে একটু দূরে রাখা পানীয় বোতল আঘাত করে ফেলানো আর বিনিময়ে সেই পানীয় বোতল জেতা। রাশেদ বরাবরই ভাগ্যের পরীক্ষায় পরাজিত। তবুও সময় কাটানোর জন্য এটা নিয়ে কিছুক্ষণ ব্যস্ত থাকা যায়। একসময় হাতের টিপ(লক্ষ্য) খুব ভাল ছিল। স্কুলের একটা প্রতিযোগিতা ছিল এরকম। রাশেদ তা দেখে চোখ বন্ধ করে লাগাতে পারত এবং জয়ী হত। গিনেসবুকে নাম উঠানোর মত অবস্থা।

রাশেদের হাতে বল। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লক্ষ্যের দিকে। একটা মুভিতে দেখেছিল নায়ক তিনটা নুড়ি নিয়ে ভাগ্যপরীক্ষা করে। তিনটা নুড়ির মধ্যে যদি একটা নুড়ি মগের মধ্যে পড়ে, তাহলে সে ধরে নেয় তার প্রেমের জয় হবে। সিনেমার নায়ক কখনো পারে না। কিন্তু রাশেদ পারবে। সে খেলার আয়োজক ছেলেটাকে বলল, আমি যদি তিনটা ঢিল দিয়ে সামনের তিনটা বোতল ফেলাতে পারি, তাহলে আমার ভালবাসা সাকসেস হবে, ওকে? পিচ্চি ছেলেটা অবাক হল। সে অনেক কিসিমের লোক দেখে এই পার্কে, এরকম আধপাগল খুব কম দেখেছে। অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য স্থির করে ঢিল ছুড়ল। সাথে সাথে দুইটা বোতল পড়ে গেল। এবার আরও কঠিন হয়ে গেল। দ্বিতীয় বলটা নিয়ে লক্ষ্য স্থির করার চেষ্টা করছে। কপাল ঘামছে রাশেদের। সে ফিরে গেল স্কুল জীবনে। লক্ষ্য স্থির করে চোখ বন্ধ করল। তারপর ঢিল ছুড়ল। পড়ে গেল তৃতীয় বোতলটা। দশটাকায় তিনটা বলের বিনিময়ে জিতে গেল একটা পঁচিশ টাকা দামের পানীয়।

ভ্রাম্যমাণ সিগারেটের দোকান থেকে একটা সিগারেট নিয়ে বসে পড়ল একটা জায়গায়। তার পাশ থেকে উৎকট একটা গন্ধ আসছে যা সিগারেটের গন্ধের চেয়েও মারাত্মক। হেঁটেহেঁটে সিগারেট টানতে ভাল লাগে না। সেখানে বসেই সিগারেট শেষ করে ফোন বের করল রাশেদ। মৌকে মেসেজ দিল, কত দূর? ওপাশ থেকে রিপ্লাই আসে নাই। এরপর উঠে ঘুরাঘুরি করতে লাগল সে। কিছুক্ষণের মধ্যে মেসেজের উত্তর এলো। মৌ লিখেছে, এখন প্রেসক্লাব।

রাশেদের বুক ঢিপঢিপ করছে। গলা শুকিয়ে আসছে। নবম শ্রেণীতে পড়া কোন ছেলের প্রথম প্রেম করার সময় এরকম অনুভূতি হয়। নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বের হয়ে শাহবাগ পর্যন্ত হাঁটা ধরল। কোন নীল শাড়ি পরা মেয়েকে দেখলে ভাল করে মেয়েটার দিকে তাকায়। এই বুঝি মৌ!
কিন্তু না। কেউই মৌ হয় না। রাশেদ কল্পনায় তাদের কথোপকথন এবং তাদের দেখা হওয়াটা ভাবে। রাশেদ আনমনে হাঁটছে। মৌ পিছন থেকে এসে বলছে, “এই যে মিস্টার, আমার দিকে না তাকিয়ে রাস্তার সব মেয়েদের দিকে তাকান কেন?” অথবা “এক্সকিউজ মি, আপনি কি মি. রাশেদকে চিনেন?” এসব উদ্ভট ভাবনা ভাবতে ভাবতে রাশেদের ফোনে মেসেজ এলো, আমরা মেলার মধ্যে। বাংলা একাডেমিতে। রাশেদ পাগলের মত হয়ে গেল। শাহবাগ থেকে দৌড়ে চলে গেল বাংলা একাডেমিতে। গেটে খুব ভিড়। তবুও ধান্ধাবাজি করে আগেই ঢুকে পড়ল। সেখান থেকে মেসেজ দিল, কত নম্বর স্টলে? কোন স্টলে?

