বাসে মহিলা সীট খালি না থাকায় আমি দাড়িয়ে ছিলাম। অপর পাশের একজন প্রায় ৪৬/৪৭ বছর বয়স্ক লোক আমাকে দেখে সীট থেকে উঠে দাড়িয়ে বসতে বললেন। আমি উনার দিকে তাকিয়ে না বললাম কারণ শারীরিক ভাবে তেমন টা সুস্থ মনে হচ্ছিল না। হেল্পার উনাকে বসিয়ে রেখে পাশের সীটে কানে হ্যাডফোন লাগানো ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলল, ভাই আপনি তো সামনে নেমে ই যাবেন আর একটু আপনি উনাকে সীট টা দিয়ে দিন। ছেলেটা কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারল না। বসে পরলাম। দেখতে মনে হচ্ছিল কিছুটা বিরক্ত হয়েছে। না দিলে না বলত এভাবে তাকিয়ে থাকার কি আছে!
এভাবে সাত /আট মিনিট যাওয়ার পর ই হঠাৎ গাড়িটি জোরে ব্রেক ধরল। গাড়ি থামতে ই একজন মহিলা বয়স ৩৭/৩৮ হবে এরকম বাসে উঠলেন। হেল্পার উনাকে বলল এভাবে গাড়ি আটকানো কতটা রিস্ক বুঝেন..! মহিলা কিছু না বলে বাসে উঠে ঠিক আমার অপর পাশের সেই আঙ্কেল এর নিকট গেলেন। নিয়ে একটু ক্লান্তি মাখা হাসি মুখে একটা টিফিন ক্যারিয়ার হাতে তুলে দিলেন। আমি প্রথমে কিছুটা অবাক হয়ে যাই।
তারপর মহিলা বললেন, টিফিন আনো নি, সাথে দুপুরের ঔষধ নাও নি। শরীরের কি অবস্থা দেখেছ। অফিসে আজ মিটিং এ কোথায় থেকে কোথায় যাবে আমি পাব কোথায় তোমায়। শরীর যে খারাপ করবে সে খেয়াল আছে। তাই বাসটার পিছন পিছন গাড়ি নিয়ে আসলাম। এরকম শাসন ভরা কথাগুলো শুনে কেন জানি খুব ভালো লাগছিল। ঐ আঙ্কেল তখন ই বললেন, ইশশ একদম খেয়াল করিনি কাজের চাপে। তুমি এভাবে ছুটে আসলে।
একথা বলে ই তিনি নিজের সীট থেকে উঠে উনার স্ত্রীকে বসতে দিলেন। নিজে দাড়িয়ে থেকেও যেন মুখে কিরকম একটা শান্তি পবিত্র প্রশান্তির ছোঁয়া মুখে লেগে ছিল। বললেন, সামনে স্টেশনে দুজন নেমে গিয়ে স্ত্রীকে আলাদা গাড়িতে তুলে দিবেন। কিভাবে যেন সীট টাকে আগলে ধরে দাড়িয়ে আছেন। আর আমি দেখছিলাম যে প্রিয়জনকে মানুষ কতটা আগলে রাখে সেই দৃশ্য।
আমি আঙ্কেলের পাশের সীটের লোকটাকে আমার সীটে আসতে বললাম। লোকটাকে আমার সীট টা দিয়ে আঙ্কেল কে উনার স্ত্রী’র পাশে বসতে বললাম। আঙ্কেল মানা করছিলেন। আমাকে ই বসতে বললেন। আমি না বসে বললাম, আপনারা বসুন। আপনাদের একসাথে বসা দেখব আমি। আর কিছু না বলে বসে পরলেন। মুখে দুজনে মিষ্টি হাসি। বয়স হচ্ছে সময় যাচ্ছে সবকিছু পুরনো হচ্ছে কিন্তু এই যে ভালোবাসা টা সেটা যেন আরো গভীর ভাবে আকঁড়ে ধরছে একজন আরেকজনকে। যা সবার মাঝে থাকে না।
সবকিছু চলে যাবে কিন্তু এই বিশ্বাস ভরসা ভালোবাসা টা আরো বেড়ে যাবে। কারণ দুজনের প্রতি দুজনের যে সম্মান তা এই ভালোবাসা টাকে বাঁচিয়ে রাখবে। কারণ সত্যিকার ভালোবাসা গুলো যত পুরনো হয় তত আরো মজবুদ হয়। শুধু নামে মাত্র সম্পর্ক গুলো ই পুরনো হলে হারিয়ে যায়। সামনের স্ট্যান্ডে আমিও নেমে পরলাম। খুব ভালো লাগছিল সকাল সকাল এরকম মানুষদের দেখে। সবার মধ্যে এরকম কিছু দেখা যায় না। স্কুলে ঢুকে পরলাম। ক্লাস করাচ্ছি। ক্লাস নাইনের গনিত। হঠাৎ অফিস থেকে ডাক আসল তুশা’ র জন্য। ক্লাসের ফাস্ট গার্ল। সাথে আমাকেও যেতে বলা হল।
অফিসের কথাবার্তা শুনে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল। তারপরও তুশাকে নিয়ে চললাম তুশাকে কিছু না বলে ই। হাসপাতালে কেবিনে ঢুকতে ই যেন আমার মাথা টা ঘুরছিল। এ আমি কাকে দেখছি। এই তো কিছুক্ষণ আগে মুখ ভরা হাসি নিয়ে দুটো মানুষকে দেখে ছিলাম। আর এখন উনারা তুশার বাবা মা প্রিয় মানুষটার সামনে যেন পাথরের মূর্তির মত হয়ে বসে আছেন। এই তো কিছুক্ষণ আগে ছিলেন শেষ টিফিনের খাবারটাও খেতে পারলেন না। স্ত্রীকে গাড়িতে তুলে দিয়ে রাস্তা পার হতে ই এক্সিডেন্ট হয়। যাকে সুস্থ ভালো রাখার জন্য এতকিছু করলেন কই বিধাতা তো তাকে ছিনিয়ে নিলেন। কোনো ঔষুধ কোনো খাবারের তোয়াক্কা না করে ই।
এই কয়েক মুহূর্তের দেখা মানুষগুলো কে এখন এই অবস্থায় দেখে যেন নিজের ভেতরটা কেমন জানি করছিল। আন্টি টি হঠাৎ হুশ আসলে পাগলের মত একদম পাগলের মত করছিলেন। তার প্রিয় মানুষটাকে এভাবে দেখে। যেখানে আমি একটু সময় দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারছি না সেখানে সারাটা জীবন পাশে থাকা মানুষটাকে এভাবে দেখে কিভাবে ঠিক থাকবেন।
তুশাকেও স্বান্তনা দেওয়ার ভাষা পাচ্ছিলাম না। শুধু ভাবছিলাম, সারা জীবন পাশে চলা ভালোবাসার মানুষ গুলো হঠাৎ চুপ হয়ে গেলে কেমন লাগে আমি শিউরে উঠছিলাম। কারণ পবিত্র ভালোবাসার বন্ধন গুলোর অনেক জোর থাকে। এই আঙ্কলের ভালোবাসার স্মৃতি গুলো ই আন্টিকে বাচিয়ে রাখবে তার সন্তানের জন্য। কারণ স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসার বন্ধন গুলো এমন ই হয়। সৃষ্টিকর্তা এভাবে ই তৈরি করে দেন। আন্টির দিকে তাকাচ্ছিলাম আর আনমনে চোখের জল ফেলছিলাম।