ওপাশ থেকে মেসেজ আসে না। দুই মিনিট, তিন মিনিট পর মেসেজ এলো ১১২ নাম্বার স্টলে। রাশেদ জানে এটা বাংলা একাডেমিতে নয়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। বের হয়ে আবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গেল। এখানে দ্বিগুণ ভিড়। মেলার শেষের দিক হওয়ায় এখন প্রতিদিনই ভিড় হয়। এই ভিড় ঠেলে ভিতরে যাওয়া আর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ জয় করা সমান। রাশেদ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ জয় করেছে। এখন সে ১১২ নাম্বার স্টলের সামনে। কিন্তু মৌকে দেখা যাচ্ছে না। চরকির মত স্টলের চারপাশসহ তার আশপাশের স্টলগুলোও ঘুরে দেখল। না, মৌ কোথাও নেই। হঠাৎ আরেকটা মেসেজ, প্রথমা প্রকাশনীর সামনে আসো।

এবার এক ছুটে রাশেদ গেল প্রথমা প্রকাশনীর সামনে। এই স্টলের সামনে “স্পেশাল” ভিড়। সম্ভবত স্টলে বিশেষ কোন লেখক আছে। রাশেদ উঁকি মেরে দেখল বিখ্যাত লেখক আনিসুল হক আছেন। সাদা চুল-গোফে মুখময় হাসি হেসে ভক্তদের সাথে সেলফি তোলায় ব্যস্ত তিনি। এই ভিড়ের মধ্যে মৌ থাকলে চিড়েচ্যাপটা হয়ে যাওয়ার কথা। না, মৌ এখানেও নেই। মোবাইলে মেসেজ টাইপ করতে করতে একটু সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো সে। রাশেদের থেকে প্রায় ছয় ফুট সামনে নীল রঙের শাড়ি পরা খোলা চুলের কেউ। পিছন দিক থেকে দেখলেও রাশেদ নিশ্চিত এটা মৌ। ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে। এত কোলাহলের মধ্যেও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে শব্দটা। কিন্তু কোথা থেমে আসছে, তা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড লাগল রাশেদের। বুকের বাম পাশ থেকে। হৃৎপিণ্ডের কম্পনের শব্দ।

দ্রুত বার্তা পাঠালো মৌকে, পিছনে তাকাও। কিন্তু মৌ ফোনই তুলছে না। তার বোন মাইশা এবং মায়ের সাথে কথা বলছে। রাশেদের ইচ্ছা করছে পিছন থেকে এগিয়ে মৌয়ের কাঁধে হাত রাখতে। অনেক কষ্টে ইচ্ছা দমন করল। প্রায় তিন মিনিট পর ফোন হাতে নিয়ে মেসেজ দেখল মৌ। সেও শব্দ পাচ্ছে। ঢিপঢিপ শব্দ। মনে মনে বুকে থুত্থুড়ি দিয়ে একটু ঘুরে আড়চোখে তাকালো রাশেদের দিকে। কী অদ্ভুত! ভালো লাগার হাসিটা কেমন অনায়াসে চেপে রাখছে সে। তবুও রাশেদের চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি মৌয়ের ভালোলাগার অনুভূতিটা।

মৌ তার বোন আর মায়ের সাথে সামনের ক্যান্টিনের দিকে যাচ্ছে। ওরা যদি এখন খেতে বসে, তাহলে কি রাশেদও খেতে বসবে? এই মুহূর্তে কোনকিছু তার গলা দিয়ে নামবে না। না, মৌরা ক্যান্টিন থেকে শুধু আইসক্রিম নিল। রাশেদ ভাবল সেও একটা আইসক্রিম নিবে। কিন্তু কী মনে করে নিল না। এখন মৌয়ের মায়ের সামনে যদি কোন কারণে সন্দেহের উদ্রেক সৃষ্টিকারী হয়, তাহলে খুব বড় সমস্যা হবে।

আইসক্রিম খেতে খেতে মেলার পূর্বপাশে চলে এল তারা। প্রায় প্রতিটা স্টলের সামনে বই উল্টেপাল্টে দেখছে ওরা। আর তাদের সাথে নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে এগিয়ে যাচ্ছে রাশেদ। মাঝেমধ্যে মৌয়ের ডান পাশ দিয়ে, আবার বাম দিয়ে হাঁটছে। চোখাচোখি তো হচ্ছেই। একটা স্টলে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটালো ওরা। রাশেদ মৌয়ের মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে বই দেখছে। মৌয়ের কপাল ঘামছে। ওর মা যদি রাশেদকে চিনে ফেলে, তাহলে বারো বারো চব্বিশটা বাজবে। কী টেনশন!

না। কোন সমস্যা হয়নি। এভাবে বেশকিছু স্টল ঘুরে ওরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বেরিয়ে বাংলা একাডেমির মধ্যে গেল। মেয়েদের লাইনে ভিড় কম। মৌ তার মা বোনের সাথে আগে ঢুকে পড়ল। রাশেদের কিঞ্চিৎ দেরী হচ্ছে। ঈগল যেমন অনেক উপর থেকে শিকারের উপর চোখ রাখে, অনেকটা সেভাবেই চোখ রাখতে হচ্ছে মৌয়ের দিকে। ভিতরে ঢুকে দেখল মৌরা কাছেই আছে। এদিকওদিক তাকিয়ে তারা হাঁটা ধরল নজরুল মঞ্চের দিকে। রাশেদেরও তাদের পিছু নেওয়া ছাড়া গতি নেই।

নজরুল মঞ্চে খ্যাত-অখ্যাত শিল্পীরা গান গাইছে। এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে মা-মেয়েরা। এই মুহূর্তে মঞ্চের গান খুবই বিরক্তি লাগছে রাশেদের। তবুও অনিচ্ছাসত্ত্বেও মন দিয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। হঠাৎ পাশে তাকিয়ে দেখে মৌ নেই। গেল কই? এদিকওদিক, সেদিক তাকিয়ে দ্রুত নজরুল মঞ্চ থেকে বেরিয়ে বাংলা একাডেমি প্রকাশনীর সামনে এলো। খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। রাশেদের ইচ্ছা করছে মাইকে ঘোষণা ‘হারানো বিজ্ঞপ্তি’ দিতে। চাতক পাখির মত এদিকওদিক খুঁজতে খুঁজতে পাওয়া গেল তাদের। এক বুক দীর্ঘনিঃশ্বাস জমে ছিল। দেখার পর তা বের করে দিল।

আবারো সেই পিছু নেওয়া, মাঝেমাঝে চোখাচোখি। মৌয়ের মা দুইএকবার তাকিয়েছে। কিছু সন্দেহ করল কি না কে জানে? একটা একটা করে স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে বই দেখছে। রাশেদ গেল পাশের স্টলে। সেও বই দেখছে। বই থেকে চোখ তুলে দেখে আবারও হারিয়ে গেছে মৌ। এ কী বিপদ! বারবার হারিয়ে যাচ্ছে কেন? এখনি যদি এভাবে হারিয়ে যায়, তাহলে সারাজীবন তাকে ধরে রাখবে কিভাবে? আবার বাংলা একাডেমির স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে অভিধান দেখছে। হঠাৎ করে কানের কাছে উষ্ণ শব্দ, এদিকে আসো। রাশেদ এগিয়ে গেল মৌয়ের সাথে। দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিস করে মৌ বলল, একটু দূরে দূরে থাকো। আম্মু দেখে ফেলবে। রাশেদ নির্বাক। বাচাল ছেলেটা কথা হারিয়ে ফেলেছে। বাংলা একাডেমি থেকে দুজনে বের হয়ে গেল। রাশেদ জিজ্ঞেস করল, তোমাকে একা ছেড়ে দিল?

-হুম, মা হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আমাকে বলেছে ঘুরাঘুরি করতে। আমি তো অবাক।
-শাশুড়ি মহাশয়া বুঝতে পেরেছেন যে তার মেয়েজামাই একা একা কষ্ট পাচ্ছে।
-যাও, ফাজিল। আমার খুব ভয় করছে।

রাশেদ বলতে চাচ্ছিল, ভয় কর না জান। কিন্তু এই কথা বলার সময় হাত না ধরলে কথাটা সম্পূর্ণতা পায় না। তাই বলল না। ততক্ষণে তারা আবার সোহওয়ার্দী উদ্যানে চলে এল। সন্ধ্যা হয়ে গেছে খানিক আগে। সন্ধ্যার প্রাকৃতিক আলো ব্যর্থ ইলেকট্রিক বাতির কাছে। তবুও মৌকে শাড়িতে অপরূপ লাগছে। যাকে বলে ‘নেশাধরা ভালোলাগা’ মৌ বলল, কয়েকটা বই কেনা দরকার। আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, আয়েশা ফয়েজের নতুন বই।

-তাহলে চল। খুঁজে দেখি।

হাঁটতে গিয়ে হোচট খেল মৌ। শাড়ির কুচির একটা ভাঁজ লম্বা হয়ে যাওয়ায় পায়ে বেঁধে হোচট খেল। রাশেদ তাকে ধরতে গিয়েও ধরল না। খুবই অস্বস্তি লাগছে রাশেদের। মৌয়ের সাথে পা মিলিয়ে মন্থর গতিতে এগিয়ে গেল রাশেদ। রাশেদ লজ্জানত অবস্থায় মৌকে জিজ্ঞেস করল, একটা কথা বলব?

-হ্যাঁ, বল।
-আমি কি তোমার হাত ধরতে পারি?

রাশেদের এই প্রশ্নে মৌ হা করে তাকালো তার দিকে। কিছুক্ষণ এভাবে তাকিয়ে থেকে শব্দ করে হেসে উঠল সে। হাসির শব্দটা আসছে হৃৎপিণ্ডের মধ্য থেকে। আর সেই শব্দ গিয়ে লাগছে রাশেদের হৃৎপিণ্ডে। মৌ বলল, ধর। তুমি এত পাগল কেন, বল তো?

-ভালবাসি যে, তাই।
-ভালবাসলেই পাগল হতে হয়?
-না। ভালবাসা পাগল বানিয়ে দেয়।
-আমি কি পাগল হয়েছি?
-অবশ্যই।

রাশেদ মৌয়ের হাত ধরল। তুলতুলে নরম হাত ছোঁয়া মাত্রই বিদ্যুতের শকের মত একটা স্রোত বইয়ে গেল রাশেদের সারা শরীরে। মৌয়ের আঙ্গুলের ফাঁকের মধ্য দিয়ে রাশেদের আঙ্গুল জাল বুনেছে। শক্ত করে চেপে ধরে আছে রাশেদ। এমনভাবে ধরেছে যে সারাজীবনেও মৌয়ের হাত সে ছাড়বে না।

-তোমার হাতটা না খুব নরম।
-হুম।
-ইচ্ছা করছে…
-কী?
-তোমার হাতটা বুকে জড়িয়ে ধরি।
-শুধু হাত? আমাকে না?
-না, মানে ইয়ে…
-লাভ ইউ জান।

কথা বলছে আর হাঁটছে। চলে এসেছে অন্যপ্রকাশ প্রকাশনীর সামনে। সেখানে দাঁড়িয়ে রাশেদ আবু সায়ীদের বই খুঁজতে লাগল। মৌ আলতো করে রাশেদের কাঁধে হাত রাখল। এই অনুভূতি রাশেদের মনে চিরস্থায়ী বসত তৈরি করছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মধ্যে ইটের সলিংয়ের উপর দিয়ে হাঁটতে গিয়ে বেশ কয়েকবার হোচট খেল মৌ। প্রত্যেকবারই রাশেদ শক্ত করে ধরে রাখল তাকে। সারাজীবন যাকে এভাবে সে ধরে রাখবে, তার হাতটা ধরে থাকার মধ্যে অপার আনন্দ। আয়েশা ফয়েজের বইটা খুঁজতে গেলে এক স্টলে গেলে বলে আরেক স্টলে যেতে। এদিকে মৌ ভয় পাচ্ছে।

-এই।
-বল সোনা।
-আমার ভয় লাগছে।
-কেন?
-অনেকক্ষণ তো এলাম। আম্মু যদি দেখে ফেলে।
-আরে পাগলী, হিটলার তো বাংলা একাডেমিতে। সে আমাদের দেখবে কিভাবে? মৌ হেসে উঠল। সাথেসাথে বেজে উঠল তার ফোন। ওর আম্মু ফোন করেছে।
-হ্যাঁ, আম্মু।
-আমি এই পাশে।
-আসছি। মৌ বলল, আম্মু খুঁজছে। রেগে আছে মনে হয়।
-আরে নাহ। অবশেষে তাম্রলিপি স্টলে আয়েশা ফয়েজের বইটা পাওয়া গেল। সেখান থেকে ঘুরে আবার গেটের কাছে চলে এসেছে তারা। মৌ বলল, ছবি তুলবে?

-হুম।
-তা বল না কেন?
-এমনি। তোমার বলার অপেক্ষায় আছি।
-ওকে, তোল।

রাশেদ ফোন বের করে বেশ কয়েকটা ছবি তুলল। আলতো করে হাত রাখল মৌয়ের কাঁধে। আর মৌ এগিয়ে এল রাশেদের বুকের কাছে।

-দেখেছ, আমাদের দারুণ মনের মিল।
-কেমন?
-তুমি নীল শাড়ি আর আমি নীল শার্ট।
-হাহাহা, তাই তো। কিন্তু মি. আপনি পাঞ্জাবী পরেন নাই কেন?
-সত্যি বলতে, তাড়াহুড়ো করে বেরোতে গিয়ে ভুলে গেছি।
-তুমি না?
-আমি কী?

-পাগল। রাশেদের ইচ্ছা করছে সারাজীবন মৌকে এভাবে জড়িয়ে ধরে রাখতে।
-এই, এখন চল। আম্মু বকবে।
-আম্মুকে কী বলবে?
-এই বইগুলো দিয়ে বলব, আম্মু, তোমার জামাই কিনে দিয়েছে।
-তাহলে তোমাকে ত্যাজ্যকন্যা করবে।
-হাহাহা। মিথ্যা বলতে হবে। ক্রেডিটটা তোমাকে দিতে পারছি না। আমার কথাই বলতে হবে। মৌ ঘড়ি দেখে বলল, ও মাই গড। এক ঘণ্টা হয়ে গেছে!
-হুম।
-তাড়াতাড়ি চল।

গেট দিয়ে বের হওয়ার সময় মৌয়ের পিঠে হাত দিয়ে তাকে আগলে রাখার চেষ্টা করছে রাশেদ। মৌ ভিড়ের মধ্যে শুধু একবার তাকালো রাশেদের দিকে। গেট থেকে বের হয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি আমাকে এত ভালবাসো কেন?

এর উত্তর নেই। আবার তারা ঢুকল বাংলা একাডেমিতে। মৌ চলে গেল তার আম্মুর কাছে। আর রাশেদ তাদের পিছে পিছে। দূরত্ব নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মৌ আবার হারিয়ে গেল। ঘড়ির কাটা আটটার কাছাকাছি। তাহলে কি তারা বের হয়ে গেল? মৌকে মেসেজ দিল। কিন্তু রিপ্লাই আসে না। তাই ভেবে রাশেদ গেট থেকে বের হয়ে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যেকটা মানুষের দিকে তাকিয়ে মৌকে খুঁজছে। এইমুহূর্তে রাশেদের চেয়ে অসহায় আর কেউ নেই।

এসএমএস এসেছে। ‘আমরা ক্যান্টিনে এসেছি। মেসেজ পেয়ে রাশেদ খুব খুশি হল। অসহায় ভাব দূর হয়েছে। তাকে রিপ্লাই দিল, বেরোনোর আগে যেন জানায়। এতক্ষণ মাথাটা হ্যাঙ হয়ে ছিল। গলা শুকিয়ে গেছে। চা খাওয়া দরকার। রাশেদ চলে গেল চা খাওয়ার জন্য। বেশ খানিক পরে মৌ মেসেজে জানালো যে তারা বের হচ্ছে। রাশেদ চলে এল গেটের কাছে। প্রায় সাড়ে আটটার দিকে তারা বের হল। মৌয়ের পাশেপাশে হাঁটছে সে। মৌয়ের আম্মু সন্দেহ করছে না। কারণ সবাই সবার পাশে পাশে হাঁটছে। এখন ঘরে ফেরার সময়।

টিএসসি চত্বরে এসে রিকশা নিল তারা। এই জ্যামের মধ্যে রিকশা! রাশেদ রিকশা নিল না। দ্রুত হাঁটছে সে। হঠাৎ জ্যাম কমে যাওয়ায় রিকশা দ্রুত চলতে শুরু করল। এবার হারানোর ভয়টা খুব বেশি কাজ করছে। রাশেদ দৌড়ানো শুরু করল। সে দৌড়াচ্ছে আর আমজনতা ভাবছে কোন পকেটমার হয়তো পকেট মেরে পালাচ্ছে। যদিও সেরকম কিছুই হয়নি। হঠাৎ একটা চলন্ত গাড়িকে ক্রস করতে গিয়ে রাশেদ গাড়ির সাথে বাড়ি খেয়ে পড়ে গেল। হাত ও পায়ের চামড়া উঠে গেছে। কিন্তু সেই ব্যথা এখনো ছুঁতে পারেনি। কারণ এখনো হাতে লেগে আছে মৌয়ের ছোঁয়া।

শাহবাগ এসে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছে মৌরা। রাশেদ এসে পাশে দাঁড়ালো। রাশেদের গাড়ি রাস্তার ওপাশ থেকে। কিন্তু মৌকে ছেড়ে একা একা যেতে ইচ্ছে করছে না। এইসব ছেলেমানুষিও এখন অনেক গুরুত্ব পায়। মৌদের ওদিকের বেশ কয়েকটা গাড়ি এসেছে কিন্তু আগেই লোক উঠে যাচ্ছে না। নারীরা যে কিছু ক্ষেত্রে ‘অবলা’ তা বোঝা যায় বাসে ওঠার সময়। মৌরা ওঠার আগে অন্য যাত্রী উঠে যাচ্ছে।

রাশেদ একটা বুদ্ধি বের করল। হেঁটে পিছনে চলে গেল। সেখান থেকে একটা গাড়িতে উঠে বলল, সামনে আমার তিনজন যাত্রী আছে। ওদেরকে নিতে হবে। এবং আগে ওঠাতে হবে। হেল্পার লোকটা অবাক হল। হয়তো রাশেদের বুকের ধুকধুকানি সেও বুঝতে পেরেছে। যাইহোক, বাস মোড়ে আসা মুহুর্তে মৌকে ইশারায় ডাকল। অন্য যাত্রী উঠতে গেলে রাশেদ বলল, আগে নামতে দেন। যতক্ষণ মৌরা না এল, সে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকল। মৌ বাসের কাছে আসামাত্র নেমে গেল। আর মৌ উঠল গাড়িতে। রাশেদ পেল। স্বস্তির নিঃশ্বাস।

রাস্তা পার হয়ে রাশেদ তার গন্তব্যের গাড়িতে উঠল। সিটে বসে বাম হাতটা ডান হাতে বুলাচ্ছে। “এই হাত ছুঁয়েছে মৌয়ের হাত, এ হাত পাপ করতে পারে না” হাসছে রাশেদ। তার পাশের যাত্রীরা ভাবছে সে পাগল। আসলেই সে পাগল। কারণ পাগল না হলে এতটা ভালবাসা যায় না।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত